Author Picture

সাহিত্য সম্পূর্ণরূপে ফর্মের বিষয়: জন ফস

মেজবাহ উদদীন

পুড়ছে পৃথিবী। অন্তরীক্ষে কাঁপছে তার ছায়া। অথচ তাঁর লেখায় কোনো আগুন নেই! রয়েছে জ্যোৎস্নার ইন্ধন। আর তাতে সেঁকেই নিজেদের উত্তাপ প্রস্তুত করার চেষ্টা চলে পাঠকের অন্তরজুড়ে। বলছি ২০২৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাওয়া নরওয়ের লেখক জন ফসের কথা। ফসের সাহিত্যকর্ম ৪০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সমসাময়িক নাট্যকারদের একজন হিসেবে বিবেচিত। দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের সেরা ১০০ জীবন্ত প্রতিভাবানদের তালিকায় আছেন ফস। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি, শিশুসাহিত্যিক ও অনুবাদক। কিন্তু নাট্যকার হিসেবে সর্বাধিক পরিচিত তিনি। কয়েক দশকের দীর্ঘ কর্মজীবনে তাকে কখনও হেনরিক ইবসেন, ফ্রাঞ্জ কাফকা, টমাস বার্নহার্ড, জর্জ ট্র্যাকলের, স্যামুয়েল বেকেট, এমনকি বিটলসের জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে।
২৯ সেপ্টেম্বর ফসে তাঁর ৬৫তম জন্মদিনের আগে দ্য বুকার প্রাইজকে যে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন সেটা অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদ্দিন


আপনার ‘সেপ্টোলজি’ সাতটি খণ্ডে লেখা হয়েছে আপনার নিজস্ব শৈলীতে, এবং বলা যেতে পারে একটি সাত-পর্বের উপন্যাস একটি মাত্র বাক্যে লেখা হয়েছে। একটু ব্যাখ্যা করতে পারেন কী আপনাকে উপন্যাসটির এমন গঠনে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং আপনি কীভাবে এটি পাঠকের কাছে আনতে চেয়েছিলেন? 

: আমি লেখা শুরু করার আগেই কোনো কিছু পরিকল্পনা করতে পছন্দ করি না। একসময় আমার মনে হচ্ছিল উপন্যাসটি ইতোমধ্যেই লেখা হয়েছে, এবং আমাকে কেবল এটি লিখে রাখতে হবে এটি হারিয়ে যাওয়ার আগেই। লেখার সময়, আমার নিজেকেই চমকে দিতে হবে, এমন কিছু তৈরি করতে হবে যা আগে জানতাম না, যেমন চরিত্র ও গল্প। যখন ‘সেপ্টোলজি’ লিখতে শুরু করলাম, তখন ফুল স্টপ ছাড়াই উপন্যাসটি লেখার আমার কোনো পরিকল্পনা ছিল না, কিন্তু লেখার সময় আমি এমন একটি ফ্লোতে প্রবেশ করেছিলাম যেখানে কোনো ফুল স্টপের প্রয়োজন ছিল না। বরং, ফুল স্টপ সেই ধারাটিকে ক্ষতিগ্রস্ত করত।

‘দ্য আদার নেম’-এর ভাষাও গভীরভাবে কাব্যিক এবং ছন্দময়। আপনার কবিতা ও মঞ্চের জন্য লেখার যে ব্যাকগ্রাউন্ড সেটা কীভাবে উপন্যাস লেখার সময় আপনাকে প্রভাবিত করে?

: আমি কিশোর বয়সেই লেখালেখি শুরু করি, এবং তখন আমি গিটার বাজাতাম, ইলেকট্রিক এবং ক্লাসিকাল গিটার উভয়ই। এরপর হঠাৎ করে গিটার বাজানো বন্ধ করে দিয়ে লেখালেখি শুরু করি, এবং যখন লিখতাম তখন আমি কোনোভাবে সেই পরিবেশ বা আবহ পুনরায় সৃষ্টি করতে চেষ্টা করতাম যেমনটা গিটার বাজানোর সময় তৈরি হতো। আমি মনে করি এটি আমাকে ভাষার সঙ্গীতময় দিকের দিকে নিয়ে গিয়েছিল, বিশেষ করে একটি নির্দিষ্ট ছন্দে লেখা, ব্যপকঅর্থে— ভাষার কাব্যিক ব্যবহারের দিকে। আমি থিয়েটারের জন্য প্রচুর লিখেছি, এবং এটি অবশ্যই আমার কথাসাহিত্যে প্রভাব ফেলেছে। আমি মনে করি আমার সংলাপগুলো এখন অনেক ভালো, যা আমি থিয়েটারের জন্য লেখার আগে ছিল না। একই কথা পরিস্থিতি স্থাপনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

অস্তিত্ববাদ, পরিচয়, বিশ্বাস, সময়ের প্রবাহ এবং আমাদের বিকল্প সংস্করণগুলো আপনার কাজে পুনরাবৃত্তিমূলক থিম। কী আপনাকে এই থিমগুলোর দিকে টানে এবং আপনার কাজের মাধ্যমে পরিচয় অনুসন্ধান করতে উদ্বুদ্ধ করে?

: যেমন আমি আগেই বলেছি, আমি পরিকল্পনা করে কিছু লিখি না, এবং আমি কী লিখছি তাও ঠিক করে লিখি না। এটি কেবল ঘটে যায়। বেকেট (স্যামুয়েল বার্কলে বেকেট— আইরিশ ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, ছোট গল্প লেখক, থিয়েটার পরিচালক, কবি) বলেছিলেন, তিনি কোনো কিছু সম্পর্কে লেখেন না, এবং আমিও একই কথা বলতে পারি। আমি যা লিখছি তা ফর্মে’র অংশ, অথবা হয়তো ফর্মে’র সাথে অভিন্ন। আমার কাছে সাহিত্য সম্পূর্ণরুপে ফর্মের বিষয়। তবে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে, আমিও কিছু সম্পর্কে লিখি যেটা উল্লিখিত বিষয় এবং আরও অনেক কিছুর সাথে সম্পর্কিত। হয়তো নিটশে (ফ্রেডরিক নিটশে) ঠিকই বলেছিলেন, লেখকের কাছে যা ফর্ম পাঠকের কাছে তা বিষয়বস্তু। আমি দর্শন শিখেছি, বিশেষ করে মার্টিন হাইডেগার-এর ‘বিইং অ্যান্ড টাইম’র ওপর মনোযোগ দিয়েছিল। এটি অস্তিত্ববাদের অন্যতম প্রধান কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়, এবং এটি আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। আমি মনে করি অন্য কোনো উপন্যাসের চেয়ে হাইডেগার-এর দর্শনই আমার লেখায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে।

আমি পরিকল্পনা করে কিছু লিখি না, এবং আমি কী লিখছি তাও ঠিক করে লিখি না। এটি কেবল ঘটে যায়। বেকেট বলেছিলেন, তিনি কোনো কিছু সম্পর্কে লেখেন না, এবং আমিও একই কথা বলতে পারি। আমি যা লিখছি তা ফর্মে’র অংশ, অথবা হয়তো ফর্মে’র সাথে অভিন্ন। আমার কাছে সাহিত্য সম্পূর্ণরুপে ফর্মের বিষয়

আপনি দুইবার আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন এবং ‘নির্বাককে কণ্ঠ দেওয়ার উদ্ভাবনী নাটক এবং গদ্যের জন্য’ ২০২৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার জিতেছেন। প্রথম নরওয়েজিয়ান লেখক হিসেবে আপনি এই পুরস্কার জিতেছেন। আপনার কাছে এই ধরনের প্রশংসার মানে  কি? এই পুরস্কার কি আপনাকে ‘সেপ্টোলজি’ সম্পর্কে ভিন্নভাবে ভাবতে বাধ্য করে? এই পুরস্কার কি নরওয়েতে এবং বিশ্বব্যাপী আপনার কাজের গ্রহণযোগ্যতায় কোনো পরিবর্তন এনেছে?

: যখন আমি ‘সেপ্টোলজি’ লিখছিলাম, তখন আমি ভেবেছিলাম এটি খারাপভাবে গ্রহণ করা হবে। কিন্তু ঘটল এর বিপরীত, এটি ভালোভাবে গ্রহণ করা হলো, শুধুমাত্র নরওয়েতে নয়, অন্যান্য অনেক দেশেও। আমি ‘সেপ্টোলজি’-এর সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া দেখে আমি অবাক হয়েছি। এবং এখন, এই দীর্ঘ উপন্যাসটি লেখার পর, আমি অবশ্যই লেখালেখি চালিয়ে যাব, তবে আমি নিজেকে প্রতিযোগিতায় নামাতে চাই না। ‘সেপ্টোলজি’-র পর আমার প্রথম গদ্যগ্রন্থ হলো উপন্যাস ‘এ শাইনিং’। এবং এরপর আমি দুটি নাটকও লিখেছি।

একটি বই সম্পর্কে বলুন যেটা আপনাকে লেখক হতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এটি কীভাবে আপনাকে আপনার নিজের সৃজনশীল যাত্রায় অনুপ্রাণিত করেছে, এবং এটি কীভাবে একজন লেখক হিসেবে আপনার লেখার শৈলী বা উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে প্রভাবিত করেছে?

: এমন কোনো বই নেই। যখন আমি খুব ছোট ছিলাম এবং লেখালেখি শুরু করেছিলাম, তখন আমার লেখক হওয়ার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। আমি লেখালেখি করতে ভালোবাসতাম, কিন্তু আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল কোনো স্থানীয় পত্রিকার সাংবাদিক হওয়া। কিন্তু তারপর আমি আমার প্রথম উপন্যাস লিখলাম, যখন আমার বয়স ২০, এবং হঠাৎ আমি একজন লেখক হয়ে গেলাম। এবং তারপর থেকে আমি কেবল লিখেই চলেছি। থিয়েটারের ক্ষেত্রেও একই, আমি সত্যিই থিয়েটারের জন্য লিখতে চাইনি, তবে আমি একটি কমিশন পেয়েছিলাম, আমার তখন অর্থের প্রয়োজন ছিল, এবং আমার প্রথম নাটক ‘সামওয়ান ইজ গোয়িং টু কাম’ লিখলাম। এটি এখনও আমার সবচেয়ে বেশি প্রযোজিত নাটক।

আমার কিশোর বয়সে আমি খুবই বিদ্রোহী ছিলাম, আমি স্কুলকে বিশেষভাবে ঘৃণা করতাম, এবং তারপর আমি নরওয়েজিয়ান লেখক জেনস বিওর্নবোর-এর উপন্যাস ‘জোনাস’ পড়লাম, যেখানে তিনি নরওয়েজিয়ান স্কুল ব্যবস্থার সমালোচনা করেছিলেন। এটি আমার কাছে পরম সান্তনার ছিল

একটি বই সম্পর্কে বলুন যেটা পড়ার প্রতি আপনার ভালোবাসা তৈরি করেছিল। এটি কীভাবে একজন কিশোর বা প্রাপ্তবয়স্ক তরুণ হিসেবে আপনাকে বা আপনার দৃষ্টিভঙ্গিকে আকার দিয়েছিল?

: আমার কিশোর বয়সে আমি খুবই বিদ্রোহী ছিলাম, আমি স্কুলকে বিশেষভাবে ঘৃণা করতাম, এবং তারপর আমি নরওয়েজিয়ান লেখক জেনস বিওর্নবোর-এর উপন্যাস ‘জোনাস’ পড়লাম, যেখানে তিনি নরওয়েজিয়ান স্কুল ব্যবস্থার সমালোচনা করেছিলেন। এটি আমার কাছে পরম সান্তনার ছিল। আমি এই উপন্যাসে খুব বেশি সাহিত্যিক মূল্য দেখতে পাই না। তবে একই সময়ে আমি তারজেই ভেজাস-এর উপন্যাসগুলো পড়েছি, যেখানে ছিল ‘দ্য বার্ডস’, এবং সেইসাথে কান্ট হ্যামসুনের ‘হাঙ্গার’, যা আমাকে তখনও এবং এখনো গভীরভাবে প্রভাবিত করে।

এমন কোনো বই আছে যা উপন্যাস সম্পর্কে আপনার চিন্তা করার ধরণকে বদলে দিয়েছে, একটি বই যা আপনাকে সাহিত্যে নতুন সম্ভাবনার কথা ভাবতে বাধ্য করেছে, বা একজন লেখক হিসেবে আপনার নিজস্ব দিগন্তকে প্রসারিত করেছে?

: এভাবে বলতে গেলে হয়তো উইলিয়াম ফকনারের ‘দ্য সাউন্ড অ্যান্ড দ্য ফিউরি’র কথা বলা যায়। কিছুদিন আগে যখন আমি বইটি আবার পড়তে নিয়েছিলাম, তখন আমি এই উপন্যাসকে নিজের মতো অনুভব করছিলাম।

আপনি বর্তমানে কোন বইটি পড়ছেন এবং আপনি এটি কেন বেছে নিয়েছেন?

: আমি দান্তের ‘ডিভিনা কমেডিয়া’ পড়ছি, কতবার পড়ছি তা জানি না। কারণ এই গ্রীষ্মের শুরুতে আমাকে ‘দান্তেস লরেল’ পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল, র‌্যাভেনার সেই চার্চে যেখানে দান্তে সমাহিত আছেন।

এমন কোনো বইয় কি আছে যেটার কাছে আপনি বারবার ফিরে যেতে চানÑ পুরনো কোনো কাজ বা ক্লাসিক যা আপনি বহুবার পড়েছেন? কী সেই বইয়ের প্রতি আপনাকে বারবার টেনে আনে? আপনি কি প্রতিবার সেই বইয়ে নতুন কিছু খুঁজে পান?

: ডিভিনা কমেডিয়া। আমার ধারণা এটি এমন একটি বই যেটি আমি বোঝার চেষ্টা করছি, এবং বারবার চেষ্টা করছি। আরেকটি বই অবশ্যই বাইবেল।

সূত্র: দ্য বুকার প্রাইজ

আরো পড়তে পারেন

ক্যালিডোনিয়া বুকস নামে একটি দোকানে আমার সমস্ত টাকা খরচ করতাম: স্টুয়ার্ট মারডক

স্টুয়ার্ট মারডকের লেখাগুলো পড়তে পড়তে মনে হয় ঠিক যেন পাশে বসে কেউ কথাগুলো বলছেন। বিদ্যায়তনিক গাম্ভীর্য সরিয়ে রেখে পাঠকের সঙ্গে এই লেখক যেন একেবারে ব্যক্তিগত আলাপন রচনা করেছেন। স্মৃতি, অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, উপলব্ধি, মন্তব্য সব মিলিয়ে লেখা মারডকের বইগুলো বহু সংখ্যক পাঠকের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে তাকে। তাঁর শৈলীর জাদুতেই তিনি কথার স্থাপত্যের ভার কমিয়ে দিয়েছেন। অসম্ভবের….

আমার লেখালেখি এবং আমার প্রশ্নগুলো একে অপরের সাথে জড়িত: হান ক্যাং

স্বার্থপরতার গল্পে মোড়ানো জীবনের পাতায় পাতায় অসুখ। তবু জীবনের কাছে বাড়তে থাকা দায় শোধে মনোযোগী যারা, হান ক্যাং তাদেরই দলে। দক্ষিণ কোরিয়ান এই ঔপন্যাসিক, শিশু সাহিত্যিক, কবি জিতে নিয়েছেন ২০২৪ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার। মানব জীবনের দুঃখ-কষ্ট কাব্যিকভাবে রূপায়ন করার স্বীকৃতি হিসেবে হান ক্যাংকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম সাহিত্যিক হিসেবে হান ক্যাং….

মুখোমুখি: আন্দ্রেজ আল-আসাদি

১৯৯৭ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করা আন্দ্রেজ আল-আসাদি বর্তমান সময়ে মেসিডোনিয়ান ভাষায় লেখালেখি করা প্রধানতম তরুণ কবিদের অন্যতম। তার বহুসাংস্কৃতিক পটভূমি এবং তার ও অন্যান্য সমসাময়িক মেসিডোনিয়ান কবিদের কাজকে অনুপ্রাণিত করার প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন ব্রিটিশ-আমেরিকান সাহিত্যিক অনুবাদক পিটার কনস্টানটাইনের সাথে। ওয়ার্ল্ড লিটারেচার টুডে কর্তৃক প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদ্দিন আপনার জন্ম লন্ডনে, আপনার….

error: Content is protected !!