Author Picture

আমি অ্যালিস মুনরোর মতো লিখি না, তবে আমি তার মতো বাঁচতে চাই: শীলা হেতি

মেজবাহ উদদীন

ক্যানাডিয়ান লেখক এলিস মুনরো ছোটগল্পের জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত। তার লেখার স্বতন্ত্র শৈলী এবং গভীর মানবিক অর্ন্তদৃষ্টি তাকে সমসাময়িক সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তিনি ২০১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন, যা তার অসাধারণ লেখনীশক্তির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

কানাডার অন্টারিও প্রদেশের উইংহাম শহরে জন্ম নেওয়া মুনরোর তরুণ বয়স থেকেই ছোটগল্প লেখা শুরু করেন। তাঁর গল্পগুলো প্রধানত কানাডার ছোট শহর এবং গ্রামের মানুষের জীবন নিয়ে, যা সহজেই পাঠকের মনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। মুনরো গভর্নর জেনালের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনবার। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ‘ড্যান্স অব দ্য হ্যাপি শেডস’, ১৯৭৮ সালে ‘হু ডু ইউ থিংক ইউ আর’ এবং ১৯৮৬ সালে ‘দ্য প্রোগ্রেস অব লাভ’ বইয়ের জন্য। তিনি কানাডার সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কারও পেয়েছেন। ‘দ্য বেয়ার কাম ওভার দ্য মাউন্টেন’ বইয়ের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেলের পর সর্বোচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ম্যান বুকার পুরস্কার পেয়েছেন ২০০৯ সালে। তাঁর এই বই অবলম্বনে পরিচালক সারাহ পলি তৈরি করেন সিনেমা অ্যাওয়ে ফ্রম হার।

এলিস মুনরোর লেখার শৈলী খুবই সহজ এবং সরল, কিন্তু তার গল্পের চরিত্র এবং ঘটনা এমনভাবে বিবৃত হয় যা পাঠকের মনে গভীর প্রভাব ফেলে। তার গল্পগুলোর প্রধান থিমগুলোর মধ্যে রয়েছে — মানব সম্পর্ক, গ্রামীণ জীবন, সমাজ ও নারীবাদ। এলিস মুনরো তার অসাধারণ গল্পগুচ্ছের মাধ্যমে সাহিত্যের জগতে একটি অমর অবস্থান তৈরি করেছেন। তার গল্পগুলো মানব জীবনের গভীরতা এবং জটিলতা তুলে ধরে, যা পাঠকদের মুগ্ধ করে এবং চিন্তার খোরাক যোগায়।

যেখানে সব আছে আবার কিছুই নেই, এমন অ্যারিথমেটিকের নামই জীবন। এমন জীবনে প্রেমিকের মতো শান্ত চরণে নেমে আসে মৃত্যুর অভিঘাত। জীবনের বিপরীতপ্রান্তে বেড়ে ওঠা এই মৃত্যুর কাছেই থেমে যায় কলমের আচঁড়। ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে লিখে চলা এলিস মুনরোর কলম সম্প্রতি থেমে গেছে ৯২ বছর বয়সে। এলিস মুনরোর এই চলে যাওয়া নিয়ে পুরস্কার জয়ী আরেক ক্যানাডিয়ান লেখক শীলা হেতি নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ যে কলাম লিখেছেন সেটা ভাষান্তর করেছেন মেজবাহ উদ্দিন —

 

সাধারণভাবে বলা হয় যে ‘এটা শুনে আমার হৃদয় ভেঙে গিয়েছে’ যে অমুক মারা গেছে। কিন্তু অ্যালিস মুনরোর মৃত্যু সম্পর্কে জানতে পেরে আমার  হৃদয় সত্যিই ভেঙে গেছে। একজন লেখক হিসেবে, তিনি তাঁর জীবন এবং শিল্পে এটা প্রতিষ্ঠিত করেছেন যে, প্রত্যেককে অবশ্যই আবেগপূর্ণ আন্তরিকতা ও সূক্ষ্মতা এবং একাগ্রতা ও গভীরতার সাথে কাজ করতে হবে — সব ধরণের লেখায় না হলেও যে ধরনের লেখা লেখকের হৃদয়ের সবচেয়ে কাছাকাছি সে ধরণের লেখায় অবশ্যই চাই। তিনি দীর্ঘদিন ধরে অনেক লেখকের জন্য পথ নির্দেশক তারকা ছিলেন এবং এমন একজন ছিলেন যাকে আমি সর্বদা নিজের গাইড মনে করতাম। আমাদের দু’জনের লেখার ধরণ আলাধা, কিন্তু আমি তাকে  কয়েক দশক ধরে প্রতিদিন মনে করেছি।

একজন কথাসাহিত্যিক এমন কেউ নন যিনি যেকোনো কিছু লিখতে পারেন— সিনেমা, নিবন্ধ, মৃত্যু সংক্রান্ত খবর! তিনি ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র, প্রকাশক বা এমনকি তার শ্রোতাদের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি নন। তাকে এখনকার রাজনৈতিক ইস্যুতে বা সংস্কৃতির গুরুত্বের বিষয়ে কথা বলতে হবে না; তবে তাকে তার কাজটিতে গুরুত্ব সহকারে উপস্থিত হওয়া উচিত, যা তার একমাত্র কাজ। আর এই বিশেষ জিনিসটি লেখার বিষয়ে মুনরো ছিলেন সবচেয়ে উপযুক্ত।

জনসমক্ষে একজন লেখকের কেমন হওয়া উচিত মুনরো ছিলেন তার উদাহরণ: বিনয়ী, নজিরবিহীন, মজার, উদার এবং দয়ালু। উদারতার পাঠ প্রথম দিকে আমি তার কাছ থেকে শিখেছি

মুনরো শুধুমাত্র ছোটগল্প লিখেছেন, উপন্যাস নয়; যদিও তাঁর কাছে উপন্যাসের দাবী ছিল। তিনি একটি ছোট একটি শহরে মারা গিয়েছেন, যেখানে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন তার থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তিনি যে ধরণের লোকদের সাথে বেড়ে উঠেছেন তাদের কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলেন; যাদের সম্পর্কে তিনি সর্বদা কৌতূহলী ছিলেন।

মনে করা হয় যে, কথাসাহিত্যিকরা হচ্ছেন মানুষ, যাদের অবশ্যই কিছু বলার আছে; কারণ তারা শব্দগুলোর সাথে খুব ভালোভাবে পরিচিত। তাই লোকেরা সর্বদা তাদের জিজ্ঞাসা করে: আপনি কি এই সম্পর্কে কিছু বলতে পারেন? কিন্তু একজন কাল্পনিক ব্যক্তির কণ্ঠস্বর শোনার বা কাল্পনিক জগৎকে অনুধাবন করা বা অকল্পনীয় কিছু সৃষ্টির ওপর বছরের পর বছর ধরে কাজ করার শিল্পীর আসলে নিজের মতামত বাস্তব জ্ঞানের বিপরীত। এটি বরং নিজের মতামত এবং অহংকে একপাশে রেখে আপনার মাধ্যমে কিছু বলার নম্র নৈপুণ্য। মুনরো এই বিভক্তিকে ধরে রেখেছেন এবং কথায় ভাল হওয়ার সাথে যে অসারতা আসতে পারে তা তাকে সর্বত্র, সম্ভাব্য সব উপায়ে তাঁর মতামতকে গোপন রাখতে প্ররোচিত করত।

জনসমক্ষে একজন লেখকের কেমন হওয়া উচিত মুনরো ছিলেন তার উদাহরণ: বিনয়ী, নজিরবিহীন, মজার, উদার এবং দয়ালু। উদারতার পাঠ প্রথম দিকে আমি তার কাছ থেকে শিখেছি। আমার বয়স যখন ২০ এবং সবেমাত্র ছোট গল্প প্রকাশ করা শুরু করছিলাম, আমি তাকে একটি ফ্যান চিঠি পাঠিয়েছিলাম। আমার চিঠিতে কি লেখা ছিল মনে নেই। কয়েক মাস পর, আমি মেইলে তাঁর কাছ থেকে একটি হাতে লেখা ধন্যবাদ নোট পেয়েছি। তিনি আমার চিঠির উত্তর দিয়েছিলেন এবং এত যত্ন সহকারে তা করেছিলেন, সেটা আমাকে করুণা এবং বিবেচনা সম্পর্কে অনেক কিছু শিখিয়েছিল এবং সেই দিন থেকে আমার মধ্যে একটি ভালোলাগা রয়ে গেছে।

তিনি আমার এবং আরও অনেকের জন্য সবসময় থাকবেন, সেই কবরের মডেল হয়ে যেটা এখনও শিল্পের প্রতি আনন্দদায়ক উত্সর্গ। তিনি বিশ্বকে যা দিয়েছেন তার জন্য এবং এটি দেওয়ার জন্য তিনি যে সমস্ত ত্যাগ স্বীকার করেছেন তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। ধন্যবাদ, অ্যালিস মুনরো।

 

সূত্র: নিউ ইয়র্ক টাইমস

আরো পড়তে পারেন

চোখ মানুষের জীবনের গল্প ধারণ করে: বেরিশা আলিসদোত্তি

দক্ষ ছায়াপুতুল নাচিয়ের জন্য অন্ধকারই প্রধান প্রেক্ষাপট। আলো সেখানে এক ‘ভাইটাল নেগেটিভ’। আলবেনিয়ান নারীবাদী চিত্রশিল্পী ফিতোরে বেরিশা আলিসদোত্তি তেমনি। নিজে নারী স্বাধীনতা ভোগ করলেও নির্যাতনের অন্ধকারে বন্দি নারীই তার শিল্পের বিষয়বস্তু। যদিও নিঃসঙ্গতার ‘মুদ্রাদোষ’ তার ছিল; তবুও সমাজের চোখরাঙানিকে অগ্রাহ্য করে নির্মাণ করে যাচ্ছেন অন্য এক সাঁকো। যেন প্রতিবাদের ‘এন্টিবডি’ ছড়িয়ে দিচ্ছেন সমাজের শিরায়। আর….

মুখোমুখি: আন্দ্রেজ আল-আসাদি

১৯৯৭ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করা আন্দ্রেজ আল-আসাদি বর্তমান সময়ে মেসিডোনিয়ান ভাষায় লেখালেখি করা প্রধানতম তরুণ কবিদের অন্যতম। তার বহুসাংস্কৃতিক পটভূমি এবং তার ও অন্যান্য সমসাময়িক মেসিডোনিয়ান কবিদের কাজকে অনুপ্রাণিত করার প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন ব্রিটিশ-আমেরিকান সাহিত্যিক অনুবাদক পিটার কনস্টানটাইনের সাথে। ওয়ার্ল্ড লিটারেচার টুডে কর্তৃক প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদ্দিন আপনার জন্ম লন্ডনে, আপনার….

মাহমুদ দারবিশের ডায়েরি ‘নদী মরে যায় পিপাসায়’— (পর্ব: ২)

মেয়েটি আর তার চিৎকার সমুদ্রতীরের মেয়েটি, যার একটি পরিবার আছে আর সেই পরিবারটির একটি বাড়িও আছে। বাড়িটির মধ্যে দুটি জানালা আর একটি দরজা আছে। সমুদ্রে একটি যুদ্ধজাহাজ মজার ছলে তীরে হাটাহাটি করতে থাকা লোকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে: চার, পাঁচ, সাত জন বালির উপর পড়ে যায়। একটি অস্পষ্ট ঐশ্বরিক হাতের সাহায্যে মেয়েটি কিছুক্ষণের জন্য কোন প্রকারে….

error: Content is protected !!