Author Picture

শারদুল সজলের একগুচ্ছ কবিতা

শারদুল সজল

রবিবার থেকে শনিবার

দুখের দৈর্ঘ্য মাপতে গিয়ে ঘর ছেড়েছি, আজও ফেরা হয়নি।
হাওয়ার শিকড় ছিঁড়ে ঝুলে আছে ফেরারি চাঁদ
কচ্ছপের আয়ু নিয়ে রবিবারের হাটে
একখাচি দুখের স্যাম্পল সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছি
বনেদি, ছোটলোকি, আফ্রিকান—
স্বতন্ত্র কিছু দুঃখ
আমার হাতের তালুতে সূর্যকে ইঙ্গিত করে
জেগে ওঠে

ভোর হয়
উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ গোলার্ধে
এক ঝাঁক মেঘ গিজগিজ করে আছড়ে পড়ে
নাম না জানা বুকের গহীনে
কামারপাড়ার সুবলা পাগলের লোহা পিটুনির আড়ালে
দেবে যায় সরলতার আয়ু, মহাকাল
আর—
আমার হাটবার বেড়ে চলে রবিবার থেকে শনিবার

 

যুবক

সম্পূর্ণ অন্ধকার গিলে খেয়ে
যে আমি দাঁড়িয়ে আছি।
যে আমি ভেঙেছি— দোজখের দুর্যোগ-আগুন
মুগ্ধতার তুমুল সৌরভে…
মৃতময় মুখগুলোকে জড়ো করে
যিশুর মুজেজায় আদেশ করেছি
জেগে ওঠো—
মৃত্যুকে অনুবাদ করে ফিরে আসা— হে যুবক

বলো— আমি—

একমাত্র আমিই—

যে মৃত্যুর কাছে কখনো কৃপণভাবে দাঁড়াইনি!

 

মঞ্চ

উঁচু চেয়ারে অভিনব হত্যাকারীই বসবেন
প্রধান অতিথি হবেন কৌশলি গোপন দালাল
সভাপতিত্ব করবেন খুনি-শয়তানের মতো মিষ্টি মুখ
বোকচোদ বয়ানের প্রটোকল দেবেন
বাজার ফর্দির মতো কতিপয় কিছু অফিসার

আর—
করতালির মজুদে উপস্থিত হবো
তুমি আমি তারছেঁড়া অবুঝ আ-বাল!

 

উচ্চতা

কখনো কখনো
উঁচু, পাহাড়ের পথ একা হয়ে যায়
পাহাড় অপেক্ষা করে, দেখে—
কেউ তার দিকে আসছে কিনা

কারণ পাহাড় তার উঁচুতে
সুস্বাদু ফল ও দূরের দৃশ্যকে দেখার উচ্চতা
জমা করে রাখে

ওখানে, একবার কেউ পৌঁছাতে পারলে
তখন, পৃথিবীর অনেক দূরত্বই ছোট হয়ে আসে

 

পথ

পথ আর কতদূর নিয়ে যাবে, মানুষ যদি না হাঁটে
এই পথ রোদ্দুর হিমালয় পাথর ভেঙে…
জীবনকে, ছেড়ে দিতে হবে গহীন জঙ্গলে
কুয়াশায়, স্রোতে, পাহাড়ের পর পাহাড়ে
অসংখ্য ছোট-বড় নদী সাঁতরিয়ে
মারিয়ানা ট্রেঞ্চের গভীর অন্ধকারে—
তুমিও জানতে পারবে একদিন

জীবন ছোট নয়—
জীবন ছাড় দিতে, ছেড়ে দিতে নয়

কোন ভাঙন—বেদনা নিরর্থক নয়
জীবনকে এরা ভরপুর দিয়ে যায়
কখনো কখনো সাময়িক যন্ত্রনার পরীক্ষা চালায়

তাই, শুধু সুখ নয়, যেয়ো দুঃখের কাছে
দুঃখের কাছে বিজয়ী হওয়ার মন্ত্র আছে…
পথ আর কতদূর নিয়ে যাবে, মানুষ যদি না হাঁটে
এই পথ রোদ্দুর হিমালয় পাথর ভেঙে…

 

অর্জন

প্রতিদিন লাখ লাখ মাইল দূরত্ব টেনে এনে মিলিত হই
ভুলগুলো ফুল দিয়ে ঢেকে বড় করি তিন সত্যির আয়ুষ্কাল
কাচি করাতে কেটে-কুটে প্রতি রাতে ঠোঁটে ঠোঁটে ইচ্ছে মেশাই

বিষ খাই— বিষ হজম করি—
বহুগমণ সংবর্ধনায় ফিরি।

প্রতিদিন মৃতছবি দেয়ালে টানাই
নিজহাতে গোলাপপোড়া ছাইয়ের উপর সু-ঘ্রাণ ছড়াই!

ঘুড়ি-সুতোয় টেনে তুলি সুদীর্ঘ সময়ের খসড়া

আশ্চর্য, আশ্চর্য এই জীবন দিয়ে যা কিছু অর্জন—
তার একাংশ প্রতারণা!

 

হোমারের চাঁদ

জানি— এ কারাগার মৃত্যু পর্যন্ত সুন্দর!
এখানে শিখেছি প্রেম— প্রার্থনা

একথা আমি জেনেছিলাম নিষ্পাপ হৃদয় অবহেলা করে
গোপনে—
লাজুক পাখির ঠোঁট থেকে রক্ত ঝরিয়ে,  যখন—
একটি হৃদয়হীন লোভের ভেতর মমি হয়েছিলাম

তারপর, খন্ডকালীন সমস্ত মৃত্যুই ছিল অভিজ্ঞতা
শস্যভর্তি শরীরের নুন ছেকে ঘুমহীন রাতের রাজা আমি

হা করে গিলছি
উত্তর গোলার্ধ থেকে দক্ষিণ গোলার্ধ
সৌরঝড়, এমন কী নক্ষত্রের অলিগলি

এক জাত সাপে খেলে হয়— উন্নতি
দশ জাতে খেলে হয় পদোন্নতি

কলিজা পোড়া গন্ধ পান? ও কিছু না—
হোমারের চাঁদ
আমার প্রায়চিত্ত

 

দূরত্বের কথা নিয়ে আসিনি

অন্ধ হতে হতে কী যেন দেখে ফেললাম
কুয়াশার অস্থির পাতাবাহারে
হেঁটে ঘেটে দৌড়ে—
একটি জন্মের অতীত ব্যবধানে
অনর্থ এই জীবন কতবার গিলে খেয়েছি
গ্লাসভর্তি মদে, কতবার তুলে দিয়েছি
নিঃশর্ত—তোমাদের দখলে!
তার হিশেব বা ফর্দি নিয়ে আসিনি আমি
আসিনি—
পিথাগোরাসের জটিল ধাঁধায়…

শীত আসে! শীত যায়—
বিস্মৃতির পরাস্ত মাঠে
গান গেয়ে যে কোকিল গেছে ভুলে
স্বর্ণলতা যেভাবে পেঁচিয়ে বাড়ে—
একটি আস্ত জীবনে,
তার চোখ হারানো দূরত্বের কথা নিয়েও
আসিনি আমি

আমার মতো এভাবে কেউ আসে না

ক্ষতির সংবর্ধনা দিয়ে বিপরীত ভাঙা বোতামে
সূর্য ছড়াতে!

 

আত্মীয়

সবাই সংসার গোছায় আর আমি ধ্বংস গুছাই।
রাত্রি গভীর হলে—
টিভির অফস্কিনের কালো কাচে
হাজার মুখের তর্ক ছাড়ি
দেখি—
প্রাণের আত্মীয়রা আমাকে—
খন্ড খন্ড করে
তাদের আনন্দ বৃদ্ধি করছে
গোপন কৌশলে হাসছে

এমন হাসিমাখা মুখ আমাকে নেশার মতো টানে
তাই নিয়ম করে ছোট হই
আমি ছোট না হলে মানুষের হাসি মুখ দেখবো কীভাবে

 

রোদ-কাহিনি হাইফেন

স্বভাব
জুতার দোকানের সামনে দিয়ে যেতেই
দোকানওয়ালা
পায়ের দিকে লক্ষ্য করল—

শার্টের দোকানওয়ালা শার্ট দেখে নিল কয়েকবার

আর একজন নারীর সামনে দাঁড়াতেই
সে আমার— রক্তের ঘনত্ব মাপল

 

প্রেম

প্রতিদিন একটি করে গোলাপ বাড়ে
আর একটি করে মরে যায়
মৃত গোলাপটি ধরে চিৎকার করি
চিৎকার একসময় মিলিয়ে যায়
দূর বাতাসে—

ভেসে আসে দিগন্তের প্রথম রোদ
যেন এই প্রথম চাইলাম আমি

তখন দেখি—
গোলাপ আর চিৎকার দুটোই ছিল অর্থহীন!

 

আয়না

আমি একটি আয়না।
মানুষ তার মুখ যতবার আমার ভেতরে দেখে
ততবার—
আফ্রিকার জঙ্গলগুলো দৌড়ে এসে
ঢুকে পড়ে—
       মুখোশ হয়ে
             দাঁত হয়ে…

কাউকে বোঝাতে পারি না
একটি মানুষের মুখ দেখব বলে
এই আমি কতকাল ধরে অপেক্ষায় আছি

আরো পড়তে পারেন

সুলতানা নাছিরা হীরার একগুচ্ছ কবিতা

বিরুদ্ধ সময় একেকটা দিন কী বীভৎস হয়েই না আসে! বীভৎস সময়, বীভৎস মন, বীভৎস মানুষ, বীভৎস সভ্যতা! মধ্যাহ্নের প্রাখর্যকে কম্পমান পর্দা বানিয়ে ভয়ার্ত রাজহাঁসের মতো চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল একটা অ্যাম্বুলেন্স। এই গাড়িটার ভেতর আপাতত আশ্রয় পেলে বেঁচে যেতাম। ভীষণ বিরুদ্ধ সময়! এই বিরুদ্ধতার কথা জানে ঘরের চার দেয়াল, শূন্য বারান্দা, জীর্ণ দেয়াল ঘড়ি,….

রিয়াসাত আল ওয়াসিফের একগুচ্ছ কবিতা

রেট্রোসপেক্টিভ বই সাজাতে সাজাতে জনৈক কবির মনে হলো— এত এত বই কবে পড়ব! এই ফোকাস হারানো সময়ে মানুষ যেন গুড়ো গুড়ো কাচ। হঠাৎ তাঁর মনে হলো বই বাদ দিয়ে আজ বরং পাপগুলোকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা যাক। কতদিন দেখেনি দেখতে চায়নি, দেখা হয় না, দেখা যায় না। যাপিত জীবনের কাদায় শুধু মুখ ঢেকে যায়। মুখ….

সাযযাদ আনসারীর একগুচ্ছ কবিতা

ঋতু রমনী অন্তহীন পথের মত ছিলো ঋতু রমনী চেনা পাতা ও পাখি থেকে অচেনা ফুলের পথে চলে গেল সে। কথা ছিলো তার সাথে রাগ-রাগিনীর কথা ছিলো অসংখ্য পত্র-পল্লবীর, কথা ছিলো আমাদের নাম উড়াবার কথা ছিলো কত কথা দেবার নেবার। এই খানে আমাদের মন অন্ধ অধীর এই খানে না বাঁধা ঘাট জীবন নদীর, এই খানে পথে….

error: Content is protected !!