Author Picture

নদী বিষয়ে জনসাধারণ এখন কেবল সচেতন নয়, সোচ্চারও

শেখ রোকন


 

শেখ রোকন নদী বিষয়ক অলাভজনক উদ্যোগ ‘রিভারাইন পিপল’-এর প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব। নদ-নদী বিষয়ে লেখালেখি ও গবেষণা করেন। পেশাগত দিক থেকে তিনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি পরামর্শক হিসেবেও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করেন। প্রকাশিত গ্রন্থ : নদীচিন্তা (২০১৫); নিসর্গের নোটখাতা (২০১৩); বিষয় নদী (২০১২); জলবায়ু জিজ্ঞাসা (২০১১); নদী প্রসঙ্গ (২০০৭); মেঘনা পাড়ের সংকট ও সংগ্রাম (২০০৬)। শেখ রোকন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এছাড়া ভারতের সিকিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশ-ভারত পানিসম্পর্ক
বিষয়ে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিবেশ ও সম্পাদকীয় নীতি বিষয়ে সংক্ষিপ্ত শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন।

জীবনের একটি বড় অংশ নদীর সংক্রান্ত কাজের সাথে কেটেছে। শৈশবের নদী সম্পর্কে জানতে চাই।

আমার শৈশব কেটেছে দুটি ছোট্ট অথচ সুন্দর নদী দেখে দেখে। এর একটি জিঞ্জিরাম, অপরটি সোনাভরি। আমাদের গ্রামের পূর্ব দিকে ছিল জিঞ্জিরাম। এটি একটি আর্ন্তজাতিক নদী, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত। সীমান্ত এলাকায় জিঞ্জিরাম নদীর তীরে চর ফুলবাড়ি গ্রামে আমার বড় খালাম্মার বাড়ি ছিল। সেখানে প্রায়শই যাওয়া হতো। তখন এই নদীর ধার দিয়ে বা পারি দিয়ে যেতে হতো। এছাড়া ভারতের আসাম রাজ্যে আমার মাতৃকুলের আত্মীয়-স্বজন রয়েছে। শৈশবে সেখানে বেড়াতে যেতাম আমরা ভিসা-পাসপোর্ট ছাড়া। তখনও এই নদী পাড়ি দিতে হতো। তবে নদীটির মূল আকর্ষণ ছিল এর চরে অনুষ্ঠিত অষ্টমীর মেলা। আবার সোনাভরি নদীতে দুর্গা প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হতো। এছাড়া কুড়িগ্রাম, রংপুরের মতো শহরগুলোতে যেতে ব্রহ্মপুত্র পাড়ি দিতে যে নৌকা ছাড়তো, সেটা সোনাভরি নদী থেকেই। আমার শৈশবের নদী-
স্মৃতিজুড়ে রয়েছে এই দুই নদী। এর বাইরে বিপুলা ও বিশাল ব্রহ্মপুত্রের কথা বলতে হয়। বড় হয়ে জেনেছি, ব্রহ্মপুত্র হচ্ছে মহানদী। সৈয়দ শামসুল হক বলেছেন ‘পিতামহ ব্রহ্মপুত্র’। তবে ব্রহ্মপুত্র ঠিক জিঞ্জিরাম বা সোনাভরির মতো করে ভালোবাসা কঠিন, বরং সমীহ করতে হয়। শ্রদ্ধা ও সমীহ মিশ্রিত ভালো লাগা কাজ করে। এর বিশালত্ব, এর বিপুল প্রবাহ, এর গর্জন, ভাঙনের ক্ষমতা, দূকুল ছাপানো বন্যা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য- সবই শ্রদ্ধা ও সমীহ জাগায়।

আপনি নদী নিয়ে কাজ শুরু করলেন কীভাবে? কোনো বিশেষ ঘটনা আছে?

এই প্রশ্নের মুখে আগেও পড়েছি। সত্যি বলতে এখন আর মনে পড়ে না যে কোনও বিশেষ ঘটনা ছিল কি না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই লেখালেখির অভ্যাস ছিল। ব্রহ্মপুত্র বিধৌত রৌমারীর কথা লিখতে গিয়ে, মুক্তিযুদ্ধে সেখানকার গৌরবজ্জ্বল ইতিহাসের কথা বলতে গিয়ে নদীর কথা এসেছে। রৌমারী থেকে জেলা শহর কুড়িগ্রাম যেতে ব্রহ্মপুত্রের মতো নদী পাড়ি দিতেই হতো, ফলে নদী নিয়ে নির্লিপ্ত থাকার অবকাশ ছিল না। এখন মনে পড়ে চিন্তা নামে একটি পত্রিকায় ব্রহ্মপুত্রের চরাঞ্চলে বাদাম চাষের সম্ভাবনা নিয়েও লিখেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পরিবেশ, প্রতিবেশ, কৃষি, পানিসম্পদ নিয়ে লেখলালেখি, পড়াশোনা করেছি। একটা পর্যায়ে বুঝতে পারি নদী নিয়ে বেশি লিখছি, নদী নিয়ে লিখতে আগ্রহ ও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি। ছাত্রাবস্থাতেই আমার প্রথম গবেষণাধর্মী কাজ ছিল ইলিশনির্ভর জেলেদের নিয়ে। এ নিয়ে
পরবর্তীতে আমার প্রথম বই প্রকাশ হয় 'মেঘনা পাড়ের সংকট ও সংগ্রাম'। এসময় চাঁদপুরের ষাটনল থেকে চর ভৈরবী পর্যন্ত আমার কর্মএলাকা ছিল। তখন সেখানে সড়কপথে বা নারায়ণগঞ্জ থেকে নৌপথে অনেকবার যাতায়াত করেছি। পথে পড়তো শীতলক্ষ্যা, গোমতী, ধনাগোদা, ডাকাতিয়া প্রভৃতি নদী। একবার ভোলার চরফ্যাশনে যেতে গিয়ে আরও অনেক নদী দেখা হয়ে গেলো। তখনই নদ-নদীর বিভিন্ন দিক পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করেছি, নদীতীরবর্তী জনপদ, জেলেদের নিয়ে কাজ করেছি। তারও আগে কুমিল্লার কালাডুমুর নামে একটা ছোট্ট নদী নিয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন করেছিলাম। বিষ দিয়ে নদীটির সব মাছ মেরে ফেলা হয়েছিল, সেখানকার প্রতিবেশ ব্যবস্থায় একটা বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। বিষয়টির ভয়াবহতা আমাকে ভাবিয়েছিল বেশ।

পানি আমার পছন্দ। এখনও পানিকে আমার সবচেয়ে বিস্ময়কর সৃষ্টি মনে হয়। আর শৈশব থেকেই সাতার কাটা আমার পছন্দ। দীর্ঘক্ষণ ডুবে থাকতে পারতাম। মাছ ধরতে, শাপলা শালুক তুলতে তুলতে যেতাম গ্রামের সমবয়সীদের সঙ্গে। বিল-ঝিল থেকে প্রাকৃতিক ও লকলকে কলমি শাক তুলে এনে মাকে দিতাম, তিনি খুব খুশি হতেন। আসলে আমি বেড়ে উঠেছি, এক নদী, বিল, পুকুর বহুল এলাকায়।

খুব সম্ভবত ২০০০ সালে যশোর-সাতক্ষীরা অঞ্চলে অস্বাভাবিক বন্যা হয়েছিল। সেটা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে দেখি, আসলে বন্যা বিপর্যয়কর হয়ে ওঠার কারণ ওই অঞ্চলের নদীগুলো ভরাট হয়ে
যাওয়া। এসাইনমেন্ট শেষ করার পরও ওই অঞ্চলের নদী নিয়ে আরও পড়াশোনা করেছিলাম।

নদীর প্রতি প্রেমের পেছনের গল্পটি জানতে চাই।

পানি আমার পছন্দ। এখনও পানিকে আমার সবচেয়ে বিস্ময়কর সৃষ্টি মনে হয়। আর শৈশব থেকেই সাতার কাটা আমার পছন্দ। দীর্ঘক্ষণ ডুবে থাকতে পারতাম। মাছ ধরতে, শাপলা শালুক তুলতে তুলতে যেতাম গ্রামের সমবয়সীদের সঙ্গে। বিল-ঝিল থেকে প্রাকৃতিক ও লকলকে কলমি শাক তুলে
এনে মাকে দিতাম, তিনি খুব খুশি হতেন। আসলে আমি বেড়ে উঠেছি, এক নদী, বিল, পুকুর বহুল এলাকায়। সেখানে প্রায় প্রতিবছর উৎসবের আমেজে বন্যা আসতো। বাড়ি-ঘরে কয়েক দিন পান উঠতো। বড়রা সেটা কীভাবে নিতেন তখন বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমাদের ছোটদের জন্য বন্যা আসা, এর পানি ক্রমে বাড়া, নেমে যাওয়া প্রভৃতি এক উত্তেজনাকর ও আনন্দময় উপলক্ষ্য ছিল। বন্যার নতুন পানির স্রোতের আগে আগে পুটি মাছের ঝাকের লাফালাফি যে দেখেনি, তার জীবন বৃথা। কলেজে পড়ার সময়ই আমি নিজের উপজেলার সব নদী ঘোরা শেষ করেছিলাম- জিঞ্জিরাম, জালছিড়া, সোনাভরি, হলহলিয়া, দন্নি, কালো। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হওয়ার পর নিজের এলাকার বাইরের নদীগুলোও ঘুরতে শুরু করি। পথে যেখানেই নদী পড়তো, সম্ভব হলে আমি নেমে যেতাম। একটা কমদামী কোডাক ক্যামারা ছিল, ফিল্মওয়ালা। সেটা দিয়ে ছবি তুলতাম। এ নিয়ে বিড়ম্বনাও কম হয়নি। কিন্তু আমি মেনে নিতাম। এখন ভাবতে ভালো লাগে যে, ছাত্রজীবনেই আমি দেশের বাইরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, অরুণাচলের বেশ কিছু নদী দেখা সম্পন্ন করে ফেলেছিলাম।

রিভারাইন পিপল গঠিত হলো কীভাবে?

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কিছুদিন ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও পরে এক ধরনের পরিবেশবাদী হয়ে যাই। কয়েকজন বন্ধু মিলে অনানুষ্ঠানিকভাবে গঠন করি ‘রিভার লাভিঙ পিপল’। মূলত নদীতে ঘুরতে যাওয়ার মতো রোমান্টিক উদ্দেশ্য থেকে। চাদনী রাতে নদীর সৌন্দর্য ব্যাখার মতো নানা বিষয় তখন মাথায় ঘুরতো। আমরা চেয়েছি, নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীভিত্তিক পর্যটন গড়ে উঠুক। কিন্তু আমরা দ্রুতই উপলব্ধি করতে পারি যে, আমাদের দেশে নদীর রোমান্টিকতা কম নেই, জীবনের জন্য সেটা জরুরিও বটে; কিন্তু বিদ্যমান বাস্তবতায় নদী নিয়ে আরও অনেক সিরিয়াস কাজ করার ব্যাপার আছে। নদীকে বাচাতে হবে, সুরক্ষা দিতে হবে, তাহলেই নদী রোমান্টিকতার উপাদান হিসেবে টেকসই হবে। নদীর সঙ্গে আমাদের সভ্যতা, সংস্কৃতি, জীবন, জীবিকা, প্রকৃতি ও প্রতিবেশ কতটা ঘনিষ্ঠ এই সময় আরও ভালোভাবে বুঝতে শুরু করি। এর ফলশ্রুতিতে রিভার লাভিঙ পিপল আরও সিরিয়াস নাম নিয়ে গঠিত হয় ‘রিভারাইন পিপল’। প্রথমে ফেসবুকের একটি গ্রুপ হিসেবে যাত্রা শুরু করে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় কিছুদিন ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত থাকলেও পরে এক ধরনের পরিবেশবাদী হয়ে যাই। কয়েকজন বন্ধু মিলে অনানুষ্ঠানিকভাবে গঠন করি ‘রিভার লাভিঙ পিপল’। মূলত নদীতে ঘুরতে যাওয়ার মতো রোমান্টিক উদ্দেশ্য থেকে। চাদনী রাতে নদীর সৌন্দর্য ব্যাখার মতো নানা বিষয় তখন মাথায় ঘুরতো। আমরা চেয়েছি, নদীমাতৃক বাংলাদেশে নদীভিত্তিক পর্যটন গড়ে উঠুক।

এ প্রসঙ্গে বলতে চাই, ফেসবুক তখন কেবল বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে পরিচিতি পাচ্ছে। মনে আছে, ২০০৭ সালের জুলাই মাসে গ্রুপটি খোলা হয়। সেদিক থেকে এই গ্রুপ নদী বিষয়ে বাংলাদেশের প্রথম ফেসবুক গ্রুপ। আরেকটি মজার ব্যাপার হলো, যাদের নিয়ে রিভারাইন পিপল যাত্রা শুরু করে, তারা প্রথমে ফেসবুকে বা অনলাইন পরস্পর পরিচিত হয়েছেন, তারপর অফলাইনে বা সামনা সামনি দেখা হয়েছে। যে কারণে আমি অনেকসময় মজা করে বলি, মধ্যপ্রাচ্যে আরব বসন্তের আগে বাংলাদেশে রিভারাইন বসন্ত এসেছে। ২০১০ সাল থেকে রিভারাইন পিপল আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে।

বাংলাদেশের নদীরা এখন ভালো নেই। দুষিত হচ্ছে, ভরাট হচ্ছে। এর প্রভাব আমরা প্রাকৃতিক ভাবে অনেকটা অন্দাজও করতে পারছি। তবে যদি এর অর্থিক ক্ষতিটির ব্যাখ্যা চাই আপনার কাছে।

খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। এক্ষেত্রে একটি সীমাবদ্ধতার কথা বলতে চাই। দখল, দূষণ, ভরাট, প্রবাহ স্বল্পতা, এর কারণ, বিরূপ প্রভাব নিয়ে আলোচনা, প্রতিবেদন, সমীক্ষা দেখতে পাবেন। কিন্তু এসবের কারণে আমরা আর্থিকভাবে কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, এ ব্যাপারে কোনো একাডেমিক কাজ দেখতে পাবেন না। আপনি দেখবেন, আমাদের অর্থনীতিবিদরা জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কতটা আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে কতটা আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে, প্রায়শই হিসেব করে ও তুলে ধরে। হরতাল-ধর্মঘটের মতো রাজনৈতিক কর্মসূচিরও আর্থিক ক্ষতির হিসাব আপনি পাবেন। কিন্তু নদীবিরোধী তৎপরতার কোনো আর্থিক ক্ষতির হিসবা নেই। আমাদের অর্থনীতিতে নদীর অবদান কতখানি, জিডিপির কত শতাংশ, সেই হিসাবও আছে কি না আমি জানি না। এমনিতে পর্যবেক্ষণ থেকে বলতে পারি। যেমন একটি নদী যখন দূষিত হয়, তখন অন্তত চারটি দিকে আর্থিক ব্যয় বেড়ে যায়। প্রথমত, মৎস্য সম্পদের আকাল। তার মানে কিছু মানুষের আয় কমে যায় আবার ভোক্তাদের বেশি দামে মাছ কিনতে হয়। দ্বিতীয়ত, সুপেয় পানির সংকট। নদী থেকেই যে পানি পাওয়া যেতো, তা দূর থেকে আনতে গিয়ে সময় ও অর্থের ব্যয় বেড়ে যায়। ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে গেলেও খরচ আছে। এর প্রতিবেশগত বিরূপ প্রভাবের কথা বাদ দিলেও। তৃতীয়ত, ওই পানি দিয়ে আর সেচ কাজ চলবে না। তার মানে, খরচ বেড়ে যাবে। চতুর্থত, দূষিত নদী এলাকায় রোগব্যাধি বেড়ে যায়। অর্থ্যাৎ চিকিৎসা ব্যয়ও বেড়ে যায়।

নদীদের এই দুর্দশার জন্য অনেক কথা আছে। একে অপরের দোষারোপের মধ্যেই কি সীমাবদ্ধ থাকছে নদীরক্ষা আন্দোলন?

নদী রক্ষা বা সুরক্ষা আন্দোলনের কয়েকটি ধাপ আছে। প্রথম ধাপ হচ্ছে, আওয়াজ তোলা বা জনপ্রিয় একটি শব্দ হচ্ছে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। বলা যে নদীগুলো ভালো নেই। নদী ভালো না থাকায় এই এই সমস্যা ও সংকট দেখা দিচ্ছে। বলতে থাকা যে কী কারণে বা কার কারণে নদীগুলো ভালো নেই। এছাড়া সংবাদপত্রে প্রতিবেদন দেখে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা বা শহরেরর পরিচিত এলাকায় মানববন্ধন করে মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়ে থােক। এসব করতে গিয়ে দোষারোপের প্রসঙ্গ অবশ্যই আসতে পারে। আপনার ভাষ্যমতে একে অপরেরর দোষারোপও আসতে পারে। এমনকি নদী আন্দোলনগুলোর মধ্যে পরস্পর দোষারোপও আসতে পারে বৈকি। কেউ বলতে পারে এভাবে নয়, সেভাবে আন্দোলন করতে হবে। বাংলাদেশে নদী আন্দোলন শুরু হয়েছে একুশ শতকের শুরুতে। কমবেশি দুই দশক কেটে গেছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এখনও আমাদের বিপুল অধিকাংশ আন্দোলন প্রথম ধাপেই রয়ে গেছে। আমি মনে করি এখন সময় এসেছে দ্বিতীয় ধাপ বা সেকেন্ড জেনারেশন নদী আন্দোলনের।

দ্বিতীয় ধাপের নদী আন্দোলন কেমন?

এর মূল কথা হচ্ছে, ধরে নেওয়া হবে নদী বিষয়ে মানুষ যথেষ্ট সচেতন। দুই দশকের নদী আন্দোলনের ফলে সচেতন হওয়াই স্বাভাবিক নয়? এখন জনসাধারণের কাছ থেকে অঙ্গীকার আদায় করতে হবে। যে নদী সুরক্ষায় তারা কী ধরনের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে। উন্নত বিশ্বে দ্বিতীয় ধাপের বা প্রজন্মের নদী আন্দোলনে আপনি দেখবেন, জনসাধারণ তহবিল যোগান দিচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল রিভারস নামে আমেরিকান একটি সংগঠন রয়েছে। তাদের বার্ষিক প্রতিবেদনে একশ ডলার চাঁদা প্রদানকারীরও নাম ছাপা হয়। এছাড়া দ্বিতীয় ধাপের নদী আন্দোলনে রাস্তায় দাঁড়ানোর চেয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে টেবিল টক বা দর কষাকষিতে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়।
কেবল দাবি জানানোর বদলে নিজেরা নদী রক্ষার বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই পর্যায়ে নদী বিষয়ে আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর নিজস্ব ভাষ্য, সমীক্ষা তৈরি হয়। তারা মিডিয়ার প্রতিবেদন দেখে প্রভাবিত না হয়ে বরং মিডিয়াকে আধেয় বা কনটেন্ট সরবরাহ করে। এই পর্যায়ে নদীকে নিছক ‘বাঁচাও’ ইস্যুতে আন্দোলন সীমাবদ্ধ থাকে না। বরং নদীর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্ভাবনা অনুসন্ধান, উন্মোচন ও উপযোগীতা তৈরিতে মনোযোগ দেওয়া হয়। আপনাকে বলতে পারি, রিভারাইন পিপল শুরু থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ের নদী আন্দোলন করার চেষ্টা করছে। আপনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি আমারা আয়োজন করিনি। কোনো নদী নিয়ে নিজেরা আগে বোঝাপড়া করেছি, তারপর মাঠে নেমেছি।

অনেক নদী কিংবা শাখা নদীর মরে যাওয়াও দেখেছেন- কীভাবে নদীর মৃত্যু হয়, কারণগুলো কী কী?

নদী মরে যাওয়াটা নানাভাবে ঘটে। এর একটি হলো জৈবিকভাবে, যেমন বুড়িগঙ্গা নদীতে প্রবাহ রয়েছে কিন্তু সেখানে কোনো মৎস্য সম্পদ বা জলজ প্রাণ নেই। এর পানি দিয়ে সেচ কাজ চালানো যায় না। আবার শারিরীকভাবে বা কাঠামোগতভাবে মরে যায় বা মেরে ফেলা হয়। যেমন নড়াই নামে একটি নদী ছিল ঢাকা শহরেই। আজকের ধানমন্ডি খাল ও হাতিরঝিল এর অংশ। এই নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল কারওয়ান বাজারের অম্বর শাহ মসজিদ। এটাকে মেরে ফেলা হয়েছে। মাত্র দুই দশক আগে দোলাই নদী বা ধোলাই নদীকে বক্স কালভার্ট দিয়ে ঢেকে মেরে ফেলা হয়েছে।

অপরিকল্পিত স্থাপনার কারণেও নদী মরে যায়। যেমন বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু তৈরির সময় তথাকথিত নদীশাসন করতে গিয়ে ধলেশ্বরী নদীকে মেরে ফেলা হয়েছে। এখন ড্রেজিংয়ের তোড়জোড় দেখছি আমরা, এটা পরিবেশসম্মতভাবে না করলে মৎস্যসম্পদে বিপর্যয় দেখা দেবে। নদী অববাহিকায় বিসবুজীকরণও নদীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

কাঠামোগত মৃত্যু প্রাকৃতিকভাবেও হতে পারে। যেমন তিস্তার মূল প্রবাহ দিক পরিবর্তন করায় করতোয়া নদীটি মরে গেছে। ব্রহ্মপুত্রের মূল প্রবাহ দিক পরিবর্তন করায় যমুনা প্রশস্ত হয়েছে কিন্তু পুরাতন ব্রহ্মপুত্র ক্রমশ মরে যাচ্ছে। আবার নদীর উজানে পানি প্রত্যাহার বা ব্যারাজ দেওয়ার কারণে প্রমত্ত গঙ্গা নদী এখন শীর্ণকায়। অপরিকল্পিত স্থাপনার কারণেও নদী মরে যায়। যেমন বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু তৈরির সময় তথাকথিত নদীশাসন করতে গিয়ে ধলেশ্বরী নদীকে মেরে ফেলা হয়েছে। এখন ড্রেজিংয়ের তোড়জোড় দেখছি আমরা, এটা পরিবেশসম্মতভাবে না করলে মৎস্যসম্পদে বিপর্যয় দেখা দেবে। নদী অববাহিকায় বিসবুজীকরণও নদীর মৃত্যুর কারণ হতে পারে। যেমন পাহাড়ে বন উজার করার কারণে ছড়া বা ঝোরাগুলো গাছের শেকড় চোয়ানো পানি পাচ্ছে না, শঙ্খ নদীর শুকনো মৌসুমে পানি পাচ্ছে না। আর নদী মরে গেলে একটি জনপদের বা অঞ্চলের প্রাণপ্রবাহ মরে যায়, তখন বিপর্যয় অবধারিত।

বিপর্যয়ের ফলে কোন কোন দিক থেকে আমরা নদীর প্রতিশোধের শিকার হতে পারি?

প্রতিশোধ কি ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে যায়নি? ঢাকার কথাই ধরি। একসময় নদী ও খালের কারণে এটি একটি স্নিগ্ধ আবহাওয়ার নগরী ছিল, এখন চরম ভাবাপন্ন। শীতকালেও গরম যাচ্ছে না। মোগল ও ব্রিটিশ আমলে আমরা ঢাকার যে সুনাম শুনে থাকি, তার বড় কারণ এখানকার ‘নদী-হাওয়া’। চতুষ্পার্শ্বে ও অভ্যন্তরের নদ-নদী ঢাকা আবহাওয়াকে স্নিগ্ধ ও পরিবেশকে পরিচ্ছন্ন রাখত। যে নগরেরর দক্ষিণ দিকে নদী থাকে, সেটাকে বলা হয় সৌভাগ্যবতী। অথচ ঢাকার চারপাশেই নদী ছিল। ফলে যাতায়াত, সুপেয় পানি, মৎস্য সম্পদের জন্য এই নগরী বিখ্যাত ছিল। এখন সবই হারিয়েছি। যানজটে বসে হাসফাস করতে হয়। এখন পানি শীতলক্ষ্যা থেকে আনতে হচ্ছে। তারপর আনার কথা হচ্ছে পদ্মা বা মেঘনা থেকে। ওই দুই নদী দূষণ হলে তখন? আমরা ভূগর্ভস্থ পানি তুলে ভূমিকম্প ও ভূমিধ্বসের ঝুঁকি তৈরি করছি। দূষণের কারণে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক অবনতিতে পড়েছে। সারাদেশে নদীনির্ভর সেচ হারিয়ে ফেলে ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে গিয়ে আর্সেনিকের অভিশাপ ডেকে আনছি। নৌপথ হারিয়ে সড়কপথে জোর দিয়ে খরচ বাড়াচ্ছি, দূষণ বাড়াচ্ছি, দুর্ঘটনায় মরছি। আপনি নৌপথ ও সড়কপথে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা তুলনা করলেই ভয়াবহতার মাত্রা বুঝতে পারবেন। একসময় ঢাকার সঙ্গে বর্তমান বাংলাদেশের অন্যান্য শহর ও ঢাকা-কলকাতা তো বটেই, রংপুর থেকে কলকাতা যাতায়াতেরও অন্তত তিনটি ‘ব্যস্ত নদীপথ’ ছিল। এখন সব হারিয়ে ফেলে যেচে যন্ত্রনা ভোগ করছি।

নদীকে কেন্দ্র করে আমাদের নগরায়নের বিকাশ। নদী মরে গেলে নগর কি অস্তিত্ব সংকটে  পড়ে?

অবশ্যই পড়ে। দুনিয়াজুড়েই নগর গড়ে ওঠে নদীর আশীর্বাদে। আরেকটি বাস্তবতা হচ্ছে, নদীর আশীর্বাদে গড়ে ওঠা নগরগুলো ক্রমে নদীর ওপরই চাপ সৃষ্টি করে। অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুরও কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রিভারাইন পিপল থেকে গত বছর নদী দিবসে আমরা একটি চকিত জরিপ করেছিলাম। তাতে দেখা গিয়েছিল, দেশে দখল ও দূষণের শিকার কমবেশি ৩০টি নদীই নগরসংশ্লিষ্ট। দুনিয়াজুড়েই আরেকটি রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে, নদী মরে গেলে বা মজে গেলে নগরও ক্রমে মরে যেতে থাকে। প্রাচীন ও সমৃদ্ধ নগরী পুণ্ড্রবর্ধন জৌলুশ হারাতে থাকে করতোয়া নদী সরে যেতে থাকলে। প্রাচীনকালে গঙ্গা যখন মেদিনীপুর অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হতো, তখন তাম্রলিপি বা তমলুক হয়ে উঠেছিল পূর্ব ভারতের প্রধান বাণিজ্যনগরী ও বন্দর। গঙ্গা সরে গেলে তাম্রলিপির সমৃদ্ধিও মজে যেতে থাকে। যশোর অঞ্চলে জৌলুশ কমতে শুরু করেছিল উনিশ শতকের শেষার্ধে ভৈরব, কপোতাক্ষ গঙ্গার সংযোগ হারিয়ে মজে যেতে থাকলে। আঠারো শতকে প্রথম যখন রাজশাহী জেলা ঘোষিত হয়, তখন তার সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করা হয় নারদ নদের তীরে বর্তমান নাটোরে। কিন্তু এক বন্যায় গঙ্গার সঙ্গে নারদ নদের সংযোগস্থল ভরাট হয়ে গেলে প্রবাহটি মরে যেতে থাকে। বদ্ধ পানিতে দেখা দেয় নানা রোগ-জীবাণু। ফলে রাজশাহী জেলার সদর দপ্তর বর্তমান রাজশাহী শহরের রামপুর-বোয়ালিয়া এলাকায় স্থানান্তর করা হয়। আমরা যদি নদীগুলো পুনরুদ্ধার করতে না পারি, টেকসই রাখতে না পারি, তাহলে ঢাকার কপালেও দুঃখ আছে।

একদিকে নদী ভাঙ্গন অপরদিকে নদী দুষন এবং নদী ভরাট। এ থেকে নিস্তার মিলবে কীভাবে?

দেখুন, নদী ভরাট হওয়া, ভাঙন, দখল, দূষণ সবই একসূত্রে গাথা। প্রবাহ স্বল্পতা দেখা দিলে তখন ভরাট হতে থাকে। কারণ তলানি প্রবাহ বা সিল্ট তখন মাঝপথে আটকে যায়। ফলে নদীর গভীরতা কমতে থাকে। আবার গভীরতা কম থাকলে বর্ষাকালে যখন বেশি প্রবাহ আসে, তখন কূলের দিকে ভাঙন দেখা দেয়। ব্রহ্মপুত্র-যমুনার ক্ষেত্রে আমরা একই লক্ষণ দেখছি। ক্রমেই নদীটির গভীরতা কমছে আর ভাঙন বাড়ছে। ভাঙতে ভাঙতে প্রশস্ত হয়ে যাচ্ছে। যত প্রশস্ত হচ্ছে, ততই গভীরতা কমছে। আবার ভাঙনের কারণে সিল্টেশন বাড়ছে। গড়াই নদীতেও আমরা দেখব পর্যাপ্ত প্রবাহ না থাকার কারণে ক্রমেই গভীরতা কমছে। ফলে দফায় দফায় ড্রেজিং করেও লাভ হচ্ছে না। এভাবে একটি নদী যখন প্রশস্ত ও মন্থর হতে থাকে, তখন সেখানে দখলদারি তৈরি হয়। একটি স্রোতস্বিনী নদী দখল করা কিন্তু সহজ নয়। আপনি দেখবেন, নদী যখন দুর্বল হয়, তখনই দখল হতে থাকে। আবার দখল হওয়া ভূমিতে নানা স্থাপনা তৈরি হয়, কল- কারখানা বসে, শুরু হয় দূষণ। নগর সংশ্লিষ্ট নদীগুলোতে আমরা দেখবো, বর্জও ফেলা হয় দখল প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে। ফলে এই চার ধরনের বিপর্যয় থেকে বাঁচার প্রাথমিক শর্ত হচ্ছে, নদীতে পর্যাপ্ত প্রবাহ থাকতে হবে। ভাঙন রোধ করতে নদী ব্যবস্থাপনা, দখল মুক্ত করতে কর্তৃপক্ষের সক্রিয়তা, দূষণ রোধ করতে ইটিপি নিশ্চিত করা এসব পরবর্তী পদক্ষেপ বলে আমি মনে করি।

এ বিষয়ে সরকারের ভূমিকা কি এবং কী হওয়া উচিৎ ?

খুবই সিম্পল। আমাদের প্রায় সব নদী যেহেতু উজানের দেশ ভারত থেকে আসা আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ওপর নির্ভরশীল, সেগুলোতে স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। এর বিকল্প নেই। এরপর নদীর টেকসই ব্যবস্থাপনা, দখল উচ্ছেদ, দূষণ রোধে জোর দিতে হবে। তাহলেই নদীগুলো ভালো থাকবে। যেসব নদী ইতিমধ্যেই বিপন্ন, সেগুলোও ক্রমান্বয়ে প্রাণ ফিরে পাবে।

নদী রক্ষার জন্য এ পর্যন্ত সরকারি কি কি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে? আশাবাদী হতে পারি এমন কোনো দিক আছে কি?

সরকারি পর্যায়ে নদী রক্ষায় আর যাই হোক উদ্যোগের ঘাটতি নেই। আইন ও প্রতিষ্ঠানও রয়েছে অনেক। গত দুই আড়াই দশকে বেশ কয়েকটি আইন ও নীতি হয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ আইন, পানি নীতি, জলাধার সংরক্ষণ আইন, পানি আইন, নদী রক্ষা কমিশন আইন প্রভৃতি। সম্প্রতি নদী বিষয়ক টাস্কফোর্স, কমিশন গঠিত হয়েছে। আগে থেকেই ছিল পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়। এসব সবই নদী নিয়ে কাজ করে। এছাড়া মন্ত্রণালয়গুেলার অধীেন হাওর বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ড, অভ্যন্তরীন নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, নৌপরিবহন কর্পোরেশন, যৌথ নদী কমিশন, নদী রক্ষা কমিশন, নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট, ওয়ারপো, আইডব্লিউএম, সিইজিআইএস, বিএডিসি, পরিবেশ অধিদপ্তর প্রভৃতি নানা সরকারি বা স্বায়ত্ত্বশাসিত সংস্থা রয়েছে। মোট কথা নদী রক্ষায় সরকারের
নীতিগত, আইনী, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যেগের কমতি নেই। সেদিক থেকে আশাবাদী হওয়াই যায়।

সরকারি পর্যায়ে নদী রক্ষায় আর যাই হোক উদ্যোগের ঘাটতি নেই। আইন ও প্রতিষ্ঠানও রয়েছে অনেক। গত দুই আড়াই দশকে বেশ কয়েকটি আইন ও নীতি হয়েছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ আইন, পানি নীতি, জলাধার সংরক্ষণ আইন, পানি আইন, নদী রক্ষা কমিশন আইন প্রভৃতি। সেদিক থেকে আশাবাদী হওয়াই যায়। কিন্তু নিরাশার দিক হচ্ছে, কিছুতেই যেন কোনো কাজ হচ্ছে না। আইন আছে, প্রয়োগ নেই। প্রতিষ্ঠান আছে, সক্রিয়তা নেই।

কিন্তু নিরাশার দিক হচ্ছে, কিছুতেই যেন কোনো কাজ হচ্ছে না। আইন আছে, প্রয়োগ নেই। প্রতিষ্ঠান আছে, সক্রিয়তা নেই। আমরা দেখছি, দেশের উচ্চ আদালত নদী রক্ষায় যুগান্তকারী কিছু রায় ও নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু সেই নির্দেশনা পালনেও আমরা অবহেলা দেখেছি প্রশাসনের তরফে। যেমন ঢাকার চারপাশের নদীগুেলার সীমান্তখুটি বসানোর ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা ছিল। কিন্তু অধিকাংশ খুটি জেলা প্রশাসন নদীর ভেতরে বসিয়েছে। এসব যখন দেখি, তখন আশাবাদী হওয়া কঠিন। তবে একটা আশার দিক হচ্ছে, নানা নিরাশার দিক থাকলেও সরকারের শীর্ষ পর্যায় বা নীতিগত পর্যায়ে নদী রক্ষায় অঙ্গীকার রয়েছে। বিশেষত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে যথেষ্ট সদিচ্ছার প্রমাণ দিয়ে চলছেন। তিনি বিভিন্ন সময়ে নির্দেশনা ও নীতিগত উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা দেখছি, নদী বিষয়ে যে দাবিই উঠেছে, তিনি ইতিবাচক অবস্থান নিয়েছেন। শীর্ষমহলের এই সদিচ্ছা ও ইতিবাচক অবস্থানকে মাঠ পর্যায়ে বা প্রায়োগিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।

নদীর সাথে জড়িত কিছু সম্ভাবনার গল্প জানতে চাই।

সম্ভাবনার সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে, নদী বিষয়ে জনসাধারণ এখন কেবল সচেতন নয়, সোচ্চারও। বড় কথা, তারা সংগঠিত হচ্ছে। যেমন ২০০০ সালে হয়তো একটি বা দুটি সংগঠন নদী নিয়ে কাজ করতো। এখন সারা দেশে অর্ধশতাধিক সংগঠন রয়েছে। এগুেলা ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। আপনি ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দেখবেন, নদী নিয়ে পোস্ট আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। মানুষ আগের তুলনায় বেশি নদী দেখতে যাচ্ছে। মূলধারার সংবাদমাধ্যমে নদী বিষয়ক প্রতিবেদন, বিশ্লেষণ, টক শো বেড়েছে। বড় কথা, তরুণরা এগিয়ে আসছে। আমরা রিভার অলিম্পিয়াড করতে গিয়ে দেখেছি, তরুণরা নদী রক্ষায় কতটা আন্তরিক, আবেগময় ও সক্রিয়। এগুলোকে আমি খুবই সম্ভাবনাময় হিসেবে দেখি। এগুলোর প্রভাবও পড়ছে। নদী দখল, দূষণকারীরা আগের মতো বুক ফুলিয়ে অপকর্ম করতে পারে না। দু’বার ভাবতে হয়। এছাড়া নদী আন্দোলনের দুটি সাফল্যের গল্প আপনাকে বলতে চাই। একটি হচ্ছে বড়াল রক্ষা আন্দোলন। বৃহত্তর রাজশাহী ও পাবনার এই নদী নিয়ে আন্দোলনের ফলে অন্তত তিনটি মাটির বাঁধ অপসারিত হয়েছে, দখল উচ্ছেদ চলছে। দুটো স্লুইসগেট কীভাবে অপসারিত হতে পারে, এ নিয়ে সরকারি পর্যায়ে আলোচনা চলছে। নদীটি উদ্ধার হবে এবং একটি উদাহরণ তৈরি হবে আশা করা যায়। আরেকটি নদী সাতক্ষীরার শ্যামনগরেরর আদি যমুনা নদী। নাগরিকদের আন্দোলনের ফলে এই নদীটিও উদ্ধার হয়েছে। এমন আরও উদাহরণ সামনের দিনগুলোতে দেখতে পাবেন।

নদী রক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের সচেতনতার দিকগুলো কেমন হতে পারে?

সচেতনতা শুধু নয়, এখন আসলে সময় এসেছে দায়িত্বশীলতার। আপনার নদী আরেকজন বা সরকার এসে রক্ষা করবে কেন? আপনার নদী আপনাকেই সুরক্ষা ও সংরক্ষণ করতে হবে। সেই দায়িত্বশীলতার অনেক দিক আছে। বিস্তৃত পরিসরে হতে পারে, ছোট পরিসরে হতে পারে। ব্যক্তিগত বা সামষ্টিক পরিসরেও হতে পারে। নদীর জন্য আপনি এক ঘণ্টা উৎসর্গ করতে পারেন আবার একজীবন দিয়ে দিতে পারেন। সব দিক বিবেচনা করে আমরা রিভারাইন পিপল থেকে একটি ফর্মুলা বের করেছি। সেটা হচ্ছে, নদী নিয়ে আপনি তিনটি কাজ করবেন। প্রথমত, একটি প্রিয় নদী ঠিক করা। দ্বিতীয়ত, নদীটির ব্যাপারে অনুসন্ধান, পরিদর্শন, বোঝাপড়া করা এবং তৃতীয়ত, সেই নদী নিয়ে আপনার বোঝাপড়া, আবেগ, অনুসন্ধান, ছবি, টেক্সট, ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া। এটা করতে গেলে দেখবেন, এক একটি নদী নিয়ে এক একটি গ্রুপ তৈরি হচ্ছে এবং তাদের মধ্যে আবেগ ও অঙ্গীকার সঞ্চারিত ও সংক্রমিত হচ্ছে। এটা খুবই সামান্য কাজ, কিন্তু যখন অনেকেই এই কাজ করবেন, তখন এর সামষ্টিক মূল্য হবে অসামান্য। আমরা গত কয়েক বছর ধরে নদী সুরক্ষার এই ফর্মুলা সবাইকে বলছি। ইতিমধ্যেই এর সুফল টের পেতে শুরু করছি।

আরো পড়তে পারেন

রুশ সংস্কৃতির প্রধান শত্রু রুশ রেজিম: মিখাইল শিশকিন

অন্য দেশে ইমপেরিয়াল অথবা সোভিয়েত রাশিয়া থেকে বর্তমানের রুশ ফেডারেশনের নির্বাসিত লেখকদের সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। অনেকে যাকে সমকালীন রুশ সাহিত্যে পাস্তারনাক ও সলঝোনেতসিনের উত্তরসূরি হিসেবে মনে করেন, সেই মিখাইল শিশকিন ১৯৯৫ সাল থেকে বসবাস করছেন সুইজারল্যান্ডে। একমাত্র লেখক হিসেবে লাভ করেছেন রাশিয়ার প্রথমসারির প্রায় সব সাহিত্য পুরস্কার, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— রুশ বুকার (২০০০), বিগ….

বাংলা সাহিত্যের লেখকদের কূপমণ্ডূকতা পাঠকদের কূপমণ্ডূক করেছে : হারুন আল রশিদ

রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন উপন্যাসের লেখক হারুন আল রশিদ বাংলা সাহিত্যে এক ব্যতিক্রম ও সম্পূর্ণ নতুন কণ্ঠ। তার  গদ্যের শক্তি ও গভীরতা পাঠকের কাছে যেমন বিস্ময়ের ব্যাপার তেমনি তার ভাষার সহজবোধ্যতা বাংলা গদ্যের একটি নতুন ধারা তৈরি করেছে। মাত্র দুটি উপন্যাস প্রকাশ করে তিনি পাঠকদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন। অন্য উপন্যাসটি হল— ‘রেণুর আবির্ভাব’। তাঁর তৃতীয়….

ঘৃণা কাটিয়ে ওঠা একজন ফিলিস্তিনি এবং একজন ইসরায়েলি বাবার মুখোমুখি

তাদের গল্পটা এতটাই অবাস্তব যে মনে হয় এটি কোনো চলচ্চিত্রের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এমনকি, স্টিভেন স্পিলবার্গ  তাদের গল্পকে বড় পর্দায় আনার স্বত্বও কিনেছিলেন। ফিলিস্তিনি বাসাম আরামিন এবং ইসরায়েলি রামি এলহানান বছরের পর বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য অক্লান্ত লড়াই করে যাচ্ছেন। যারা মধ্যপ্রাচ্যের চলমান সংঘাতে সন্তান হারিয়েছেন তাদের দল ‘দ্য প্যারেন্টস সার্কেল’ নামে….

error: Content is protected !!