Author Picture

নিজেকে জানো

রোমেনা আফরোজ

সক্রেটিস বলেছেন, ‘টু নো দাইসেলফ ইজ দ্যা বিগিনিং অব উইজডম’। এর অর্থ হলো, ‘নিজেকে জানার মধ্যে দিয়ে আরম্ভ হয় প্রজ্ঞার জগত’। এই জ্ঞানগর্ভের প্রাসঙ্গিকতা তখনো ছিল, এখনো আছে। যেহেতু বর্তমান যুগ পুঁজিবাদী যুগ, পুঁজিবাদ তার নিজ স্বার্থে সকল বস্তু এবং সম্পর্ক থেকে ঐতিহ্যগত মূল্য বাদ দিয়ে যোগ করেছে অর্থ মূল্য, ফলে প্রতিটি বস্তু পরিণত হয়েছে পণ্যে। এই পণ্যকরণ থেকে সমাজ, পরিবার এবং ব্যক্তিকে বাঁচাতে হলে নিজেকে জানার বিকল্প নেই।

ডেকার্ট বলেছেন, ‘আই থিংক দেয়ারফর আই অ্যাম’। লালন শাহ বলেছেন, ‘আত্মতত্ত্ব যেই জেনেছে, সেই হয়েছে দিব্যজ্ঞানী’। মূলত নিজেকে না জানলে শরীর এবং মনকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। তখন মানবিক গুণাবলী অনুপস্থিত থাকে; জীবন হয় অনিয়ন্ত্রিত।

একটু খেয়াল করলে দেখবেন সবকিছুর একটা ক্রম আছে। যেমন একের পর দুই আসে, তারপর তিন। শিশু জন্মের পর প্রথমে হামাগুড়ি দেয়; তারপর বসে; এরপর দাঁড়ায়। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে প্রথমে শেখানো হয় স্বরবর্ণ, তারপর ব্যঞ্জনবর্ণ। ঠিক সেভাবে আমাদের পাঠের আরম্ভ করতে হবে নিজেকে দিয়ে। মূলত একজন মানুষের বাঁচার জন্য যা যা প্রয়োজনীয় তার সবই জানতে হবে; যেমন, শরীর-মন, খাদ্য, মাটি, সংস্কৃতি এবং রাজনীতি ইত্যাদি। নিজেকে না জানলে পুঁজিবাদের বিপক্ষে টিকে থাকা অসম্ভব ব্যাপার।

১.
সাধারণ দৃষ্টিতে মানুষকে অখণ্ড সত্তা বলে মনে হয়। কিন্তু মানবশরীর ত্রিশ ট্রিলিয়ন কোষের সমন্বয়ে গঠিত। মানুষের শরীর শুধু শরীর নয়, এতে মনও যুক্ত আছে। আমরা শরীর সম্পর্কে টুকিটাকি জানলেও মন সম্পর্কে একেবারে অজ্ঞ। কম্পিউটার সম্পর্কে জানতে হলে যেমন হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার দুটোকেই জানতে হয়, ঠিক তেমনি নিজেকে জানতে হলেও শরীর এবং মন দুটোকেই জানতে হবে। যেহেতু আমাদের শরীরের যাবতীয় কার্যাবলী মন দ্বারা সম্পাদিত, তাই মনকে জানার বিকল্প নেই। আমাদের মনের দুটো অংশ: সচেতন মন এবং অবচেতন মন। অবচেতন মনের অংশ হলো ৯৫% এবং সচেতন মনের অংশ হলো ৫%। এ থেকে বোঝা যায়, অবচেতন মনকে না জানলে সচেতন মনের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। একইভাবে ত্রিশ ট্রিলিয়ন কোষের বিশাল কমিউনিটিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য জীবদেহের একক কোষ কীভাবে কাজ করে, কীভাবে খাদ্য থেকে পুষ্টি এবং শক্তি উৎপাদিত হয় তা জানা জরুরি।

২.
সাধারণত একটা দেশের অর্থনীতি গড়ে উঠে তার প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ভিত্তি করে। যদি প্রাকৃতিক সম্পদের প্রাচুর্যকে বাদ দিয়ে অর্থনীতি গড়ে তোলা হয়, তবে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। বর্তমানে বাংলাদেশেও খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়ায় বেড়েছে আমদানি ব্যয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাণিজ্য ঘাটতি ছাড়িয়ে গিয়েছিল প্রায় ৩৩ বিলিয়ন ডলার। অথচ বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতার বর্ণনা থেকে আমরা বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থার যে-চিত্র দেখতে পাই, তাতে কৃষিব্যবস্থার প্রাচুর্য বেশ স্পষ্ট ধরা পড়ে।

একসময় আমাদের নিজস্ব বীজের সংস্কৃতি ছিল, আমাদের পূর্বপুরুষরা বীজধান করে ফসল ফলাতেন। স্থানীয় বীজ সংরক্ষণের মধ্যে দিয়ে শুধু বীজ সংরক্ষণই হয় না, এ দ্বারা স্থানীয় সংস্কৃতিরও রক্ষা হয়। স্থানীয় বীজ সংরক্ষণ করতে না পারলে একসময় বীজের স্বত্বাধিকার চলে যাবে কর্পোরেশনের দখলে। প্রথমে কোম্পানি বীজ দখল করবে, এরপর দাম বাড়াবে। বিভিন্ন সময়ে পেঁয়াজ নিয়ে ভারত যে-কাণ্ড করে, তা আমরা সবাই জানি

বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের সবচেয়ে বড় খাত হচ্ছে কৃষি। ২০১৮ সালের বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সমীক্ষার তথ্যমতে, এটি মোট শ্রমশক্তির ৪০.৬ ভাগ জোগান দিয়ে থাকে এবং জিডিপিতে এর অবদান হলো ১৪.১০ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের এক তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ২ কোটি ১ লাখ ৫৭ হাজার একর অর্থাৎ আমাদের বিপুল পরিমাণ চাষের জমি আছে। নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় আমাদের কৃষি জমিগুলো বেশ উর্বর। বর্তমানে সরকারিভাবে পলি বিক্রি করার বিভিন্ন পরিকল্পনাও নেওয়া হচ্ছে। অথচ আমরা এই সম্ভাবনাময় কৃষিকে বাদ দিয়ে শিল্পকে প্রাধান্য দিচ্ছি। শিল্পের প্রয়োজন আছে। কিন্তু এর অর্থ যদি হয় কৃষিকে অবহেলা করা, তবে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। কৃষি এবং মাটি নিয়ে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে। তা না হলে আমরা একদিকে সংস্কৃতি হারাবো, আরেকদিকে বাড়বে নির্ভরশীলতা। এই নির্ভরশীলতার প্রভাব রাষ্ট্রের প্রতিটি ব্যক্তির উপর পড়তে বাধ্য।

একসময় আমাদের নিজস্ব বীজের সংস্কৃতি ছিল, আমাদের পূর্বপুরুষরা বীজধান করে ফসল ফলাতেন। স্থানীয় বীজ সংরক্ষণের মধ্যে দিয়ে শুধু বীজ সংরক্ষণই হয় না, এ দ্বারা স্থানীয় সংস্কৃতিরও রক্ষা হয়। স্থানীয় বীজ সংরক্ষণ করতে না পারলে একসময় বীজের স্বত্বাধিকার চলে যাবে কর্পোরেশনের দখলে। প্রথমে কোম্পানি বীজ দখল করবে, এরপর দাম বাড়াবে। বিভিন্ন সময়ে পেঁয়াজ নিয়ে ভারত যে-কাণ্ড করে, তা আমরা সবাই জানি।

বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে হাইব্রিড চাষ আরম্ভ হয়েছিল ১৯৯৮ সালে। বিভিন্ন কর্পোরেশন এবং সরকারিভাবে নতুন জাতের ফসলের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। একদিকে পৃষ্ঠপোষকতা, অপরদিকে বেশি ফলনের লক্ষ্যে কৃষকরা হাইব্রিড চাষের দিকে ঝুঁকেছেন। কিন্তু এই ফসল উৎপাদনের জন্য প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। এতে সেচের খরচ বেড়ে যায়। ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে ভূমিকম্প হবার সম্ভাবনাও বাড়ে। জিন প্রযুক্তি ব্যবহার করে অধিক ফসল ফলছে ঠিকই, কিন্তু এ সমস্ত খাদ্যে শরীরের পুষ্টিগুণ ব্যাহত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, পৃথিবীর প্রায় ২ বিলিয়ন মানুষ মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টসের অভাবে ভুগছে।

আমাদের কৃষকদের কৃষি বিষয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। তারা জানে না, কতটুকু জমিতে কতটুকু সার ব্যবহার করতে হয়। এসব নিয়ে তেমন বিধিনিষেধও নেই। তাই নতুন জাতের ক্ষেত্রে প্রচুর রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়, যা মাটির ক্ষতি করছে প্রত্যক্ষভাবে। ফলে মাটির ভেতর থাকা অনুজীব ও ক্ষুদ্র প্রাণী মারা যাচ্ছে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ জমির জৈব উপাদান কমে গেছে। যেখানে জমিতে ৫ শতাংশ জৈব উপাদান থাকা দরকার, সেখানে জৈব উপাদান নেমে গেছে দুই শতাংশে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, ইউরোপ, এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকাতে মাটির দূষণ মারাত্মক। বস্তুত  মাটি দূষিত হলে তা খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে অর্থাৎ মাটির ক্ষতি মানে মানুষেরও ক্ষতি। একটা বিষয় আমাদের সবাইকে বুঝতে হবে, স্থানীয় ফসলের ফলন কম হলেও অঞ্চলভিত্তিক সহিষ্ণুতা এবং পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে। তাই আমাদের স্থানীয় জাতের দিকে ফিরে যেতে হবে।

৩.
গত ৫০ বছরে সারা বিশ্বে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে আত্মহত্যার হার বেড়েছে ৬০ শতাংশ। এর কারণ শহরের মানুষজন ফাস্টফুড, প্রসেসড ফুডের মত অপ্রাকৃতিক খাদ্য গ্রহণ করে। এতে পুষ্টিগুণ না থাকায় স্নায়ু শিথিল হতে পারে না, যার কারণে অ্যাংজাইটি, বিষণ্ণতা বেড়ে চলছে। সারা পৃথিবীতে ২৬৪ মিলিয়ন লোক অ্যাংজাইটিতে ভুগছে। প্রায় ২৮০ মিলিয়ন লোক বিষণ্নতার শিকার। প্রায় ২০ মিলিয়ন লোক প্রতিবছর কার্ডিওভ্যাস্কুলার রোগে মারা যায়। এতকিছুর পরেও আমাদের মধ্যে সচেতনতা নেই। আমরা বুঝতে পারছি না, অপ্রাকৃতিক খাদ্যদ্রব্য হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়; টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার আশংকা তৈরি করে; উচ্চ রক্তচাপের প্রবণতা বাড়ায়। ২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ফাস্টফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার ১২ শতাংশ পর্যন্ত ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে। ডব্লিউএইচও-এর হিসাবমতে, ফাস্টফুডের কারণে প্রতিবছর ১১ মিলিয়ন লোক মারা যায়, যেখানে ধূমপানের জন্য মারা যায় ৭ মিলিয়ন লোক।

পুঁজিবাদ উৎপাদনের ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে ধর্মের প্রতি মানুষকে করে তুলেছে অসহিষ্ণু। কারণ ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পরম্পরা মানুষকে একজোট করে রাখে। এই সমাজবদ্ধ মানুষকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত করতে না পারলে পুঁজিবাদ দুইশ বছর ধরে ক্ষমতা বিস্তার করতে পারতো না। বস্তুত প্রতিটি ধর্ম মানুষকে সমাজবদ্ধ থাকার দিক নির্দেশনা দেয়

বেশিরভাগ মানুষ ছোটখাটো অসুখ-বিসুখের জন্যও চিকিৎসকের দ্বারস্থ হন। কিন্তু জীবন-যাপন পরিবর্তন না করে ঔষধ গ্রহণের ফলে তাদের সমস্যা বাড়তে থাকে। শুধু আমেরিকাতেই ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় প্রতিবছর ৪০,০০০ লোক মারা যায়।

আমাদের জন্য ভিটামিন ডি খুব প্রয়োজনীয় উপাদান হলেও এ নিয়ে আমরা সচেতন নই। পৃথিবীর প্রায় এক বিলিয়ন মানুষ ভিটামিন ডি’র অভাবে ভুগছে। তাই শুধু প্রাকৃতিক খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করলেই চলবে না, ভিটামিন ডি’র দিকেও নজর দিতে হবে। শরীর এবং মনকে সুস্থ রাখতে ব্যায়াম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ কারণে শারীরিক ক্ষমতা ও বয়স অনুযায়ী ব্যায়ামও করতে হবে।

৪.
একটা দেশের মাটি এবং পরিবেশ অনুযায়ী তার সংস্কৃতি গড়ে উঠে। সেই সংস্কৃতিতে থাকে সাধারণ মানুষের জীবন-যাপন, ধ্যান-ধারণা এবং ধর্মের প্রভাব। কিন্তু বর্তমানে আকাশসংস্কৃতির কল্যাণে আমরা অন্ধের মত পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকছি। বিজাতীয় সংস্কৃতি যে আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে, তা ভাবছি না একবারও। প্রগতিশীল ব্যক্তি, মিডিয়া, বিভিন্ন কর্পোরেশন প্রতিটি মাধ্যম ধর্মকে চিহ্নিত করেছে শত্রু হিসেবে। একে বাদ দিয়ে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ প্রতিষ্ঠা করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে সবাই। পুঁজিবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য যেসব ধ্যান-ধারণা, মতবাদ কায়েম করা হয়েছিল তার মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ অন্যতম। একটা সম্প্রদায়, জাতি এবং গোষ্ঠীকে সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য যেমন সংস্কৃতির প্রয়োজন, তেমনি ধর্মেরও প্রয়োজন আছে।

পুঁজিবাদ উৎপাদনের ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে ধর্মের প্রতি মানুষকে করে তুলেছে অসহিষ্ণু। কারণ ধর্ম, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, পরম্পরা মানুষকে একজোট করে রাখে। এই সমাজবদ্ধ মানুষকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র খণ্ডে বিভক্ত করতে না পারলে পুঁজিবাদ দুইশ বছর ধরে ক্ষমতা বিস্তার করতে পারতো না। বস্তুত প্রতিটি ধর্ম মানুষকে সমাজবদ্ধ থাকার দিক নির্দেশনা দেয়। মানুষকে সততা, সহানুভূতিশীল, পরস্পরকে ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার উপদেশ দেয়। প্রতিটি ধর্মই মানবপ্রেম, পরার্থপরতা, সহনশীলতা এবং সদাচারের কথা বলে। আমরা সেসব না বুঝে, ধর্মের বৃক্ষকে কাটতে কাটতে বহু পূর্বেই মৌলিকতা থেকে সরে এসেছি দূরে।  এখন সারা পৃথিবীতে ধর্মের নামে চলছে রাজনীতি, সন্ত্রাস। সৈয়দ ওয়ালিওয়াল্লাহ বিষয়টি অনুধাবন করেই লাল সালু গল্পে লিখেছেন, ধর্মের চেয়ে আগাছা বেশি।

সাধারণ মানুষের মধ্যে রাজনীতি নিয়ে একটা বিরূপ মনোভাব আছে। তারা মনে করেন, রাজনীতি তাদের বিষয়বস্তু নয়। কিন্তু প্রতিটি মানুষ যে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত এটা অনুধাবন করতে তারা ব্যর্থ হন। যেকোনো দেশে পুঁজিবাদের প্রথম শিকার হয় রাজনীতি। পুঁজিবাদ প্রথমে খুব কৌশলে রাজনীতিকে দখল করে নেয়। এরপর দেশের ভেতর পুঁজিবাদী আগ্রাসন বিস্তার করা সহজ হয়ে যায়। আমাদের দেশের রাজনীতিতে যে-মেরুকরণ সৃষ্টি হয়েছে, সাধারণ মানুষের সাথে রাজনীতিবিদদের যে-আকাশচুম্বী দূরত্ব, এসবের মূল কারণ তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি। বর্তমানে প্রতিটি দেশই বিভিন্ন ইস্যু দিয়ে জনগণকে বিভক্ত করে রাখে, যাতে তারা মৌলিক ইস্যু নিয়ে একত্রিত হতে না পারে। এ কারণে আমাদের রাজনীতি নিয়ে সোচ্চার হতে হবে, তা না হলে ইস্যুর চক্রে জীবন হবে তালপাতার সেফাই।

একটা দেশের মাটি এবং পরিবেশ অনুযায়ী তার সংস্কৃতি গড়ে উঠে। সেই সংস্কৃতিতে থাকে সাধারণ মানুষের জীবন-যাপন, ধ্যান-ধারণা এবং ধর্মের প্রভাব। কিন্তু বর্তমানে আকাশসংস্কৃতির কল্যাণে আমরা অন্ধের মত পাশ্চাত্য সংস্কৃতির দিকে ঝুঁকছি। বিজাতীয় সংস্কৃতি যে আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে, তা ভাবছি না একবারও

৫.
এখন আমাদের হাতের নাগালের মধ্যে পুঁজিবাদী পণ্য। আমাদের চারপাশে ব্যাঙের ছাতার মত নিত্যনতুন রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠছে। আছে হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা। তাই ব্যক্তির ভোগবাদে লিপ্ত হওয়া খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হওয়া উচিত স্বাস্থ্য। কথায় বলে, স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল। তাই মন নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ভোগবাদী জীবন-যাপন থেকে সরে আসতে হবে। প্রযুক্তির ব্যবহারে হতে হবে সতর্ক। কারণ প্রযুক্তি মানুষে মানুষে দূরত্ব সৃষ্টি করে; ধাবিত করে ব্যক্তিস্বার্থের দিকে। যেহেতু প্রকৃতি এবং মানুষ একে-অপরের পরিপূরক, তাই প্রকৃতির সান্নিধ্য একান্ত প্রয়োজন। প্রয়োজন আধ্যাত্মিকতার।

৬.
আমার অসুস্থতা আরম্ভ হয়েছিল এগারো সালের দিকে। তখন থেকে হাইপোথাইরয়েডিজমের জন্য থাইরিক্সিন চলছিল। একসময় ঔষধ গ্রহণের ফলে বিভিন্ন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।  মাথা ব্যথা, অনিদ্রা, বদহজমের মত রোগগুলো ছিল আমার নিত্যসঙ্গী। এছাড়া ডায়াবেটিস, অ্যাডোনোমাইসিস ইত্যাদি অসুখবিসুখ ধীরেধীরে আমার শরীর দখল করে নিয়েছিল। আমার মূল শত্রুকে মেডিকেল সায়েন্স কখনো চিহ্নিত করতে পারেনি। তাই অদৃশ্য শত্রুর সাথে যুদ্ধ করতে করতে চরম বিষণ্ণতার মধ্যে আমার দিন কাটছিল।

আঠারো সাল থেকে আমার মানসিক সমস্যাও দেখা দেয়। একদিকে শারীরিক অসুস্থতা, আরেকদিকে মানসিক সমস্যা। মরার উপর খাঁড়ার ঘা বোধ হয় একেই বলে। তখন কথা বলার জন্য একজন মানুষ হন্যে হয়ে খুঁজেছি। নারী কিংবা পুরুষ এ নিয়ে কোন বাছবিচার ছিল না। কিন্তু সাহিত্য জগতের নারীরা  আস্তিকতার কারণে আমাকে গ্রহণ করেননি। ওদিকে পুরুষ মানুষ যাদেরকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছি, তারা চেয়েছে আমার শরীর। তাই সব সম্পর্ক এবং ঔষধপত্র বাদ দিয়ে নতুন পথের সূত্রপাত করলাম। যদিও যুদ্ধটা আরম্ভ করেছিলাম ঝোঁকের মাথায়, একদম হঠাৎ, পরে বুঝেছি যুদ্ধ করার জন্য অস্ত্র দরকার। সেই অস্ত্র হলো হলিস্টিক জ্ঞান, মন নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল ইত্যাদি। এ কারণে হলিস্টিক ট্রিটমেন্ট নিয়ে পড়ার আগ্রহ তৈরি হলো। এ পদ্ধতিতে মন-আত্মা-দেহ সবকিছুর উপর লক্ষ রেখে প্রোগ্রাম নির্ধারণ করা হয়। কেন যেন মনে হয়েছিলো, এটাই উত্তরণের একমাত্র পথ।

আমি একটু একটু করে জীবনযাত্রা পরিবর্তন করছিলাম। নিত্যনতুন মানসিক এবং শারীরিক সমস্যা দেখা যাচ্ছিলো। আমার জন্য ভেঙে পড়া ছিল খুব সাধারণ ব্যাপার। এত সমস্যার মধ্যেও কিছু বিষয়ের প্রতি আমি খুব সচেতন ছিলাম যেমন অর্গানিক খাদ্য। এর সাথে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং চলছিল। আমাকে শুধু শরীর এবং মনের সাথেই যুদ্ধ করতে হয়নি, চারপাশের মানুষজনের নেতিবাচক কথাবার্তাও আমাকে মারাত্মকভাবে বিদ্ধ করতো।  তারা আমার সাহস এবং শক্তিকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিত। তবুও এগিয়ে গেছি। একুশ সালের দিকে যখন প্রথম ‘নো দাইসেলফ’ দর্শনের সাথে পরিচিত হলাম, তখন অনুভব করেছি, নিজেকে জানা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি যদি পূর্বে নিজেকে জানতাম বিশেষ করে শরীর এবং মনকে, তবে যুদ্ধটা অনেক সহজ হত।

উপসংহারে বলতে চাই, আমাদের শত্রু ধর্ম নয়, পুঁজিবাদ। আমাদের শত্রু আমরা নিজেরাও। কারণ আমরা আমাদের জানি না। এ কারণে সংস্কৃতি, ধর্ম, পরম্পরা থেকে আমরা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি।

আরো পড়তে পারেন

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

আগের পর্বে পড়ুন— চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও একটি সার্থক গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো দেশপ্রেম থেকে জাত সেই অনুভূতি, যার একটি রাজনৈতিক প্রকাশ রয়েছে। আর, বাঙালি জাতিসত্তাবোধের প্রথম রাজনৈতিক প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দুই হাজার মাইল দূরত্বের….

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল)

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ একুশের আবেগ সংহত থাকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র….

error: Content is protected !!