কবিতা ও গণিত নিয়ে বাংলাদেশে তেমন লেখালিখি হয়েছে বলে আমার জানা নাই। নব্বইয়ের দশকে মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা নামক একটা লিটল ম্যাগাজিন বের হতো। ওটার একটা পর্ব ছিলো গণিত সংখ্যা। বেশ ঢাউস আকারের। সংখ্যাটা হাতে না থাকায় বলতে পারছিনা ওখানে গণিত ও কবিতা নিয়ে কেমন লেখা হয়েছিলো। আমার জানা মতে পশ্চিম বাংলা থেকে এরকম কিছু লেখা বের হয়েছে। প্রবাসে থাকার কারণে ঐ লেখাগুলো সংগ্রহ করে কি লেখা হয়েছে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। ভরসা একমাত্র ইন্টারনেট যেখানে এখনো পর্যন্ত বাংলাতে ও বাংলাদেশের খুব বেশী কিছু পাওয়া যায় না । তাই লেখা শুরুর আগেই পাঠকের কাছে আমার অজ্ঞতার জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আমি যা লিখবো তা হয়তো আগেই অন্য কেউ লিখে গেছেন। এছাড়া এমন অনেকেই আছেন যারা কবিতা ও গণিত দুইটা জিনিসই আমার চেয়ে ভালো বুঝেন। তাদের বিরাগভাজন হবার আশংকা মাথায় নিয়েও এ লেখাটা। কবিতা ও গণিত শিরোনামে অবশ্য ইংরেজি ভাষায় কিছু লেখা পড়ার সুযোগ হয়েছে। এর মধ্যে কাই তিয়ানশিন (Cai Tianxin)এর ‘ম্যাথম্যাটিশিয়ানস ও পয়েটস’ যা অ্যামেরিকান ম্যাথম্যাটিক্যাল সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছিলো তার কথা বিশেষ করে উল্লেখ করবো বর্তমান লেখাটার মূল অনুপ্রেরণা হিসাবে।
আমি যেহেতু প্রশ্ন করার মাধ্যমে লিখতে ভালোবাসি তাই লেখাটিরও শুরু করছি একটা প্রশ্নের মাধ্যমে। এই প্রশ্নটা খুব স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন। তা হলো কবিতা ও গণিতকে নিয়ে এই প্রবন্ধটাতে কি আলোচনা করা হবে? উত্তর হল এ প্রবন্ধটির লেখার ক্ষেত্রে আমার কোন বিশেষ অ্যাজেন্ডা বা লক্ষ্য নাই। কবিতা ও গণিতকে নিয়ে একটা আলোচনা করাই লক্ষ যাতে আমার ভাবনাগুলো যতদূর সম্ভব প্রকাশ পেতে পারে।
লেখার শুরুতে কবিতা ও গণিতের সংজ্ঞা নিয়ে কিছু বলাই যথাযথ মনে হয়। কবিতা ও গণিত কি, কীভাবে তাদেরকে সংজ্ঞায়িত করা হয়? উইকিপিডিয়া বলছে ‘গণিত হলো পরিমাণ, সংগঠন, পরিবর্তন ও স্থান বিষয়ক গবেষণা’। কবিতা সম্পর্কে বলছে ‘কবিতা বা পদ্য শব্দের ছন্দময় বিন্যাস যা একজন কবির আবেগোত্থিত অনুভূতি, উপলব্ধি ও চিন্তাকে সংক্ষেপে এবং উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের সাহায্যে উদ্ভাসিত করে এবং শব্দের ছন্দায়িত ব্যবহারে সুমধুর শ্রুতিযোগ্যতা যুক্ত করে’। এই সংজ্ঞাগুলো পড়ে আমার কাছে মনে হয়েছে বিষয়টিকে অহেতুক জটিল করে ফেলা হচ্ছে। তাই সংজ্ঞাগুলো কতটুকু যথাযথ বিবেচনা না করে বরং কবিতা ও গণিত সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত অনুধাবনটাই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করবো। ব্যক্তিগত হলেও এ নিয়ে কিছু পঠন-পাঠনের মাধ্যমেই তা সৃষ্টি হয়েছে।
আমি মনে করি কোন কিছুকে যে কবিতা আবার কোন কিছুকে যে আমরা গণিত হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি- তা এসেছে মানুষের মস্তিষ্কের শ্রেণী বিন্যাস করার ক্ষমতা থেকে। একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করা যাক।
আমারা সবাই আপেলকে আপেল হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি। কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখলে দেখা যাবে যে দুটি আপেল কখনোই এক রকম হতে পারে না। তবু মস্তিষ্ক প্রত্যেকটি আপেলকে আলাদা আলাদা বস্তু হিসাবে মনে করলেও তাদেরকে একই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করতে পারে। এছাড়া মানুষের মস্তিষ্ক প্রকৃত বস্তু ও বস্তুর কোন ধরণের প্রতিরূপকেও একই শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ভাবতে সক্ষম। যেমন কোন শিশুকে একটা সত্যিকারের আপেল দেখালে এবং পরে আপেলের একটা ছবি দেখালে সে ছবির বস্তুটাকে আপেল হিসাবে চিহ্নিত করতে পারবে। এই শ্রেণীবিন্যাস করা মানুষের সহজাত বৈশিষ্ট্য। দর্শনেন্দ্রিয় ছাড়াও অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের বা একাধিক ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে পাওয়া তথ্যও মানুষ এভাবে শ্রেণীবিন্যস্ত করতে পারে। তার মানে মানুষের সক্ষমতা আছে শুধু দৃশ্যকে নয়, ধ্বনি, স্বাদ, স্পর্শ ও ঘ্রাণকে শ্রেণী বিন্যস্ত করার। মানুষ যে লিখতে পড়তে ও বলতে পারে তার কারণটাও এই শ্রেণীভুক্ত করার সক্ষমতা। এর একটি উদাহরণ হলো যে দুটো আলাদা ফন্টে লেখা ‘ক’ বর্ণকে আমরা ‘ক’ বর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করতে সক্ষম।
মানুষের মস্তিষ্ক জটিল বস্তুকেও শ্রেণীভুক্ত করতে সক্ষম। যেমন ধরা যাক আপেল ও কমলা মিলিয়ে কিছুটা বানানো হলো, ধরা যাক এক ধরণের জুস। মানুষের মস্তিষ্ক যেমন ওর মধ্যে আপেল ও কমলাকে আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারবে তেমনি তৈরি জুসকেও আলাদা বস্তু হিসাবে শ্রেণীভুক্ত করতে পারবে। এরকম ভাবে আপেল ও কমলা দিয়ে বানানো আরেকটি জুসকেও সে আপেল ও কমলার মিশ্রণের তৈরি জুস হিসাবে চিহ্নিত করতে পারবে- স্বাদ, বর্ণ বা গন্ধের তারতম্য স্বত্বেও।
কবিতাকে যে মানুষ কবিতা ও গণিতকে যে মানুষ গণিত হিসাবে চিহ্নিত করতে পারে সেখানেও কাজে আসছে এই বৈশিষ্ট্যটি। কবিতা শুধু বর্ণমালা বা শব্দের সমাহার নয় আরো অধিক কিছু। প্রায়শই কৌতুক করে বলা হয় যে গদ্যাকারে কিছু লিখে দুই পাশে ইরেজার দিয়ে মুছে দিলেই কবিতা হয়ে যায়। কথাটা তাই পুরাটা ভুল নয়। কিছুটা দেখা, কিছুটা পড়া এবং অন্যান্য আরো কিছুর সাহায্য মানুষ কবিতাকে কবিতা হিসাবে বুঝতে পারে। তেমনি গণিতের প্রধান দৃশ্যগত বৈশিষ্ট্য হলো সংখ্যার ব্যবহার। কিন্তু সংখ্যা ছাড়াও গণিত হয়। যেমন আল খোয়ারিজমি তার যে গ্রন্থে বীজগণিতের উদ্ভাবনের কথা লিখেছিলেন তাতে বীজগাণিতিক চিহ্ন ব্যবহার করেননি।
উপরের আলোচনা দেখায় সংজ্ঞার চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ণ হলো এটা বুঝতে পারা যে গণিত ও কবিতা উভয়েই মানুষের মস্তিষ্কের বৈশিষ্ট্যজনিত কারণে অস্তিত্বশীল। অন্য বিষয়গুলো যেমন- গান, চিত্রকলা, গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রেও তাই। তাহলে অন্য যেকোন কিছুর মতোই কবিতা ও গণিত এক মানব বাস্তবতা ও জীবনের অবিচ্ছেদ্য উপাদান। গণিত ছাড়া যে দৈনন্দিন জীবন অচল তা সবাই স্বীকার করবেন। কিন্তু একই কথা কি কবিতা সম্পর্কেও বলা যাবে? আমার কাছে তাই মনে হয়। মানুষের পরস্পরের সাথে যোগাযোগের মূল উপায় ভাষা। সেই ভাষার প্রথম উত্তরণ ঘটা শিল্পিতরূপ কবিতা। প্রাচীন সব কাহিনীই কবিতা আকারে লিখা। গল্প, উপন্যাস, নাটকের আগমন অনেক পরে। এমনকি সঙ্গীত যা মানব সভ্যতার ঊষালগ্নে সৃষ্টি হয়েছিলো তাও আসলে কবিতার সুরবদ্ধ রূপ।
ভাষার সৌন্দর্যের মূল উৎস তাই আমার কাছে কবিতাই। ভাষা তৈরি হয়ে যাওয়ার পরেও যে যুগযুগ তার ব্যবহার টিকে থাকে তাও আমার কাছে মনে হয় কবিতার কারণে। কারণ ভাষার টিকে থাকার সাথে ভাষা ব্যবহারে ভালো লাগার সম্পর্ক আছে। অথচ কবিতা ও ভাষার এ সম্পর্ক আমরা একেবারেই টের পাইনা। এই জায়গাতে গণিত আর কবিতায় ভীষণ মিল। গণিত ছাড়াও জীবন অচল, কিন্তু একইভাবে আমরা তা বুঝে উঠতে পারিনা।
প্রাচীন মানবের ব্যবহৃত দৈনন্দিন বস্তুতে গণিত ব্যবহারের যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। যেমন প্রাচীন মানুষ বিশ থেকে তিরিশ হাজার বছর আগে পশুর হাড়ের উপরে দাগ কেটে গণনা করতো এমন নমুনা পাওয়া গেছে। মানে তাদের এক দুই করে গণনার সক্ষমতা ছিলো। তবে এক দুই তিন গণনা থেকে সংখ্যার বিমূর্ত ধারণা পর্যন্ত পৌঁছাতে অনেক সময় লেগেছে মনে করা হয়। প্রাচীন মিশর ও মেসোপটেমিয়া থেকেই গণিতশাস্ত্রের বর্তমান রূপ বিকাশ লাভ করে বলে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। গণিত ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া গেছে মায়া সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনেও। অপর দিকে কবিতার জন্মও মানব সভ্যতার ঊষালগ্নে। প্রাচীন মানুষ যে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করতো তার অনেক নমুনাই আছে। অনুমান করা যেতে পারে যে ছন্দের তালে তালে গল্প করার সূচনাও সে সময়ে ঘটেছিলো। এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে প্রাচীন কাব্য গ্রন্থ হলো ‘গিলগামেষের উপাখ্যান’ যা রচিত হয়েছিলো প্রায় তিন হাজার বছর আগে সুমেরিয়াতে। তেমনি প্রাচীন কালেই রচিত হয়েছে হোমারের ইলিয়াড ও অডিসি,বাল্মীকি ররামায়ণ ও বেদব্যাসের মহাভারত। এর সবগুলোতেই কাহিনীর বর্ণনা হয়েছে কবিতা আকারে। গল্প-উপন্যাস কবিতা থেকে আলাদা হতে পেরেছে অনেক পরে মাত্র কয়েকশত বছর আগে। তাই ভাষাকে মানব সভ্যতায় সুদীর্ঘকাল প্রবহমান রাখতে পেরেছে কবিতাই। গদ্য ভাষার বিকাশের সাথে সাথে কবিতার মাধ্যমে কাহিনী বলার প্রয়োজন অনেকখানি কমে গেছে। কবিতা তাই এখন অনেক বেশী বিমূর্ত, কাহিনী থাকলেও তা সব সময় প্রত্যক্ষ নয়। এদিক থেকে কবিতার সাথে মিল আছে গণিতের। প্রাচীন গণিতের কাজ ছিলো গণনা করা। আধুনিক গণিত শুধুমাত্র গণনাতে সীমাবদ্ধ নেই।
কবিতা ও গণিতের মিলের আরেক জায়গা হলো- দুটোই জীবনের সাথে ওতপ্রোত জড়িয়ে থাকলেও তাদের উপস্থিতি দৈনন্দিন জীবনে যেমন সহজে টের পাই না, তেমনি পাঠ করতেও বিশেষ কিছু প্রস্তুতি লাগে। যেমন হঠাৎ করেই একজন কবিতার বড় পাঠক হয়ে উঠতে পারবে না। সে ভাষায় তার যথেষ্ট দক্ষতা, সমাজ ও জাতির ইতিহাস বোঝা, সেই ভাষায় আগে কারা কি লিখেছেন সেসব কিছুর ওপর মোটামুটি দখল দরকার। এজন্য বিদেশী ভাষায় কবিতা পড়ে ভালো মন্দ বোঝা প্রায় অসম্ভব। অনুবাদেও একই পরিণতি ঘটে। এই সমস্যা কিন্তু গান, চিত্রকলা বা গল্প-উপন্যাসের নাই। কবিতা বোঝা তাই অনেকটা যাকে বলে অ্যাকুয়ার্ড টেস্ট বা অর্জিত রুচি। গণিতেরও একই বৈশিষ্ট্য। আধুনিক গণিত কেউ চট করে বুঝে উঠতে পারবেন না। অনেক প্রস্তুতির পরেই গণিত বোঝার সামর্থ্য গড়ে ওঠে।
কবিতার ভালো-মন্দ বোঝার সমস্যাটি বেশ জটিল। গণিতের বেশ কিছু জানা সমস্যা আছে যার সমাধান অনেকেই খুঁজছেন। যার গণিত বোঝার সামর্থ্য আছে তিনি ঐ রকম কোন সমস্যার সমাধান পেলে তা পড়ে সমাধানটা সঠিক বা বেঠিক তা বুঝতে পারবেন। তবে ঐ পাঠের জন্য হয়তো তার দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে। যেমন এক দুই বছর। এরকম একটি গাণিতিক সমস্যার সমাধান প্রকাশিত হয়েছিলো আর্কাইভ (ArXiv)’ নামক একটি অনলাইন প্লাটফর্মে। সমস্যাটি সমাধান করেছিলেন গ্রিগরি পেরেলমান (Grigori Perelman) নামক একজন রুশ গণিতবিদ। তার সমাধানটা যে সঠিক তা পড়ে বুঝে উঠতে পৃথিবীর প্রথম সারীর গণিতবিদদের বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছিলো। তবু পেরেলমান যে বড় কিছু করেছেন তা বোঝা গিয়েছিলো আগেই। কবিদের বেশীর ভাগেরই সেই সৌভাগ্য হয়না। কবিতার ভালো-মন্দ বুঝতে বুঝতে বিদগ্ধ পাঠকের বছরের পর বছর লেগে যায়। অনেক সময় কবির জীবদ্দশায়ও তা হয়ে উঠে না। অপরদিকে জীবনকালে খ্যাতিমান অনেক কবিকেই দেখা যায় মৃত্যুর পরে বিস্মৃত হয়ে পড়তে। এরকম উদাহরণ বাংলা ভাষাতেই আছে। যেমন জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন কবিতাটি। প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বুদ্ধদেব বসু সম্পাদিত কবিতা পত্রিকায় ১৯৩৪ সালে। বুদ্ধদেব বসু ডাকসাইটে সম্পাদক ও কবি ছিলেন তাই কবিতাটি অনেকেই পড়েছিলেন নিশ্চিত ভাবে। কবিতাটি বিখ্যাত প্রাবন্ধিক আবু সাইদ আইয়ুব সম্পাদিত একটি সংকলনেও স্থান পেয়েছিল ১৯৩৯ সালে। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ কবি হিসাবে সত্যিকার ভাবে খ্যাতিমান হলেন ১৯৫৪ সালে ট্রাম দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরে। আজ অনেকেই মনে করবেন বনলতা সেন বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা। হয়তো বা শ্রেষ্ঠতমই। কবিতাটি থেকে আসা বেশ কিছু শব্দবন্ধ যেমন ‘নাটোরের বনলতা সেন’ , ‘হাজার বছর ধরে’, ‘পাখির নীড়ের মতো’ ,‘দারুচিনি দ্বীপ’, ‘চুল তার কবেকার’ , ‘এতদিন কোথায় ছিলেন’ ইত্যাদি বাংলা ভাষাতে ঢুকে পড়েছে পাকাপোক্ত হয়ে। আমি আগে কবিতা ভাষাকে যে নির্মাণ করে ও সৌন্দর্য প্রদান করে বলেছি ‘বনলতা সেন’ কবিতাটি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। যারা সেই সময় কবিতাটি পড়েছিলেন তাদের তাই জীবনানন্দ দাশকে মাথায় তুলে রাখা উচিত ছিলো। কিন্তু কবিতাটির শক্তিমত্তা বুঝতে বুঝতে বিশ বছরেরও অধিক সময় লেগে গেছে।
কাই তিয়ানশিনের প্রবন্ধ মোতাবেক শিল্পীসমাজের মধ্যে কবিরা হলো তুলনামূলক নিচু শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত, তেমনি বিজ্ঞানীসমাজের মধ্যে গণিতবিদরা অন্তর্গত তুলনামূলক ভাবে নিচু শ্রেণীতে। এই নিয়ে আমার কিছুটা দ্বিমত আছে। বাংলাদেশে অন্তত: কবিদের মর্যাদা সবচেয়ে বেশী। এজন্য সবাই কবি হতে অস্থির। বইমেলাতেও দেখা যায় পাঠক বা বই বিক্রি যতই কম হোক না কেন, কবিতার বইয়ের প্রকাশনার সংখ্যাই বেশী। কিন্তু আমি যে জায়গাতে কাই তিয়ানশিনের সঙ্গে একমত তা হলো- যারা কবিতা লেখেন মানে কবি ও যারা গণিত চর্চা করে অর্থাৎ গণিতবিদদের নিয়ে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি। স্বাভাবিক সামাজিক জীবন যাপনের সাথে কবি জীবন ঠিক মতো খাপ খায়না বলেই আমার মনে হয়। শিল্প চর্চায় সাফল্য না আসলে সমাজে সেই শিল্পীর পরিচয়ের সংকট প্রবল হয়ে উঠে। কবিতাকে বলা হয় শিল্প-সাহিত্যের বিশুদ্ধতম রূপ। গল্পকার, উপন্যাসিক, চিত্রশিল্পী বা অন্যান্যদের কাজের ভালো-মন্দ যে রকম ভাবে তাড়াতাড়ি বোঝা সম্ভব তেমনটা কবিদের ক্ষেত্রে হয় না। এছাড়া গল্প, উপন্যাস বা চিত্রকলার বাজার মূল্য অনেক বেশী। তেমনটা কবিদের ভাগ্যে সাধারণত জুটে না। বাংলাদেশের যারা কবিতা চর্চা করেন তাদের অনেককেই দেখা যায় সামাজিকভাবে আগেই প্রতিষ্ঠিত। সামাজিক অবস্থানকে শিল্পী পরিচয়যুক্ত করে আরেকটু এগিয়ে দেবার জন্য কবিতা চর্চাকে তারা ব্যবহার করেন বলেই মনে হয়। যারা শুধুমাত্র কবিতা লেখেন সমাজের সাথে তাদের মিলিয়ে চলতে বেগ পেতে হয়।
গণিতবিদদের সামাজিক পরিচয়ের সংকট কবিদের থেকে খানিকটা কম। গণিতবিদদের আয় রোজগার মোটামুটিই ভালোই। তবে শিল্প-সাহিত্যের যেমন বিশুদ্ধ ও প্রায়োগিক রূপ আছে তেমনি গণিতেরও আছে বিশুদ্ধ ও প্রায়োগিক রূপ। গণিতবিদের মধ্যে যারা প্রায়োগিক কাজ করে থাকেন, উদাহরণ সরূপ কম্পিউটার প্রোগ্রাম লিখে থাকেন বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হয়ে, তাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও আয় দুটোই বেশী। এই সৌভাগ্য যারা বিশুদ্ধ গণিতের চর্চা করেন তাদের হয় না, যদি না তাদের ভাগ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরী জোটে।
কাই তিয়ানশিন আরেকটি মনে দাগ কেটে যাবার মতো পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। তা হলো- একজন কবির পক্ষে সহজেই গল্পকার বা উপন্যাসিক হয়ে ওঠা সম্ভব কিন্তু গল্প-উপন্যাস থেকে শুরু করে কবি হয়ে ওঠা সাধারণভাবে সম্ভব না। গল্প-উপন্যাস থেকে শুরু করে কবি হয়ে ওঠার উদাহরণ হয়তো দুই একটা পাওয়া যাবে, কিন্তু সাহিত্যের ইতিহাসে বেশীর ভাগ খ্যাতিমান গল্পকার-উপন্যাসিকই শুরু করেছেন কবিতা থেকে। প্রথমে কবিতা লিখে হাত পাকানোর পরেই তাদের কথাসাহিত্যে যাত্রা। তেমনি কাই তিয়ানশিন বলেছেন যে গণিতবিদদের পদার্থ বিজ্ঞানী হয়ে ওঠার উদাহরণ পাওয়া যাবে কিন্তু পদার্থ বিজ্ঞানীদের গণিতবিদ হয়ে ওঠার উদাহরণ অপ্রতুল।
কাই তিয়ানশিন যে গণিত ও কবিতাকে মনে করা হয় পরস্পরের পুরোপুরি বিপরীত তার কথাও উল্লেখ করেছেন। কবিতাকে মনে করা হয় অযৌক্তিক কল্পনার সৃষ্টি যেখানে গণিত নির্মিত হয় পুরোপুরি যুক্তির মাধ্যমে। আরো মনে করা হয় যে কবিতা কল্পনা ও সৃজনশীলতার এবং গণিত যুক্তির সর্বোত্তম প্রকাশ। কাই তিয়ানশিনের মতো আমিও এই ভাবনাকে ভুল মনে করি। কবিতা মোটেই যুক্তিহীন নয়। যাদের কবিতা লেখার অভিজ্ঞতা আছে তারা জানেন যে একটা শব্দের পরে আরেকটা যথাযথ শব্দ খুঁজে পেতে কি পরিমাণ চিন্তা ভাবনা করার প্রয়োজন পড়ে। যৌক্তিক প্রক্রিয়াতে যেমন যৌক্তিক বাক্যগুলোর ধারাবাহিকতা থাকে তেমনি ধারাবাহিকতা থাকে কবিতার শব্দগুলো সাজানোতে। ইচ্ছা মতো লিখলেই কবিতা হয়ে উঠে না। কবিতাতে তাই নির্মাণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক কবিই তাই পছন্দ মতো শব্দ না পেলে কবিতাকে বছরের পর বছর অপ্রকাশিত রাখেন। বড় কবিরা তাই শব্দ দিয়ে যুক্তির শ্রেষ্ঠ কারিগর।
সৃজনশীলতার দিক থেকে কবিতাকে সর্বোত্তম মনে করা হয় ও এতে আমার দ্বিমত নেই। যদি কোন কিছু সৃজনশীলতার দিক থেকে কবিতাকে অতিক্রম করতে পারে তা হলো গণিত। কবিতার মতোই গণিতের মূল শক্তির জায়গাটা কল্পনা। কিভাবে তা বোঝাবার জন্য দাবা খেলার উদাহরণ দেবো। দাবা খেলার সাথে গাণিতিক সমস্যা সমাধানের মিল আছে। মাথার মধ্যে অনেক দ্রুত হিসাব নিকেশ করে, কি চাল হলে কি হবে তা ভেবেই দাবা খেলা হয়। দাবার ঘুটিকে বাইরে থেকে অচল ও নিষ্প্রাণ মনে হলেও দাবা যারা খেলেন তাদের কাছে দাবার ঘুটি তাই প্রাণবন্ত এবং দাবার চেয়ে গতিশীল ও উত্তেজনাপূর্ণ খেলা অন্য কিছু হতে পারে না। কিন্তু আধুনিক কম্পিউটার এই হিসাব নিকাশের কাজটা মানুষের চেয়ে অনেক বেশী দক্ষতার সাথে করতে পারে। প্রায় বছর বিশেক আগে তৎকালীন দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারাভের সাথে ডিপ ব্লু নামক এক কম্পিউটারের প্রতিযোগিতা সংবাদের শিরোনাম হয়েছিলো। কাসপারাভকে সর্বকালের সেরা দাবা খেলোয়াড় বলে মনে করা হয় তবু কাসপারাভ ডিপ ব্লুর সাথে হেরে গিয়েছিলেন। কারণটা অনুধাবন করা খুবই সহজ। আধুনিক কম্পিউটারের মেমরি ও সেমেমরি ব্যবহার করে হিসাব নিকাশ করার সক্ষমতা মানুষের চেয়ে অনেক বেশী। তাই যতই দিন যাবে দাবা-তাস ধরণের খেলা, যেখানে মেমরি ও দ্রুত হিসাব নিকাশ করার দরকার হয় সেগুলোতে মানুষ কম্পিউটারের সাথে পেরে উঠবে না। কল্পনা ছাড়াও তাই দাবা খেলা সম্ভব এবং মানুষের মধ্যে যাদের স্মরণশক্তি বেশী ও দ্রুত গতিতে অনেক চালের হিসাব কষতে পারেন তারা সাধারণত দাবা খেলায় ভালো করেন।
অনেকেই মনে করেন যে গণিত মানে যোগ, বিয়োগ, গুন, ভাগ করতে পারা এবং যারা এগুলো ভালো করতে পারেন তাদেরকে গণিতে ভালো মনে করা হয়। তা যদি সত্যি হত তাহলে সেরা দাবা খেলোয়াড় মাত্রই পৃথিবী সেরা গণিতবিদ হতেন। কিন্তু গণিত দ্রুত হিসাব নিকাশের সক্ষমতা অতিক্রম করে কল্পনার সাহায্যে। গণিতের বিখ্যাত অনেক প্রমাণের সাথে তাড়াতাড়ি অংক কষার বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নাই। যেমন কান্টরের অসীমত্ব বা ইউক্লিডের মৌলিক সংখ্যার অসীমত্ব বিষয়ক প্রমাণ। যে যুক্তির সাহায্যে ঐ প্রমাণগুলো করা হয়েছে তা নির্মাণ করা হয়েছে কল্পনার সাহায্যে। ওরকম প্রমাণের কথা আগে কেউ ভাবতে পারেনি ও দ্রুত অনেক বেশী অংক কষার সাথে তারা সম্পর্কহীন।
কবিতা সুন্দর- দ্বিমতের কোন অবকাশ নাই। কিন্তু এই সৌন্দর্য যেনতেন রকম নয়। একটু ভিন্ন ধরণের। যারা কবিতা পাঠে অভ্যস্ত তারা গদ্যে, গানে এমনকি প্রাকৃতিক দৃশ্যের মধ্যে কবিতার সৌন্দর্য টের পান। গদ্যের বাক্যে যখন কবিতার সৌন্দর্য ধরা পড়ে তা পাঠের আনন্দ তীব্র হয়ে পড়ে। সুরের মধ্যেও মন কাড়া সৌন্দর্য আছে। কিন্তু সুরকে আমার কাছে মনে হয় এক গতির ও এক মুখি। জীবন যাপনের নানামুখী কর্মকাণ্ডের গতিশীলতা ভিন্ন রকমের। সেই গতি কবিতার মতো প্রগাঢ় ভাবে আর কোন কিছুই ধরতে পারে না। তাই এক গোধূলির সৌন্দর্যকে হঠাৎ করে কবিতা মনে হতে পারে যখন নিশ্চল আবির রাঙ্গা আকাশের পটভূমিতে পাখিরা নানা ভাবে, নানা শব্দে ঘরে ফেরা শুরু করে। সব পাখি ঘরে ফেরে কিন্তু এক গতিতে একই ঘরে নয়। এই বৈচিত্র একসাথে ধারণ করতে পারে কবিতাই।
একই সাথে কবিতা পাঠে বিজড়িত থাকে অপার আনন্দ। কবিতার পঙক্তি যদি মাথায় থাকে ও সে পঙক্তিগুলো যখন জীবনের কোন ঘটনার সাথে মিলে যায় তখন নিজের অজান্তেই তারা মস্তিষ্কে অনুরণন তুলতে থাকে। বাল্মীকির অজান্তে যেভাবে কবিতার প্রথম পঙক্তি তার মুখ থেকে উচ্চারিত হয়েছিল, তেমনি কবিতার পাঠকও যেন সেই জানা কবিতাকে নতুন করে উচ্চারণ করে সৃষ্টি করেন- সৌন্দর্য উপভোগ করা শুরু করেন।
গণিতের সৌন্দর্য কবিতা থেকে ভিন্ন। গণিতের সৌন্দর্য বুঝতে কবিতার মতোই যথেষ্ট পাঠ-প্রস্তুতি লাগে। গণিতের সৌন্দর্য আসে অনেকখানি বিস্ময় থেকে। প্রথমত গণিতের সৃষ্টিটাই বিস্ময়কর। ছোটবেলায় আমাদেরকে যেভাবে গণিত শিক্ষা দেয়া হয়, তা গণিত যে আসলে মনুষ্য নির্মিত এক বিমূর্তধারণা সে সত্যকে একেবারে আড়াল করে ফেলে। কিন্তু গণিত আসলেই পুরোপুরি মানুষের মস্তিষ্কের সৃষ্টি। আমাদের সবার গণিত শিক্ষা শুরু এক দুই ইত্যাদি করে গণনা থেকে। আসুন ভাবে দেখি আসলেই এক দুই বলে কিছু আছে কিনা। এই ব্যাপারটা আমার অপর একটা লেখায় আগে ব্যাখ্যা করেছিলাম। পাঠকের সুবিধার্থে তা এখানে আবার বর্ণনা করা হলো।
এক, দুই, তিন, চার ইত্যাদি সংখ্যাগুলো আমাদেরকে ছোটবেলা থেকেই শিখতে হয়। আমাদের চারপাশে সবখানে সংখ্যার ছড়াছড়ি-লিখিত ও মৌখিক দু’ধরণের ভাষামাধ্যমেই। কিন্তু আসলেই কি সংখ্যা বলে কিছু আছে তা বোঝার জন্য নিজের হাতের আঙুলগুলোর দিকে তাকাই। নিশ্চয়ই পাঁচটা আঙুল দেখছেন? হাতের কোথাও কিন্তু পাঁচ চিহ্নটি নেই। তার মানে ‘৫’ একটি ধারণা, যা আমার মস্তিষ্কের নির্মাণ। এই নির্মাণ ঘটেছে মস্তিষ্কের বস্তুকে শ্রেণীভুক্ত করার ক্ষমতার কারণে, যা আমি এ লেখার প্রথম দিকে বর্ণনা করেছি। হাতের আঙুলগুলোর প্রত্যেকটি আলাদা। মস্তিষ্ক প্রত্যেকটিকে আলাদা আলাদা বস্তু মনে করতে পারতো। তা না করে মস্তিষ্ক তাদেরকে একই শ্রেণীভুক্ত মনে করছে, যে শ্রেণীটির নাম বাংলাতে ‘আঙুল’। মস্তিষ্ক শ্রেণীভুক্ত করার পরেও শ্রেণীভুক্ত প্রত্যেকটি বস্তুকে আলাদাভাবে দেখার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে না। আলাদা আলাদা বস্তুকে মস্তিষ্ক যেমন শ্রেণীভুক্ত করে তেমনি আলাদা আলাদা করেও ভাবতে পারে। এই আলাদা করে দেখার ক্ষমতার মধ্যেই আছে সংখ্যার জন্ম রহস্য। আর সাথে যুক্ত হয়েছে মস্তিষ্কের আরেকটি ক্ষমতা তাহলো পরিমাপ ছাড়াই কমবেশী বুঝে ফেলার ক্ষমতা। যেমন দূর থেকে দুটি গাছের দিকে তাকিয়ে আমরা কোনটা দীর্ঘ আর কোনটা খর্ব বলে দিতে পারি। এর জন্য মাপ ঝোঁকের দরকার হয়না। তেমনি দুইটি হাতের একটিতে যদি চারটি আর আরেকটিতে যদি পাঁচটি আঙুল থাকে, তা দেখে মস্তিষ্ক বলে দিতে পারে দুটো একই শ্রেণীর হলেও একটিতে বস্তুর পরিমাণ অন্যটি থেকে কম-বেশী আছে। শুধু তাইনা, মস্তিষ্ক যদি আরেকটি হাত দেখে যেখানে তিনটি আঙুল আছে তাহলে বুঝতে পারে যে চারের তুলনাতে হাতটাতে কম আঙুল আছে এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারে যে পাঁচের তুলনায়ও কম আঙুল আছে। এই পার্থক্যগুলো ভাষাতে প্রকাশ করার প্রয়োজনে সংখ্যার অর্থাৎ এক, দুই, তিন, চার করে গণনার উদ্ভাবন। গণিতশাস্ত্রের এই জন্ম-রহস্যই বিস্ময়কর। এ নিয়ে কেউ যত ভাববে ততই মুগ্ধ হবে। মানুষের তৈরি এই সংখ্যা জন্ম দিয়েছে আরো অনেক বিস্ময়ের। যেমন পিথাগোরাসের উপপাদ্যের মাধ্যমে টের পাওয়া গেছে অমূলদ সংখ্যার অস্তিত্ব– যে সংখ্যাকে দুইটি সংখ্যার ভাগফল হিসাবে প্রকাশ করা যাবে না। তার মানে সংখ্যা মানুষের মস্তিষ্কের নির্মাণ হলেও তা এমন কিছুর অস্তিত্ব জানান দিতে পারে যা মস্তিষ্কের অনুধাবনের বাইরে। গণিতের আরেক সৌন্দর্য তার প্রমাণের প্রক্রিয়াতে। গাণিতিক প্রমাণের যুক্তির শক্তিমত্তা, কল্পনা ও সরলতা ইত্যাদি মিলে গণিতে অসামান্য সৌন্দর্য প্রকাশ পায়। কবিতার মতোই গণিতের সেই সৌন্দর্য অনুধাবনে পূর্ব প্রস্তুতি ও পঠন-পাঠন লাগে। তবে কবিতার মতোই একবার সে সৌন্দর্য অনুধাবন করতে পারলে তা চিরকালই আনন্দ জোগাবে।
গণিত ও কবিতা উভয়ই মানুষের মস্তিষ্কের উপজাত ও মানুষকে আবিষ্ট করে রাখার ক্ষমতা রাখে। মানব ইতিহাসে এই দুই বিষয়েই সমান দক্ষতা বা আগ্রহ প্রকাশ করেছেন বা অর্জন করেছেন এমন মানুষ কিন্তু খুব কম নেই। কবিতা লিখেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন গণিতবিদ হিসাবে পরিচিত আর্কিমিডিস। তবে উভয়ক্ষেত্রে গুনগত উৎকৃষ্টতা অর্জন করেছিলেন এমনদের মধ্যে সবার প্রথমেই বলতে হবে ওমর খৈয়ামের নাম। ওমর খৈয়াম বিখ্যাত তার রুবাইয়াৎ নামক কাব্য গ্রন্থের জন্য, কিন্তু তিনি একই সাথে ছিলেন অত্যন্ত প্রভাবশালী গণিতবিদ ও জোতির্বিজ্ঞানী। ওমর খৈয়ামের মতোই সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখা আরেকজন আইরিশ গণিতবিদ উইলিয়াম রোয়ান হ্যামিল্টন (William Rowan Hamilton) । কবি হিসেবেও তিনি ছিলেন যথেষ্ট দক্ষ। বিংশ শতকে কবিতা ও গণিত দুই বিষয়েই দক্ষতা অর্জন করেছিলেন এমনদের মধ্যে আছেন চিলির স্প্যানিশ ভাষার কবি নিকোনর পাররা, যিনি একই সাথে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গণিতের অধ্যাপক ও একজন প্রথম সারির কবি। তিনি নোবেল পুরষ্কার পাবেন বলেও অনুমান করা হতো, যদিও তা শেষ পর্যন্ত ঘটেনি। নিকোনর পারা বাংলাদেশের কবিদের মহলেও এক পরিচিত নাম। গণিতবিদ ও কবিদের দলে এছাড়া আরো আছেন রোমানিয়ার ইওন বারবু (Ion Barbu) যিনি একই সাথে ছিলেন প্রভাবশালী কবি ও গণিতবিদ। তাকে বলা হয় গত শতকের রোমানিয়ার অন্যতম প্রধান কবি, আবার গণিতেও তার নামে বারবালিয়ান স্পেস নামে একটি ধারনার প্রচলন আছে। কবি ও গণিতবিদদের এই দলে আরো আছেন জ্যাকস রুবাউদ (Jacques Roubaud) যিনি একাধারে ছিলেন ফরাসী ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কবি ও গণিতের অধ্যাপক।
গণিত ও কবিতার পরস্পরের উপরে প্রভাব ও সম্পর্কের আরো অনেক উদাহরণ আছে। আইনস্টাইন বলেছিলেন যে ‘বিশুদ্ধ গণিত, যৌক্তিক ধারণার কবিতা’। বিখ্যাত রুশ গণিতবিদ আন্দ্রেই মারকোভ ‘মারকোভ প্রসেস’ নামে পরিচিত একটি পদ্ধতি উদ্ভাবনের পরে তা বিখ্যাত রুশ কবি আলেকজান্ডার পুশকিনের কবিতাবিশ্লেষণে ব্যবহার করেছিলেন। জার্মান কবি গ্যোটে গণিত ও গণিতবিদদেরকে নিয়ে লিখেছিলেন যা প্রমাণ করে যে গণিত তাকে যথেষ্ট ভাবিয়েছিল। ইংরেজ কবি স্যামুয়েল কোলরিজ গাণিতিক সমস্যা নামক একটা কবিতা লিখেছিলেন। স্কটল্যান্ডের জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল যিনি গাণিতিক পদার্থবিদ্যার অন্যতম পথিকৃৎ একই সাথে চর্চা করতেন কবিতারও। এমিলি ডিকিন্সনের কবিতাতে অনেকবার গাণিতিক শব্দ ব্যবহারের উদাহরণ আছে। কবিতা ও কবিদের নিয়ে মজার ও স্মরণীয় মন্তব্য করেছেন অনেক প্রখ্যাত গণিতবিদ। এদের মধ্যে বিশেষভাবে স্মরণ করবো কার্লভাইয়ারস্টসের মন্তব্য, যিনি বলেছিলেন- কবিত্ব না থাকলে পূর্নাঙ্গ গণিতবিদ হওয়া সম্ভব না। কবিতা ও গণিত পরস্পরকে প্রভাবিত করেছে তার উদাহরণ এরকম আরো অনেক পাওয়া যাবে। আমি অনেক উচ্চতর গণিতের পাঠ্য বইয়ে কবিতার পঙক্তি ব্যবহার করার উদাহরণ দেখেছি। কবিতা ব্যবহার করে গণিতবিদদের নিয়ে লেখার উদাহরণও অনেক আছে। এদের মধ্যে আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত স্মরণযোগ্য মনে হয়েছে অস্ট্রেলিয় টম পেটসিনিসকে (Tom Petsinis),যিনি কবিতা চর্চার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের শিক্ষকতা করে থাকেন।
অপরদিকে বাংলা ভাষার কবিতা আপাতদৃষ্টিতে গণিত থেকে তেমন প্রভাব নেয়নি যদিও কিছু উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যতিক্রম মনে হয় জীবনানন্দ দাশ। জীবনানন্দ দাশের কবিতা জ্যামিতিক সুষমাময় ও গূঢ় অর্থে ঠাসা। রূপসী বাংলার উপরের আমি একটা আলোচনা করতে গিয়ে জীবনানন্দ দাশের কবিতার সঙ্গে জ্যামিতিক আকৃতির মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। প্রবন্ধটি কিছুধ্বনি নামক একটি লিটল ম্যাগাজিনে নব্বই দশকের শেষ দিকে প্রকাশিত হয়েছিলো। তবে জীবনানন্দ দাশের কবিতাতে গণিত নিয়ে সরাসরি উচ্চারণ তেমন নেই।
গণিত অনেক বেশী প্রত্যক্ষ বিনয় মজুমদারের কবিতায়। বিনয় মজুমদার গণিতশাস্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পাঠ গ্রহণ করেছিলেন। তার কবিতায় গণিতের প্রসঙ্গ বেশ কয়েকবারই এসেছে। তার ‘একটি গান’ কবিতাটি লেখা হয়েছে গাণিতিক সমীকরণের অনুকরণে। সাম্প্রতিক সময়ে মাসুদ খান, কামরুল হাসান ও রাদ আহমেদ সরাসরি গাণিতিক ধারণা প্রভাবিত কবিতা লিখেছেন। মুজিব ইরম ও ফরিদ কবিরের কবিতাতেও এসেছে গণিতপাঠের অভিজ্ঞতা। কামাল চৌধুরী তার বেশকিছু লেখায় ও সাক্ষাৎকারে কবিতার গাণিতিক রূপের কথা উল্লেখ করেছেন। এরকম উদাহরণ আরো হয়তো কিছু আছে। তবু অনুমান করি যে বাংলাভাষার খুব বেশী সংখ্যক কবি গণিত নিয়ে ভাবনাচিন্তা প্রকাশ করেননি। অন্যদিক থেকে বাংলাদেশে ও বাংলাভাষায় গণিতকে কবিতা প্রভাবিত করেছে তেমন উদাহরণ মনে হয় বেশী নাই। এমন একজন সম্ভবত প্রফেসর মিজান রহমান, যিনি কানাডাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিতের অধ্যাপক ছিলেন। তার বেশ কিছু বাংলায় লেখা গ্রন্থ আছে। অনুমান করি কবিতাও লিখেছিলেন, যদিও পাঠের সৌভাগ্য হয়নি। প্রফেসর জামাল নজরুল ইসলাম গণিতবিদ হিসাবে সুপরিচিত হলেও শিল্প সাহিত্য নিয়েও লেখালিখি করেছিলেন। হুমায়ুন আহমেদ কথাসাহিত্যিক হলেও কবিতা ও গণিত উভয়ের প্রভাব তার লেখায় সুস্পষ্ট। এমনটা তার ছোট ভাই প্রফেসর মুহাম্মদ জাফর ইকবাল সম্পর্কেও বলা যাবে। পশ্চিম বাংলাতেও এরকম কয়েকজন আছেন বলে অনুমান, তবে তাদের লেখা পাঠের সৌভাগ্য হয়নি।
সব মিলিয়ে কবিতা ও গণিত যুগ যুগ ধরে মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে থেকেছে এবং পরস্পরকে প্রভাবিত করেছে। গণিত যেমন আকর্ষণ করেছে কবিদের তেমনি কবিতা আকর্ষণ করেছে গণিতবিদদের। এতে কবিতা ও গণিত উভয়েই ঋদ্ধ হয়েছে বলে আমার অনুমান। আধুনিক যুগে দুঃখজনক ভাবে বাংলা ভাষার কবিদের ভিতরে গণিত বিষয়ে আগ্রহের ঘাটতি আছে। এছাড়া ঘাটতি আছে বৈচিত্র্যময় বিষয়ে পাঠের। মনে রাখতে হবে বাংলা ভাষা রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ হয়ে পৌঁছে গেছে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম কাব্য ভাষার কাতারে। সে তুলনায় বাংলাদেশে ও বাংলা ভাষাতে গণিত তেমন অগ্রসর হতে পারেনি। তবু দুপক্ষেরই আছে পরস্পরের কাছ থেকে নেবার। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গণিতবিদরা কবিতা থেকে দীক্ষা নিতে পারবেন কল্পনা ও আবেগের। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের কোন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেই বের হয়ে আসবেন হয়তো আরেক রামানুজন, যার স্বপ্নে দেখা দেবেন গণিতের মহাদেবী। কবিরা গণিতের কাছ থেকে নেবেন সুষমাময় অটুট কবিতার দীক্ষা যা কল্পনা ও আবেগের প্রকাশকে করবে সুসংহত ও কালোত্তীর্ণ। এ লেখাটি কবি, গণিতবিদ ও সাধারণ পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করবে এবং তাদের গণিত ও কবিতা নিয়ে ভাবতে আগ্রহী করবে এই প্রত্যাশা নিয়ে সমাপ্ত করছি।

তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট

আরো পড়তে পারেন

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

আগের পর্বে পড়ুন— চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও একটি সার্থক গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো দেশপ্রেম থেকে জাত সেই অনুভূতি, যার একটি রাজনৈতিক প্রকাশ রয়েছে। আর, বাঙালি জাতিসত্তাবোধের প্রথম রাজনৈতিক প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দুই হাজার মাইল দূরত্বের….

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল)

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ একুশের আবেগ সংহত থাকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র….

error: Content is protected !!