যে পরিবেশে জলছবি আর রংমশালের গল্প ছিল না। না ছিল রূপকথার পরীদের গল্পও। কেবল ছিল অভাবের গল্প, আর একটা বল ছিল। যতবার সেই বলকে দূরে ছুড়ে দিত রোগা পা, ততবার, একবেলা খেতে না পাওয়ার কথা ভুলে যেতেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। ভুলে যেতেন, তাঁদের জীবনটা অভাব অন্ধকার আর না-পাওয়ার সবটুকু রংহীনতা মেখে নিচ্ছে রোজ।
ফুটবলের সঙ্গে দারিদ্র্যের সমানুপাতিক সম্পর্ক, অনেকেই বলে থাকেন। কে জানে, দারিদ্র্য থেকেই হয়তো দৌড়টা শুরু হয়, দূরে যাওয়ার জন্য। সেখান থেকেই উঠে আসেন ডি মারিয়া-রা। এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, কী প্রবল পরিশ্রম তাঁর বাবা আর মা করতেন, তাঁকে ফুটবলার বানানোর জন্য। একটা সাইকেলের পিছনে ছেলেকে চাপিয়ে রোদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে মা পৌঁছে যেতেন ফুটবল কোচিং ক্যাম্পে।
সেদিনের সেই ছেলেটাই অলিম্পিকস, বিশ্বকাপ, কোপা আমেরিকা, ফাইনালিসিমা, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ; ফুটবল বিশ্বের এই ট্রফিগুলো স্পর্শ করেছেন । আর্জেন্টিনার জার্সিতে ফুটবল ক্যারিয়ার ‘কমপ্লিট’ করেছেন অ্যাঞ্জেল ফাবিয়ান ডি মারিয়া। জয় করা প্রতিটা ফাইনালের গোলদাতার তালিকায় আছে তাঁর নাম। এরকম বিরল রেকর্ড আর কারই-বা আছে? তিনি তো নিজেই তারকা, তবে মেঘে ঢাকা। সাফল্য-ব্যর্থতার হাজারও পথ অতিক্রম করে ডি মারিয়া সেই ‘অ্যাঞ্জেল’-এর নাম, যিনি ভক্তদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেন ফুটবলের ‘ঈশ্বর’দের।
১৪ ফেব্রুয়ারি, ১৯৮৮ সালে আর্জেন্টিনার রোসারিও শহরে জন্মগ্রহণ করা ডি মারিয়া একজন উইঙ্গার বা আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার হিসেবে খেলেন। ডি মারিয়া তার গতিশীল খেলা, ড্রিবলিং দক্ষতা এবং নিখুঁত পাসের জন্য সুপরিচিত।
দি মারিয়ার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে এখন বেলাশেষের গান। সায়াহ্নে এসে দাঁড়িয়েছেন মেসিও। ‘লিটল বয় ফ্রম রোসারিও’ আজ মহীরুহ। তাঁর পাশেই শেষবার নীল-সাদা জার্সি গায়ে দিলেন ডি মারিয়া। যাঁর জন্য কোপা জিততে চেয়েছিল গোটা আর্জেন্টিনা দল। কোনও আক্ষেপ নেই, অভিমান নেই। বিদায় নেওয়ার আগেই বলেছিলেন, “জীবনে যা চেয়েছি, তার থেকে অনেক বেশিই পেয়েছি।” সত্যিই তো, কজনের নামের পাশে লেখা রয়েছে বিশ্বের সেরা টুর্নামেন্টগুলোর ফাইনালের গোলের রেকর্ড? অলিম্পিকের ফাইনালে গোল। রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালেও গোল। পরের বছর ফাইনালিসিমায় নাকানি-চোবানি খাইয়ে গোল করলেন ইউরোপ সেরা ইটালির বিরুদ্ধে। অবশেষে ২০২২-র বিশ্বকাপে সেই ‘গ্লোরিয়াস গোল’। দুহাতে হৃদয়ের চিহ্ন এঁকে ভক্তদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী জায়গা করে নিলেন ‘ফিদেও’।
এরকম বিরল রেকর্ড আর কারই-বা আছে? তিনি তো নিজেই তারকা, তবে মেঘে ঢাকা। সাফল্য-ব্যর্থতার হাজারও পথ অতিক্রম করে ডি মারিয়া সেই ‘অ্যাঞ্জেল’-এর নাম, যিনি ভক্তদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেন ফুটবলের ‘ঈশ্বর’দের
বন্ধুরা ভালোবেসে এই নাম দিয়েছিল। যার ইংরেজি অর্থ ‘নুডল’। বক্সের আশেপাশে ছটফটানি। কোমরের দোলায় বিপক্ষের ডিফেন্ডারকে চরকিপাক খাওয়ানো। গোল আর অ্যাসিস্টে তাঁর ঝুলি ভর্তি। আর্জেন্টিনার জার্সিতে ১৪৪টি ম্যাচে ৩১টি গোল। আশ্চর্যের বিষয়, এই সংখ্যার থেকে মাত্র ৪টি বল বেশি দিয়ে একদিন এল টোরিতো থেকে কিনে নিয়েছিল রোসারিও সেন্ট্রাল। হ্যাঁ, ৩৫টি ফুটবল! এটাই ছিল তাঁর প্রথম ‘ট্রান্সফার ফি’। তখন মাত্র ৬ বছর বয়স ডি মারিয়ার।
ক্লাব ক্যারিয়ার
ডি মারিয়া তার পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করেন আর্জেন্টিনার ক্লাব রোসারিও সেন্ট্রাল থেকে। ২০০৭ সালে তিনি পর্তুগালের ক্লাব বেনফিকাতে যোগ দেন, যেখানে তার পারফরমেন্স ইউরোপীয় ফুটবলে পরিচিতি পেতে সহায়তা করে। ২০১০ সালে তিনি স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দেন। এখানে তিনি ২০১৪ সালে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জয়ের পাশাপাশি বহু ঘরোয়া শিরোপা জয় করেন। ২০১৪ সালে ডি মারিয়া ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে যোগ দেন। যদিও এখানে তার সময় সীমিত ছিল। ২০১৫ সালে তিনি ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেন্ট-জার্মেই (পিএসজি) তে যোগ দেন এবং এখানে তিনি অসংখ্য শিরোপা জয় করেন। ২০২২ সালে তিনি ইতালির ক্লাব জুভেন্টাসে যোগ দেন।
আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার
ডি মারিয়া আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে ২০০৮ অলিম্পিকে সোনার পদক এবং ২০২১ কোপা আমেরিকা শিরোপা জয় করেন। ২০২২ সালের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার শিরোপা জয়ের পেছনে তার অসাধারণ অবদান ছিল।
সাফল্য আর ব্যর্থতার সমানুপাতিক সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে হয়তো ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে ছোটবেলায়। যখন দুরন্ত, অবাধ্য এক শিশুর অফুরন্ত প্রাণশক্তিকে সঠিক পথে নিয়ে আসার জন্য ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল ফুটবলে। বাকি ইতিহাসটা তৈরি হয়েছে নিজের পথে, নিজের ছন্দে। রোনাল্ডো-মেসির পাশে খেলা। ফাইনালে গোল। বিশ্বজয়। সব ভিড় করে আসতে পারে চোখের তারায়। কোপা আমেরিকা ২০২৪ জয় দিয়েই আন্তর্জাতিক কেরিয়ার শেষ হল ডি মারিয়ার। মেসি চোট পেয়ে উঠে যাওয়ার পর হাতে ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড।
কৌশল এবং দক্ষতা
অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার খেলার ধরন তাকে একজন বিশেষ খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত করেছে। তার কিছু উল্লেখযোগ্য দক্ষতা এবং কৌশল হলো:
ড্রিবলিং
ডি মারিয়া তার দুর্দান্ত ড্রিবলিং দক্ষতার জন্য বিখ্যাত। সে দ্রুত এবং নিখুঁতভাবে প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডারদের পাশ কাটিয়ে যেতে পারেন।
পাসিং এবং ক্রসিং
ডি মারিয়ার পাস এবং ক্রস করার ক্ষমতা অসাধারণ। সে দলকে আক্রমণাত্মক সুযোগ তৈরি করতে সহায়তা করেন।
শট নেয়ার ক্ষমতা
ডি মারিয়ার দূর থেকে শট নেওয়ার অনন্য দক্ষতা আছে। সে প্রায়ই গোল করার জন্য দূরপাল্লার শট নেয়।
গতি
তার গতি এবং ক্ষিপ্রতা তাকে উইঙ্গার হিসেবে সফল করেছে। সে দ্রুত গতিতে ফাঁকা জায়গা তৈরি করে আক্রমণ গড়ে তোলে।
সেট-পিস
ফ্রি কিক এবং কর্নার কিকের ক্ষেত্রে ডি মারিয়া একজন বিশেষজ্ঞ। তার সেট-পিস দক্ষতা দলকে অনেক গোল করার সুযোগ করে দিয়েছে।
তিনি সাধারণত শান্ত এবং পরিশ্রমী প্রকৃতির একজন খেলোয়াড়। তার সতীর্থ এবং কোচদের সাথে তার সম্পর্ক সবসময় ভালো। ডি মারিয়া তরুণ ফুটবলারদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা এবং তার খেলার স্টাইল এবং অর্জন অনেককে উৎসাহিত করছে
ডি মারিয়া তার ক্যারিয়ারে অনেক সম্মাননা এবং শিরোপা অর্জন করেছেন। ডি মারিয়া তার ক্লাব এবং জাতীয় দল উভয় ক্ষেত্রেই একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে তার ভূমিকা পালন করেছেন। ক্লাব পর্যায়ে ৭৬৭ ম্যাচে ১৭৯ গোল আর ২৬৭ অ্যাসিস্ট এবং জাতীয় দলে ১৪৪ ম্যাচে ৩১ গোল ও ৩২ অ্যাসিস্ট। এই পরিসংখ্যান দেখলে খুব সাধারণ মনে হলেও অসাধারণ সব কীর্তি গড়েছেন অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া।
ফুটবলে অনেক অনেক গোল অ্যাসিস্ট না করেও যে ম্যাচে ইম্প্যাক্ট রাখা যায়, সেটা ডি মারিয়া করে দেখিয়েছেন। ফুটবল ইতিহাসের সেরা, সেরা ক্লাবে খেলেছেন, জাতীয় দলে মেসিকে, ক্লাবে (রিয়াল মাদ্রিদ) রোনালদোকে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছেন। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচগুলোতে গোল পেয়েছেন।
ডি মারিয়া কেবল তার খেলার জন্যই নয়, তার ব্যক্তিত্ব এবং মাঠের বাইরে তার আচরণের জন্যও পরিচিত। তিনি সাধারণত শান্ত এবং পরিশ্রমী প্রকৃতির একজন খেলোয়াড়। তার সতীর্থ এবং কোচদের সাথে তার সম্পর্ক সবসময় ভালো। ডি মারিয়া তরুণ ফুটবলারদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা এবং তার খেলার স্টাইল এবং অর্জন অনেককে উৎসাহিত করছে।
ডি মারিয়া তার খেলোয়াড়ি ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার পর কোচিং বা ফুটবল সম্পর্কিত অন্যান্য কাজে যুক্ত হতে পারেন। তার অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতা নতুন প্রজন্মের ফুটবল খেলোয়াড়দের জন্য মূল্যবান হতে পারে। অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া ফুটবলের জগতে তার চিহ্ন রেখে যাচ্ছেন এবং তার অসাধারণ পারফরমেন্স ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।
গল্প তো থামে না। গলিঘুঁজির যত জীবন ফুটবলের রাজপথের উদ্দেশে দৌড় শুরু করছে, তাদের জন্য রয়ে গেল আস্ত একটা রূপকথা। যে রূপকথায় সিলমোহর করে দিলেন ডি মারিয়া।