Author Picture

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

একেএম শামসুদ্দিন

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে ভেঙ্গে দিয়ে, চোরের মতো পালিয়ে যান সামরিক জান্তা জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান।

২৫ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকার পরিস্থিতি ছিল থমথমে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্টকে দেওয়া সংবিধানের খসড়ার চূড়ান্ত প্রতিবেদন পেশ করা এবং অনুমোদনের জন্য সময় নির্ধারণের কথা ছিল এদিন। ১৬  থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত আলোচনায় তেমন কোনো অগ্রগতি না হলেও ২০ মার্চের বৈঠকে আওয়ামী লীগের দেয়া তিনটি মৌলিক বিষয় প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। এগুলো হলো, (১) সামরিক আইন প্রত্যাহার (২) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং (৩) পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ব্যাপকভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন। পরবর্তী দু’দিন তারা নানাটালবাহানা করে সময় কাটিয়ে দেন। ২৩ মার্চ ঘোষণার খসড়া সংশোধন করতেই দিন পার হয়ে যায়। ২৪ মার্চ দুপুরের দিকে জানানো হয়, প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার জেনারেল এসজিএমএম পীরজাদা ২৫ মার্চ কোনো একসময় ড. কামাল হোসেনকে প্রেসিডেন্টের ঘোষণাসংক্রান্ত সিদ্ধান্তেরকথা টেলিফোনে জানিয়ে দেবেন। ২৫ মার্চ সারাদিন ধরেই আওয়ামী লীগের নেতারা টেলিফোনের অপেক্ষায় থাকেন, কিন্তু সেই ফোন আর আসেনি। অথচ ড. কামালকে টেলিফোনে জানিয়ে দেওয়ার কথা যখন বলা হয়েছিল ঠিক তার কয়েকঘণ্টা আগেই ২৪ মার্চ বেলা ১১টায় বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের আনুষ্ঠানিক আদেশ জারি করা হয়। অতঃপর  খুব দ্রুত বাংলাদেশের দৃশ্যপট পালটাতে থাকে।

২৫ মার্চ মধ্যরাতের আগেই ঢাকাসহ দেশের সকল সেনানিবাস থেকে হালকা ও ভারী অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী  ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিনা নোটিশে, এমনভাবে যে হিংস্র হায়নার শিকারে পরিণত হবে তার জন্য বাঙালি জাতি মোটেও প্রস্তুত ছিল না। অথচ এর আয়োজন চলছিল অনেক আগে থেকেই। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহ থেকেই এদেশে অবস্থিত পাকসেনাদের শক্তি বৃদ্ধির প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছিল। হাজার হাজার সৈনিক পাকিস্তান থেকে ঢাকায় উড়িয়ে আনা হয়। অত্যাধুনিক ভারী অস্ত্র ও গোলাবারুদ বোঝাই জাহাজ ‘এমভি সোয়াত’ ততদিনে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌছে গিয়েছিল। দুষ্কৃতিকারী মোকাবেলায় দেশের বিভিন্ন জেলায় সেনাবাহিনী প্রেরণ করার কাজটিও সম্পন্ন করা হয়। বাঙালি সংখ্যাধিক্য ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ড স্ট্রাকচার ভেঙ্গে দিয়ে ব্যাটালিয়ানগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া হয়। এতসব ব্যাটেল ইন্ডিকেশনের পরও আমাদের পক্ষ থেকে কি ধরণের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল সে প্রশ্ন আজও মানুষের মনে তাড়া করে ফিরে। অনেকেই মনে করেন, দূরদর্শিতা এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের অভাবে প্রায় অপ্রস্তুতভাবেই  বাঙালি সেদিন এক অসম লড়াইয়ের মুখোমুখি হয়েছিল।

একাত্তরের মার্চের প্রথমভাগেই আক্রমণের প্রস্তুতি হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী অনেকটাই এগিয়ে গিয়েছিল। এমনকি রংপুর সেনানিবাসে অবস্থিত ২৯ ক্যাভালরী রেজিমেন্ট থেকে ট্যাঙ্কবহর ঢাকায় এনে রাজপথে সহজেই যাতে অপারেট করা যায় সে জন্য ট্যাঙ্কের চাকার চেইনে রাবার বেল্ট লাগিয়ে প্রস্তুত করে রাখা হয়েছিল। এসব তৎপরতা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকায় ইস্টার্ন কমান্ড হেড কোয়ার্টার এবং চট্রগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারসহ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সামরিক কর্মকর্তারা তৎপর হয়ে উঠেন। স্বাধীনতার অনেক পরে, এসব ঘটনায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিত্বদের লেখা বিভিন্ন বই, নিবন্ধ ও বক্তব্য থেকে এ সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানা যায়। তারা সকলেই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাদের কেউ সম্মুখ সমরযোদ্ধা ছিলেন, আবার কেউ প্রবাসী সরকারের স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন।

২৫ মার্চ কালরাত এবং তারও পরে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় যে লাখ লাখ বাঙালি গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন, সে কথা বিবেচনা করে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রস্তুতির আগাম তথ্য পাওয়া সত্ত্বেও প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না কেনো?

সে সময় পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে জেষ্ঠ বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন চট্টগ্রামে অবস্থিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের কমান্ড্যান্ট ব্রিগেডিয়ার এম আর মজুমদার। তিনি তখন একই সঙ্গে চট্টগ্রামের সামরিক আইন প্রশাসকও ছিলেন। ফলে বেসামরিক প্রশাসন ও আওয়ামী লীগসহ  স্থানীয় অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে তার যোগাযোগের সুযোগ ছিল। চট্টগ্রাম অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও হেড কোয়ার্টারের সঙ্গেও তাঁর সরাসরি যোগাযোগ ছিল। এ কারণে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আগাম তথ্য পাওয়ার সুবিধাও ছিল তার এ ছাড়াও, একজন উর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা হিসেবে অভিজ্ঞতার আলোকে, সামরিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাও ছিল। ২ মার্চ বিপুল পরিমাণ ভারী অস্ত্র ও গুরুত্বপূর্ণ সামরিক সরঞ্জামসহ পাকিস্তানি জাহাজ এমভি সেয়াত নোঙর করার পর, ২৪ মার্চ পর্যন্ত তিনি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সকল চাপ উপেক্ষা করে টেকনিক্যাল কারণ দেখিয়ে জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস বন্ধ রেখেছিলেন। ওদিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দও শ্রমিক অসন্তোষ সৃষ্টি করে অস্ত্র খালাসে বাধা দিয়েছিলেন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বিগ্রেডিয়ার মজুমদার মনে করেছিলেন, পাকিস্তানের সামরিক তৎপরতা সামরিকভাবেই মোকাবেলা করা সমীচীন হবে এবং সময় নষ্ট না করে তা যত দ্রুত করা যায় ততই মঙ্গল। তবে, এ বিষয়ে রাজনৈতিক দিক-নির্দেশনার প্রয়োজন আছে। অসহযোগ আন্দোলন শুরু হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক প্রশাসন থেকে সরকারের সকল বিভাগ  তখন বঙ্গবন্ধু নির্দেশ মেনেই চলছিল। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার এ বিষয়েও বঙ্গবন্ধুর অনুমতির প্রয়োজন আছে বলে মনে করেছিলেন। এমন চিন্তা থেকেই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী মোকাবেলায় তার পরিকল্পনার কথা বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে প্রয়োজনীয় অনুমতির জন্য, ১৪ মার্চ ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরীকে (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) ঢাকায় কর্ণেল ওসমানীর (পরবর্তীতে জেনারেল) নিকট প্রেরণ করেন। সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্যদের একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকাও পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।

ক্যাপ্টেন আমিন সেদিনই কর্ণেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের সামরিক পরিকল্পনা সবিস্তার খুলে বলেন। কর্ণেল ওসমানী সব শোনার পর উচ্চতর রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে কথা বলে ক্যাপ্টেন আমিনকে জানান,‘তিনি বাঙালি সেনাদের দুশ্চিন্তার কারণগুলো চিহ্নিত করতে পারছেন, তাদের পরিকল্পনার সারবত্তাও উপলব্ধি করতে পারছেন। তবে রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে দ্বিধামুক্ত নন। সঙ্গত কারণেই তারা আলোচনায় বসে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে বিশ্বাসী। তারা মনে করেন, বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের পক্ষে রাখার জন্য আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।’ এমতাবস্থায়, ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ২১ মার্চ চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম আর সিদ্দিকীকে বলেন,‘আমাদের হাতে সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই। শিগগিরই কিছু ঘটবে…; কাজেই তিনি যেন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অনুমতি এনে দেন। ‘ ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের অনুরোধে এম আর সিদ্দিকী ঢাকায় গিয়ে ফিরে এসে জানান, ‘রাজনৈতিক আলোচনা চলছে। আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে অবশ্যই ধৈর্য ধরতে হবে।’

তার দু’দিন পর ২৪ মার্চ,পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ ছলচাতুরি মাধ্যমে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসে। ঢাকায় আসার একদিন পরেই ব্রিগেডিয়ার মজুমদার কর্ণেল ওসমানীর সঙ্গে দেখা করে বলেন, ঢাকা সেনানিবাসের গোপন সূত্র থেকে তিনি খবর পেয়েছেন, ইয়াহিয়া খান কিছুতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ক্ষমতা দেবেন না। অসহযোগ আন্দোলন ঠেকাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শিগগিরই অভিযানে নামবে। ইতঃপূর্বে যখন তিনি সেনা বিদ্রোহের পরিকল্পনা নিয়ে খবর পাঠিয়েছিলেন, তখন যদি অনুমতি দেওয়া হতো, তাহলে হয়তো পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ভাল কিছু করা যেতো। জবাবে কর্ণেল ওসমানী ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে বলেছিলেন,’তাকে ধৈর্য ধরতে হবে। কারণ শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার সঙ্গে একটি সমঝোতায় এসেছেন। ‘ কর্ণেল ওসমানী নাকি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে টেলিফোনে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে এ কথা বলেছিলেন।

বাঙালি সামরিক কর্মকর্তারা যদি প্রথমেই নির্দেশ পেয়ে যেতেন যে, স্বাধীনতার জন্য তাদের লড়তে হবে, তাহলে বেসামরিক প্রশাসনের সবাই যেমন পাকিস্তানিদের অসহযোগিতা করার নির্দেশ মেনে নিয়েছিলেন, তেমনই সশস্ত্র বাঙালি সদস্যরাও অস্ত্র হাতে তুলে নিতেন। এভাবে প্রথমেই  যদি সকল বাহিনীর সশস্ত্র বাঙালি সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হতো, তাহলে পাকিস্তানিদের হাতে বাঙালির মৃত্যুর হার হয়তো আরও কম হতে পারত

কথিত আছে, মার্চের গোড়াতেই বেসামরিক ব্যক্তিদের মাধ্যমেও  অনুরূপ তথ্যবার্তা রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। মার্চের ৩ বা ৪ তারিখ, ইস্টার্ন কমান্ড হেড কোয়ার্টারের ইন্টেলিজেন্স শাখার জেনারেল স্টাফ অফিসার গ্রেড-২, সংক্ষেপে জি-২(আই), বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা মেজর মসিউদ দৌলা তার সহকর্মী ক্যাপ্টেন সালামকে নিয়ে পাকিস্তানি ও বাঙালি সৈনিকদের তুলনামূলক সৈন্যসংখ্যা ও শক্তির পরিসংখ্যান তৈরি করেন। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়ে ছিলেন, তখন পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত পাকিস্তানিদের তুলনায় বাঙালি যে সেনাসদস্য আছে, তাতে সহজেই তাদের নিরস্ত্র করা সম্ভব। ৬টি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার, এয়ার ফোর্স, নেভি, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীতে কর্মরত সকল বাঙালি সদস্য সংখ্যা বিবেচনায় নিয়ে তিনি এ বিশ্লেষন করেছিলেন। তার সেই বার্তায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনী অসহযোগ আন্দোলন দমনে শিগগিরই যে আক্রমণ শুরু করবে, সে রণকৌশল সম্পর্কে নির্দিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ বিবরণও ছিল। তিনি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্বলিত একটি  মিলিটারী অপারেশনাল ম্যাপসহ তথ্যবার্তাটি তার বোন, প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ফিরোজা বেগমের মাধ্যমে উচ্চতর রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে পৌছে দিয়েছিলেন। বিশিষ্ঠ সাংবাদিক, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও ‘মূলধারা’৭১ -এর লেখক মঈদুল ইসলাম তার ‘উপধারা একাত্তর মার্চ-এপ্রিল’ বইয়ে দাবি করেছেন, ৫ মার্চ তিনি নিজে ওই একই তথ্য রাজনীতির উচ্চ মহলে পৌছে দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন হচ্ছে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি সেনাসদস্যদের যে সশস্ত্র বিদ্রোহের কথা বলা হয়েছে তা কতটুকু কার্যকর করা সম্ভব ছিল? নাকি রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে আলোচনার পথে চলাই সেদিন সঠিক ছিল? ২৫ মার্চ কালরাত এবং তারও পরে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় যে লাখ লাখ বাঙালি গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন, সে কথা বিবেচনা করে অনেকের মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ প্রস্তুতির আগাম তথ্য পাওয়া সত্ত্বেও প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলো না কেনো? আমাদের সশস্ত্র বাঙালি সদস্যরা তো প্রস্তুতই ছিলেন? বাঙালি সামরিক কর্মকর্তারা যদি প্রথমেই নির্দেশ পেয়ে যেতেন যে, স্বাধীনতার জন্য তাদের লড়তে হবে, তাহলে বেসামরিক প্রশাসনের সবাই যেমন পাকিস্তানিদের অসহযোগিতা করার নির্দেশ মেনে নিয়েছিলেন, তেমনই সশস্ত্র বাঙালি সদস্যরাও অস্ত্র হাতে তুলে নিতেন। এভাবে প্রথমেই  যদি সকল বাহিনীর সশস্ত্র বাঙালি সদস্যদের ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হতো, তাহলে পাকিস্তানিদের হাতে বাঙালির মৃত্যুর হার হয়তো আরও কম হতে পারত।

আবার অনেকেই মনে করেন, তখন যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল তাতে হটাৎ করে একটি সশস্ত্র যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া কতটা সঠিক হতো। সেদিন রাজনৈতিক মহল থেকে বাঙালি সামরিক কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে এমন প্রশ্নও করা হয়েছিল,’ আপনারা যে বিদ্রোহ করতে চান, আপনাদের কাছে কত অস্ত্র আছে?’ রাজনৈতিক নেতৃত্ব ভেবেছিলেন, রাজনৈতিক আলোচনার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধানে পৌছানো যাবে। এভাবে হটাৎ করে আঘাত করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বল প্রয়োগের শুধু অজুহাতই পেত না, নিজেদের ইচ্ছা চাপিয়ে দিতে সবকিছুর ওপরই আঘাত করত। নিরস্ত্র জাতি কি সে আঘাত সহ্য করতে পারত? বহিঃবিশ্বেই বা কি প্রতিক্রিয়া হতো? এমন চিন্তা-ভাবনা ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে আগেই করা হয়েছিল। সশস্ত্র পথে পা না বাড়িয়ে, আন্দোলনের গতি বজায় রেখে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখার কথাই তখন ভাবা হয়েছিল। তখন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী নেতৃবৃন্দ হয়তো ভেবেছিলেন, আন্দোলনের গতি বজায় রাখলে এবং জনগণের একতা সংহত করা গেলে ইয়াহিয়া খানের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে যে, সামরিক বল প্রয়োগ করে তিনি যে উদ্দেশ্য হাসিল করতে চাচ্ছেন, তা অর্জন করতে পারবেন না। সুতরাং, তিনি  হয়তো সে পথে আর পা বাড়াবেন না। কিন্তু বাস্তবে, ২৫ মার্চ কালরাতে, তাদের সেদিনের সেই চিন্তা-ভাবনার কোনো প্রতিফলন দেখা গেলো না।

আরো পড়তে পারেন

ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

আগের পর্বে পড়ুন— চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও একটি সার্থক গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো দেশপ্রেম থেকে জাত সেই অনুভূতি, যার একটি রাজনৈতিক প্রকাশ রয়েছে। আর, বাঙালি জাতিসত্তাবোধের প্রথম রাজনৈতিক প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দুই হাজার মাইল দূরত্বের….

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল)

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ একুশের আবেগ সংহত থাকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র….

বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর প্রস্তুতি পর্ব (১৯৪৯-১৯৫১) পাকিস্তান উন্মেষ ধারা থেকে ধূমায়িত ক্ষোভ প্রকাশে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সর্বব্যাপী রূপ পরিগ্রহ করে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবর্তন ও ঘটনাচক্রে খাজা নাজিমউদ্দীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ২৪ থেকে ২৬ জানুয়ারি পূর্ব বাঙলা মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে যোগদানের উদ্দেশ্য ২৫ জানুয়ারি তিনি সস্ত্রীক ঢাকায় আগমন করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী….

error: Content is protected !!