Author Picture

চৌধুরী রওশন ইসলামের একগুচ্ছ কবিতা

চৌধুরী রওশন ইসলাম

দ্বিধা

দ্বিধার পাথারে পড়ে থাকি আজীবন,
যেদিকে তাকাই থইথই দ্বিধারাশি।
কূলহারা দরিয়ায় দ্বিধার চুম্বন
কোন পার হতে কোন পারে লয় ভাসি?

কত কী দেখিতে পাই, দেখি না কতই,
দেখা-না-দেখার দ্বিধা-বুদবুদ এসে,
মনের অতলে ভীড় করে সে স্বতই;
কেবলি সংশয়ে দ্বিধা-স্রোতে যাই ভেসে।

হবে কি হবে না, কিছু দেবে কি না দেবে,
লাভ না কি ক্ষতি, কার কথা নেব মেনে?
এইসব দ্বিধান্বিত ক্ষণে ভেবে ভেবে,
অনিশ্চিত এ জীবন বয়ে চলি টেনে।

দ্বিধা আছে বলে আজো দুরুদুরু বুক,
তবু দ্বিধা আছে বলে বুকে এত সুখ।

 

নাগর

১.
দুঃখ আমার রসিক নাগর, বুকে পেতে তারে,
রোজ নিশীথে ঘর ছেড়ে যাই গোপন অভিসারে।
সুখ সুখ করে কম কাঁদিনি, সুখের দেখা পাইনি,
দুঃখ আমার রসিক নাগর, আমায় ছেড়ে যায়নি।

২.
আমার দুঃখ মাপার মতোন সাহস রাখে কে সে?
তলাবিহীন দুঃখ আমার মরলো বুঝি হেসে !
দুঃখ আমার মাথার মুকুট, শরীর ঢাকা পোশাক,
দুঃখ আমার রসিক নাগর, গোখরো হয়ে দংশাক।

৩.
দুঃখের সাথে বসতি আমার, এক বালিশে মাথা,
শীতে-বর্ষায় দু’জন মিলেই জড়ায় ওমের কাঁথা।
দুঃখ আমার রক্ত-গোলাপ, হৃৎ-মাঝারে ফোটে,
দুঃখ আমার রসিক নাগর, চুম দিয়ে যায় ঠোঁটে।

৪.
দুঃখ আমার শূন্য-থালা ক্লিষ্ট শিশুর হাতে,
দুঃখ আমার রসিক নাগর, ঘুম কেড়ে নেয় রাতে।

 

সাদা-মেঘ

আমি এক সাদা-মেঘ আকাশের গায়,
কাউকে ভেজাতে পারি সেই সাধ্য নাই।
অযথাই ঘুরিফিরি নীলাকাশ জুড়ে,
বাতাস আমারে ঠেলে পাঠায় সুদূরে।

পৃথিবীর ফসলের সবুজের রাগে,
মাটিতে ফেরার সাধ আমারও জাগে।
বৃষ্টির অঝোর ধারা সাদা-মেঘে নাই,
নিয়তির এ বঞ্চনা ললাট-লেখায়।

বুক জুড়ে আছে শুধু ব্যর্থ জলবিন্দু,
আমার স্মরণে তবু জন্মদাত্রী সিন্ধু।
একদিন নিশ্চয় এ পৃথিবীর বুকে,
আবার ফিরিব আমি এ ব্যর্থতা চুকে।

সাদা-মেঘ তবু আমি বুকে জল রাখি,
ধরণীর আলিঙ্গন-প্রতীক্ষায় থাকি।

 

অসংলগ্ন পঙক্তি

নেকড়ে কুকুর হায়েনারা রাস্তাঘাটে অল্প,
ওরা এখন মানব-মনে পেতেছে সব তল্প।

মানবের মন জানোয়ারে চাষ করে খায় আজকে,
উড়িয়ে দেয় অট্টহাসে সকল পুণ্য কাজকে।

পুণ্য কাজে আছে কেবল সবার গলাবাজি,
সামনে পেলে মাংস-লুচি ছাড়তে কে আর রাজি?

রাজি আছে অল্প কিছু বোকার হদ্দ যারা,
দিনে তাদের গা পুড়ে যায়, রাতে দিশেহারা।

রাতের বেলা নেকড়ে কুকুর স্বস্তি খোঁজে নিত্য,
অন্ধকারে শিকার ধরে আনন্দিত চিত্ত।

চিত্ত এখন পুণ্য-পাপের বিভেদ গেছে ভুলে,
পাপের কূলে চর জেগেছে, ভাঙন পুণ্য-কূলে।

ভাঙতে ভাঙতে মানুষগুলো টুকরো হয়ে যাচ্ছে,
নেকড়ে কুকুর হায়েনারা টুকরোগুলো খাচ্ছে।

 

জীবনের স্বাদ

প্রভু, নিরস শুষ্ক জীবন দিও না আমায়।
প্রয়োজন হলে তুচ্ছ করো ঘাসের মতোন,
তবু সতেজ সবুজ রেখো আমার জীবন;
সরসতা চাই জীবনের খরায়-বন্যায়।

দুদিনের কুড়েঘর উড়ে গেলে ঝড়ে,
আবারও বেঁধে নেব নব উৎসাহে।
একদিনে ভাঙে যদি, গড়বো সপ্তাহে;
আয়নায় হাসিমুখ তবু চোখে পড়ে।

কী বা আছে হারানোর ? ভুবন অপার;
যা কিছু পেয়েছি আজ, তা সৌভাগ্য মানি।
জগতের সুখ-দুখ আনিয়াছি টানি,
আমার দু’হাত ভরা আশীষ তোমার।

জীবনের এ আস্বাদ আজীবন চাই,
শোকে-তাপে দুর্বিপাকে যেন না হারায়।

 

বেনোজল

বেনোজল ধেয়ে এলে পলিমাটি জমে,
কৃষকের মুখ তবু দুঃখ-থমথমে।

ফসলের মৃতদেহে নব পলি এসে
মাঠের শরীরে একাকার হয়ে মেশে;
ঘরমুখী ফসলেরা মাঠের ভেতর
বেনোজলে ডুবে মরে যায় অকাতর,
কৃষক-পিতার বুকে পাষাণের ভার,
মৃত ফসলের শোকে দীর্ঘ হাহাকার।

পলিমাটি চায় কৃষকের, তার চেয়ে
বেশি চায় তার ফসলের গান গেয়ে
হাসিমুখে ঘরে ফেরা তৃপ্ত সন্ধ্যা এক;
গৃহবধূ শিশু নিয়ে পেট ভরে খাক
তার পুণ্য-হাতে-ফলা স্বর্ণশস্যদানা।
বেনোজল বর্গিসম দিয়ে যায় হানা।

আরো পড়তে পারেন

গাজী গিয়াস উদ্দিনের একগুচ্ছ কবিতা

ক্লান্তির গল্প যারা উপনীত সন্ধ্যে বেলায় ফিরে দেখো দিন মলিন স্বপ্ন – ধূসর জীবন, প্রখর রোদের শায়ক ক্রীড়া প্রাচুর্যে আত্মহারা ছিলে স্বাধীন একদিন, পশ্চিম বেলা চেয়ে চেয়ে আজ শেষ করো ক্লান্তির গল্প।   ছড়ানো বিদ্রুপ সাপের চুমোতে কোথা বিষ হিংস্র নিশ্বাসে তোমার গরল বিশ্বাসে আমাকে পাবে জিয়ল সরল। রুক্ষতা ছেঁটে ফেল – চেহারা কমনীয় সব….

বিপিন বিশ্বাসের একগুচ্ছ কবিতা

শূন্যতায় বাজে প্রণবধ্বনি শূন্যতায় বাজে প্রণবধ্বনি আড়ালে যার মহাজাগতিক রশ্মির চারণভূমি প্রতিবন্ধকতাকে পাশকাটিয়ে নিমগ্ন বিশ্বের স্বরূপ দেখি ধ্যানের স্তরে। মায়ার কায়া ঝেড়ে ফেলে সত্যকে চিনি আপন করে জ্যোতির্ময় জেগে আছে দীপ্ত শিখার আপন জলে । মূল্যবোধের সলতে টাকে মারতে চাই না দিন-দুপুরে অন্ধকারে আলোক রেখা সদাই খোঁজি হৃদ মাঝারে।   জীবনের ধর্ম এই জীবন মা….

সুলতানা নাছিরা হীরার একগুচ্ছ কবিতা

বিরুদ্ধ সময় একেকটা দিন কী বীভৎস হয়েই না আসে! বীভৎস সময়, বীভৎস মন, বীভৎস মানুষ, বীভৎস সভ্যতা! মধ্যাহ্নের প্রাখর্যকে কম্পমান পর্দা বানিয়ে ভয়ার্ত রাজহাঁসের মতো চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল একটা অ্যাম্বুলেন্স। এই গাড়িটার ভেতর আপাতত আশ্রয় পেলে বেঁচে যেতাম। ভীষণ বিরুদ্ধ সময়! এই বিরুদ্ধতার কথা জানে ঘরের চার দেয়াল, শূন্য বারান্দা, জীর্ণ দেয়াল ঘড়ি,….

error: Content is protected !!