Author Picture

বাংলা সাহিত্যের লেখকদের কূপমণ্ডূকতা পাঠকদের কূপমণ্ডূক করেছে : হারুন আল রশিদ

সৃজন ডেস্ক

রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন উপন্যাসের লেখক হারুন আল রশিদ বাংলা সাহিত্যে এক ব্যতিক্রম ও সম্পূর্ণ নতুন কণ্ঠ। তার  গদ্যের শক্তি ও গভীরতা পাঠকের কাছে যেমন বিস্ময়ের ব্যাপার তেমনি তার ভাষার সহজবোধ্যতা বাংলা গদ্যের একটি নতুন ধারা তৈরি করেছে। মাত্র দুটি উপন্যাস প্রকাশ করে তিনি পাঠকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। অন্য উপন্যাসটি হল— ‘রেণুর আবির্ভাব’। তাঁর তৃতীয় বাংলা উপন্যাস ‘ওসিডি’ থেকে কিছু অংশ সৃজনে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। সৃজন থেকে ওসিডি জানুয়ারি ’২৪ এর শেষ নাগাদ বই আকারে প্রকাশিত হবে। হারুন আল রশিদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চলমান কাজ হল জেমস জয়েসের ইউলিসিস উপন্যাসের অনুবাদ— যা ধারাবাহিকভাবে দৈনিক যুগান্তরের সাহিত্য পাতায় ছাপানো হচ্ছে। এটা সর্বজনবিদিত যে ইউলিসিস পৃথিবীতে এ যাবৎ লেখা উপন্যাসগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কঠিন ও দুর্বোধ্য দুটি উপন্যাসের একটি (অন্য কঠিন উপন্যাসটি হল জয়েসের ফিনেগান ওয়েকস।)


‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’ উপন্যাসে একটা মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি লক্ষ করা যায়। এটার জন্য আপনাকে কী ধরনের প্রস্তুতি নিতে হয়েছিল?

: এই গল্প আমার জানা ছিল। কাজেই প্লটের জন্য কোনও প্রস্তুতি আমাকে নিতে হয়নি। তবে কীভাবে লিখব, সে ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে হয়েছে অনেক। আমি কখনও সাধারণ মানের লেখা লিখতে চাইনি। লেখার সময় আমি আমার প্রিয় উপন্যাসগুলো পড়ি। তাদের বাক্য, প্যারাগ্রাফ ইত্যাদি পরীক্ষা করি। আমার একটা বাক্যের সাথে তাদের একটা বাক্য মিলিয়ে দেখি। আমার একটা প্যারাগ্রাফের সাথে তাদের একটা প্যারাগ্রাফ মিলিয়ে দেখি। যখন দেখি আমার বাক্য, আমার প্যারাগ্রাফ আমার প্রিয় ঔপন্যাসিকদের সাথে তাল মেলাতে পারছে, তখন আমি আমার বাক্য, প্যারাগ্রাফ ইত্যাদিকে অনুমোদন দিই।

এই সব প্রিয় ঔপন্যাসিক কারা?

: রুদেবিশ শেকাবের ক্ষেত্রে কয়েক জনের নাম করা যাবে। প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। তখন তাঁরা আমার হিরো। কাফকা, বোরহেজ আর মার্কেজের নাম সহজে মনে আসে। আর মনে আসে বালজাক, ফ্লবেয়ার, মপাসা, দস্তেভস্কির আর হেমিংওয়ের নাম। এদের মধ্যে মার্কেজ বেশি সুখপাঠ, তাই আমি মার্কেজকে অনুসরণ করতে চেয়েছি।

পেরেছেন?

: পেরেছি। তবে রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবনের বিষয়টা একুট ভেঙে বলা দরকার। এটি তিনটি উপন্যাসের একটা ট্রিলজি। প্রকাশ পেয়েছে একটি উপন্যাস। এর আরও দুটি উপন্যাস আছে। যা ইংরেজিতে লেখা। তিনটি যখন বাংলায় প্রকাশ হবে, তখন আপনার আর এই প্রশ্ন থাকবে না, আমি পেরেছি কি পারিনি। রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবনের প্রথম উপন্যাস যা সৃজন বাংলায় প্রকাশ করেছে, তা যদি মন খুলে কেউ পড়েন, তবে তিনিও ব্যাপারটা বুঝবেন। এর নির্মাণে কোনও ত্রুটি নাই। যেটুকু দোষ এই উপন্যাসের তা হল এর অসম্পূর্ণতা। যে কোনও সিরিজ উপন্যাসেরই এই দোষ আছে।

আপনি যেভাবে বলছেন তাতে তো পাঠকের মনে সন্দেহ আসতে পারে আপনি নকল করেছেন

: নকল করার বিষয়টা ভিন্ন। আপনি জানেন আমাদের দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিকের নামে এবং আরও কয়েকজনের নামে সাহিত্য চুরির অভিযোগ আছে। যাদের সাহিত্য চুরি করা হয়েছে বলে বলা হয় আমি তাদের বই পড়িনি। আমি যেহেতু সে ধরনের সাহিত্য চর্চা করি না, তাই আমি ওই অভিযোগগুলো সম্পর্কে বলতে পারব না। তবে চুরি করা এক জিনিস। আর দক্ষ সাহিত্যিকদের কাছ থেকে শিল্পের কলাকৌশল শেখা আরেক জিনিস। পাশ্চাত্যের সব সাহিত্যিক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হোমার থেকে শিখেছেন। ভারতবর্ষের সব সাহিত্যিক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রামায়ণ আর মহাভারত থেকে শিখেছেন। বোরহেস কাফকা থেকে শিখেছেন। মার্কেজ হোমার থেকে শুরু করে জেমস জয়েস, ভার্জিনিয়া উল্ফ, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, হরহে লুই বোরহেস থেকে শিখেছেন বলে তিনি তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন। আমি সৌভাগ্যবান আমি এঁদের সবার কাছ থেকে শিখেছি। কিন্তু আমি যা লিখি তা আমার গল্প। আমি তাঁদের কাছ থেকে গল্প লেখার কলাকৌশল শিখেছি। তাঁরা আমার গুরু। সাহিত্য করা খুব কঠিন কাজ। অনেক অধ্যবসায়ের। আমি যেটুকু লেখা প্রকাশ করি, তা অনেক পরিশ্রম করে তৈরি করা। ওসিডি উপন্যাসটি প্রকাশ হলে আমাকে নিয়ে পাঠকের ধারণা স্বচ্ছতর হবে।

হুমায়ুন আজাদের উপন্যাগুলোকে কিছু ক্রেডিট দেয়া যায়। দেখা যায় তিনি কথাশিল্পের দিগন্ত সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কিন্তু তাঁর দুর্বলতা হল বাস্তবায়নে। হুমায়ুন আজাদ তাঁর পরিকল্পনা ঠিকমতো করেছেন, কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গভীরতায় পৌঁছাতে পারেননি। দুটোর যদি মিশ্রণটা সফলভাবে করতে পারতেন তবে আমরা তাঁর কাছ থেকে কয়েকটা আরও উন্নত মানের উপন্যাস পেতাম

আপনি শুধু বিদেশি সাহিত্যিকদের নাম বলছেন? সবার কাছে কি এই যুক্তি গ্রহণযোগ্য হবে?

: মোটামুটি গ্রহণযোগ্য করতে হলেও একটু ভেতরে যেতে হবে। অনেকের মতো আমিও কিশোর বয়সেই বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরতের প্রায় সব গদ্য পড়ার সুযোগ পেয়েছি এবং পড়েছি। তবে তা ছিল আনন্দের জন্য পড়া। পড়া একটা ভালো কাজ এই বোধ শৈশবে তৈরি হওয়াটাও ভাগ্যের ব্যাপার। আমার তা হয়েছিল। আমি যখন ঔপন্যাসিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তখন আমি আরও অনেক বই পড়েছি। তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি, বালজাক, মঁপাসা, ফ্লবেয়ার, টোয়েন, উল্ফ, ডিকিন্স, হেমিংওয়ে, ডি. এইচ. লরেন্স, হেনরি জেমস, টমাস মান, জেমস জয়েস এ সব কথাশিল্পীদের উপন্যাস পড়ার পর আমার সাহিত্যিক হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া। তখন বাংলা সাহিত্যের সেরা কথাশিল্পীদের আমার রোল মডেল বানানোর সুযোগ আর থাকে না। এর মূল কারণ হল বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎ কর্তৃক তাঁদের শিল্পের দিগন্ত বাঙালির জীবনের বাইরে নিয়ে যেতে না পারা। ব্যাপারটা বোঝা এবং বোঝানো দুটোই কঠিন। তবে প্রায়োগিক দিক থেকে কিছু উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। কপালকুণ্ডলার কথা ধরুন। রোমান্টিক গল্প হিসাবে, যদিও দ্রুত টেনে শেষ করা যা বঙ্কিমের উচিত হয়নি, এর তুলনা চলে পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তের লেখা সেরা রোমান্টিক উপন্যাসগুলোর সাথে, অন্তত বোধের গভীরতায় নাড়া দেওয়ার সক্ষমতার নিরিখে। কিন্তু কপালকুণ্ডলার সংগ্রামকে বঙ্কিম বড় করে দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা চলে কপালকুণ্ডলা সাহসী তবে ততটা সাহসী নন যতটা সাহসী ফ্লবেয়ারের মাদাম বোভারি উপন্যাসের নায়িকা এমা বোভারি। কপালকুণ্ডলা আর তাঁর একই রকম কাপুরুষ স্বামী কোনও সংগ্রাম না করেই নদীতে ঝাঁপ দেন। সে তুলনায় এক এমা বোভারি কত কত সাহসী কাজ করেছেন, যদিও শেষ পর্যন্ত তিনিও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন, সেটাও এক ধরনের বিজয়, শিল্পীর কৌশলের বিজয়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে তা হলে কাপুরুষ চরিত্র কী সাহিত্যের বড় চরিত্র হতে পারে না? উত্তর হল অবশ্যই পারে। সাহিত্য নির্মাণের কৌশলটা এখানে বড় ব্যাপার। আর একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে। সাহিত্যের চরিত্র আর বাস্তব চরিত্র দুটি ভিন্ন প্রাণি। শিল্প মানেই অতিরঞ্জন অথবা তার বিপরীত। ঠিক বাস্তবের সমান সমান হলে তা আর শিল্প থাকে না। এটা বোঝার জন্য নাটকের সংলাপ শুনুন। নট নটীরা মঞ্চে যা বলেন তা জোর দিয়ে বলেন। কারণ ওই জোরটা প্রয়োগ না করলে তা শিল্প হবে না। এই সংলাপের উৎপাদনে আরও অনেক কৌশল প্রয়োগ করা হয়। সবই নির্মাণের অংশ হিসেবে। মোটকথা সাহিত্য নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা করার এবং বোঝানোর আছে। যদিও এখানে এই নিয়ে সব কথা বলার সুযোগ নাই।

রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন । হারুন আল রশিদ
উপন্যাস । প্রকাশক: সৃজন । প্রচ্ছদ: দেওয়ান আতিকুর রহমান । প্রথম প্রকাশ: বইমেলা-২০২৩ । মূল্য: ৪৫০টাকা
ঘরে বসে বইটি সংগ্রহ করতে মেসেজ করুন ‘সৃজন’-এর ফেসবুক পেইজে— fb.com/srijon2017
রকমারি ডটকম থেকে অর্ডার করতে— www.rokomari.com/book/290130
কল করুন +৮৮ ০১৯১৪ ৬৯৬৬৫৮

আবার বাংলা সাহিত্যে ফিরে আসি। আজ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের কোনও সাহিত্যিক সাহিত্যের উপকরণগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার করে কথাশিল্পের দিগন্ত ছোঁয়ার চেষ্টা করেছেন এমনটা কেউ বলতে পারবেন না। শওকত ওসমানের জননীর কথা ধরুন। সেখানেও ব্যাপারটা একই। হুমায়ূন আহমেদের বদি ভাইও একই। এই সংকীর্ণতাটা বোঝানোর জন্য আমরা হেমিংওয়ের দি ওল্ড ম্যান এন্ড দি সি গল্পটার সাথে এদের একটু মিলিয়ে দেখি। ওটা মাত্র ছাব্বিশ হাজার শব্দের একটা গল্প বা ক্ষুদ্র উপন্যাস। ওই গল্পের কুশীলব বৃদ্ধ জেলে পাঁচটা পর্যায়ে সংগ্রাম করে। প্রথমত দীর্ঘদিন ধরে কোনও মাছ ধরতে না পারা, দ্বিতীয়ত মাছ ধরার জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া, তৃতীয়ত মাছটা ধরা, চতুর্থত মাছটাকে হাঙ্গরের কাছ থেকে রক্ষা করার চেষ্টা, পঞ্চমত বাড়ি ফেরা। পরিধি ছোট কিন্তু গল্পের হিরোর পথটা ছোট নয়। আমাদের জনপ্রিয় সাহিত্যিকরা তাঁদের সৃষ্ট চরিত্রের এই যে দীর্ঘ সংগ্রাম এই জায়গাটা ধরতে পারেন না। তাই দেখা যায় সব মিসির আলী সব হিমু কতগুলো একাঙ্কিকাতে অভিনয় করে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে  হুমায়ুন আজাদের উপন্যাগুলোকে কিছু ক্রেডিট দেয়া যায়। দেখা যায় তিনি কথাশিল্পের দিগন্ত সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কিন্তু তাঁর দুর্বলতা হল বাস্তবায়নে। হুমায়ুন আজাদ তাঁর পরিকল্পনা ঠিকমতো করেছেন, কিন্তু বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গভীরতায় পৌঁছাতে পারেননি। দুটোর যদি মিশ্রণটা সফলভাবে করতে পারতেন তবে আমরা তাঁর কাছ থেকে কয়েকটা আরও উন্নত মানের উপন্যাস পেতাম। কাজেই ঘুরেফিরে আমাদেরকে হুমায়ূন আহমেদের কথাই বলতে হয়। তাঁর পাঠকপ্রিয়তা অর্জনের কৌশল শরৎচন্দ্রের সাথে প্রায় মিলে যায়। বিন্দুর ছেলে বিন্দুর ছেলে নয়, বিন্দুর ভাসুরের ছেলে। হিমুর সব সহ্য করে তার খালা (সম্ভবত)। মা কোনও ছেলেকে আদর করে, এটা পাঠকের কাছে স্বাভাবিক। আদর যখন সৎমা থেকে আসে তখন পাঠক তা পছন্দ করে। শরৎ ও হুমায়ূন দুজনেই উপন্যাসিকা লিখে সফল হয়েছেন। কিন্তু তাঁদের হাত থেকে আমরা যাকে মহাকাব্য বলা হয় তা পাইনি। শরৎচন্দ্র যখন শ্রীকান্ত দীর্ঘ করতে গেলেন তখন তাঁর লেখা হয়ে গেল ঢিলা। শ্রীকান্তের শুরুটা পড়া যত আনন্দের শেষের দিকটা পড়া ততটাই বিরক্তিকর। হুমায়ূন আহমেদ সাহিত্যের যেই অংশটা কাঁধে নিয়েছেন তা একাঙ্কিকার জোয়াল—যা তিনি তাঁর পাঠকদের কাছে সফলভাবে নিয়ে গেছেন। এই সাহিত্যিকরা যে পাঠকের কাছে নন্দিত এটাকে আমাদের সম্মান জানাতে হবে। আবার একই সাথে মোটা দাগে শুধু এই একাঙ্কিকা পাঠে পাঠকের ওপর যে ঋণাত্মক প্রভাব তৈরি হয় তা সম্পর্কেও আমাদের সচেতনতা দরকার। সুখপাঠ্য একাঙ্কিকাগুলো পড়ে আপ্লুত হওয়া পাঠকের পক্ষে শিল্পের বড় বড় হিরোদের জীবন-ভ্রমণ কল্পনা করা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সহসা কোনও উপন্যাসে তেমন সংগ্রামী নায়ক-নায়িকার মুখোমুখি তারা হলে তারা মনে করেন এটা বেমানান। এখানে অর্জন হল লেখক আর পাঠক দুই পক্ষের আত্মতুষ্টি, আর তা এতটা জোরালো যে এর বাইরের বিষয়গুলো দেখাতে গেলে তাদের উষ্মার শিকার হওয়া ছাড়া উপায় নাই। মূলত বাংলা সাহিত্যের লেখকদের কূপমণ্ডুকতা পাঠকদের কূপমণ্ডুক করেছে, ফলে তারা ভাবেন তারা যা পড়েন, যা দেখেন, তা-ই সেরা। বাংলাসাহিত্যের এই সীমাবদ্ধতা ধরতে হলে যে পরিমাণ বাইরের সাহিত্য পড়া দরকার তা আমাদের দেশের পাঠকের ভাগ্যে কমই জোটে। বাংলাসাহিত্যের সার্বিক মান নিম্নগামী হওয়া এবং পাঠকের সংখ্যা হ্রাস পাওয়া, দুটোর ওপরই এই বিষয়টার প্রভাব আছে। এটা একটা দুষ্টচক্রের মতো। তবে শুধু এই কারণেই আজ বাংলা সাহিত্যের এই দশা তা বলা যাবে না। মূল কারণগুলো বলার সাহসই আমরা হারিয়ে ফেলেছি, যার জন্য সমাজের পশ্চাদ্গমন দায়ী।

বাংলা সাহিত্যের লেখকদের কূপমণ্ডুকতা পাঠকদের কূপমণ্ডুক করেছে, ফলে তারা ভাবেন তারা যা পড়েন, যা দেখেন, তা-ই সেরা। বাংলাসাহিত্যের এই সীমাবদ্ধতা ধরতে হলে যে পরিমাণ বাইরের সাহিত্য পড়া দরকার তা আমাদের দেশের পাঠকের ভাগ্যে কমই জোটে

সাহিত্যের বর্তমান পরিণতির জন্য তারপরও কিছু কারণ যদি বলতেন। যতটা সম্ভব হয়।

: শিক্ষার ক্ষেত্রে সাহিত্যের ভূমিকার বিষয়টি আমরা তুলে ধরতে পারিনি। ধর্মীয় বাণীপ্রচারকারিগণ সারাক্ষণ সাহিত্যের পেছনে লেগে আছেন। তারপর সহজ আনন্দের জন্য আছে ইন্টারনেটকেন্দ্রিক সহজলভ্য পণ্য, যার প্রভাব সারা পৃথিবীর সাহিত্যের ওপর ব্যাপক এবং তা নেতিবাচক। এগুলো মূলত পাঠককে সাহিত্যবিমুখ করেছে। তবে সবচেয়ে বেশি তা করেছে নিম্নমানের সাহিত্য। যা পড়তে আনন্দ নাই, তা পাঠক পড়বে কেন?

আমরা আবার রুদেবিশ শেকাবের গল্পে একটু ফিরে আসি। এই উপন্যাসে একটা নতুন ভাষা পাওয়া যায়। সাধারণত বাংলাদেশের(ব্যতিক্রম বাদে) উপন্যাসের ভাষা যেমন কোমল এবং চরিত্রের এক ধরনের রক্ষনশীল এবং সংযত জার্নি থাকে— এই উপন্যাসে তা নাই। আপনার ভাষা এক ধরনের সোজাসাপ্টা ভাষা এবং এর ডিটেলিংএ অনেক দার্শনিক কথাবার্তা বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে… ভাষার এই কাজটি সচেতনভাবে করেছেন? না আপনার কাছে উপন্যাসের ভাষাই এরকম?

: ব্যাপারটা সচেতনভাবে করেছি। যে কোনও একটা ভালো উপন্যাস পড়তে যাওয়া মানে হঠাৎ একটা নতুন পথে ভ্রমণ করার মতো।

যেমন ধরুন আপনি ডাঙা থেকে একটা নৌকায় উঠলেন আর নদীতে অনেক ঢেউ। এই যে পরিবর্তনটুকু এটা সম্পর্কে সচেতনতা দরকার। প্রথম বাক্যেই একটা ধাক্কা দেয়া, বা প্রথম প্যারাতে পাঠককে নাড়া দেয়া, এটা সব ভালো সাহিত্য করে। সোজাসাপটা ভাষার বিষয়টাও গুরুত্বপূর্ণ। এটা আমাদের এখানে পাওয়া যায় না। সাধারণত আমরা দেখি হয় গদ্যের ভাষা ম্যানমেনে নয়তো পড়া যায় না, এমন কঠিন করে ফেলা হয়। আর সবচেয়ে বড় বিষয় হল যা তিন শব্দে বলা যায় তার জন্য তিন থেকে নয় বাক্য খরচ করা হয়। আবার কেউ কেউ মনে করেন পরিবেশনার জটিলতা প্রয়োজন। ধরুন খোয়াবনামা উপন্যাস। অনেক নাম করেছে সত্য। প্রথম বাক্যে চমক সৃষ্টির চেষ্টা আছে লেখকের কাছ থেকে। কিন্তু পাঠককে তা বুঝতে হলে বাক্যটা দশ বার পড়তে হয়। দ্বিতীয় বাক্যে আরও বড় ধাক্কা খেতে হয়। অষ্টাদশ শতকের শেষের দিকে বের হওয়া রবিনসন ক্রুশো উপন্যাসে এমন বাক্য দেখা যায়, তবে ওই উপন্যাসের বাক্যগুলো জটিল হলেও তাদের প্রবাহ মসৃণ। আসলে বাক্য বড় হওয়া সাহিত্যের জন্য তেমন দোষের কিছু নয়, বরং সুলিখিত এবং একটা নির্দিষ্ট সীমার বড় বাক্য পাঠকের মনোযোগ ধরে রাখতে সহায়তা করে, শুধু দেখতে হয় বাক্যের স্রোতটা পূর্বাপর সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং মসৃণ কি না।

খোয়াবনামার মতো করে লেখা উপন্যাস বর্তমানে বাংলা ভাষায় ছাড়া অন্য কোনও প্রতিষ্ঠিত ভাষায় ছাপানোই সম্ভব হবে না, যদি না তা কয়েকবার পুনর্লিখন করে ভাষার প্রবাহ মসৃণ করা হয়, অর্থাৎ ইংরেজিতে যাকে বলে কম্যুনিকেটিভনেস, সেটা প্রতিষ্ঠিত করা না হয়। এবার আমার কথায় ফিরে আসি। আমি দীর্ঘদিন ধরে লিখি, যদিও আমার বইয়ের সংখ্যা নগন্য। লিখতে লিখতে আমার একটা নিজের ভাষা দাঁড়িয়ে গেছে। কাজেই সচেতন পাঠক আমার ভাষার নিজস্বতা খুঁজে পাবেন, এটাই স্বাভাবিক। আর আমি খেয়াল রাখি পাঠককে যেন কষ্ট করে আমার লেখা বুঝতে না হয়।

উচ্চাভিলাষী সাহিত্যকর্মে এ ধরনের কাজ করা হয়। এবং এটা যে কোনও লেখকের জন্য একটা বড় ঝুঁকি। বিষয়টা সৃজনশীল লেখার ওপর যারা পড়েছেন বা ডিগ্রি নিয়েছেন তারা বুঝবেন। সৃজনশীল লেখা বিষয়ক পাঠশালায় শুরুতেই বলে দেয়া হয় গল্পকে একটা স্থান এবং একটা সময়ে গেঁথে নিতে

পুরো উপন্যাসজুড়েই ভালোবাসাকে ভিলেন হিসেবে এবং প্রায় অপ্রয়োজনীয় দেখানো হয়েছে। এক জায়গায় এমনও বলা হয়েছে যে ‘ভালোবাসা পুরুষের অণ্ডকোষে বীর্যের উৎপাত ছাড়া আর কিছুই না’। অথচ আমরা রুদেবিশকে উপন্যাসের শেষের দিকে গিয়ে দেখতে পাই তার মধ্যে প্রবল ভালোবাসার চাওয়া নিয়ে শূন্যবুকে হেঁটে যেতে…

: আমার তা মনে হয় না। এটা একটা প্রতিদানহীন প্রেমের কাহিনি। ভালোবাসাকে অপ্রয়োজনীয় হিসাবে যাঁরা চিত্রিত করেছেন, তাঁরা সকলে পার্শ্বচরিত্র। গল্পের কুশীলব রুদেবিশ শেকাবের কাছে ভালোবাসার চেয়ে মূল্যবান কিছু নাই।

রুদেবিশের নায়িকাদের মধ্য থেকে আপনি রুদেবিশের জন্য কাকে বেছে নিবেন?

: লুনাভা মিনি।

রুদেবিশ শেকাবের ৩৩ বছরের জীবনের ২৩ বছরকে আমরা জানতে পেরেছি। বাকি ১০ বছর সম্পর্কে কিছু নেই কেন?

: এই কথাটা আমাদের এখানে আগে একবার এসেছে। রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন একটা ট্রিলজি। পরবর্তী দুটি উপন্যাসে তাঁর জীবনের পরবর্তী দশ বছর বর্ণিত হয়েছে।

রুদেবিশের পরিণতি কি পূর্ব নির্ধারিত ছিল, নাকি আখ্যানের স্রোতে তৈরি হয়েছে?

: দুটোই। একটা জিনিস লক্ষ করেছেন নিশ্চয়ই। রুদেবিশ শেকাব তাঁর কাহিনি বর্ণনা শুরু করেছেন তাঁর মৃত্যুর পর। কাজেই লেখকের পরিকল্পনায় ছিল তাঁর মৃত্যু হবে। লিখতে লিখতে গল্পের অনেক ডালপালা বের হয়েছে। সেগুলোকে আবার নিয়ন্ত্রণও করতে হয়েছে। আর রুদেবিশ শেকাবের মৃত্যু কীভাবে হবে তা ধীরে ধীরে নির্ধারিত হয়েছে।

এই উপন্যাসের পটভূমি কোনো বিশেষ দেশের কিনা বোঝা যায় না। যদিও এর দর্শন এবং শিল্পগুণ পাঠককে সঙ্গে করে নিয়ে এগিয়েছে। তবুও জানতে চাই কোনো বাস্তব ভিত্তি আছে, নাকি এটা শুধুই লেখকের কল্পনাপ্রসূত?

: আমার সব লেখা আমার দেখা, অভিজ্ঞতা এবং চিন্তার ফল। আর আমি ঘটনা ধার করি। একবার ফেসবুকে লিখেছিলাম মির্চা গল্পটার, যেটা যুগান্তরের ঈদ সংখ্যায় বেরিয়েছিল। একটা অংশ কীভাবে আমি মঈনুল আহসান সাবেরের একটা টিভি নাটক থেকে নিয়েছিলাম। তবে সব উপাদানকে জোড়া দেওয়ার যে উপকরণ তাকে আমি বলি স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ। এই ওষুধের সন্ধান পাওয়া না গেলে সাহিত্য তৈরি করা যায় না। এই স্বপ্নে পাওয়া ওষুধটার মানের ওপর যে কোনও সাহিত্যিকের সাহিত্যের মান নির্ভর করে। রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন ভালোভাবে পড়লে বোঝা যায় এটা বাংলাদেশের গল্প। আবার নাম উল্লেখ না থাকাতে এটা যে কোনও দেশের গল্প বলেও চালিয়ে দেয়া যায়। ব্যাপারটা ইচ্ছাকৃত।

দেশে ভালো বইয়ের পাঠকের সংখ্য তিনশ থেকে পাঁচশ। এটা নিয়ে ফেসবুকে আমি আলোচনা করেছি। অনেকে বলেছেন কথাটা সত্য। তবে আমি মনে করি অবস্থা এত খারাপ নয়। আর খারাপ হলেও এর জন্য লেখক সমাজ বেশি দায়ী

উচ্চাভিলাষী সাহিত্যকর্মে এ ধরনের কাজ করা হয়। এবং এটা যে কোনও লেখকের জন্য একটা বড় ঝুঁকি। বিষয়টা সৃজনশীল লেখার ওপর যারা পড়েছেন বা ডিগ্রি নিয়েছেন তারা বুঝবেন। সৃজনশীল লেখা বিষয়ক পাঠশালায় শুরুতেই বলে দেয়া হয় গল্পকে একটা স্থান এবং একটা সময়ে গেঁথে নিতে।

যেটাকে সেটিংও বলা হয়। যেমন: ঢাকা, ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের ১৪ তারিখ।

বাংলা উপন্যাসের বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’র সফলতাকে কীভাবে দেখছেন?

: বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে লেখা উপন্যাস রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন। বাংলা সাহিত্যের চিরাচরিত যে সীমাবদ্ধতা, চরিত্রের জীবন-পথের ভ্রমণকে পুরোপুরি বিস্তৃত না করা, তা অতিক্রম করা হয়েছে এই উপন্যাসে। সিরিজের তিনটি উপন্যাস বের হলে এটা পরিষ্কার হবে রুদেবিশ শেকাব উপন্যাসের একটা পূর্ণাঙ্গ চরিত্র, যিনি বিশ্বসাহিত্যের কালজয়ী চরিত্রগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী। লেখককে সফলতা দেয় পাঠক। কয়দিন আগে জানতে পারলাম আমাদের

দেশে ভালো বইয়ের পাঠকের সংখ্য তিনশ থেকে পাঁচশ। এটা নিয়ে ফেসবুকে আমি আলোচনা করেছি। অনেকে বলেছেন কথাটা সত্য। তবে আমি মনে করি অবস্থা এত খারাপ নয়। আর খারাপ হলেও এর জন্য লেখক সমাজ বেশি দায়ী। আরও অনেক কারণও আছে। তবে লেখকরা এই অবস্থার উন্নতি করতে পারতেন। এ বিষয়ে অনেক কথা বলা যায়।

ওসিডি । হারুন আল রশিদ
প্রকাশিতব্য উপন্যাস (জানুয়ারি ‘২৪ এর শেষ দিকে সৃজন থেকে প্রকাশিত হবে)। প্রচ্ছদ: দেওয়ান আতিকুর রহমান।
অর্ডার করতে কল করুন +৮৮ ০১৯১৪ ৬৯৬৬৫৮

বর্তমানের বাংলাদেশে কোন ধরনের উপন্যাস লেখা হচ্ছে। যে ধরনের লেখা সমাজ রাষ্ট্রের অন্যায় অনিয়ম বা প্রচলিত অচল প্রথা ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করে তা কী লেখা হচ্ছে?

: বাংলাদেশে কোন ধরনের উপন্যাস লেখা হচ্ছে তা এক কথায় বললে গালি খাওয়া ছাড়া উপায় নাই। যেটা বলা যায় সেটা হল— বাংলা সাহিত্যের লেখকদের একদেশদর্শিতা মনে হয় নিরাময়ের অযোগ্য। সবচেয়ে জনপ্রিয় আর মেধাবী হিসাবে আমরা যাঁকে চিনি সেই হুমায়ূন আহমেদের কথা ধরুন। তাঁর সৃষ্ট এমন কোনও চরিত্র কি আছে যা শিল্পের সম্ভাব্য গভীরতায় পৌঁছতে পেরেছে? হুমায়ূন আহমেদের চরিত্র বলতে আমরা হিমু, মিসির আলী, মুনা, বদি ভাই এদের নামই বেশি জানি। হয়তো আরও কিছু আছে। হিমু আর মিসির আলী বাস্তবতাবর্জিত চরিত্র। এ ধরনের চরিত্র জনপ্রিয় হয়। এগুলোর সৃষ্টি অন্যান্য ভাষার সাহিত্যিকরাও করেন। এর বিয়োগান্তক দিকগুলোর একটা হল এরা সাহিত্যের জগতে স্থায়িত্ব পায় না। জে. কে. রাউলিং-এর হ্যারিপটার অবশ্যই এই ধারাটির উচ্চতম উদাহরণ। এই চরিত্রগুলোর সীমাবদ্ধতা ব্যাপক। মুনা আর বদি ভাই নিয়েও একই কথা বলা চলে। কিন্তু গদ্যসাহিত্য চূড়ান্ত বিচারে চরিত্র দিয়েই মাপা হয়। সেক্ষেত্রে বাংলা গদ্য সাহিত্য এখনও বিশ্ব সাহিত্যের অঙ্গনে আসন পায়নি। বাংলা সাহিত্যে অনেক অতুলনীয় লেখা আছে। অধিকাংশই যদিও বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ আর শরতের। কিন্তু সে রকম গভীর কোনও চরিত্র আমরা দেখি না। দি কাউন্ট অফ মন্টে ক্রিস্টো, লিয়োপল্ড ব্লুম, অডিসিয়াস, ডন কিহৌতি; এরা হল সাহিত্যের চরিত্রের কিছু উজ্জ্বল উদাহরণ। বাংলা সাহিত্যে এ ধরনের কোনও চরিত্র নাই। এ ধরনের চরিত্র নির্মাণের জন্য দক্ষ কোনও শিল্পীও এই ভূমিতে তৈরি হয়নি। ওজনদার সাহিত্য তৈরির জন্য শ্রম লাগে। সেই শ্রম দেওয়ার মতো পড়ালেখা, স্বাস্থ্য, মনোবল ইত্যাদি অর্জন করা কঠিন। রবীন্দ্রনাথের সবই ছিল। তিনি তা পদ্যে ব্যয় করেছেন, ধারণা করি। আর তার জন্য তো তিনি আমাদের ঋষি। এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যা তথ্য আছে তা থেকে এ কথা বলা যায় এক মাত্র তিনিই পারতেন বাংলা সাহিত্যের সেরা উপন্যাসটা লিখতে। বাকিদের মেধা থাকলেও প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য আর অধ্যবসায়ের ঘাটতি দেখা যায়। প্রতিভা আর অধ্যবসায়ের সমন্বয়ে উপন্যাস তৈরি হয়। শুধু প্রতিভা দিয়ে একাঙ্কিকা হয়। মহাকাব্য হয় না। তলস্তয়ের ওয়ার এন্ড পিচ-এর কথা ভাবুন। কত বড় অধ্যবসায় থাকলে এত বড় একটা উপন্যাস লেখা যায়। এ ধরনের কষ্ট করার জন্য কেউ যদি প্রস্তুত থাকেন অবশ্যই তাঁর দ্বারা ভালো সাহিত্য সৃষ্টি করা সম্ভব। আর একটা কথা বলা যেতে পারে। দুর্বল স্বাস্থ্য, বিশেষত চোখের এবং আলস্য নিয়েও সাহিত্যে কালজয়ী কিছু করা সম্ভব। সেক্ষেত্রে পুরো ব্যাপারটা নিয়ে সচেতন থাকতে হয় আর কার্যকর কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়। এর উজ্জ্বল উদাহরণ হলেন হরহে লুই বোরহেস। আর কেউ কেউ দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়েও বড় কিছু করে ফেলেন। কাফকা, চেখভ এই দলের। এদের স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ, কথাটাকে আক্ষরিক অর্থে নেয়া যাবে না, অতি উচ্চ মানের। মোট কথা আমি যা বলছি তা হল প্রথমে শিল্পটা নির্মাণ করতে হবে। প্রতিভা আট আনা থাকলে ছয় আনা অধ্যবসায় যোগ করতে হবে। প্রতিভা দুই আনা থাকলে চৌদ্দ আনা অধ্যবসায় তার সাথে যোগ করতে হবে। এই দুয়ের সমন্বয়ে লিখলে যা পাওয়া যাবে তাতে আপনি যা চাচ্ছেন সমাজ পরিবর্তনের মতো জোরালো লেখা তা পাওয়া যাবে। এখনও হয়তো এ ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে উপন্যাস লেখা হচ্ছে। কিন্তু তা যতক্ষণ প্রতিভা আর অধ্যবসায়ের সমন্বয়ে সৃষ্টি না হবে ততক্ষণ তা পাঠকের ওপর প্রভাব ফেলবে না।

হুমায়ূন আহমেদের কথা ধরুন। তাঁর সৃষ্ট এমন কোনও চরিত্র কি আছে যা শিল্পের সম্ভাব্য গভীরতায় পৌঁছতে পেরেছে? হুমায়ূন আহমেদের চরিত্র বলতে আমরা হিমু, মিসির আলী, মুনা, বদি ভাই এদের নামই বেশি জানি

জনপ্রিয় লেখক আর গুরুত্বপূর্ণ লেখক; এরকম দুটো বিষয় প্রচলিত আছে। বিশেষত আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। দুটো আলাদা কেন হয়? কখন আলাদা হয়? মার্কেজ, তলস্তয়, রবীন্দ্রনাথ, দস্তয়েভস্কি, ডিকেন্স…, এরা তো জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণও।

: জনপ্রিয় লেখক বিনোদন দেন। গুরুত্বপূর্ণ লেখক বিনোদনের অতিরিক্ত হিসাবে প্রভাব বিস্তার করেন। জনপ্রিয় লেখক পরবর্তী জনপ্রিয় লেখক দ্বারা প্রতিস্থাপিত হন। যে জনপ্রিয় লেখক স্থায়ী হয়ে যান তিনি গুরুত্বপূর্ণ লেখক হয়ে ওঠেন। জনপ্রিয় লেখকের পুস্তক সংখ্যা সাধারণত বেশি হয়, কারণ হল জনপ্রিয়তার সূত্রের সন্ধান পাওয়ার পর তিনি তা বার বার উৎপাদন করেন, যাতে তিনি বেশি টাকা রোজগার করতে পারেন। গুরুত্বপূর্ণ লেখকের পুস্তক সংখ্যা কম হয়, কারণ গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক রচনা সময়সাপেক্ষ। তবে ব্যতিক্রমও আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে অতিপ্রজ গুরুত্বপূর্ণ লেখক হলেন বালজাক, কিন্তু বালজাক ব্যতিক্রমও বটে, যিনি সমারসেট মমের মতে একমাত্র প্রকৃত প্রতিভাবান লেখক। মম এই কথা বলেছেন বড় বড় লেখকদের সাথে বালজাককে তুলনা করে, যেমন তলস্তয়, দস্তেভস্কি, চার্লস ডিকিন্স, স্তাঁদল, ফ্লবেয়ার ইত্যাদি। দ্বিতীয় অতিপ্রজ যে গুরুত্বপূর্ণ লেখকের কথা এই মুহূর্তে মনে আসছে তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অতিপ্রজ জনপ্রিয় লেখকের নাম বলে শেষ করা যাবে না। তবে উদাহরণ হিসাবে আমরা বাংলাদেশের হুমায়ূন আহমেদ ও আমেরিকার স্টিভেন কিং, ডিন কুনজ, ব্রিটেনের আগাথা ক্রিস্টির নাম উল্লেখ করতে পারি। কেউ কেউ আছেন উপন্যাস লিখে রেকর্ড করেছেন। যেমন স্প্যানিশ লেখিকা করিন তেইয়াদো ৪০০০ উপন্যাস প্রকাশ করেছেন এবং চল্লিশ কোটি বই বিক্রি হয়েছে। ব্রিটিশ লেখিকা বারবারা কার্টল্যান্ড ৭০০ উপন্যাস প্রকাশ করেছেন। তবে এগুলো বিষয়ভিত্তিক উপন্যাস, রোমান্স, থ্রিলার এ জাতীয়। এগুলো নিয়ে চিন্তা করলে জনপ্রিয় লেখক আর গুরুত্বপূর্ণ লেখকের পার্থক্য ধরা সহজ হয়। তবে জনপ্রিয় লেখক চিহ্নিত করা অপেক্ষকৃত সহজতর এবং গুরুত্বপূর্ণ লেখক আবিষ্কার করা অপেক্ষাকৃত কঠিনতর। সব জনপ্রিয় লেখক গুরুত্বপূর্ণ নন, কিন্তু সব গুরুত্বপূর্ণ লেখক জনপ্রিয়, তবে কে কার কাছে জনপ্রিয় তার ভিন্নতা আছে। জনপ্রিয় লেখক জাতি-ভিত্তিক ও সময়-ভিত্তিক, গুরুত্বপূর্ণ লেখক জাতজয়ী ও কালজয়ী। একটা উদাহরণ দেয়া যাক। বালজাককে কেন্দ্র করেই। বালজাকের সমসাময়িক এক ফরাসি সাহিত্যিক ছিলেন, নাম ইউজিন সু, যিনি তার সময়ে জনপ্রিয় ছিলেন। কিন্তু তিনি শুধু জনপ্রিয় লেখক ছিলেন। আর বালজাক ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ লেখক। তাই এখন এমনকি ফরাসিরাও ইউজিন সুর উপন্যাস তেমন পড়েন না, অথচ বালজাকের উপন্যাসগুলো আমরা পৃথিবীর সকল মানুষ পড়ি। তবে কে গুরুত্বপূর্ণ কে গুরুত্বপূর্ণ নন এটা নিয়ে সাধারণ পাঠক তেমন মাথা ঘামান না, আর তার কাছে তার প্রয়োজনও নাই। পাঠক দেখেন তিনি কোন লেখকের লেখা ভালোবাসেন। এই অবস্থার কারণে একটা কথা বলা হয় যে, কে গুরুত্বপূর্ণ লেখক তা সময় নির্ধারণ করে। কথাটা আংশিকভাবে সত্য। যিনি সাহিত্যের পণ্ডিত তিনি জনপ্রিয় লেখা আর গুরুত্বপূর্ণ লেখার পার্থক্য বুঝতে পারেন। অথবা বলা যায় যিনি তা বুঝতে পারেন না, আমরা তাকে সাহিত্যের পণ্ডিত বলতে পারি না।

প্রথমে শিল্পটা নির্মাণ করতে হবে। প্রতিভা আট আনা থাকলে ছয় আনা অধ্যবসায় যোগ করতে হবে। প্রতিভা দুই আনা থাকলে চৌদ্দ আনা অধ্যবসায় তার সাথে যোগ করতে হবে। এই দুয়ের সমন্বয়ে লিখলে যা পাওয়া যাবে তাতে আপনি যা চাচ্ছেন সমাজ পরিবর্তনের মতো জোরালো লেখা তা পাওয়া যাবে

তা হলে আমরা কি বলতে পারি হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয় লেখক। হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস গুরুত্বপূর্ণ লেখক?

: আমরা তা সরলভাবে বলতে পারি না। আমরা বলতে পারি হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয় লেখক। অন্যরা গুরুত্বপূর্ণ লেখক কি না, ব্যাপারটা ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। হুমায়ুন আজাদ সাহসী লেখক। লেখকের যা প্রয়োজন, সংস্কারমুক্ত হওয়া, তা তিনি ছিলেন এবং সাহসের সাথে তিনি তা প্রকাশ করেছেন। একটা অন্ধকারাচ্ছন্ন সমাজে তাঁর আবির্ভাব অবশ্যই সেই সমাজের জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। তাঁর মৃত্যু তথা পরোক্ষ হত্যাকাণ্ডের পর সমাজ যে আরও অন্ধকারের দিকে ছুটছে, ব্যাপারটা কাকতালীয় নয়। এই দিক থেকে দেখলে এঁদের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যা বিশ্বাস করতেন তা প্রয়োগ করতেন না। এ দিক থেকে সৈয়দ শামসুল হক মধ্যপন্থা অবলম্বনকারী প্রগতিশীল লেখক। তবে এগুলো তেমন গুরুত্বপূর্ণ না। সাহিত্যের বিচারে যে জিনিসটা এঁদের ক্ষেত্রে লক্ষণীয় তা হল ইংরেজিতে যাকে বলে ইনসাফিশিয়েন্ট এক্সিকিউশন অর্থাৎ নির্মাণে দুর্বলতা। এই বিষয়টা আমাদের আলোচনায় ওপরে একবার এসেছে। এবার আরও একটু খোলাশা করে বলি। এক্সিকিউশন তথা বাস্তবায়ন করতে হয়, একটু আগে আমি যাকে স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ বললাম, তা দিয়ে। যিনি যত বেশি স্বপ্নে পাওয়া ওষুধটা পরিশুদ্ধ করতে পারেন, ওটার ব্যবহারে যত দক্ষতা অর্জন করতে পারেন, তিনি তত ভালো এক্সিকিউটর। হুমায়ূন আহমেদের ফিনিশড প্রোডাক্টগুলো জনপ্রিয় সাহিত্যের বিবেচনায় সফল, অর্থাৎ তাঁর এক্সিকিউশন সফল। সে কথা আমরা অন্যদের ক্ষেত্রে জোর দিয়ে বলতে পারব না, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যের বিচারে হলেও না। সাহিত্যের সাফল্য আসে সফল এক্সিকিউশন থেকে, যেমনটা আমরা হুমায়ূন আহমেদের ক্ষেত্রে দেখি। এক্সিকিউশনে দুর্বল বলেই হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এঁদের আমরা যে পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ মনে করি তাঁরা সে পরিমাণ জনপ্রিয় নন। তাঁরা সামাজিকভাবে জনপ্রিয়, কিন্তু সাহিত্যিকভাবে কতটা জনপ্রিয় তা আমাদের দেখতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় লিখলেন, ধরলাম। এক্সিকিউশন খারাপ হলেতো লোকে পড়বে না, বা কম লোকে পড়বে, বা আপনার লেখার বিষয়ের ব্যাপারে যারা প্রবলভাবে আবেগপ্রবণ শুধু তারা আপনার বই পড়বে। অন্যরা পড়বে না। ভবিষ্যতের মানুষ আরও কম পড়বে।

আহমদ ছফার কথা কিছু বলবেন?

: গদ্য সাহিত্যের এক্সিকিউশনে আহমদ ছফা ওপরের সবার চেয়ে দুর্বল ছিলেন, অনেক বেশি দুর্বল।

আবার আমরা রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবনে ফিরে আসি। আপনার এই বই নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে অনেক আলোচনা সমালোচনা হয়েছে। সেগুলোকে আপনি কীভাবে নিচ্ছেন?

: এগুলো ঠিক আছে। তবে এই উপন্যাসের মূল্যায়ন হতে সময় লাগলে অবাক হবার কিছু নাই। তারপরও যাঁরা লিখেছেন তাঁদের সবাইকে ধন্যবাদ আপনার সাথে আমার পরিচয়টা যেভাবে হল তা নিয়ে এখানে কিছু বলার নাই। তবে এটুকু না বললে অন্যায় হবে।ভালো সাহিত্য চিনতে পারা একজন সম্পাদকের আসল গুণ।সেটা আপনার মধ্যে পেয়ে আমি অভিভূত হয়েছিলাম, কারণ এমন ঘটনা আমরা সচরাচর দেখি না। একথা এজন্য বলছি যে, এখানে ভালো লেখা বের করে আনার মানুষের সংখ্যা খুব কম। এগুলো নিয়ে দুঃখ করেও লাভ নাই। যেমন ধরুন বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতাকে নিয়ে লেখা যত গল্প উপন্যাস আছে শিল্পের মানে তাদের মধ্যে ‌‘রেণুর আবির্ভাব’ সেরা। আমার সাথে যাদের কথা হয়েছে আমি তাদের বলেছি এ রকম দ্বিতীয় আর একটা সাহিত্য গ্রন্থ দেখিয়ে আমাকে লজ্জা দেয়ার জন্য। হতেও তো পারে আমার দাবি অন্যায্য। কিন্তু কেউ আমাকে লজ্জা দেওয়ার জন্যেও কোনও চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসেননি। প্রকাশ্যেও আসেননি। নীরবেও আসেননি। আসতে পারার কথাও নয়। কারণ বাজারে যা আছে আমি নিজেই তা যাচাই করেছি। যাদের এ বই পড়লে দেশের উপকার হত তারা জানেও না যে এ রকম একটা বই আছে। এমনকি আমাদের মুজিববর্ষের পক্ষেও সম্ভব হয়নি এ রকম একটি কাজ করা, তেমনি মুজিববর্ষের পক্ষে রেণুর আবির্ভাবকেও খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। আমি যখন ব্যাপারটা ভাবি, আমি তখন ততটাই হাসি, যতটা কষ্ট পাই। তবে একটা কথা বলে রাখি। বইয়ের মান একটা পর্যায় অতিক্রম করলে তা চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। আমি এই সত্যের ওপর ভরসা রাখি। আর আমি আমার লেখার মান নিয়ে কোনও আপস করতে রাজি নই।

পৃথিবীর সবচেয়ে অতিপ্রজ গুরুত্বপূর্ণ লেখক হলেন বালজাক, কিন্তু বালজাক ব্যতিক্রমও বটে, যিনি সমারসেট মমের মতে একমাত্র প্রকৃত প্রতিভাবান লেখক। মম এই কথা বলেছেন বড় বড় লেখকদের সাথে বালজাককে তুলনা করে, যেমন তলস্তয়, দস্তেভস্কি, চার্লস ডিকিন্স, স্তাঁদল, ফ্লবেয়ার ইত্যাদি। দ্বিতীয় অতিপ্রজ যে গুরুত্বপূর্ণ লেখকের কথা এই মুহূর্তে মনে আসছে তিনি হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

আমার ফেসবুকে লিখেছিলাম এবং অনেক লেখকবন্ধুকে বলেওছিলাম যে গত ১০ বছরে আমার পড়া সেরা বাংলা উপন্যাস ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’। পড়ে অনেকে একমত হয়েছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ বইটি নিয়ে রিভিউ লিখেছে। এরা প্রায় সবাই বয়সে তরুণ। আমি ভেবেছিলাম, সিনিয়র লেখকরা কেউ কেউ বইটি সম্পর্কে ভালোমন্দ যা-ই মনে হয় লিখবেন… সাহিত্যের সঙ্গে আমার প্রায় দুই দশকের জার্নিতে একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করেছি, এখানে একটা মন্দ বই নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়, সেই বইটি এবং এর লেখককে আক্রমণ করে অনেক সময় ব্যয় করা হয়, কিন্তু একটা নতুন চিন্তার শক্তিশালী বইয়ের বিষয়ে সবাই চেপে যায়…এটা কেন হয় বলে আপনার মনে হয়?

: এটা আমাদের দেশে প্রত্যাশিত হবারই কথা। কারণ যাদেরকে আমরা নামকরা সাহিত্যিক এবং লেখক বলে জানি তাদের লেখা এতটা দুর্বল যে তারা তাদের সুনাম ধরে রাখার জন্য তাদের চেয়ে যারা ভালো লেখে তাদের কথা জনসমক্ষে বলবেন না। নামকরা দুর্বল লেখকদের সুনামের সাথে, কাজের সাথে নয়, তাদের জীবন-জীবিকা, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি সংযুক্ত। কাজেই তারা কাউকে আলোচনায় আনবেন না, যদি টের পান সে ব্যক্তি তাদের চেয়ে ভালো লেখে। তারা তাদের চেয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের হাজির করবেন। বিভিন্ন পুরস্কার ইত্যাদি দেবেন। তারা ওপরে থাকতে চাইবেন, অভিভাবক শ্রেণি হিসেবে। তাদের সৃজনশীল লেখা এতটাই দুর্বল যে—বর্তমানে ফেসবুকে তাদের চেয়ে ভালো লেখে আমি এমন কিছু লেখক দেখেছি। তারা নিজেরা যদি সেই পরিমাণ ভালো লেখক হতেন, যে রকম ভালো লিখলে নিজের অবস্থানের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা থাকে না, তাহলে তারা অবশ্যই অন্যদের লেখা নিয়ে নিরপেক্ষভাবে আলোচনা করতেন। এটা বড় দোষের হিসেবে দেখা যাবে না। তবে একটা সাহিত্যিক আন্দোলন দরকার। একটা বড় পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকা দরকার। কমপক্ষে এককোটি টাকার। কারণ বইতো বিক্রি হয় না। লিখে যেহেতু রুজি করা যায় না তাই রুজির জন্য অন্য পথ নিতে হয়। বড় একটা পুরস্কারের ব্যবস্থা থাকলে এবং সেই পুরস্কারের জন্য একটা মানদণ্ড থাকলে অবশ্যই নীরবে নিভৃতে কিছু লোক পুরস্কারটা পাওয়ার জন্য নিবিড়ভাবে সাহিত্য সাধনায় মগ্ন হত।

রেণুর আবির্ভাব। হারুন আল রশিদ
জীবনীভিত্তিক উপন্যাস । প্রকাশক: অনন্যা । মূল্য: ৩২৫টাকা

আপনি ‘রেণুর আবির্ভাব’ নিয়ে যা বলেছেন এটা খুবই উদ্বেগজনক হলেও আমরা মোটামুটি এগুলোকে স্বাভাবিকভাবেই দেখে অভ্যস্ত। ভালো বইয়ের কদর সরকারিভাবেও খুব এটা করা হয় না। শিক্ষা যেখানে জাতির মেরুদণ্ড সেখানে নতুন চিন্তার শিল্পমানসমৃদ্ধ বইকে গুরুত্ব না দিলে জাতি গঠনে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?

: রেণুর আবির্ভাব-কে অনেক বেশি লুকানো হবে বর্তমান সময়ে, এই বাস্তবতা মেনে না নিয়ে উপায় নাই। সরকারিভাবে যে সব বই কেনা হয় তা নিয়ে আমার বক্তব্য সীমিত। সব জায়গায় জনসংযোগ কাজ করে। তাছাড়া সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের বই দুচারটা সব জায়গায় বিক্রি হয় আর এটাকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নেয়াই ভালো। আমার কথা বলতে পারি। আমি আমার বই নিয়ে, বিশেষ করে রেণুর আবির্ভাব নিয়ে, আমি কর্তৃপক্ষের কাছে যাব না। আর আমি গেলেই যে আমি সফল হব, তার নিশ্চয়তাও নাই। আমি লেখক। আমি এ সবের মধ্যে গেলে আমার লেখকসত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে আমি পাঠকদের কাছে যেতে চাই। আবার সমাজে পাঠক নাই। এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য লেখাকে বর্তমানে যেভাবে দালালি পেশায় পরিণত করা হয়েছে তা থেকে মুক্ত করা দরকার।

যে সব সাহিত্যিক সরকারের কাছে বই বিক্রি করে তারা মূলত ভিক্ষাবৃত্তি করে। অমুকের তমুক, তমুকের সমুককে ধরে বই বিক্রি করা। এই ভিক্ষাবৃত্তি পেশায় থাকা সবাই কোনও না কোনও সিন্ডিকেটে আছে। লেখা আর পেয়াজের ব্যবসা এখানে এক হয়ে গেছে। এটা হাস্যকর। তবে রেণুর আবির্ভাব যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে লেখা সেরা শিল্পকর্ম এই দাবি আমি আবার করলাম এবং এই দাবি মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য আমি আবারও উন্মুক্ত আহ্বান জানাই। কাজটা আমি আরও সহজ করে দিচ্ছি কেউ যদি এগিয়ে আসেন। পাঁচটা মানদণ্ডের ভিত্তিতে বিষয়টা করতে হবে: ১। উপন্যাসের গঠন ২। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার চরিত্র নির্মাণে যে গভীরতার দাবি রাখে সে জায়গায় পৌঁছানো ৩। শিল্পের উন্মোচন ৪। লেখার মান ৫। রাজনৈতিক বিশুদ্ধতা।

যে সব সাহিত্যিক সরকারের কাছে বই বিক্রি করে তারা মূলত ভিক্ষাবৃত্তি করে। অমুকের তমুক, তমুকের সমুককে ধরে বই বিক্রি করা। এই ভিক্ষাবৃত্তি পেশায় থাকা সবাই কোনও না কোনও সিন্ডিকেটে আছে। লেখা আর পেয়াজের ব্যবসা এখানে এক হয়ে গেছে

শেষ প্রশ্ন আপনার অনুবাদ নিয়ে। আপনি আমাকে কিছু কিছু বলেছেন। এখানে সৃজনের জন্য বলুন।

: এই শতাব্দীর শুরুর দিকে বিংশ শতাব্দীর সেরা ১০০টা ইংরেজি উপন্যাসের বিভিন্ন তালিকা বের হয়। কয়েকটা তালিকায় ইউলিসিসকে এক নম্বরে রাখা হয়। তখন থেকে ‘ইউলিসিস’ উপন্যাসের নাম আমাদের এখানে সাধারণ মানুষ বেশি করে জানতে পারে। আমার মনে হয় আমাদের এখানে জেমস জয়েসের ‘ইউলিসিস’ এবং গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ গত বিশ-পঁচিশ বছর যাবত সবেচেয়ে আলোচিত দুটি বিদেশি উপন্যাস। মার্কেজের উপন্যাসের কয়েকটা অনুবাদ হয়েছে। ইউলিসিসের কোনও অনুবাদ হয়নি। কেউ কেউ ইউলিসিসের দুয়েক অধ্যায় অনুবাদের চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের এক অন্যতম সেরা অনুবাদকও এর মধ্যে আছেন। এ নিয়ে অনেক কথা বলা যায়। সংক্ষেপে যার অর্থ দাঁড়াবে ইউলিসিসের মানসম্মত বাংলা অনুবাদ করতে সক্ষম এমন কোনও লেখক বা অনুবাদকের দেখা পাওয়াতো দূরের কথা, বর্তমান অবস্থায় তা কল্পনা করাও কষ্টকর, আর যারা ইউলিসিস ঘেঁটেঘুটে দেখেছেন তাদেরও এই মতই হবার কথা, যদি তারা উদারতা প্রদর্শন করতে সক্ষম হন। শুরুতে ইউলিসিসের অনুবাদ শেষ করা নিয়ে আমি ততটা মাথা ঘামাইনি। কারণ আমার চেষ্টা সব সময় ঔপন্যাসিক হওয়ার, অনুবাদক হওয়ার নয়। কিন্তু বাংলা অনুবাদের দুরবস্থা দেখে আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি ইউলিসিস পুরোটা অনুবাদ করব। এবং আমি আরও একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর সেটা হল আমি আমার দেখা ইউলিসিসের ইতালিয়ান, জার্মান, স্প্যানিশ, ফরাসি অনুবাদগুলোর তুলনায় আমার বাংলা অনুবাদ হবে উন্নততর এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ। ব্যাপারটা আমি এমনকি ডাবলিনের জেমস জয়েস সেন্টারকেও জানিয়েছি। তাদের এই ব্যাপারে আগ্রহ আছে। কিন্তু তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি, উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, একই সাথে বাংলা জানেন, ইংরেজি জানেন, ফরাসি জানেন এমন পণ্ডিত খুঁজে বের করা তাদের জন্য দুরূহ। আর আমার ইউলিসিসের অনুবাদ শেষ হতে আরও সময় লাগবে। তবে এই চ্যালেঞ্জ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি রইল। ত্রিশ-বত্রিশ কোটি বাংলাভাষী মানুষের কাছেও ইউলিসিসের বাংলা অনুবাদ নিয়ে একই চ্যালেঞ্জ দেয়া আছে। আমার ইউলিসিসের অনুবাদের নবম অধ্যায়ের সাথে তুলনা করে কেউ আমাকে এটা দেখিয়ে অপদস্থ করুক যে কেউ ইতালিয়ান, স্প্যানিশ, জার্মান, ফরাসি ভাষায় ইউলিসিসের আমার চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো অনুবাদ করতে পেরেছেন, কিংবা এমন কোনও বাঙালি বা অবাঙালি আছেন যিনি বর্তমানে বাংলায় ইউলিসিসের আমার চেয়ে ভালো অনুবাদ করতে পারবেন। আপনি বলতে পারেন ইউলিসিস অনুবাদ করার মতো বাঙালি নিশ্চয়ই আছে, হয়তো তাদের করার ইচ্ছা নাই। এ ব্যাপারটাকে এ ভাবে দেখুন। যে কোনও একটা বই নাম করলে তা কিন্তু অনুবাদ হচ্ছে। খারাপ হোক, ভালো হোক, অনুবাদতো হচ্ছে। তলস্তয়, দস্তয়ভস্কি থেকে শুরু করে হাল আমলের মুরাকামি কেউ কিন্তু বাদ যাচ্ছে না। আর ইউলিসিসতো সারা পৃথিবীতে সামষ্টিকভাবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত উপন্যাস। অবশ্যই ইউলিসিসের চেয়েও মহত্তর কিছু উপন্যাস আছে। কিন্তু আলোচনা-সমালোচনার দিক থেকে ইউলিসিস সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে। তারপরও এটার বাংলা অনুবাদ হল না কেন। আর আমি যা বলছি তা শুধু অনুবাদের কথা বলছি না। মানসম্পন্ন অনুবাদের কথা বলছি। ত্রিশ-বত্রিশ কোটি বাঙালির মধ্যে এই কাজ করার জন্য একজন মাত্র লোক আছে, তা অবশ্যই ব্যক্তিগতভাবে আমোদের ব্যাপার। কিন্তু এই ব্যাপারটা সার্বিকভাবে অতগুলো মানুষের সামষ্টিক পরিচয়েরও একটা মানদণ্ড, অন্তত সাহিত্যের ক্ষেত্রে, ভাষাজ্ঞানের ক্ষেত্রে, যা অবশ্যই দুঃখজনক।

আরো পড়তে পারেন

রুশ সংস্কৃতির প্রধান শত্রু রুশ রেজিম: মিখাইল শিশকিন

অন্য দেশে ইমপেরিয়াল অথবা সোভিয়েত রাশিয়া থেকে বর্তমানের রুশ ফেডারেশনের নির্বাসিত লেখকদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। অনেকে যাকে সমকালীন রুশ সাহিত্যে পাস্তারনাক ও সলঝোনেতসিনের উত্তরসূরি হিসেবে মনে করেন, সেই মিখাইল শিশকিন ১৯৯৫ সাল থেকে বসবাস করছেন সুইজারল্যান্ডে। একমাত্র লেখক হিসেবে লাভ করেছেন রাশিয়ার প্রথমসারির প্রায় সব সাহিত্য পুরস্কার, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— রুশ বুকার (২০০০), বিগ….

ঘৃণা কাটিয়ে ওঠা একজন ফিলিস্তিনি এবং একজন ইসরায়েলি বাবার মুখোমুখি

তাদের গল্পটা এতটাই অবাস্তব যে মনে হয় এটি কোনো চলচ্চিত্রের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এমনকি, স্টিভেন স্পিলবার্গ  তাদের গল্পকে বড় পর্দায় আনার স্বত্বও কিনেছিলেন। ফিলিস্তিনি বাসাম আরামিন এবং ইসরায়েলি রামি এলহানান বছরের পর বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত লড়াই করে যাচ্ছেন। যারা মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাতে সন্তান হারিয়েছেন তাদের দল ‘দ্য প্যারেন্টস সার্কেল’ নামে….

বিস্তৃত পাঠ সবচেয়ে আনন্দের : ইমান মিরসাল

ইমান মিরসাল ১৯৬৫ সালে মিসরে জন্মগ্রহণ করেন। একজন আধুনিক আরব কবি, প্রবন্ধকার, অনুবাদক, সাহিত্য গবেষক এবং কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সহযোগী অধ্যাপক। নব্বই দশকের উজ্জ্বল তরুণ লেখকদের একজন। সমসাময়িক আরবি কবিতার অন্যতম আকর্ষণীয় কণ্ঠ ইমান মিরসালের বহু কবিতাই এক ডজনেরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিখ্যাত লিটারারি জার্নালগুলোয় নিয়মিত লেখাপত্র প্রকাশের পাশাপাশি পৃথিবীর….

error: Content is protected !!