Author Picture

ইলিশ মাছের ভর

খন্দকার রেজাউল করিম

বাংলাদেশের এক অজপাড়াগাঁয়ে আইনস্টাইন আমার বাসায় অতিথি হয়ে এসেছেন। কেমন করে এ অসম্ভব ঘটনা সম্ভব হয়েছে তা জিজ্ঞেস করবেন না। শুনেছিলাম ‘মিষ্টান্নে ইতরজনা’, আমি তার লাগসই উদাহরণ, খেতে খুব ভালোবাসি। আমার প্রিয় কবিতার লাইন, ‘যত খুশি তত চুষি, হাড়ে হাড়ে রস।’ কিন্তু আইনস্টাইনের রসনা আমার জিহ্বাকেও হার মানায়। কাল গাঁয়ের হাটে আইনস্টাইনকে জিলাপি কিনে খাইয়েছি। পেঁচানো মিষ্টান্নের মাঝে এমন তীব্র মিষ্টির স্বাদ আইনস্টাইন নাকি জীবনে কখনো পাননি। ভবিষ্যতে তাকে কাঁঠাল খাওয়াব ঠিক করে রেখেছি। আরও খাওয়াতে চাই ইলিশ মাছের ঝোল। শুনেছি বাংলাদেশে ফাঁসির আসামি মরার আগে ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেতে চায়। স্বর্গে ইলিশ মাছের বর্ণনা নেই বলে আমার বাঙালি বন্ধুদের আফসোস করতে দেখেছি। স্বর্গে গিয়ে কি শুধুই আঙুর আর আপেল খেয়ে দিন কাটাতে হবে? আম, জাম, ইলিশ, রুই কোথায় গেল? ইলিশ মাছ আইনস্টাইনকে খাওয়াতেই হবে। আজ আইনস্টাইনকে নিয়ে চলেছি গ্রাম থেকে ১০ কিলোমিটার দূরের এক হাটে। সেখানে ভালো ইলিশ মাছ পাওয়া যায়।

আইনস্টাইন তবুও খুশি : সময় তো আপেক্ষিক, তা ছাড়া মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে সময় বলে কিছুই ছিল না! ঠিক তাই। বাঙালিরা এখনো মহাবিশ্বের জন্মলগ্নেই বাস করছে!

বাস এসে গেল। বাসের ভেতরে এবং ছাদে উপচে পড়া মানুষের ভিড়। আমরা দু’জনে ঠেলেঠুলে বাসের ভেতর ঢুকে পড়লাম। বাসের পরিবহণ ক্ষমতা দেখে আইনস্টাইন একই সঙ্গে অবাক এবং খুশি হয়ে গেলেন। তিনি বাসের ছাদে মুক্ত বায়ুতে নিশ্বাস নিয়ে রূপসী বাংলার রূপ দেখতে দেখতে গন্তব্যে পৌঁছানোর কথা ভাবছিলেন, কিন্তু কখন হঠাৎ কোনো গাছের ডালে বাড়ি খেতে হবে ভেবে এমন ঝুঁকি আমি নিতে চাইনি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞানীর জীবন এভাবে বিপন্ন করা ঠিক হবে না। শুধু মানুষ নয়; বাসের ভেতরে ছাগল, মুরগি, তরমুজ, কাঁঠাল, সবই আছে। কেউ ক্রেতা, কেউ বা বিক্রেতা। কেউ যাচ্ছে হাটে ছাগল বিক্রি করতে, কেউ বা যাচ্ছে কিনতে। ক্রেতা, বিক্রেতা, মানুষ, ছাগল, মুরগি, তরমুজ, সবাই সমান। একেই বলে সমতা! আইনস্টাইন খুব খুশি হয়ে গান ধরলেন, ‘আমরা সবাই রাজা, আমাদের এই রাজার রাজত্বে।’

‘তুমি রবি ঠাকুরের গান শোনো নাকি?’ আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
‘না, তবে বাস্তবতার রূপ (on the nature of reality) নিয়ে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে কয়েকবার তর্ক যুদ্ধে নেমেছিলাম। ভদ্রলোক বিজ্ঞানের তেমন কিছুই জানেন না, কিন্তু তাকে তর্কে পরাস্থ করা প্রায় অসম্ভব।’
‘হ্যাঁ, আমাদের, বাঙালিদের, চাপার জোরের তুলনা নেই।’
‘তার মানে?’
‘সে তুমি বুঝবে না।’

বাসটি প্রতি এক কিলোমিটার যেতে দু’বার করে থামছে, যাত্রী উঠছে, সেই সঙ্গে আরও ছাগল, আরও মুরগি। ১০ কিলোমিটার যেতে প্রায় এক ঘণ্টা লেগে গেল। হাটের দিন বলে কথা। আইনস্টাইন তবুও খুশি : সময় তো আপেক্ষিক, তা ছাড়া মহাবিশ্বের জন্মলগ্নে সময় বলে কিছুই ছিল না! ঠিক তাই। বাঙালিরা এখনো মহাবিশ্বের জন্মলগ্নেই বাস করছে!

ঝামেলা বাধল ইলিশ মাছ কেনার সময়। দুটি এক কেজি সাইজের ইলিশ মাছ কিনে দোকানিকে মাপতে বললাম। দোকানদার মাছ দুটি দাঁড়িপাল্লার ওপরে পাশাপাশি না রেখে একটি মাছের ওপর আরেকটি মাছে রেখে ওজন নেওয়া শুরু করল। তাতে আইনস্টাইনের ভয়ানক আপত্তি!
‘এই দুটি মাপের মধ্যে কি কোনো তারতম্য হবে?’ আমি অবাক হয়ে আইনস্টাইনকে জিজ্ঞেস করলাম।
‘হ্যাঁ, হবে! একটি এক কেজি মাছ আরেকটি এক কেজি মাছের ওপর রাখলে ওদের মোট ভর দুই কেজির চেয়ে একটু বেশি হবে। পার্থক্যটা এতই অল্প যে দোকানদারের দাঁড়িপাল্লায় তা ধরা পড়বে না। তবে আমার আপেক্ষিকতা তত্ত্বকে ফাঁকি দেওয়া অতো সহজ নয়।’

‘এই দোকানদার কি তোমার আপেক্ষিকতা তত্ত্ব পড়েছে? তা ছাড়া, ভর আর ওজনের মধ্যে পার্থক্য কী?’

‘ভরকে মাধ্যকর্ষণজনিত ত্বরণ দিয়ে গুণ করলে ওজন পাওয়া যায়। ওজন এবং ভর যদিও আলাদা, এখানে এদের আলাদা না ভাবলে ক্ষতির কোনো ভয় নেই।’

‘তোমার আপেক্ষিকতা তত্ত্বে ভর মাপার নিয়মটা কী?’

‘আমার ভর মাপার পদ্ধতি তোমার কাছে অদ্ভুত মনে হতে পারে:

m=E/c^2 (mass = energy divided by c square);

এখানে m= ভর, E=energy, c= আলোর গতি। এভাবেই ১৯০৫ সালে জার্নালে আমার সমীকরণটি প্রথমে লিখেছিলাম, যদিও এখন সবাই ওকে E=mc^2 (energy=mass c square). ভাবেই চেনে।

একটি হাইড্রোজেন পরমাণু একটি ইলেকট্রন এবং একটি প্রোটন দিয়ে তৈরি। একটি ইলেকট্রন এবং একটি প্রোটনের ভর যোগ করলে কি হাইড্রোজেন পরমাণুর ভর পাওয়া যাবে? না, হাইড্রোজেন পরমাণুর ভর একটু কম হবে। একটি প্রোটন দুটি আপ কোয়ার্ক এবং একটি ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি? কিন্তু এ তিনটি কোয়ার্কের ভর যোগ করলে কি প্রোটনের ভরের সমান হবে? না, প্রোটনের ভর প্রায় একশ গুণ বেশি।’

‘কিন্তু কেন?’

‘ইলিশ মাছের হিসাবটা করে বুঝিয়ে দেওয়া যাক। দার্শনিক এরিস্টটল বলেছিলেন, ‘sum of the parts is not equal to the whole.’ দর্শনের এই উক্তি যে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে কতটা নির্ভুল তা ইলিশ মাছের ওজনের হিসাব থেকেই বোঝা যাবে। ইলিশ মাছ এবং আর সব কিছুকেই পৃথিবী মাধ্যাকর্ষণের বল দিয়ে নিজের কেন্দ্রের দিকে টানছে। একটি ইলিশ মাছকে আরেকটি ইলিশ মাছের ওপরে উঠাতে এ বলের বিরুদ্ধে কাজ করতে হবে, কিছু এনার্জি খরচ করতে হবে। এ এনার্জি দ্বিতীয় ইলিশ মাছের ভেতরে সঞ্চিত হয়ে থাকবে। পদার্থবিদরা একে মাধ্যকর্ষণজনিত সুপ্ত এনার্জি (gravitational potential energy) বলে। দুটি ইলিশ মাছ পাশাপাশি থাকলে যে এনার্জি হবে, ওপরে নিচে থাকলে তার চেয়ে বেশি এনার্জি হবে, তাই দ্বিতীয় অবস্থানে ওদের মোট ভরও বেশি হবে। কারও ভর মাপতে হলে সবার আগে ওর এনার্জির কথা ভাবতে হবে। পরমাণুর বেলা ইলেকট্রনের দৌড়াদৌড়ির এনার্জি এবং ইলেকট্রন এবং প্রোটনের মাঝের বৈদ্যুতিক সুপ্ত এনার্জির কথা ভাবতে হবে। একটি প্রোটনের ভেতরে কোয়ার্কগুলো প্রচণ্ড বেগে ছোটাছুটি করছে। এ এনার্জি বাদ দিয়ে প্রোটনের ভর মাপতে গেলে হিসাবে মস্ত ভুল হবে।’

‘মাছের বাজারে তোমার আপেক্ষিকতা তত্ত্বের কথা গোপন রাখাই ভালো, নইলে পাগল বলে অপবাদ জুটবে।’

‘যে তোরে পাগল বলে, তারে তুই বলিস নে কিছু,’ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন। আমার বিশ্বাস, ‘Brilliant spirits have always encountered violent opposition from mediocre minds.’

রাতে ইলিশ মাছের ঝোল দিয়ে আইনস্টাইন ভাত খেয়েছিলেন। আমেরিকার শ্যাড মাছ অনেকটা ইলিশ মাছের মতো। কিন্তু আমেরিকায় যেমনটি হয়, সব কিছুর আকার-ওজন যেমন বেশি, স্বাদ-গন্ধ তেমনি কম। সেই রাতে ইলিশ মাছ এবং শ্যাড মাছের আপেক্ষিকতা নিয়ে তুমুল আড্ডা জমেছিল।

আরো পড়তে পারেন

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

আগের পর্বে পড়ুন— চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও একটি সার্থক গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো দেশপ্রেম থেকে জাত সেই অনুভূতি, যার একটি রাজনৈতিক প্রকাশ রয়েছে। আর, বাঙালি জাতিসত্তাবোধের প্রথম রাজনৈতিক প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দুই হাজার মাইল দূরত্বের….

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল)

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ একুশের আবেগ সংহত থাকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র….

error: Content is protected !!