Author Picture

ক্ষুধা এবং করোনা ভাইরাস

খন্দকার রেজাউল করিম

ক্ষুধা করোনা ভাইরাসের মতো সংক্রামক ব্যাধি নয় হলে ভালোই হতো, এতদিনে ক্ষুধা-রোগের একটা সমাধান
বের হয়ে যেত। শিশুর পেটে যে ক্ষুধার আগুন জ্বলে তা থেকে আমি-আপনি নিরাপদ, ও আগুন আমাদের পেটে ছড়িয়ে পড়ে না।

২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনে প্রথম করোনা ভাইরাস বাদুড় থেকে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে। ২০২০ সালের জানুয়ারী মাসে চীনের উহান প্রদেশে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে একজন ৬১ বছর বয়স্ক লোক প্রথম মৃত্যুবরণ করেন। তারপরে ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি – এই রোগ বিশ্বজুড়ে দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। সেই সাথে মরণ। আজ পৃথিবীর প্রায় সবদেশে এই রোগ মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হয়েছে।

করোনা ভাইরাসের বিরুদ্ধে বিজ্ঞানীরা যুদ্ধ শুরু করে দিলেন। রাজনীতিবিদ, ধনবান, পুণ্যবান, ক্ষমতাবান
মানুষেরা তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে বসলেন। কেন? কারণ, করোনা ভাইরাস ধনী-গরিব, শ্রমিক-রাজনীতিবিদ, পাপী- সাধু, জ্ঞানী-মূর্খ, রাজা-প্রজা বিচার করে না। পৃথিবীর দুই প্রতাপশালী দেশের প্রধান, ইংল্যান্ডের বরিস
জনসন, এবং আমেরিকার ডোনাল্ড ট্রাম্প, এই ভাইরাসের কবলে পড়ে হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে সময় কাটাতে বাধ্য হন। ওদিকে ‘ক্ষুধা ভাইরাস’ শুধু গরীবদেরই ধরে। যারা না খেয়ে মারা যায় তারা ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের নাম কখনো শোনেনি। আমেরিকার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের প্রতিদিনের খরচ প্রায় ৮০ হাজার ডলার, দরিদ্র দেশে একজন ক্ষুধার্তকে দুবেলা ভরপেট খাওয়াতে লাগে ২ ডলার।

করোনা ভাইরাসে গত দুই বছরে পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৫৩ লক্ষ লোক মারা গেছে, মৃতের সংখ্যা গড়ে প্রতিদিন ৭ হাজার জন। ‘ক্ষুধা রোগে’ পৃথিবীতে কতজন মানুষ প্রাণ হারায়? জাতিসংঘের খাদ্য এবং কৃষি (FAO, food and agriculture organization) দফতরের মতে প্রতিবছর পৃথিবীতে ক্ষুধায় মারা যায় প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষ, মৃতের সংখ্যা গড়ে প্রতিদিন ২৫,০০০ জন, তার মধ্যে ৮,৫০০ জন শিশু। আর কোনো রোগে এতো বেশি লোক মরে না!

২০২০ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আমেরিকায় প্রথম করোনাভাইরাসে একজনের মৃত্যু হয়। করোনাজড়িত কারণে আজ পর্যন্ত (ডিসেম্বর ১০, ২০২১) আমেরিকার মৃত্যুসংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮ লক্ষ, ভারতে প্রায় ৫ লক্ষ। করোনা ভাইরাসে গত দুই বছরে পৃথিবীজুড়ে প্রায় ৫৩ লক্ষ লোক মারা গেছে, মৃতের সংখ্যা গড়ে প্রতিদিন ৭ হাজার জন। ‘ক্ষুধা রোগে’ পৃথিবীতে কতজন মানুষ প্রাণ হারায়? জাতিসংঘের খাদ্য এবং কৃষি (FAO, food and agriculture organization) দফতরের মতে প্রতিবছর পৃথিবীতে ক্ষুধায় মারা যায় প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষ, মৃতের সংখ্যা গড়ে প্রতিদিন ২৫,০০০ জন, তার মধ্যে ৮,৫০০ জন শিশু। আর কোনো রোগে এতো বেশি লোক মরে না! ‘ক্ষুধা রোগে’ মেয়েরা বেশি ভোগে। দরিদ্র, অশিক্ষিত, সুবিধা-বঞ্চিত, গর্ভবতী মায়েদের সাথে এই রোগ বিমাতাসুলভ আচরণ করে, এঁরা অনেকেই রক্ত-শূন্যতায় ভুগেভুগে অবশেষে মৃত্যুবরণ করেন। এদের মৃত্যুর শেষ দীর্ঘশ্বাসের শব্দ ক্ষমতাবানদের কানে পৌঁছায় না।

জাতিসংঘের হিসাব মতে পৃথিবীকে ক্ষুধামুক্ত করার জন্যে বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হবে। পৃথিবীর সাত কোটি ক্ষুধার্ত শিশুকে খাওয়াতে প্রতিবছর ৩.২ বিলিয়ন ডলার লাগার কথা। করোনার প্রকোপ থেকে আমেরিকার অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখা এবং গৃহবন্দী মানুষদের আর্থিক সাহায্যের জন্যে মার্কিন সরকার এ পর্যন্ড বরাদ্দ করেছেন প্রায় ৫,০০০ বিলিয়ন ডলার। ইউরোপের দেশগুলোও পিছিয়ে নেই।
২০২০ সালের জানুয়ারী মাসে ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশান (W.H.O) কোরোনাভাইরাস প্রতিরোধকে পৃথিবীজুড়ে ইমার্জেন্সি হিসাবে ঘোষণা করে। শুরু হয় ভ্যাকসিন আবিষ্কারের প্রতিযোগিতা। করোনাভাইরাসের সাথে বিজ্ঞানীদের লড়াই প্রশংসা করার মতো। পৃথিবীজুড়ে ওষুধ কোম্পানি, বিশ্ববিদ্যালয়, এবং গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা আদাজল খেয়ে লেগেছিলেন। করোনাভাইরাসকে ঠেকাবার মতো প্রায় ১২ টি ভ্যাকসিন এখন মানুষের শরীরে দেওয়া শুরু হয়েছে: Moderna, Pfizer-BioNT, BBIBP-CorV, CoronaVac, Covaxin, Sputnik V, Oxford- AstraZeneca, Convidicea, Johnson & Johnson vaccine, ইত্যাদি। আরো ৩০৮ টি ভ্যাকসিন ল্যাবরেটরিতে তৈরী করা হয়েছে, মানুষের উপরে ওদের প্রাথমিক পরীক্ষানিরীক্ষার পালা শেষ হওয়ার পথে।
মানুষের জীবন শুরু হয় ক্ষুধা এবং কান্না দিয়ে। পাকস্থলীকে বিজ্ঞানীরা দ্বিতীয় মস্তিষ্ক বলে মনে করেন।
যন্ত্রণার মোচড় দিয়ে সে সব সময় তার অস্তিত্বের কথা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়। পাকস্থলীকে খুশি
রাখতে সব প্রাণী সারা জীবন সংগ্রাম করে যায়। আইনস্টাইন একে এক দৌড় প্রতিযোগিতার সাথে তুলনা
করেছেন, যা আমাদের অনেক মানবিক অনুভূতিকে আচ্ছন্ন করে রাখে, ‌‌‘‘By the mere existence of his
stomach everyone is condemned to participate in that chase. The stomach might well be satisfied by such participation, but not man insofar as he is a thinking and feeling being.”

মানুষের ক্ষুধা কবে ইমার্জেন্সি হিসাবে গণ্য করা হবে? ক্ষুধা এক ভয়াবহ জৈবিক অনুভূতি। জঠর-জ্বালা
মানুষকে অনেক পাপ কাজ করতে বাধ্য করে। এই পাপ অনায়াসে ক্ষমা করা যায়। মানুষের ক্ষুধা নিবারণ করার চেয়ে বড় ধর্ম আর নেই। হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত অথচ সে নিজে পেটপুরে খায়, সে মুসলমান নয়।’ যীশু বলেছেন, ‘যে ক্ষুধার্তের মুখে আহার যোগান দেয়, সে যেন ঈশ্বরের মুখেই খাবার তুলে দেয়।’ অনেকদিন অনাহারে থেকে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ একদিন মোক্ষ লাভ করেন। একটি মেয়ে দৌড়ে এসে তাঁর হাতে খাবারের থালা তুলে দেয়। মেয়েটিকে বুদ্ধদেব দেবীর আসনে বসিয়েছিলেন।

এক বছরের মধ্যে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধের টিকা বের হয়ে গেল। যে কোনো ভাইরাসের মত করোনা ভাইরাসও পরিবর্তিত হয়ে বারে বারে নবরূপে আত্মপ্রকাশ করছে। বিজ্ঞানীরা তার সাথে পাল্লা দিয়ে নতুন নতুন টিকা আবিষ্কার করে চলেছেন। ক্ষুধার টিকা বের হবে কবে? ক্ষুধা যদি করোনা ভাইরাস হতো!

আরো পড়তে পারেন

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

আগের পর্বে পড়ুন— চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও একটি সার্থক গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো দেশপ্রেম থেকে জাত সেই অনুভূতি, যার একটি রাজনৈতিক প্রকাশ রয়েছে। আর, বাঙালি জাতিসত্তাবোধের প্রথম রাজনৈতিক প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দুই হাজার মাইল দূরত্বের….

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল)

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ একুশের আবেগ সংহত থাকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র….

error: Content is protected !!