Author Picture

ছাত্র-প্রতিবাদ: শক্তির এক প্রমাণপত্র

মেজবাহ উদদীন

নিয়তি চিত্রনাট্য লেখে ঠিকই। তবে সেই কলমে কালিটা আপনাকেই জোগাতে হয়। নয়তো নিয়তি নিশ্চুপ বসে থাকে প্রাণহীন কলমের প্রান্ত হাতে; আর জীবন-ইতিহাসের পৃষ্ঠা সাদাই থেকে যায় আলস্যের করুণ পরিণতি হয়ে। সেই করুণ পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই হঠাৎ আমাদের ছাত্রসমাজ বৈষম্যবিরোধী এক্সটেনশন নিয়ে হাজির হলো নিয়তিকে দিয়ে বাঙালির বিজয়গাঁথা লিখিয়ে নিতে।

‘এমন কতদিন কাঁদিনি / কতদিন ভাবিনি / কতদিন জাগিনি এভাবে, ঐ তো বাংলাদেশ / স্বৈরাচারের শেষ / এ আগুন কেই-বা নেভাবে, আবার বাঁচতে চাই / মৃত্যুর মুখে ছাই, বাংলা ভাষাই হলো প্রাণ, মুক্তির এই আলো / বাংলাদেশ জ্বালালো / এ লড়াই মুক্তির গান।’ বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নিয়ে বাঁধা কবির সুমনের নতুন গানের কথা এগুলো। এখন থেকে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাসে ৫২’র পাশাপাশি ২৪’কেও সমান গুরুত্বপূর্ণ স্থান দিতে হবে। কারণ এই ২৪শেই ছাত্রদের ৩৬ দিনের জীবনদানকারী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পেয়েছে ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’।

বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন নিয়ে বিশ্বের অনেক গুণী মানুষ এবং গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাকে সরব হতে দেখা গেছে। তাদের পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছাত্র সংগঠনও বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে তাদের পাশে ছিল। গত ১৬ জুলাই আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে একটি যৌথ বিবৃতি দেয় ভারতের প্রগতিশীল সংগঠনগুলো। যেখানে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ জেগে উঠেছে এবং ‘কোটা নয়, মেধা’দাবিতে আন্দোলন করছে। ‘মুক্তিযোদ্ধা কোটা’র দীর্ঘদিনের নীতি এবং এর ফলে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সুবিধা দেওয়ার চর্চা ছাত্র ও যুবসমাজের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি করে আসছে। এর আগেও এ নিয়ে অসংখ্য প্রতিবাদ হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। এটি ছিল দেশের কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, যুবক ও নারীসমাজের সকল স্তরের একীভূত সংগ্রাম। ক্ষমতাসীন দল তাদের সুবিধাবাদী স্বার্থে ‘মুক্তিযোদ্ধা’ কোটাকে কাজে লাগিয়ে এ ইতিহাসকে অপব্যবহার করছে।

……আওয়ামী লীগ সরকার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় না গিয়ে তাদের জাতীয় স্বাধীনতার শত্রু (রাজাকার) হিসেবে আখ্যায়িত করে সাধারণ জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। এছাড়া বাংলাদেশের পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ‘ববর্রতা’ও অব্যাহত আছে। এতে অনেক বিক্ষোভকারী গুরুতর আহত হয়েছেন এবং তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ……বাংলাদেশের রংপুরে পুলিশের গুলিতে এক ছাত্র ‘শহীদ’ হয়েছেন। এই দমন-পীড়নে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকা নিন্দনীয় এবং আমরা এই ফ্যাসিবাদী হামলার বিরুদ্ধে আমাদের দেশের গণতান্ত্রিক ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে তীব্র নিন্দা জানাই।’

এরপর অল নেপাল ন্যাশনাল ফ্রি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, ডেমোক্রেটিক স্টুডেন্ট ফেডারেশন (পাকিস্তান), সোশ্যালিস্ট স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (শ্রীলঙ্কা), সোশ্যালিস্ট ইয়ুথ ইউনিয়ন (শ্রীলঙ্কা), সোশ্যালিস্ট অ্যালায়েন্স (অস্ট্রেলিয়া), ইয়াং কমিউনিস্ট লিগ অব ব্রিটেন, সোয়াস লিবারেটেড জোন ফর গাজা (যুক্তরাজ্য)— এসব ছাত্র সংগঠনগুলো বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করে।

সেসব সংহতির পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ার দ্য ইউনিভার্সিটি অব সিডনি, ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি সিডনি (ইউটিএস), ম্যাকুয়েরি বিশ্ববিদ্যালয়, জর্জব্রাউন, ইম্পেরিয়াল কলেজ; যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়, লুইজিয়ানা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ ক্যারোলিনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়, জর্জিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়, অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ সমাবেশ ও মিছিল করেছে।

আমাদের এই ছাত্র আন্দোলন বিশ্বের অগণিত নিপীড়িত মানুষের কাছে অধিকার আদায়ের জীবন্ত উদাহরণ হয়ে উঠবে

বিশ্বব্যাপী সমর্থন আর শত শত প্রাণের বিনিময়ে এদেশের ছাত্র-জনতা দেশকে যে স্বৈরাচার মুক্ত করেছে তার জন্য গ্লোবাল স্টুডেন্ট ফোরাম ‘বাংলাদেশ স্টুডেন্ট’স ভিক্টোরি: এ টেস্টামেন্ট টু দ্যা পাওয়ার অব স্টুডেন্ট প্রটেষ্ট’ শিরোনামে একটি প্রেস রিলিজ প্রকাশ করেছে। যেখানে বলা হয়েছে—

‘বাংলাদেশে ছাত্র-নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের ঐতিহাসিক অর্জনকে স্বীকৃতি দিতে পেরে গ্লোবাল স্টুডেন্ট ফোরাম (জিএসএফ) গর্বিত, যা শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও প্রস্থানের মধ্য দিয়ে শেষ হয়েছে। এই ঐতিহাসিক ঘটনা আধুনিক বিশ্বে ছাত্র আন্দোলনের গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে।

এই বিক্ষোভ আসলে সরকারি চাকরিতে পুনঃস্থাপিত কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শুরু হয়েছিল, যা অনেকেই বৈষম্যমূলক এবং মেধার ভিত্তিতে সুযোগ পাওয়ার পথে একটি অন্তরায় হিসেবে দেখেছিলেন। সুপ্রিম কোর্টের একটি রায়কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সংস্কারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হয়। এই আন্দোলনটি দ্রুতই গণতন্ত্র এবং জবাবদিহিতার একটি জাতীয় দাবিতে রূপান্তরিত হয়, যা বিভিন্ন শ্রেণির মানুষকে সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করে।

সরকারী সহিংস দমন নীতির কারণে ২০০ জনেরও বেশি নিহত এবং হাজার হাজার আহত হয়েছিল। তবুও ছাত্রদের অবিচল সংকল্পে ঘটণাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দিকে মোড় নেয়। প্রধানমন্ত্রী হাসিনার পদত্যাগ কেবলমাত্র প্রতিবাদকারীদের জন্যই নয়, বরং বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নীতির বিজয়কেও চিহ্নিত করে। সামরিক বাহিনী সহিংস প্রতিক্রিয়ার তদন্ত করার এবং ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

জিএসএফ শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে গুরুত্ব দেয়, যা সামাজিক পরিবর্তনের সবচেয়ে কার্যকর এবং নৈতিক পন্থা হিসেবে বিবেচিত। বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলন প্রমাণ করেছে যে অবিচল আন্দোলন দীর্ঘস্থায়ী স্বৈরাচারী শাসন ভেঙে দিতে এবং অর্থবহ সংস্কার নিয়ে আসতে পারে। ভবিষ্যতের সকল আন্দোলনের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে যে, তারা অহিংসকে তাদের পথপ্রদর্শক নীতি হিসেবে গ্রহণ করবে এবং নিশ্চিত করবে যে তাদের ন্যায়বিচার অনুসন্ধান মানুষের মর্যাদা বা জীবনকে ক্ষুণ্ণ করবে না।

জিএসএফের নির্বাহী পরিচালক জ্যাকব ব্লেসিয়াস বলেছেন, “বাংলাদেশের ছাত্রদের দেখানো সাহস এবং দৃঢ়সংকল্প ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের শক্তির প্রমাণ। তাদের সাফল্য শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের গুরুত্বকে তুলে ধরে এবং দৃঢ়ভাবে স্মরণ করিয়ে দেয় যে সম্মিলিত প্রচেষ্টা বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। আমরা বাংলাদেশের ছাত্রদের পাশে আছি এবং ন্যায়বিচারপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য তাদের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করতে থাকব।”

…..এই মুহূর্তটিকে চিহ্নিত করার সাথে সাথে, আমরা বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক সংস্কারের জন্য চলমান সংগ্রামকে সমর্থন করার জন্য সতর্ক এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবো। সামনে পথ চলতে হলে অব্যাহত প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক সংহতির প্রয়োজন হবে যাতে পরিবর্তন আরও ন্যায়সঙ্গত এবং গণতান্ত্রিক সমাজের দিকে নিয়ে যায়। ভবিষ্যতের পথ অবশ্যই অহিংসা এবং গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে গড়ে তুলতে হবে।

আমরা বাংলাদেশের সাহসী ছাত্রদের প্রতি আমাদের সংহতি প্রকাশ করি এবং বিশ্বব্যাপী শান্তিপূর্ণ ছাত্র আন্দোলনকে প্রচার এবং সমর্থন করার জন্য আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করি।’

পরিশেষে বলতে পারি, আমাদের এই ছাত্র আন্দোলন বিশ্বের অগণিত নিপীড়িত মানুষের কাছে অধিকার আদায়ের জীবন্ত উদাহরণ হয়ে উঠবে।

আরো পড়তে পারেন

প্রতিটি শূন্যতা যেন নতুন শোকের জন্ম দেয়

শূন্যতার আকাশে স্মৃতির মেঘ জমে। জীবন সরে সরে আসে মৃত্যুর দিকে। ফুরিয়ে আসা সময়ের দাপট এড়াতে পারে না কেউ। একজীবনে বহু জীবনাবসানের দেখা পাওয়া যায়, হয়তো দুর্ভাগ্যক্রমেই। ব্যক্তির মৃত্যুর পরিসমাপ্তি একবারই হয়, তবে সেই ব্যক্তি যদি বহুপ্রাণের সাথে জুড়ে থাকেন, তাঁর অনুপস্থিতি বারংবার অনুভূত হয়। প্রতিটি শূন্যতা যেন এক নতুন শোকের জন্ম দেয়। ২০২৪ সালে….

অর্বিটাল’র স্রষ্টা সামান্থা হার্ভে জিতলেন বুকার প্রাইজ

আঘাতপ্রাপ্ত পৃথিবীর গল্পে আমি থাকেত চাই শুধু মানবতা আর প্রকৃতির কাছে ঋণী। ব্রিটিশ লেখিকা সামান্থা হার্ভে এমন কথা বলেছেন কি না জানা হয়নি। তবে বুকার পুরস্কারের বিচারক প্যানেল হার্ভের মানবতা আর প্রকৃতির কাছে ঋণী থাকার মনোভাবের পরিচয় পেয়েছেন তাঁর অসাধারণ উপন্যাস অর্বিটাল’র মধ্যে। যার জন্য ২০২৪ সালে বুকার পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে সামান্থা হার্ভেকেই বেছে নিয়েছেন….

মোজাম্বিকের মুক্তিযোদ্ধাদের নজর কেড়েছিলেন মিয়া কাউতো

ভালোবাসায় অন্তরের টান আবশ্যিক উপকরণ। যার অভাবে পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে অসংখ্য মানুষের হাহাকার শুনেও কি নিঃশব্দে নীরব থেকে যাচ্ছি আমরা। নির্যাতিতের জন্য ন্যায়বিচারের পথ চেয়ে বসে আছি; যখন আমাদের সরব হওয়ার কথা। তবু কবিতার ভ্রুণ জন্ম নেয় মৃত্যুর জরায়ু থেকে। আফ্রিকান কবি মিয়া কাউতোর কবিতার ভিতর সেই অভিজ্ঞতার একটা পায়ে চলা পথের সন্ধান পেয়ে ব্রিটিশ….

error: Content is protected !!