Author Picture

আকেল হায়দারের একগুচ্ছ কবিতা

আকেল হায়দার

ফটোফ্রেম
.
তোমাকে ছুঁয়েছিলাম সেই কবে
ঝলমলে এক শুক্রবার সকালে;
তারপর অজস্র দিন চলে গেল
পৃথিবী সূর্যকে সহস্রবার ঘুরে এলো
সেই সকাল আর দ্বিতীয়টি এলোনা!

নিস্তরঙ্গ দুপুরে আকস্মাৎ কেঁপে উঠি
তন্দ্রাহত চোখে তোমাকে খুঁজে ফিরি
নিবিড়তায় স্পর্শবন্দী তুমিময় আমি
ফাল্গুনী রাতের মতো উপলব্দি করি!

আমাকে ছুঁয়েছিলে তুমি, সেই কবে
শীতে ডুবে থাকা এক মায়ার শহরে
তারপর অনেক বছর কেটে গেছে-
আমাদের আর দেখা হয়না
দেখা হওয়ার কোন কথাও থাকেনা।

তোমাকে আর কাছে পাইনা
চুলে মুখ ডুবিয়ে গন্ধ শুঁকিনা
বুকে হৃদপিণ্ডের কম্পন শুনিনা
তোমার শরীরে শরীর রাখিনা-
তুমিও আর কাছে আসোনা
হাতের মুঠোয় হাত রাখোনা
আহ্লাদ করে ডেকে বলনা
কাছে এসে বসো;
কথা আছে তোমার সাথে।

হায়; স্পর্শেরা কেন বেঁচে থাকেনা
স্মৃতিদের ফের কেন ছোঁয়া যায়না
আঙ্গুলগুলো যদি ফটোফ্রেম হতো
তাহলে একান্ত মুহূর্তের স্পর্শগুলো
বাঁধাই করে রাখা যেতো!


শরতের চিঠি
.
শরতের আকাশে হাঁটতে গিয়ে
তোমার কুশল নিতে ইচ্ছে হল
কোথায় আছো?
কেমন আছো?
কিচ্ছু জানিনে-
কোন রকম সূত্র নেই তার।

কাশবনের সমুদ্রে ভেসে ভেসে
সুবর্ণ কলমে তোমাকে লিখছি-
বুকের ডালে থরে থরে জমানো
সহস্র দিনের না বলা সব কথা
নীলচে মেঘের পালকে আঁকছি
খুনসুটি বোনা ফেলে আসা দিন।

ধূসর দেয়ালে চোখ মেলে দেখি
ফেরারী সূর্যের জলভেজা ছায়া,
বিস্ময়ের বিশালতা নিয়ে ভাবি
সময় বড় কঠিন হন্তারক
সহজে এলোমেলো করে দেয় সব।

তবুও কোন কোন ক্ষণ
সযত্নে তুলে রাখি
মনের গহীনে- একান্ত গোপনে
ঋতুর দোহাই দিয়ে শব্দের চোখে
নিশিদিন খুঁজে ফিরি তাকে।

তুমি এই চিঠি পাও বা না পাও
তাতে কিচ্ছু যায় আসেনা
শুধু এইটুকু জেনো-
কাশফুলের সফেদ অক্ষরে
প্রতিমুহূর্ত তোমাকে লিখছি
শরতের অফসেট পেপারে।


মুগ্ধপাঠ
.
সকাল থেকে সন্ধ্যা
সন্ধ্যা থেকে রাত্রি
রাত্রি থেকে সুবহে সাদিক
কেবল তোমাকেই পাঠ করি…

তোমাকে পাঠ করি
প্রিয় গল্পের মতো
তোমাকে পাঠ করি
প্রিয় কবিতার মতো
তোমাকে পাঠ করি
প্রিয় উপন্যাসের মতো
তোমাকে পাঠ করি
প্রিয় ধর্মগ্রন্থের মতো
প্রতিদিন, প্রতিঘন্টা, প্রতিনিয়ত…

তবুও তোমাকে পড়া শেষ হয়না আমার
হয়না জানা তোমার ডালপালার রহস্য
তোমাকে পড়ে
কখনো শেষ করা যাবেনা
তোমাকে আদ্যোপান্ত পাঠ
আমার পক্ষে
আদৌ সম্ভব নয়!


নৈর্ব্যক্তিক
.
ফের যদি ফিরে যাওয়ার বাহানা তোলো
জেনো, এতটুকু অবাক হবনা
সমুদ্রবোনা দুটি আহত চোখ
ভগ্নাংশের মতো ছিন্নভিন্ন মন
সহস্র রাত্রির ঘুমহীন প্রলাপ
মুখ ফুটে আর কিছু বলবেনা।

ফের যদি ফিরে যাওয়ার বাহানা তোলো
জেনো, এতটুকু দুঃখ পাবনা
গুমোট কষ্টে বোনা মুমূর্ষু ঘড়ি
ডানা ভাঙা পাখির বোবা কান্না
ফেরারী সময়ের বিবর্ণ ডায়েরি
চুপ হয়ে যাবে আজীবনের জন্য।

ফের যদি ফিরে যাওয়ার বাহানা তোলো
জেনো, এতটুকু ব্যথিত হবনা
সময়ের কাঁধে প্রেতাত্মার হাসি
সুন্দরের ভাষায় মিথ্যে প্রহসন
ফিকে হয়ে আসা যোগাযোগে
ইচ্ছে হননে মুক্তি খুঁজে নেবে।

ফের যদি ফিরে যাওয়ার বাহানা তোলো
জেনো, এতটুকু বিচলিত হবনা
দূরত্ব ও বিভাজনের গ্লানি ছাড়া
আর কি বা দিতে পারো তুমি
এর অধিক কি-বা আছে তোমার
এরচে বেশী কি-বা দিয়েছো তুমি!


দুহান
.
আমাকে ভুলেছো তুমি-
ভুলেছো রাত জাগা সুর
যা কিছু কথা পাখি হয়েছিল
ছায়া ফেলে উড়ে গেছে দূর।

আমাকে ভুলেছো তুমি-
ভুলেছো ভর দুপুরের ছবি
ইচ্ছেরঙা ঠোঁটের ইজেলে
পোট্রেট হয়ে জেগেছিল স’বি।

আমাকে ভুলেছো তুমি-
ভুলেছো প্রিয় বিকেলের রোদ
মৌন উঠোনে ঘুম দরোজায়
উঠেছিল জেগে কোকিলের বোধ।

আমাকে ভুলেছো তুমি-
ভুলেছো হিম সন্ধ্যার গান
মৌনতা বোনা শিরিষের ডালে
ভালোলাগা এসে করেছিল স্নান।

আমাকে ভুলেছো তুমি
ভুলেছো উষ্ণতা বোনা রাত
বুকের ভেতর নৌকা রাখা নদী
জোছনাঝিলে আঙ্গুল ছোঁয়া হাত।


এক বিকেলে তুমি
.
একদিন বিকেলের সোনালি রোদে আমাদের দেখা-
আল্পনা আঁকা মেঘের ডানায় আকাশের ঝুল বারান্দায়।
দুজন মুখোমুখি বসি-
অতঃপর কথার নদীতে ভেসে ভেসে যাই
অনুভবের সমুদ্রে এলোমেলো ডুবি
অপলক তাকিয়ে কেবল তোমাকে দেখি
তুমি দেখো বাগানবিলাসে মগ্ন আমাকে।

বিস্তৃত অঞ্চলে সবুজ ভূমিতে তুমি
তরুণী রঙধনুর মতো হাসতে থাকো
আমার চোখের দীঘল দিগন্ত জুড়ে,
আমি মুগ্ধ দর্শক অনিমিখ তাকিয়ে দেখি
তোমার চোখ, মুখ, ঠোঁটের লাবণ্য কুঁড়ি
প্রতিটা মূহূর্ত কীভাবে ফুল হয়ে ফুটছে
এই বিকেলে, আমার বুকের বেল্কনিতে।

অচেনা নদীর স্রোতে ডুবি আর ভাসি
দিকভুল পাখি হয়ে দূরাকাশে উড়ি।
কথারা শিশিরের মতো টুপটাপ ঝরে
রাতের স্রোতে চাঁদটা ভেসে যায় দূরে
অস্তগামী হয় ঘড়ির কাঁটা, প্রহর বয়ে যায় দ্রুত
থাকেনা উদ্বৃত্ত সময় আমাদের হাতে।

এবার যেতে হবে-
কিন্তু মন ছাড়তে চাইছেনা কিছুতেই!
ইচ্ছে জাগে পোষা পাখি করে রেখে দিই তারে
সারাদিন আত্মার খাঁচায় থাকুক আর ডাকুক প্রিয় নাম ধরে।
অজস্র দিন পর তুমি এলে তাই
উল্লাসে বিমোহিত মনের শহর
এতোদিন কোথায় ছিলে তুমি!
তোমাকে খুঁজেছি কতো হাজার বছর।


কথা ছিল
.
কথা ছিল-
তোমার উদ্যানে প্রতিদিন রুটিন করে হাঁটবো
তুমি বললে আমার অরণ্য নিবিড় ঘন
পথ হারিয়ে ফেলেন যদি!

কথা ছিল-
তোমার রুপালী পদ্মায় দীর্ঘ ডুবসাঁতার দেবো
তুমি বললে আমার পদ্মা অথৈ গভীর
স্রোতে ভেসে যান যদি!

কথা ছিল-
সকাল সন্ধ্যা তোমার দু’মেরু প্রদক্ষিণ করবো
তুমি বললে আমার মেরুতে ভীষণ তুষারপাত
আপনার সহ্য না হয় যদি !

কথা ছিল-
তোমার শরীর থেকে শৈত্যপ্রবাহে উষ্ণতা নেবো
তুমি বললে আমার শরীর অগ্নিগর্ভা
জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যান যদি!

কথা ছিল-
ঝুম বর্ষায় পাহাড় হয়ে তোমাকে বুকে জড়াবো
তুমি বললে আমার বুকে তীব্র ভূমিকম্প
ভীতসন্ত্রস্থ হন যদি!

কথা ছিল কতো কিছুই-
আমাদের পূর্ণ হয়নি তার সিঁকিভাগও
স্বপ্নগুলো এখন চৈতী হাওয়ায় ওড়ে আর
যোজন যোজন দূরত্ব নিয়ে আমরা
কেবল স্মৃতির মলাট বুনি।


পঙ্খীরাজ
.
তুমি যেমন জানো
তেমনি আমিও জানি
আমরা কখনো একে অন্যের হবোনা
কেউ কাউকে কোনদিন পাবোনা।
কি-বা করার আছে তাতে-
মাঝপথে যদি মন বদল হয়
দুটি মন যদি সারাক্ষণ পড়ে থাকে পৃথক পাড়ায়
সেখানে কি-বা করার থাকে!
শরীর; সেতো বাচ্চাদের মতোই অবুঝ
তার আবদারের কোনো সীমারেখা নাই
তীব্র এক আকর্ষণে-
তোমাতে বার বার মিশে যেতে চায়;
কখনো একমুঠো পায় কখনো হারায়।
তবুও-
পরিবার কিংবা সমাজের চোখ বেঁধে
মিশে থাকি যদি; কি বা ক্ষতি তাতে!
মনের বারান্দায় মন গেঁথে রাখি
অন্ধ সৈকতে পথ হাঁটি একসাথে।

আরো পড়তে পারেন

সুলতানা নাছিরা হীরার একগুচ্ছ কবিতা

বিরুদ্ধ সময় একেকটা দিন কী বীভৎস হয়েই না আসে! বীভৎস সময়, বীভৎস মন, বীভৎস মানুষ, বীভৎস সভ্যতা! মধ্যাহ্নের প্রাখর্যকে কম্পমান পর্দা বানিয়ে ভয়ার্ত রাজহাঁসের মতো চিৎকার করতে করতে ছুটে গেল একটা অ্যাম্বুলেন্স। এই গাড়িটার ভেতর আপাতত আশ্রয় পেলে বেঁচে যেতাম। ভীষণ বিরুদ্ধ সময়! এই বিরুদ্ধতার কথা জানে ঘরের চার দেয়াল, শূন্য বারান্দা, জীর্ণ দেয়াল ঘড়ি,….

রিয়াসাত আল ওয়াসিফের একগুচ্ছ কবিতা

রেট্রোসপেক্টিভ বই সাজাতে সাজাতে জনৈক কবির মনে হলো— এত এত বই কবে পড়ব! এই ফোকাস হারানো সময়ে মানুষ যেন গুড়ো গুড়ো কাচ। হঠাৎ তাঁর মনে হলো বই বাদ দিয়ে আজ বরং পাপগুলোকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা যাক। কতদিন দেখেনি দেখতে চায়নি, দেখা হয় না, দেখা যায় না। যাপিত জীবনের কাদায় শুধু মুখ ঢেকে যায়। মুখ….

সাযযাদ আনসারীর একগুচ্ছ কবিতা

ঋতু রমনী অন্তহীন পথের মত ছিলো ঋতু রমনী চেনা পাতা ও পাখি থেকে অচেনা ফুলের পথে চলে গেল সে। কথা ছিলো তার সাথে রাগ-রাগিনীর কথা ছিলো অসংখ্য পত্র-পল্লবীর, কথা ছিলো আমাদের নাম উড়াবার কথা ছিলো কত কথা দেবার নেবার। এই খানে আমাদের মন অন্ধ অধীর এই খানে না বাঁধা ঘাট জীবন নদীর, এই খানে পথে….

error: Content is protected !!