Author Picture

রুশ সংস্কৃতির প্রধান শত্রু রুশ রেজিম: মিখাইল শিশকিন

ওয়াহিদ কায়সার

অন্য দেশে ইমপেরিয়াল অথবা সোভিয়েত রাশিয়া থেকে বর্তমানের রুশ ফেডারেশনের নির্বাসিত লেখকদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। অনেকে যাকে সমকালীন রুশ সাহিত্যে পাস্তারনাক ও সলঝোনেতসিনের উত্তরসূরি হিসেবে মনে করেন, সেই মিখাইল শিশকিন ১৯৯৫ সাল থেকে বসবাস করছেন সুইজারল্যান্ডে। একমাত্র লেখক হিসেবে লাভ করেছেন রাশিয়ার প্রথমসারির প্রায় সব সাহিত্য পুরস্কার, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— রুশ বুকার (২০০০), বিগ বুগ প্রাইজ (২০০৬, ২০১০)। ৩০টি ভাষায় তার বই অনূদিত হয়েছে। ভ্লাদিমির পুতিনের কট্টর সমালোচক এ লেখকের বই ‘ইন মাই রাশিয়া: ওয়ার অর পিস?’ সাম্প্রতিক সময়ে ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। দ্যা গার্ডিয়ানে নিজের বই, রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে কথা বলেছেন অ্যান্ড্র– অ্যান্থনির সঙ্গে। বাংলায় সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন ওয়াহিদ কায়সার


রুশ সাহিত্যে জাতীয়তাবাদী এবং উদারপন্থিদের মধ্যে গৃহযুদ্ধের কথা আপনি অতীতেও বলেছেন। ইউক্রেনে আক্রমণের পর থেকে সেটা কী আরও গভীর হয়েছে?

: বিশ বছর আগে কিয়েভে এক সাহিত্য উৎসবে আমরা সবাই— লেখক এবং কবি যারা ইউক্রেনে রুশ ভাষায় লিখত— একসঙ্গে বসে কথা বলছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল অবশেষে আমরা ভবিষ্যতের রুশ সংস্কৃতি গড়ে তুলছি, যেখানে পারস্পরিক বোঝাপড়াটা গুরুত্বপূর্ণ। তারপর ক্রিমিয়া সংযুক্তির প্রসঙ্গ সামনে চলে এলো আর দেখলাম যাদের সঙ্গে এক টেবিলে বসে গল্প করছিলাম তারা চিৎকার করছে : ‘ক্রিমিয়া আমাদের! ক্রিমিয়া আমাদের!’ এটি ছিল (ইউজিন) আয়োনেস্কোর বিখ্যাত গ্লার নাটকটার মতো, যেখানে মানুষ গণ্ডারে রূপান্তরিত হয়ে যায়। তাদের সঙ্গে আর কথা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। মস্কোয় বাস করা আমার ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলাটাও অসম্ভব। আমরা অচেনা হয়ে পড়েছি। রুশ সংস্কৃতিতে সভ্যতার ব্যবধানের মতো কিছু একটা আমাদের ভেতরও আছে। যারা বই পড়ে না তারা কেন এ যুদ্ধকে সমর্থন করে সেটা আমি বুঝতে পারি। কিন্তু সংস্কৃতিবান লোকেরা কেন এ যুদ্ধকে সমর্থন করে তা ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে অসম্ভব।

আপনার বইতে আপনি বলেছেন, যেসব রুশ লেখক এবং শিল্পীদের লক্ষ্য এটাই দেখানো যেসব রুশ যুদ্ধকে সমর্থন করে না। কিন্তু যেমনটা আপনি বলেছেন, অনেক শিল্পী এবং লেখক কিন্তু মনে করে না যে এটা তাদের লক্ষ্য।

: আমার জন্য এখন এটা একটা লক্ষ্য। সারা জীবন আমি টের পেয়েছি আমার পায়ের নিচের মাটি খুব শক্ত। রুশ সংস্কৃতিই ছিল সেটা। আর এখন এটা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একশ বছর আগে রুশ অভিবাসীরা বার্লিন বা প্যারিসের রাস্তায় রুশ ভাষায় কথা বলতে লজ্জা পেত না। কিন্তু এখন তারা নিজের ভাষায় কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে। রুশ ভাষার মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সবকিছু করাই আমার লক্ষ্য এখন। আর এটা এ যুদ্ধে আমাদের সাধারণ শত্র, ‘রুশ রেজিমের বিরুদ্ধে ইউক্রেনের বিজয়ের মাধ্যমেই সম্ভব। কারণ রুশ সংস্কৃতির প্রধান শত্র’ রুশ রেজিমই।

সারা জীবন আমি টের পেয়েছি আমার পায়ের নিচের মাটি খুব শক্ত। রুশ সংস্কৃতিই ছিল সেটা। আর এখন এটা উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। একশ বছর আগে রুশ অভিবাসীরা বার্লিন বা প্যারিসের রাস্তায় রুশ ভাষায় কথা বলতে লজ্জা পেত না। কিন্তু এখন তারা নিজের ভাষায় কথা বলতে লজ্জা পাচ্ছে

আপনি লিখেছেন যে, রুশ ভবিষ্যৎ কেবল তখনই থাকবে যদি এটি সম্পূর্ণ পরাজয়ের মধ্য দিয়ে যায়। একটা পারমাণবিক শক্তিধর দেশের জন্য এটা কি কোনো কার্যকর বিকল্প?

: পুতিনের মধ্যে সব স্বৈরশাসকের মনস্তত্ত্ব মজুত আছে: ‘আমি যদি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই, তাহলে পুরো পৃথিবীকেই আমার সঙ্গে যেতে হবে।’ মানুষের প্রতি এদের কোনো সহানুভূতি নেই। মানুষকে এরা ভালোবাসে না। ঘৃণা করে। আর তাই আমি নিশ্চিত যে, সে লাল বোতামটা টিপে দেবে। কিন্তু পৃথিবী ধ্বংস করার আদেশটা কেউ পালন করবে না। কেউ না। আর সেটা কেন জানেন? কারণ রাশিয়ায় মূল প্রশ্নটা উনিশ শতকের চিরায়ত রুশ সাহিত্যের মতো না: কে দায়ী? কী করা যেতে পারে? না, প্রধান প্রশ্নটা হলো: জার কি আসল নাকি নকল? একটা যুদ্ধ জিতে প্রমাণ করতে পারেন যে আপনি আসল। স্ট্যালিন লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল, তবে সাধারণের কাছে কিন্তু তিনি জনপ্রিয়। গর্বাচেভ পশ্চিমে জনপ্রিয় ছিলেন, কিন্তু আফগানিস্তান যুদ্ধ এবং পশ্চিমের বিরুদ্ধে ঠান্ডা যুদ্ধে তিনি পেরে ওঠেননি। (তাই) তিনি ঘৃণিত। পুতিনের জেনারেলরা তাকে আশ্বস্ত করেছিল যে তিন দিনের মধ্যে তারা কিয়েভ দখলে নেবে, আর হিসাব করতে গিয়ে এটাতেই সে ভুল করল। সে ব্যর্থ, আর এখন সে একজন নকল জার হয়ে পড়েছে। নকল জারের আদেশ কেউ পালন করবে না।

আপনার বইটা ভাষার দুর্নীতি, মিথ্যার স্বাভাবিকীকরণের বিরুদ্ধে একটি সতর্কবাণী। কিন্তু মিথ্যা যদি সত্যের চেয়ে বেশি শক্তি বহন করে, তবে তাকে চ্যালেঞ্জ করে কারাবাস বা মৃত্যুর ঝুঁকি কি কেউ নেবে? শেষবার কবে আপনি রাশিয়ায় গিয়েছিলেন?

: শেষবার আমি রাশিয়ায় গিয়েছিলাম ২০১৪ সালের অক্টোবরে। ক্রাসনোয়ারস্ক বইমেলায়। মঞ্চে আমি একাই যুদ্ধের ব্যাপারে কথা বলেছিলাম। এ নীরবতাটা এতটাই অপমানজনক ছিল যে, সেটাই ছিল রাশিয়ায় আমার শেষ সফর। এখন কোনোভাবেই সেখানে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি প্রাণনাশের হুমকি পাচ্ছি, কিন্তু করবটা কী? আমার কি চুপ থাকা উচিত? আমার কি কথা বলা বা লেখালেখি বন্ধ করে দেওয়া উচিত? সেটা করলে আমার জীবনের আর কোনো মানে থাকে না। আমি হাল ছাড়ব না।

পুতিনের মধ্যে সব স্বৈরশাসকের মনস্তত্ত্ব মজুত আছে: ‘আমি যদি এ পৃথিবী ছেড়ে চলে যাই, তাহলে পুরো পৃথিবীকেই আমার সঙ্গে যেতে হবে।’ মানুষের প্রতি এদের কোনো সহানুভূতি নেই। মানুষকে এরা ভালোবাসে না। ঘৃণা করে। আর তাই আমি নিশ্চিত যে, সে লাল বোতামটা টিপে দেবে। কিন্তু পৃথিবী ধ্বংস করার আদেশটা কেউ পালন করবে না

আপনি রাশিয়ারবর্বর ৯০ দশকসম্পর্কে লিখেছেন যখন অলিগার্করা প্রাকৃতিক সম্পদ চুরি করেছিল আর ক্ষমতা অপরাধীদের হাতে চলে গিয়েছিল। দারুণ একটা সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যায়। রুশ গণতন্ত্রকে সমর্থন করার জন্য পশ্চিমারা তখন কী করতে পারত?

: এটা বলতে আমার খারাপ লাগছে যে রুশ জনগণের কাছে অপরাধীদের এ শাসনকে পরিচয় করিয়ে দিতে পশ্চিমারাই সাহায্য করেছিল। ৯০-এর দশকে মানুষ গণতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত ছিল, কিন্তু তাদের কোনো ধারণা ছিল না যে, এটা কীভাবে কাজ করে। পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলো নতুন রুশ গণতন্ত্রকে কী দেখিয়েছিল? সুইজারল্যান্ডে আমি একজন দোভাষী হিসাবে কাজ করেছি এবং দেখেছি কীভাবে বিশাল এ লন্ড্রি মেশিনটা কাজ করে। রাশিয়া থেকে নিয়ে আসা চুরির টাকা মানুষ জুরিখে নিয়ে আসত অ্যাকাউন্ট খুলে রেখে দেওয়ার জন্য। আর আইনজীবী, ব্যাংকের লোকজন, সবাই এ অবৈধ টাকা পেয়ে খুশি হয়েছিল। তারা পুরোপুরি সচেতন ছিল যে এগুলো অবৈধ টাকা। লন্ডনেও একই ঘটনা ঘটেছে, আরও খারাপ আমার মনে হয়। প্রধান দায়িত্ব রুশদেরই ছিল, কিন্তু পশ্চিমা গণতন্ত্রের সমর্থন ছাড়া রাশিয়ায় এ নতুন একনায়কত্ব তৈরি করা অসম্ভব ছিল।

রাশিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনো ধরনের আশাবাদ কি আপনি দেখতে পান?

: আমি ইউক্রেন নিয়ে খুব আশাবাদী। আমি নিশ্চিত এ যুদ্ধে তারা বিজয়ী হবে। আর অন্যদিকে রাশিয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি খুব হতাশায়। আমি মনে করি না এটা একটা গণতান্ত্রিক, চমৎকার, সুন্দর দেশ হবে। পুতিন একদিন এ দেশে থাকবে না, আর তারপর আমরা ক্ষমতা পাওয়ার জন্য বিশাল এক লড়াই দেখতে পাব। রুশ সাম্রাজ্যের পতন অব্যাহত থাকবে; সব জাতীয় প্রজাতন্ত্রগুলো রুশ ফেডারেশন থেকে বের হয়ে যাবে। সাইবেরিয়াও যাবে। আমার মনে হয় নতুন একনায়কেরা আসবে আর পশ্চিমারা তাদের সমর্থন করবে, কারণ তারা নিজেদের পারমাণবিক অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ করার প্রতিশ্রুতি দেবে, আর রুশ ইতিহাস আবার নিজের লেজে কামড় দেবে।

আপনি বইটাতে বলেছেন যে ঘৃণাই রোগ, আর সংস্কৃতিই নিরাময়। সংস্কৃতি কি সেঅন্ধকার ভবিষ্যৎ পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারে?

: এ যুদ্ধ শেষ হলে ইউক্রেনীয় এবং রুশদের মধ্যে বিশাল বড় ঘৃণা তৈরি হবে। সেতু তৈরি করা হয়তো সহজ হবে না। কিন্তু আমাদের সেতু তৈরি করতেই হবে। আর এ সেতুগুলো গড়ে উঠতে পারে শুধু সংস্কৃতি, সভ্যতা, সাহিত্য ও সংগীত দিয়ে। চুরান্ত লক্ষ্য হবে এটাই।

আরো পড়তে পারেন

বাংলা সাহিত্যের লেখকদের কূপমণ্ডূকতা পাঠকদের কূপমণ্ডূক করেছে : হারুন আল রশিদ

রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন উপন্যাসের লেখক হারুন আল রশিদ বাংলা সাহিত্যে এক ব্যতিক্রম ও সম্পূর্ণ নতুন কণ্ঠ। তার  গদ্যের শক্তি ও গভীরতা পাঠকের কাছে যেমন বিস্ময়ের ব্যাপার তেমনি তার ভাষার সহজবোধ্যতা বাংলা গদ্যের একটি নতুন ধারা তৈরি করেছে। মাত্র দুটি উপন্যাস প্রকাশ করে তিনি পাঠকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। অন্য উপন্যাসটি হল— ‘রেণুর আবির্ভাব’। তাঁর তৃতীয়….

ঘৃণা কাটিয়ে ওঠা একজন ফিলিস্তিনি এবং একজন ইসরায়েলি বাবার মুখোমুখি

তাদের গল্পটা এতটাই অবাস্তব যে মনে হয় এটি কোনো চলচ্চিত্রের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এমনকি, স্টিভেন স্পিলবার্গ  তাদের গল্পকে বড় পর্দায় আনার স্বত্বও কিনেছিলেন। ফিলিস্তিনি বাসাম আরামিন এবং ইসরায়েলি রামি এলহানান বছরের পর বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত লড়াই করে যাচ্ছেন। যারা মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাতে সন্তান হারিয়েছেন তাদের দল ‘দ্য প্যারেন্টস সার্কেল’ নামে….

বিস্তৃত পাঠ সবচেয়ে আনন্দের : ইমান মিরসাল

ইমান মিরসাল ১৯৬৫ সালে মিসরে জন্মগ্রহণ করেন। একজন আধুনিক আরব কবি, প্রবন্ধকার, অনুবাদক, সাহিত্য গবেষক এবং কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি ভাষা ও সাহিত্যের সহযোগী অধ্যাপক। নব্বই দশকের উজ্জ্বল তরুণ লেখকদের একজন। সমসাময়িক আরবি কবিতার অন্যতম আকর্ষণীয় কণ্ঠ ইমান মিরসালের বহু কবিতাই এক ডজনেরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিখ্যাত লিটারারি জার্নালগুলোয় নিয়মিত লেখাপত্র প্রকাশের পাশাপাশি পৃথিবীর….

error: Content is protected !!