Author Picture

সিদ্ধার্থ হকের একগুচ্ছ কবিতা

সিদ্ধার্থ হক

সন্ধিক্ষণ-৬

বহুদূরবর্তী সত্য, স্বপ্ন মনে হয়। কত নদী বিস্মরণে
হারিয়ে যে যায়। আমরাও হারিয়ে যাই
সময়ের এদিকে ওদিকে।
অনেক দূরের হাত, নখ থেকে, ক্রমে
ক্ষয়ে যায়। আমরা নীরবে বসি খুব কাছাকাছি;
দুপুরের পাহাড়ের অবসরে, ঝুল বারান্দায়;
ধূলা দিয়ে তৈরি ছিল বসে থাকাগুলি;
ফলে ওরা ধ্বসে মিশে গেছে,
রূপান্তরে; কেটে গেছে অনেক সময়;
অদ্ভুত ধাঁধার মুখ, ক্ষয়ে,
সুক্ষ্ম শাদা ইথারের ক্লান্ত বেদনায় চলে গেছে।
সেই বসে থাকাগুলি এখনো ঘটছে, প্রাকৃতিক
রেকর্ডের মত, কোনো পাহাড়ের কোনে;
আমরা ওখানে নেই; কিন্তু আমাদের বসে থাকা
ওইখানে বসে আছে; পূর্ব রূপান্তরে ফিরে গিয়ে
টের পাচ্ছি আমি,
স্মরণে তা গেঁধে আছে ছিপ-সহ বর্শির মতন;
স্বপ্ন ধীরে ধীরে ক্ষয়ে যায়, কিন্তু সত্য
বারবার ফিরে আসে, বলে, দেখো, শোনো, ভাবো,
অস্বীকার করনা আমাকে, আমি ছিলাম, থাকব।
সত্যের ভিতরে এক নিগূঢ় আঁধার হতে থাকে।
আবিষ্ট, বিমূঢ় আমি, এইখানে আর বহু দূরে,
অনেক পিছনে আর অনেক সামনে, চলে যাই;
বিস্ময়, কোমল ঢুড়া, আমাকে সময় অতিক্রম করবার
অতি সূক্ষ্ম বায়বীয়তাকে দান করে, আমি এক
শাদা, নীল, অস্পষ্ট পৃষ্ঠার মত দিকে দিকে যাই।
আমার সকল স্বপ্ন প্রতিরাতে নতুন ও পুরাতন বহু,
পৃথিবীকে অতীন্দ্রিয় বেদনার মত ডেকে আনে;
স্বপ্নের দরজা খুলে সজাগ থাকতে হয় রাতে,
কেননা রাত্রের স্বপ্ন বুদ্ধের মতন ঘুমহীন;
বহু সন্ধিক্ষণ চারপাশে খুলে যায় অন্ধকারে;
সজাগ থাকতে হয়, সজাগ থাকতে হয়, রাতে।
১১/০৬/২০২১


সন্ধিক্ষণ-৭

ধানমণ্ডি কোথায় যে আছে, কোন কালো
সন্ধিক্ষণে, এতিমের মত, শান্ত, চুপ। হয়তোবা
মূলোৎপাটিত কৃশ মানুষের মন হয়ে গেছে,
আবাহনী মাঠের ভিতরে শুয়ে, সমান ঘাসের
মত, একা। আবাহনি মাঠও কি আছে?
কোথাও নিশ্চয় আছে; মানুষের পায়ে,
তারাদের ধূলার মতন,
শান্তভাবে টিকে আছে, আমার অলক্ষ্যে।
অনেক উপায়ে আমি চেষ্টা করি ধানমণ্ডি যেতে,
ঘুমের ভিতরে, ভোরে, আধো ঘুমে আধো জাগরণে,
সম্পূর্ণ সজাগভাবে, বুকে হেঁটে, উড়ে উড়ে, অনেক উপায়ে,
তবু ঠিক পৌঁছাতে পারিনা তার কাছে। মনে হয়,
বরিশাল বা পুরানো ঢাকার মত, ধানমণ্ডিও আজ,
স্থানবিহীনতা হয়ে গেছে। স্থান থেকে সরতে সরতে, শুধু এক
স্থানের ধারণা হয়ে মানুষের স্পর্শের বাইরে ভেসে গেছে,
আমার মনের সেই ধানমন্ডি, কখন যে, জানিনি তা আমি।
লেক আর মাঠ আর গেটে ইনস্টিটিউটের সেই ছাদ,
কিম্বা আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের ক্যাফেটারিয়া বুকে নিয়ে,
পাখির মতন উড়ে চলে গেছে গভীর ইগ্রেট, বহু দূরে;
অতি চেনা পুকুরের হাতগুলি কব্জি থেকে উবে গেছে ক্রমে;
অনেক দালান তার, বহু ফুটপাত; তবু কেউ হাঁটেনা সেখানে।
পুরানো আশ্রয়গুলি, ম্যাংগো-ক্যাফে, কোথায় যে গেছে।
হয়তবা বসে আছে মাতৃহারা শিশুর মতন হস্পিটালে,
সময়ের কোনো এক স্তরে, জরায়ুর মধ্যে ঢুকে,
ডিমের মতন মুখ গুজে; সেহতু পাচ্ছি না খুঁজে তাকে আর।
স্বপ্নের ভিতরে, বরং, নগ্ন হয়ে গেছি। ফোন করে
ঠিকানা যে নেবো, ধানমন্ডিকে ফোন করে তার
ঠিকানা যে নেবো, ফোনটাও খুঁজে আর পাচ্ছিনা কোথাও;
কোন এক মানসিক দ্বিধা যেন ঢুকেছে পকেটে, ফলে আমি
উবে যাচ্ছি; হাত দিয়ে এ পকেটে কোনো কিছু পাচ্ছিনা খুঁজে;
খুঁজতে গেলেই, খসে, হাত থেকে পড়ে যাচ্ছে আমার হৃদয়;
ভেঙে চৌচির হয়ে ছড়িয়ে পড়ছি আমি আর ধানমন্ডি।
যেখানে থাকার কথা, সেইখানে, আমি কিম্বা ধান আর নেই।
যেখানে থাকার কথা, এ শহরে, সেখানে কি কোনো কিছু আছে?
শীর্ণ কিম্বা স্ফীত হওয়ার জন্য যে বাতাস, যে এলাকা লাগে,
আছে নাকি সেরকম কোন কিছু আজ আর এখানে শহরে?
ধানমন্ডি খুঁজে আমি আর পাবো কিনা জানা নাই—
হয়ত হঠাৎ একদিন পেয়ে যাবো কিম্বা কখনো পাবোনা।
না পাবার আশংকাকে বুকে নিয়ে খুঁজে যাওয়াই ধানমন্ডি।
১২/০৫/২০২১


সন্ধিক্ষণ-৮

দেয়ালের অভ্যন্তরে, হে অসময়ের ঝিঁঝিপোকা, তুমি আছ।
সারাদিন শোনা যায় তোমার অটল, অবিশ্রান্ত ডাক,
উন্মাদের গাছ ধরে হেলেদুলে করতে থাকা গানের মতন;
হয়তবা তুমিও চাও সময়ের মধ্যে ফিরে যেতে;
কিন্তু তা পারো না; স্বভাবের সন্ধিক্ষণে বসে, শুয়ে,
ডেকে যাও; আমি তাকে শুনি; টের পাই, আমরা দুজনেই
আটকে আছি দুজনের ডাকের ভিতরে; দিনরাত
যেখানেই যাই আমি, সেখানেই তুমি যাও, শুনতে পাই
ডাকছো তুমি একা বসে সময়ের পর্দার পিছনে।
তুমিও শুনছ জানি আমার সকল শ্রান্ত ডাক;
আমিও রয়েছি ক্রম-সংকোচিত দেয়ালের উদ্ভট ভিতরে;
যেখানেই যাচ্ছি আমি, আমাকে বেষ্টন করে দেয়ালও যাচ্ছে
সেইখানে; আমার সকল ডাক অসময়ের ভিতর থেকে
বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সব গ্যাসের স্নায়ুতে;
ডাকছে সুদূর মাঠে ফেলে আসা ভুল, ভুলে যাওয়া
ল্যন্ড-মাইনের মত, সব দেয়ালের মধ্য থেকে। তুমি জানো,
আমি জানি, এসব বানানো নয়, নয় কারো মাথার ভিতর।
এইসব দেয়ালের ভিতরের শ্রম, ব্যথা, জীবনযাপন;
তুমি আছ, আমি আছি, সব দেয়ালের অভ্যন্তরে।
আমরা ডাকছি ক্রমে, যদিওবা জানিনা তা কেন।
এতো গ্রীল চারপাশে; উদ্ভিদ নিঃসীম হয়ে গেছে;
জগতের সব গাছ বেড়া দিয়ে গোলাকার করা
হয়ে গেছে; মনে হচ্ছে সব কিছু নিজের আকার ভুলে
মানুষের হাতে তৈরী অন্য কোনো রূপ, ধাঁচ, গ্রহন করেছে।
বাতাস গভীর তবু; অনায়াসে খেলা করে ডালে;
হেঁটে যায় পাতা থেকে পাতাহীনতায়; ঝরে যায়;
জন্ম নেয়; সে যে নদী, এই কথা ভোলেনা কখনো;
ভুলে না যাওয়া, বহু চেষ্টা করে মনে রাখা, এখন জীবন;
পৃথিবীর সব গ্রীল বা দেয়াল এক হয়েও পারেনা থামাতে
নিসর্গের বয়ে চলা; উদ্ভিদ, সবুজ নদী, চোখ বুজে দেখি;
যখন গাছের কথা ভাবি, টের পাই দেয়ালেরা ফুলে উঠছে,
ইচ্ছার বিরুদ্ধে; ঝিঁঝিপোকা চুপ করে বাতাসের বয়ে চলা
শুনে যাচ্ছে; বাগানে উন্মাদ, ঝোলাঝুলি বন্ধ করে, মুখ তুলে,
গাছের সামিয়ানার দিকে, খুব শান্ত হয়ে, তাকিয়ে রয়েছে।
দেয়ালের অভ্যন্তরে, হে অসময়ের ঝিঁঝিপোকা,
তুমি আছো, আমি আছি; কখনো ডাকছি; কখোনাবা
সব ডাক বন্ধ করে, কি যেন শুনছি, হয়তবা নীরবতা।
১৪/০৬/২০২১


সন্ধিক্ষণ-৯

লোকটাকে হাস্পাতালে নিয়ে যাবে কে আজ তাহলে?
রাতও অনেক হল। পথঘাট নীরব নিশ্চল।
পথচারী নাই। ভিখারিরা চুপ করে গেছে। উদ্ভিদ আঁধার।
কাকে তবে ডাকা যায় আজ এতো রাতে।
দিকে দিকে চালক ঘুমিয়ে গেছে। লোকটার বাড়ি চলে গেছে
তার বাড়ি থেকে দূরে। বন্ধুদের ডাকা যায় নাকি
এখন অনেক রাত, সেটা ঠিক হবেনা এখন।
সন্তানরা দূরে দূরে, শুয়ে আছে একা কিম্বা মানুষের সাথে
স্ত্রীকে ডাকা যায় তবে। কিন্তু সেও ঘুমিয়েছে অনেক অষুধে
শুধু ওই বনভূমি ইতিহাস হয়ে জেগে আছে। তাকে ডাকি।
লোকটাকে হাস্পাতালে নিয়ে যাবে কে তাহলে আজ এতো রাতে।
শেষ রাতে এম্বুলেন্স আসবে কি নক্ষত্রের ঐ পাশ থেকে


সন্ধিক্ষণ-১০—মানুষ

মানুষ বিশ্বের মত; বিশ্ব মানুষের মত নয়?
বুঝতে হলে, রাত্রে মুখ উঁচু করে, আকাশ পর্যবেক্ষণ করা,
তাকে জানা, প্রয়োজন খুব।
কেবল আয়ানা দেখে, কথা বলে, বই পড়ে, ভেবে,
মানুষকে বুঝতে পারা, মহাবিশ্ব জানা, প্রায় অসম্ভব, ভাবি।
মহাবিশ্বের শরীরে আছে গ্যালাক্সি, দুইশ বিলিয়ন;
মানুষের দেহে আছে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন সেল;
প্রতিটি সেলই, একটি ইউনিভার্স,
তার মধ্যে ঘুরে যাচ্ছে আরো ইউনিভার্স;
এক শত বিলিয়ন নিউরন মানুষের মগজে রয়েছে।
সমান সংখ্যক তারা, এক শত বিলিয়ন, আছে ছায়াপথে।
বিন্দুরও বিন্দু থেকে মানুষ জন্মায়।
ব্রহ্মাণ্ড জন্মেছে তেমনি সীমাহীন ক্ষুদ্র বিন্দু থেকে।
তাহলে মানুষ কেন মরে? যখন এ মহাবিশ্ব থাকে বেঁচে?
কেননা নিয়ম এই; মানুষ বিশ্বের মত বলে, হয়ত সে
অনিশ্চিত করেছে তার বয়সের কিস্তি, ক্রমান্বয়ে বেড়ে
উঠতে হলে, বহুমুখী মহাবিশ্বে, জন্ম, মৃত্যু, প্রয়োজন
হয়। তাই বলা যায়, মানুষের মৃত্যু হয়, অথচ হয়না।
ক্রোমোজোম, অনন্ত সময় ধরে প্রবাহিত হয়।
নক্ষত্রের মৃত্যু থেকে জন্ম নেয় নতুন নক্ষত্র।
নক্ষত্রের ক্রমোজম মহাকাশে হাঁস হয়ে ওড়ে।
যখন আয়না দেখি, টের পাই, বহু কিছু দেখছিনা আমি;
আভাসে বুঝতে পারি বহু কিছু ঘটে যাচ্ছে অবিরতভাবে
আমার ভিতরে; তবু, আমার অজান্তে;
আমি এক নিঃসীম পৃথিবী;
এক নয়, বহু বহু অনন্তের মত;
আমার লোহিত রক্ত সারাদিনে পৃথিবীকে দূরত্বের
পরিমাপে কতবার প্রদক্ষিণ করে, আমি জানি।
হয়তবা আমি এক দূরের নেবুলা;
বহু পুরানো গ্যালাক্সি; ঘুরে ঘুরে বহু দূরে চলে গেছি বলে
হয়ত তোমার চোখে, এ আমাকে ঝাপসা দেখায়।
১৭/০৬/২০২১

আরো পড়তে পারেন

বিপিন বিশ্বাসের একগুচ্ছ কবিতা

শূন্যতায় বাজে প্রণবধ্বনি শূন্যতায় বাজে প্রণবধ্বনি আড়ালে যার মহাজাগতিক রশ্মির চারণভূমি প্রতিবন্ধকতাকে পাশকাটিয়ে নিমগ্ন বিশ্বের স্বরূপ দেখি ধ্যানের স্তরে। মায়ার কায়া ঝেড়ে ফেলে সত্যকে চিনি আপন করে জ্যোতির্ময় জেগে আছে দীপ্ত শিখার আপন জলে । মূল্যবোধের সলতে টাকে মারতে চাই না দিন-দুপুরে অন্ধকারে আলোক রেখা সদাই খোঁজি হৃদ মাঝারে।   জীবনের ধর্ম এই জীবন মা….

চৌধুরী রওশন ইসলামের একগুচ্ছ কবিতা

দ্বিধা দ্বিধার পাথারে পড়ে থাকি আজীবন, যেদিকে তাকাই থইথই দ্বিধারাশি। কূলহারা দরিয়ায় দ্বিধার চুম্বন কোন পার হতে কোন পারে লয় ভাসি? কত কী দেখিতে পাই, দেখি না কতই, দেখা-না-দেখার দ্বিধা-বুদবুদ এসে, মনের অতলে ভীড় করে সে স্বতই; কেবলি সংশয়ে দ্বিধা-স্রোতে যাই ভেসে। হবে কি হবে না, কিছু দেবে কি না দেবে, লাভ না কি ক্ষতি,….

সুলতানা নাছিরা হীরার একগুচ্ছ কবিতা

বিরুদ্ধ সময় একেকটা দিন কী বীভৎস হয়েই না আসে! বীভৎস সময়, বীভৎস মন, বীভৎস মানুষ, বীভৎস সভ্যতা! মধ্যাহ্নের প্রাখর্যকে কম্পমান পর্দা বানিয়ে ভয়ার্ত রাজহাঁসের মতো চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল একটা অ্যাম্বুলেন্স। এই গাড়িটার ভেতর আপাতত আশ্রয় পেলে বেঁচে যেতাম। ভীষণ বিরুদ্ধ সময়! এই বিরুদ্ধতার কথা জানে ঘরের চার দেয়াল, শূন্য বারান্দা, জীর্ণ দেয়াল ঘড়ি,….

error: Content is protected !!