দক্ষ ছায়াপুতুল নাচিয়ের জন্য অন্ধকারই প্রধান প্রেক্ষাপট। আলো সেখানে এক ‘ভাইটাল নেগেটিভ’। আলবেনিয়ান নারীবাদী চিত্রশিল্পী ফিতোরে বেরিশা আলিসদোত্তি তেমনি। নিজে নারী স্বাধীনতা ভোগ করলেও নির্যাতনের অন্ধকারে বন্দি নারীই তার শিল্পের বিষয়বস্তু। যদিও নিঃসঙ্গতার ‘মুদ্রাদোষ’ তার ছিল; তবুও সমাজের চোখরাঙানিকে অগ্রাহ্য করে নির্মাণ করে যাচ্ছেন অন্য এক সাঁকো। যেন প্রতিবাদের ‘এন্টিবডি’ ছড়িয়ে দিচ্ছেন সমাজের শিরায়। আর আশ্চর্য সহজাত দক্ষতায় নির্মাণ করে চলছেন ‘গোল্ডেন লাভ’, ‘ব্রেকিং সাইলেন্স’, ‘বার্ডওমেন’, ‘আন্দ্রাত ই থিয়েরা’র মতো একের পর এক মাস্টারপিস। তিনি যেন আসলে কবিতাই লিখতে চেয়েছিলেন ……..। কসোভো এবং আইসল্যান্ডে নিজের সময়কে ভাগ করে নেওয়া এ আলবেনিয়ান নারীবাদী চিত্রশিল্পীর কাজ মানবাধিকার লঙ্ঘনকে উন্মোচিত এবং নিন্দা করে। টেক্সাস এএন্ডএম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্ব সাহিত্যের সহকারী অধ্যাপক এরালদা এল. লেমেবোরশি সম্প্রতি আলিসদোত্তিরের কাজ, রাজনীতি এবং শিল্পের সঙ্গে এসবের সংযোগ নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছেন। ওয়ার্ল্ড লিটারেচার টুডে-তে প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তুলে ধরেছেন মেজবাহ উদ্দিন
আপনার কাজের পরিসর, এর সাহসিকতা এবং এটি যেভাবে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক বিষয়গুলো মোকাবিলা করে, সত্যিই তা প্রশংসার দাবি রাখে। শিল্পী হিসাবে আপনার শুরুর সময়টা সম্পর্কে জানতে চাই, এবং আমি মনে করি প্রেরণা এমন একটি বীজ যা জীবনের প্রথমদিকেই রোপিত হয়েছিল। আমি জানতে চাই সে বীজটি কীভাবে আপনার ভেতরে রোপণ হয়েছে, আপনি কীভাবে এটি লালন করেছেন এবং এটি কীভাবে আপনার মধ্যে বেড়ে উঠেছে?
: আমি আমার শিল্পী জীবন, যে সমাজের সম্মিলিত অভিজ্ঞতা আমাকে গঠন করেছে এবং শিল্পের মাধ্যমে কসোভাতে একটি নতুন সমাজ গড়ার প্রচেষ্টা সম্পর্কে কথা বলার জন্য সম্মানিত বোধ করছি। আমি একটি শিল্পী পরিবারে বড় হয়েছি। আমার চাচা একজন পেশাদার শিল্পী ছিলেন, যিনি প্যারিসে অনেক বছর ধরে বসবাস করতেন। শিশুকালে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায় এবং সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ওপর একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি পাই। আমার দাদি সামাজিক মানদণ্ড অনুযায়ী একজন সাধারণ গৃহবধূ ছিলেন, কিন্তু আমার মতে তার কাজ শিল্পময় ছিল। তিনি কসোভার দুকাগজিন অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী পোশাক তৈরি করতেন এবং পোশাকের প্যাটার্নগুলো তার নিজস্ব নকশায় ছিল। মূলত, তার কাজ সৃজনশীল এবং মৌলিক ছিল; তিনি কেবল অনুলিপি তৈরি করতেন না। আমার বাবা পোর্ট্রেট তৈরিতে পারদর্শী ছিলেন, তাই আমাদের পরিবারে শিল্প ছিল।
আমি ছোটবেলায় আঁকা শুরু করেছিলাম। আমার কিশোর বয়সে, কসোভায় অনেক রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল, তাই সবাই যখন টেলিভিশনে খবর দেখছিল, তখন আমি শিল্পের মাধ্যমে নিজেকে শান্ত করছিলাম। এটি ছিল বাস্তবতা থেকে একটি পালানোর পথ।
আমি প্রথমবার ২০২২ সালে প্রিস্টিনায় আপনার ম্যুরাল আন্দ্রাত ই থেয়েরা (ভাঙা স্বপ্ন) দেখে আপনার কাজ সম্পর্কে জানতে পেরেছি। যদিও আপনি অঙ্কন, পেইন্ট এবং এমনকি পারফরম্যান্স শিল্পেও নিযুক্ত; আমি জানতে আগ্রহী যে, ম্যুরাল আপনার শিল্পী দৃষ্টিভঙ্গিতে কী প্রদান করে যা অন্য দৃশ্যশিল্পের ফর্মগুলো করে না?
: ম্যুরালের প্রতি আমার আগ্রহ শুরু হয়েছিল ২০০১ সালে ওয়াশিংটন ডিসি-তে একটি লিডারশিপ প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার সময়। প্রোগ্রামের সময় এটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে, আমার পথ আমাকে রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন, আমি ফিলাডেলফিয়াতে গিয়েছিলাম শহরের অনেক ম্যুরাল দেখতে এবং এ দৃশ্যশিল্পের মধ্যে আমি গভীর কিছু খুঁজে পেয়েছিলাম : ম্যুরালগুলোর বড় আকার, তাদের বার্তার পরিসর এবং পাবলিক-আর্টের মাধ্যমে শিল্পের প্রকাশ আমার শিল্পীস্বত্ব বিকাশের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দেয় এবং সক্রিয় সামাজিক অংশগ্রহণের জন্য নতুন সুযোগগুলো তুলে ধরে। আমি এ ধারণায় মুগ্ধ হয়েছিলাম যে, ‘মানুষ এটি করেছে’ এবং পরের চিন্তা ছিল, আমাকে এটি করতে হবে। যখন আমি কসোভাতে ফিরে আসি, তখন আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম : আমি কীসের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই? আমার প্যাশন কী এবং একটি যুদ্ধপরবর্তী দেশ যেখানে স্থাপত্যগুলো সবই ধ্বংসপ্রাপ্ত, ধূসর এবং কমিউনিস্ট যুগের স্মৃতি রয়েছে, সেখানে আমি কী প্রকাশ করতে চাই?
এরপর আমার প্রথম প্রকল্পটি ২০০২ সালে সম্পন্ন হয়েছিল। আমি প্রিস্টিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের বৈচিত্র্যকে উপস্থাপন করতে চেয়েছিলাম, যেখনে সারা বিশ্ব থেকে ছাত্ররা আসে। তাছাড়া, আমি নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছিলাম যে, আমি বড় কিছু করতে পারি। অনেকেই আমার ওপর বিশ্বাস করতেন না এবং আমি আসলেই প্রয়োজনীয় সহায়তা পাইনি, বিশেষত দুই ছোট সন্তানের মা হিসাবে কাজ করা কঠিন ছিল। এটি শেষ করতে অনেক সময় লেগেছিল, তবে আমি খুব গর্বিত ছিলাম।
আপনার রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অনিচ্ছা সম্পর্কে আরও শুনতে চাই, কারণ আমি যখন আপনার আর্ট দেখি, আমার মনে হয় এটি অন্তর্নিহিতভাবে রাজনৈতিক। আপনার শিল্পের রাজনীতি এবং সামাজিক সমস্যা সম্পর্ক নিয়ে কী বলবেন?
: আসলে, সবকিছুই রাজনীতি। আমার কাজ মানবাধিকারের লঙ্ঘনকে প্রকাশ এবং নিন্দা করে। আমি লিঙ্গসমতাকে প্রচার করি। আমার বাবা একজন বিচারক ছিলেন এবং তিনি আমাদের ন্যায়বিচার, সমান অধিকার, নারীর অধিকার সম্পর্কে শক্তিশালী বিশ্বাস নিয়ে বড় করেছেন, এবং আমি যখন সামাজিক অবিচার দেখি তখন আমার নিজেকে শক্তিশালী মনে হয়। তবে আমার একমাত্র হাতিয়ার হলো আমার শিল্প। আমি যা প্রকাশ করতে চাই ম্যুরাল বিশেষ করে তার জন্য উপযুক্ত, কারণ এটি জনসাধারণের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে, যা সামাজিক গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে সরাসরি মিথস্ক্রিয়া করার সুযোগ দেয়।
আপনার সমগ্র কাজে একটি সচিত্র পুনরাবৃত্ত থিম রয়েছে। প্রায়শই কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হিসাবে নারীদের দেখা যায়, যেটা পেছন ফিরে তাকাতে বাধ্য করে। আপনার শিল্পের নারী নিষ্ক্রিয় নয়, বরং চোখের মধ্যে একটি সম্মোহনকারী গুণ থাকে, যা দর্শককে বন্ধী করে রাখে। দেখা, দৃষ্টিপাত, বোঝার জন্য, আপনার কাজগুলো কী ভূমিকা পালন করে?
: খুব ছোটবেলা থেকেই আমি চেয়েছিলাম যে আমাকে দেখা হোক, এবং যত বড় হয়েছি, ততই বুঝতে পেরেছি যে, সবকিছু শুরু হয় শৈশবে। আমি চোখকে মানুষের আত্মার প্রতীক হিসাবে দেখি, এবং যখনই আমি কসোভোতে ফিরে আসি-কারণ আমি আইসল্যান্ড এবং কসোভো উভয় জায়গাতেই বসবাস করি-আমি জনপরিবহণ বাসে চড়ি শুধু মানুষ পর্যবেক্ষণ করার জন্য, তাদের অভিব্যক্তি, তাদের মেজাজ এবং আমি জানতে পারি যে, মানুষ কতটা অসহায়। আমি সমাজের ভাঙনের কারণে উদ্বিগ্ন, তবে আমি এটা জেনে গভীর সহানুভূতি পাই যে, প্রত্যেকেই তাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করছে। চোখ মানুষের জীবনের গল্প ধারণ করে। যখন আমি ‘আন্দ্রাত এ থিয়েরা’ রচনা করি, আমি মহিলাদের চোখের পাতায় ভাঙা আয়না এঁকেছিলাম যাতে ঘরোয়া সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তি যখন দেওয়ালের দিকে তাকাবে, ভাঙা আয়নাগুলো তাদের দিকে ফিরে তাকাবে।
‘আন্দ্রাত এ থিয়েরা’ এবং এর থিম কোসোভোতে নারীর অধিকার আন্দোলনের অংশ। কাজটিতে যেভাবে আলবেনিয়ার পতাকায় চরিত্রগুলো অবস্থান করছে যেটা দ্বি–মাথা ঈগলের প্রতিধ্বনি তোলে, তা দেখে আমি অভিভূত হয়েছিলাম। কেন মহিলারা একে অপরের দিকে মুখ করে না থেকে পেছন দিকে মুখ করে আছে? আলবেনিয়ার পতাকার এ প্রতিধ্বনির পেছনে কি ইচ্ছাকৃত কিছু ছিল?
: যখন আমি প্রথম ম্যুরালটির কাজ শুরু করি, তখন আমি দুজন মহিলাকে কল্পনা করেছিলাম যেখানে একজন ছোট এবং অন্যজন বড়। কম্পোজিশনে, বয়স্ক মহিলা কিছুটা সামনে এবং তরুণ মহিলা কিছুটা পেছনে রয়েছে। ঘরোয়া নির্যাতন শুধু তরুণ মহিলাদের প্রভাবিত করে না। এটি সব বয়সের মানুষকে স্পর্শ করে। সম্প্রতি, আমি শিশুদেরও ঘরোয়া নির্যাতনের শিকার হিসাবে কল্পনা করছি, কিন্তু এটি আরেকটি থিম যা পরে আসবে। কোসোভোতে আমাদের অনেক কাজ বাকি আছে।
ক্ষমতার অংশ হওয়া এবং মানবাধিকারকে সমর্থন করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমি আমার দেশে কোনো রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই না বা রাজনৈতিক দলের পরিচয় গ্রহণে আগ্রহী শিল্পি হতে চাই না। আমি সব সময় একটি স্বাধীন কণ্ঠস্বর থাকার চেষ্টা করেছি। এটি ক্লান্তিকর হতে পারে, তবে আমি মনে করি এটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আমার কিছু রেখে যেতে হবে। কাজ দেখা দরকার, আমাকে নয়
আপনি আইসল্যান্ড এবং কসোভোতে নিয়মিত সময় কাটান; আপনার অভিবাসন, স্থানান্তর এবং আপনার জাতীয়তা কি আপনার বিষয়বস্তু নির্বচনে ভূমিকা পালন করে?
: এটি একটি বিশাল ভূমিকা পালন করে। আমি একজন আলবেনিয়ান নারী, এবং এটি আমার পরিচয়। আইসল্যান্ড আমাকে শক্তি এবং আত্মবিশ্বাস দিয়েছে যাতে আমি আরও দৃঢ় হতে পারি, এবং আইসল্যান্ডে আমার অভিবাসন আকস্মিক যাত্রা হলেও… আমি রক্ষা পেয়েছিলাম। এটি সত্যিই আমার জীবন বাঁচিয়েছে। আমি যা হতে পেরেছি এবং নিজেকে সুস্থ করতে পেরেছি। আইসল্যান্ডে পনেরো বছর কাটানোর পর, আমি যখন কসোভোতে ফিরে যাই তখন আমি সংগ্রাম করি, কারণ আমি চাই সমাজে দ্রুত পরিবর্তন আসুক : স্বাধীনতা, সমতা, সবার জন্য ন্যায়বিচার। আইসল্যান্ডে মহিলাদের জন্য বড় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে; মহিলারা এখন সংসদে স্থান পেয়েছে, বাকস্বাধীনতাও এখানে একটি বাস্তবতা; এর বিপরীতে আমি যত বেশি সময় কসোভায় থাকি ততই আমার হতাশা বাড়তে থাকে। এটি একটি বেদনাদায়ক সত্য। আমার দেশে নারীদের জীবন অভ্যন্তরীণ দৈন্যতায় পূর্ণ এবং এটি উপড়ে ফেলা অত্যন্ত কঠিন। তবুও, আমি কসোভোর নারীদের কাজে গভীরভাবে উৎসাহিত হই। উদাহরণস্বরূপ, লুলজেতা দেমোলি সেন্টার ফর জেন্ডার ইকুয়ালিটিকে নেতৃত্ব দেন এবং একটি অসাধারণ মহিলা দলের সঙ্গে কাজ করেন। দাফিনা হালিলির অসাধারণ মতো সাংবাদিকও আছেন, যার নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে কসোভো ২.০। এ নারীরা নির্ভীক, অনুপ্রেরণাদায়ক এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য গভীর আশা।
কথোপকথনের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি আর কি কিছু যোগ করতে চান?
: আমি শিল্প ও রাজনীতি নিয়ে একটু বলতে চাই। ক্ষমতার অংশ হওয়া এবং মানবাধিকারকে সমর্থন করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমি আমার দেশে কোনো রাজনৈতিক অবস্থানের প্রতিনিধিত্ব করতে চাই না বা রাজনৈতিক দলের পরিচয় গ্রহণে আগ্রহী শিল্পি হতে চাই না। আমি সব সময় একটি স্বাধীন কণ্ঠস্বর থাকার চেষ্টা করেছি। এটি ক্লান্তিকর হতে পারে, তবে আমি মনে করি এটি গুরুত্বপূর্ণ এবং আমার কিছু রেখে যেতে হবে। কাজ দেখা দরকার, আমাকে নয়। আমি শুধু সমাজকে এ পাবলিক-আর্ট উপহার দিচ্ছি।
সূত্র : ওয়ার্ল্ড লিটারেচার টুডে