Author Picture

ঘৃণা কাটিয়ে ওঠা একজন ফিলিস্তিনি এবং একজন ইসরায়েলি বাবার মুখোমুখি

মেজবাহ উদদীন

তাদের গল্পটা এতটাই অবাস্তব যে মনে হয় এটি কোনো চলচ্চিত্রের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এমনকি, স্টিভেন স্পিলবার্গ  তাদের গল্পকে বড় পর্দায় আনার স্বত্বও কিনেছিলেন। ফিলিস্তিনি বাসাম আরামিন এবং ইসরায়েলি রামি এলহানান বছরের পর বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত লড়াই করে যাচ্ছেন। যারা মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাতে সন্তান হারিয়েছেন তাদের দল ‘দ্য প্যারেন্টস সার্কেল’ নামে একটি সংগঠনের সদস্য এবং তারা ঘনিষ্ঠ বন্ধু। প্রকৃতপক্ষে, তারা একে অপরকে ভাই হিসাবে উল্লেখ করেন, যদিও তারা উভয়েই এই অন্তহীন দ্বন্দ্বে সন্তান হারিয়েছেন। ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে এলহানানের মেয়ে স্মাদার বন্ধুর সাথে যখন একটি বই কিনতে যাচ্ছিলেন তখন হামাসের আত্মঘাতী বোমা হামলাকারী আক্রমন করে। তার বয়স ছিল ১৪ বছর। আর ২০০৭ সালে স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পথে পিছন থেকে ইসরায়েলি সীমান্ত পুলিশের চালানো গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হন আরামিনের ১০ বছর বয়সী মেয়ে আবির। সীমান্ত পুলিশ প্রাথমিকভাবে মেয়েটির (আবির) মৃত্যুর দায় অস্বীকার করলেও সিভিল কোর্টে ভিন্ন চিত্রই প্রমাণিত হয়েছিল। তবুও সন্দেহভাজন বন্দুকধারীকে কখনোই ফৌজদারি বিচারের মুখোমুখি করা হয়নি।

এসবের পরও ৭৩ বছরের এলহানান এবং ৫৫ বছরের আরামিন ঘৃণার কাছে আত্মসমর্পণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং তখন থেকেই ফিলিস্তিনি অঞ্চলে ইসরায়েলি দখলদারিত্বের সমাপ্তি এবং পুনর্মিলন প্রচার করে চলেছেন- যে কারণে তাদের উভয়ের বিরুদ্ধে নিয়মিত ‘বিশ্বাসঘাতক’ অভিযোগ তোলা হয়। দুজনে অনেক শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন, এবং তাদের জীবনের গল্পগুলো ডকুমেন্টারি ফিল্ম এবং অনেক ভাষার বইতে বর্ণনা করা হয়েছে, অতি সম্প্রতি কলাম ম্যাককানের উপন্যাস ‘এপিরোগন’-এ এসেছে তাদের কথা। জার্মান সাপ্তাহিক ডের স্পিগেল- এ প্রকাশিত তাদের সাক্ষাৎকার সৃজনের পাঠকদের জন্য অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদদীন


ডের স্পিগেল: আরামিন, এলহানানান— আপনারা বলে আসছেন যে, আমরা একে অপরের সাথে কথা না বললে এই চলমান পাগলামি থামবে না। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে যা ঘটেছে তার পরে কি আপনাদের কাছে আর কোনো শব্দ অবশিষ্ট আছে?

আরামিন: এই নৃশংসতা বর্ণনা করা খুবই কঠিন। আমরা জানতাম যে এইরকম কিছু শীঘ্রই বা পরে ঘটবে। এটি কোনো বড় চমক নয়। কিন্তু আমরা মৃতের এই সংখ্যা বা এই ভয়ঙ্কর হামলা, বিশেষ করে শিশু এবং মহিলাদের বিরুদ্ধে আশা করিনি। এগুলো যে কোনও পরিস্থিতিতে অযৌক্তিক।

ডের স্পিগেল: কেন আপনি অবাক হননি?

আরামিন: মানুষ যুগ যুগ ধরে নিষ্ঠুর দখলদারিত্ব সহ্য করতে পারে না। এই কারণেই আমি ইসরায়েলিদের সবসময় বলেছি: এখনই আমাদের সাথে শান্তি স্থাপন কর যখন তোমরা শক্তিশালী এবং কোনো যুদ্ধ চলছে না। অন্যথায়, এটি একটি বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাবে, এবং কেউ আর মানবাধিকারের কথা চিন্তা করবে না। আমরা আগে থেকেই জানতাম যে হাজার হাজার বেসামরিক নাগরিককে মূল্য দিতে হবে।

ডের স্পিগেল: আপনি কি বুঝতে পারেন কেন সারা বিশ্বের মানুষ এটা নিয়ে তর্ক করছে যে, হয় আপনাকে শুধুই ইসরায়েলিদের সমর্থন করতে হবে অথবা শুধুই ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করতে হবে?

এলহানান: না, আমি এমনটা মনে করি না। এটি ফুটবল খেলা নয় যেখানে আপনাকে আপনার দলকে সমর্থন করতে হবে এবং অন্য দলের বিপক্ষে থাকতে হবে। আমরা সবসময় বলি: ইসরায়েলপন্থী বা ফিলিস্তিনপন্থী হবেন না। শান্তির পক্ষে হোন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে হোন। আজ যা ঘটছে তা রক্তস্নাত, কুৎসিত আকারে অমানবিকতার বেলেল্লাপনা। এবং কোনো সন্ত্রাসী শিশুর মাথা কেটে ফেললে বা পাইলট বেসামরিক লোকে ভরা বাড়িতে এক টন বোমা ফেলল এটা সত্যিই বিবেচ্য নয়। ফলাফল একই।

ডের স্পিগেল: এই অন্তহীন দ্বন্দ্বে আপনারা প্রত্যেকেই একজন করে কন্যাকে হারিয়েছেন, স্মাদার এবং আবির। তবুও আপনারা পরস্পরের প্রতি ঘৃণা কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। কিভাবে?

এলহানান: আমি মনে করি এটি পারার একমাত্র উপায় হল, আপনি আপনার মেয়েকে আর দেখতে পাবেন না এই সত্য উপলব্ধি করা। এবং আপনি যদি কথা না বলেন তবে সহিংসতার এই অন্তহীন চক্র থামবে না। এটা খুব কঠিন, কিন্তু এটা সম্ভব। এটা যে সম্ভব তার প্রমাণ আমরা। আমাদের সংগঠন ‘দ্য প্যারেন্টস সার্কেল’র ৬০০ জন সদস্য প্রতিদিন এটি প্রমাণ করছি।

দেখুন— ইসরায়েলিরা ৬ মিলিয়ন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেনি। এবং ফিলিস্তিনিরা ৬ মিলিয়ন ইহুদিকে হত্যা করেনি, যেমন জার্মানরা করেছিল। এবং এখনও, জার্মানি এবং ইসরাইল বন্ধু। তেল আবিবে একজন জার্মান রাষ্ট্রদূত এবং বার্লিনে একজন ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত রয়েছেন। ওটার মানে কি? এর মানে আমরাও এটা করতে পারি। আমাদের নৃশংসতা এবং আমাদের অত্যন্ত বেদনাদায়ক অতীত থেকে মুক্তি দিতে সাহসী নেতাদের প্রয়োজন

ডের স্পিগেল: আপনার মেয়ের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের ক্ষতি বা এমনকি হত্যা করতে চাননি?

এলহানানান: আমি সে ধরনের মানুষ নই, আমি কোনোভাবেই হিংস্র নই। আমি খুব, খুব, খুব রাগান্বিত ছিলাম। আমি সবচেয়ে বেশি সেই পরিস্থিতির জন্য রাগান্বিত ছিলাম যার কারণে একটি নিষ্পাপ, ১৪ বছর বয়সী মেয়ে মারা গিয়েছিল। সে কোনো সৈনিক ছিল না। সে এই সংঘর্ষের কোনো অংশ ছিল না। প্রকৃতপক্ষে, যখন স্মাদার বয়স আট বছর, সে ইসরায়েল এবং মিশরের রাষ্ট্রপতিদের কাছে একটি চিঠি লিখেছিল- যাতে তারা একসাথে বসে পুনর্মিলন করতে পারে। তাকে হারানো আমাকে এমন বেদনায় ভরিয়ে দিয়েছে, আপনি তা বর্ণনা করতে পারবেন না। আর এটাই আমাকে এই শক্তিতে পূর্ণ করেছে, একটি পারমাণবিক শক্তি। আপনি এই শক্তি ব্যবহার করতে পারেন ধ্বংস এবং অন্ধকার বা মৃত্যু ঘটাতে। অথবা আপনি অন্য উপায়ে প্রতিশোধ নিতে পারেন এবং অন্য লোকেদের কাছে গিয়ে তাদের বলতে পারেন যে— প্রতিশোধ ছাড়াও অন্য উপায় আছে।

ডের স্পিগেল: আরামিন, এই পারমাণবিক শক্তিকে সহিংসতার জন্য ব্যবহার না করতে কী আপনাকে রাজি করালো?

আরামিন: আবির মারা যাওয়ার সময় আমি রমির চেয়ে আলাদা জায়গায় ছিলাম। ইসরায়েলি ট্যাঙ্কে পাথর নিক্ষেপের অপরাধে কিশোর বয়সে আমি ইসরায়েলি কারাগারে সাত বছর কাটিয়েছি। পরে, আমি ফিলিস্তিনি যোদ্ধা এবং প্রাক্তন ইসরায়েলি সৈন্যদের সাথে শান্তির জন্য যুদ্ধের সহ-প্রতিষ্ঠাতা হয়েছিলাম। রমির ছেলে ছিল তাদেরই একজন। তাই, আবিরকে হত্যার অনেক আগে থেকেই, আমি ইসরায়েলি সমাজকে বুঝতে শিখেছি, সেখানকার লোকেরা কীভাবে আমাদের গ্রহণ করে, যেটা আমার বিশ্বদর্শনকে এক ধরনের নাড়া দিয়েছিল। আমি সবসময় বলি আপনার শত্রুর মানবতা এবং মহত্ত্ব আবিষ্কার করা আপনার একটি বিপর্যয়।

ডের স্পিগেল: আপনি জেলে হিব্রু শিখেছেন। সে সব কি আপনার মেয়ের মৃত্যুর জন্য আপনাকে প্রস্তুত করেছিল?

আরামিন: এটা আমাকে কষ্ট এবং রাগের জন্য গ্রস্তুত করেনি। আমার রাগ আজ পর্যন্ত আছে। কিন্তু এটি আমাকে সেই ব্যক্তিকে দেখতে সাহায্য করেছিল যে তাকে শিকারের মতো গুলি করেছিল— তার শিক্ষা, তার সমাজ এবং পেশার জন্য।

ডের স্পিগেল: আপনি কি কখনো তার সাথে দেখা করেছেন?

আরামিন: আমি চেয়েছিলাম, কিন্তু ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ তাকে আমার সাথে কথা বলতে দেয়নি। আমি কেবল আদালতে তার সাথে দেখা করেছি। আমি তাকে বললাম, আপনি বীর নন, আপনি শত্রুকে হত্যা করেননি, আপনি একটি নিষ্পাপ মেয়েকে হত্যা করেছেন। আপনি যদি সে জন্য গর্বিত হন তবে আপনার অপরাধ উপভোগ করুন। কিন্তু আপনি যদি কখনো আমার কাছে ক্ষমা চাইতে আসতে চান, আমি আপনাকে ক্ষমা করে দেব। এবং আমি তা আপনার জন্য নয়, আমার মেয়ে এবং আমার পরিবারের জন্য করব। আমার আরও পাঁচটি বাচ্চা আছে, এবং আমি তাদের বড় হতে দেখতে চাই।

ডের স্পিগেল: অনেক লোকই এমনভাবে প্রতিক্রিয়া জানাতে সক্ষম বা ইচ্ছুক হবে না।

আরামিন: আমার ভাই রামি সবসময় বলে: ভাগ্যিস, আমরা মানুষ। আমরা ভাবতে পারি। আমরা আরও কবর খননের পরিবর্তে সংলাপের জন্য সেতু নির্মাণের পথ বেছে নিতে পারি।

ডের স্পিগেল: আপনারা দুজন একসাথে হাজার হাজার স্কুলছাত্র, শোকাহত পরিবার, সৈন্য এবং এমনকি জঙ্গিদের সাথে কথা বলেছেন। কিন্তু তাদের প্রতিক্রিয়া সবসময় ইতিবাচক হয় না, তাই না?

এলহানান: অনেক সময় এটা খুব কঠিন হয়। একবার, ইসরায়েলি স্কুলছাত্ররা আমাকে বলেছিল— এটা দুঃখের বিষয় যে আমি আমার মেয়ের সাথে বিস্ফোরিত হইনি। ফিলিস্তিনের একটি স্কুলে প্রধান শিক্ষক বাচ্চাদের বলেছিলেন আমার কথা না শুনতে, কারণ আমি স্বাধীনতার জন্য লড়াই করার ইচ্ছাকে দুর্বল করে দেব। যদিও আমরা এমন প্রতিক্রিয়াই আশা করি।

মধ্যপ্রাচ্যের সহিংসতার শিকার: আবির আরামিন এবং স্মাদার এলহানান

ডের স্পিগেল: আপনারা কেন এমন প্রতিক্রিয়া আশা করেন?

এলহানানান: আমরা যখন উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাসে উঠি, তখন এটি একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরির খোলা মুখে হাঁটার মতো ছিল। বেশিরভাগ বাচ্চারা কখনই একজন ইসরায়েলি এবং একজন ফিলিস্তিনিকে দেখেনি যারা একে অপরের সাথে লড়াই করছে না। আমরা দুটি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ এবং শোকাহত সমাজের মুখোমুখি হচ্ছি যা ঘৃণা ও হতাশায় পূর্ণ।

ডের স্পিগেল: ইসরায়েলিদের সাথে যে কোনও যোগাযোগকে অনেক ফিলিস্তিনি দখলকে মেনে নেওয়ার সমতুল্য বলে মনে করে।

আরামিন: হ্যাঁ, আমার লোকেরা এটাকে স্বাভাবিকীকরণ বলে। কিন্তু কোন স্বাভাবিকীকরণ হবে না কারণ আমরা কখনই ইসরায়েলি দখলদারিত্ব মেনে নেব না, এমনকি আরও ৩০০০ বছর পরেও। রামি আর আমি বন্ধু, কিন্তু আমরা সাধারন বন্ধুদের মত দেখা করতে পারি না। আমরা যখনই এবং যেখানেই যেতে চাই স্বাধীনভাবে যেতে পারি না, কারণ অনেক জায়গায় চলাচলের স্বাধীনতা নেই। এটা নিয়ে কথা বলা মানে এটা মেনে নেওয়া নয়।

ডর স্পিগেল: মার্টিন লুথার কিং বলেছিলেন: ‘পুরুষরা একে অপরকে ঘৃণা করে কারণ তারা একে অপরকে ভয় পায়। তারা একে অপরকে ভয় পায় কারণ তারা একে অপরকে জানে না। আপনি কি মনে করেন যে— ফিলিস্তিনিরা ইহুদি গণহত্যা এবং ইসরায়েলিরা নাকবা (ফিলিস্তিনি আরবদের দেশত্যাগ) সম্পর্কে আরও জানলে, পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে?

আরামিন: অবশ্যই। এখানকার বেশিরভাগ ফিলিস্তিনিরা কেবল দখল সম্পর্কে জানে কারণ তারা চেকপয়েন্ট এবং উৎপীড়ন অনুভব করে। তারা জানে না কি কারণে ইসরায়েলিরা এখানে প্রথম এসেছে। এবং এটি অন্য দিকেও একই। ইসরায়েলিরা এমন লোকদের মতো আচরণ করে যারা আপনার বাড়িতে থাকার জন্য আমন্ত্রণ ছাড়াই আসে এবং বলে: ‘তুমি কে? চলে যাও!’ এটা উভয় সমাজের ব্রেন ওয়াশিং সিস্টেমের বড় অংশ। যদি মানুষ অন্ততপক্ষে তাদের শত্রুকে চিনতে পারে এবং তাদের মানবিয় মুখ দেখতে পারে তবে সেটা একটা পার্থক্য তৈরি করবে।

ডের স্পিগেল: আরও ভাল বোঝাপড়া থাকলেও, ভয় থাকবে। কিভাবে সেটা অতিক্রম করা যেতে পারে?

এলহানান: এটা সম্ভব না। আমরা আমাদের পিঠে হাজার হাজার বছরের অত্যাচার বয়ে বেড়াই। এটি কোনো কাল্পিনিক অত্যাচার নয়, এটি সত্যিই ঘটেছে। হলোকাস্ট ঘটেছে। প্রত্যেক ইহুদি এই ভয় নিয়ে জন্মায়। প্রশ্ন হল, আপনি এটা দিয়ে কি করবেন? আপনি যদি এই ভয়টি নিজেকে শক্তিশালী করতে ব্যবহার করেন এবং বন্দুক ধরে শত্রুর আসার জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন তবে শত্রুই আসবে। আর আপনি যদি নিজে মুক্তভাবে বোঝার চেষ্টা করেন, তখনই আপনার সুযোগ থাকবে।

ডের স্পিগেল: সাম্প্রতিক সময়ে বিপরীত ভাবনাই বেশি উন্নতী করেছে বলে মনে হচ্ছে। ইসরায়েলের ইতিহাসে বর্তমানে সবচেয়ে ডানপন্থী সরকার রয়েছে। তবুও দুই রাষ্ট্রীয় সমাধানের পক্ষে আছেন এমন মানুষ দুই দিকেই বিরল হয়ে পড়ছে। এখানে বোঝানোর চেয়ে ঘৃণা বপন করা দৃশ্যত অনেক সহজ।

আরামিন: আমাদের ফিলিস্তিনিদের জন্য বর্তমান ইসরায়েল সরকার নতুন কিছু নয়। তারা দখলদারিত্ব, বসতি স্থাপন, বাড়িঘর ভাঙা, সবকিছু অব্যাহত রেখেছে। এটি ৭৫ বছর ধরে চলছে। এমনকি আইজাক রবিন…

ডের স্পিগেল: …প্রাক্তন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এবং নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী, যাকে ১৯৯৫ সালে হত্যা করা হয়েছিল..

আরামিন: …আমাদের কাছে তিনি একজন যুদ্ধাপরাধী ছিলেন। আমাদের অনেক মানুষের মৃত্যুর জন্য সে দায়ী। কিন্তু শেষ পর্যন্ত, আমরা তাকে শান্তির জন্য কাজ করা একজন যোদ্ধা হিসেবে বিবেচনা করেছি, কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে— আপনি চিরকাল অন্য জাতিকে দমিয়ে রাখতে পারবেন না।

এলহানানান: বাসাম সঠিক বলেছে। দখলদারিত্বের ক্ষেত্রে, এই সরকারের সাথে এর আগে আসা বামপন্থী সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। কিন্তু এই শেষ সরকার সমস্ত নিয়ম ভঙ্গ করেছে এবং আমাদের গণতান্ত্রিক সমাজে বিদ্যমান যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে। এই সরকারের দিন শেষ হয়ে আসছে। নেতানিয়াহুকে যেতে হবে।

আমরা ফিলিস্তিনিদের মরুভূমিতে ফেলতে পারব না, ফিলিস্তিনিরা আমাদের সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে পারবে না। আমরা এখানে একসাথে, পাশাপাশি, এক উপায় বা অন্যভাবে বসবাস করার ভাগ্যলিপি বরন করেছি। অবশেষে, দুই পক্ষকে আবার আলোচনার টেবিলে ফিরে যেতে হবে ২৩ বছর আগে ক্যাম্প ডেভিডে যেখানে ছেড়েছিল

ডের স্পিগেল: আপনার স্ত্রী নুরিত ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর একজন সহপাঠী এবং বন্ধু। তারা কি এখনও বন্ধু?

এলহানান: না, অনেক বছর ধরেই তারা আর বন্ধু নয়। ১৯৯৭ সালে যখন আমাদের মেয়েকে হত্যা করা হয়েছিল, তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং পূর্ব জেরুজালেমে একটি ইহুদি বসতি হার হোমা তৈরি করেছিলেন। যে বোমাটি আমাদের মেয়েকে আমাদের কাছ থেকে নিয়ে গেছে সেটি ছিল হার হোমার প্রতি হামাসের প্রতিক্রিয়া। আমাদের মেয়ে স্মাদারের জন্য সাত দিনের শোকের শুরুতে, নেতানিয়াহু ব্যক্তিগত ফোনে ফোন করেছিলেন। তিনি আমার সাথে কথা বলতে চেয়েছিলেন, আমি প্রত্যাখ্যান করলে তিনি নুরিতকে চাইলেন। নুরিত তাকে জিজ্ঞাসা করছিল: ‘আপনি কি করেছেন?’ এরপর তারা আর কখনো কথা বলেনি।

ডের স্পিগেল: এই পুরো সংঘাত সবসময়ই একটি সশস্ত্র সংঘাত ছাড়াও শব্দের যুদ্ধ ছিল। রামি, আপনি কি হামাসকে সন্ত্রাসী দল বলবেন?

এলহানান: ওরা আমার মেয়েকে মেরেছে। তাদের প্রতি আমার কোনো সহানুভূতি নেই। তবে আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, ইসরায়েলি গোয়েন্দ সংস্থা পিএলও এবং ইয়াসির আরাফাতের ফাতাহ আন্দোলনের পাল্টামার হিসাবে হামাসকে তৈরি করতে সহায়তা করেছিল। তখন থেকেই হামাস ইসরায়েলি রাজনীতির জন্য একটি দরকারী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

ডের স্পিগেল: ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর জন্য আপনার কথা কী, আরামিন?

আরামিন: ওরা আমার মেয়ের খুনি। এবং আমার জন্য, একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে, তারা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর একটি। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না যে তাদের সৈন্যরা সবাই দানব বা সন্ত্রাসী।

এলহানানান: আমি ১৯৬৭ সালে সেনাবাহিনীতে যোগদান করি। আমি মিশরের বিরুদ্ধে ছয় দিনের যুদ্ধ, ইয়োম কিপপুর যুদ্ধ এবং লেবাননে যুদ্ধ করেছিলাম। তবুও, বাসাম এবং আমি আজ নিজেদের ভাই বলে ডাকি।

ডের স্পিগেল: তবে শুধুমাত্র এই ভাই বলার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক এবং ভৌগলিক জগাখিচুড়ির সমাধান করা যাবে না।

এলহানান: আমাদের একটি রাজ্য বা দুটি রাজ্য বা ১০, ০০০ রাজ্য থাকতে পারে। আমাদের একটি কনফেডারেশন বা একটি ফেডারেশন থাকতে পারে, আমরা যেটাই পছন্দ করি। এটা আমাদের মূল ইস্যু হয়ে উঠলে, আমরা যে কোনও কিছু অর্জন করতে পারি। কারণ তখন, আমি আর তোমার দিকে তাকাচ্ছি না, আর তুমিও আমার দিকে তাকাচ্ছ না। আমি তোমাকে দখল করছি না এবং তুমিও আমার বাধ্য না। স্বীকার করি যে এই বিন্দুতে পৌঁছানো খুব কঠিন হবে।

ডের স্পিগেল: কী আপনাকে সেই বিন্দুতে পৌঁছে দিতে পারে বলে মনে করেন?

এলহানান: এ ছাড়া উপায় নেই। আমরা ফিলিস্তিনিদের মরুভূমিতে ফেলতে পারব না, ফিলিস্তিনিরা আমাদের সমুদ্রে নিক্ষেপ করতে পারবে না। আমরা এখানে একসাথে, পাশাপাশি, এক উপায় বা অন্যভাবে বসবাস করার ভাগ্যলিপি বরন করেছি। অবশেষে, দুই পক্ষকে আবার আলোচনার টেবিলে ফিরে যেতে হবে ২৩ বছর আগে ক্যাম্প ডেভিডে যেখানে ছেড়েছিল।

আরামিন: এইভাবে দেখুন— ইসরায়েলিরা ৬ মিলিয়ন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেনি। এবং ফিলিস্তিনিরা ৬ মিলিয়ন ইহুদিকে হত্যা করেনি, যেমন জার্মানরা করেছিল। এবং এখনও, জার্মানি এবং ইসরাইল বন্ধু। তেল আবিবে একজন জার্মান রাষ্ট্রদূত এবং বার্লিনে একজন ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত রয়েছেন। ওটার মানে কি? এর মানে আমরাও এটা করতে পারি। আমাদের নৃশংসতা এবং আমাদের অত্যন্ত বেদনাদায়ক অতীত থেকে মুক্তি দিতে সাহসী নেতাদের প্রয়োজন।

ডের স্পিগেল: এই সাক্ষাৎকারের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

সূত্র: ডের স্পিগেল (জার্মান: ‘দ্য মিরর’)

আরো পড়তে পারেন

রুশ সংস্কৃতির প্রধান শত্রু রুশ রেজিম: মিখাইল শিশকিন

অন্য দেশে ইমপেরিয়াল অথবা সোভিয়েত রাশিয়া থেকে বর্তমানের রুশ ফেডারেশনের নির্বাসিত লেখকদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। অনেকে যাকে সমকালীন রুশ সাহিত্যে পাস্তারনাক ও সলঝোনেতসিনের উত্তরসূরি হিসেবে মনে করেন, সেই মিখাইল শিশকিন ১৯৯৫ সাল থেকে বসবাস করছেন সুইজারল্যান্ডে। একমাত্র লেখক হিসেবে লাভ করেছেন রাশিয়ার প্রথমসারির প্রায় সব সাহিত্য পুরস্কার, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— রুশ বুকার (২০০০), বিগ….

বাংলা সাহিত্যের লেখকদের কূপমণ্ডূকতা পাঠকদের কূপমণ্ডূক করেছে : হারুন আল রশিদ

রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন উপন্যাসের লেখক হারুন আল রশিদ বাংলা সাহিত্যে এক ব্যতিক্রম ও সম্পূর্ণ নতুন কণ্ঠ। তার  গদ্যের শক্তি ও গভীরতা পাঠকের কাছে যেমন বিস্ময়ের ব্যাপার তেমনি তার ভাষার সহজবোধ্যতা বাংলা গদ্যের একটি নতুন ধারা তৈরি করেছে। মাত্র দুটি উপন্যাস প্রকাশ করে তিনি পাঠকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। অন্য উপন্যাসটি হল— ‘রেণুর আবির্ভাব’। তাঁর তৃতীয়….

বিস্তৃত পাঠ সবচেয়ে আনন্দের : ইমান মিরসাল

ইমান মিরসাল ১৯৬৫ সালে মিসরে জন্মগ্রহণ করেন। একজন আধুনিক আরব কবি, প্রবন্ধকার, অনুবাদক, সাহিত্য গবেষক এবং কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সহযোগী অধ্যাপক। নব্বই দশকের উজ্জ্বল তরুণ লেখকদের একজন। সমসাময়িক আরবি কবিতার অন্যতম আকর্ষণীয় কণ্ঠ ইমান মিরসালের বহু কবিতাই এক ডজনেরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিখ্যাত লিটারারি জার্নালগুলোয় নিয়মিত লেখাপত্র প্রকাশের পাশাপাশি পৃথিবীর….

error: Content is protected !!