‘পরের জন্মে আমি এর প্রতিশোধ নেব। নেবই। মোহনবাগানের ফুটবলার হয়ে জন্ম নিয়ে…।’ অনেক বছর আগে এক ভারতিয় পত্রিকায় পড়া এক চিঠি। যে চিঠি হয়তো লেখা হয়েছিল কোনও এক অনির্বাণ দহনের রাতে। লিখে আর ভাবেনি, লেখক চলে গিয়েছিল সব ছেড়েছুড়ে। প্রতিশোধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে।
প্রায় পাঁচ দশক আগে পঁচাত্তরে ইস্টবেঙ্গলের কাছে পাঁচ গোলের অনলে দগ্ধ এক মোহনবাগান সমর্থক উমাকান্ত পালধির চিঠি। উমাকান্তকে আমি দেখিনি। তবে উমাকান্ত পালধিদের দেখেছি। বাংলাদেশের খেলা হলেই এদের দেখা যায় শহরের বিভিন্ন জায়গায় বসানো বড় পর্দার সামনে। এই যেমন গত মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো কোনো বৈশ্বিক আসরের সেমিফাইনালে খেলার সুযোগ থাকার পরও বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পারলো না। আফগানিস্তানের কাছে প্রিয় দলকে হারতে দেখে দু’জন কিশোর কাঁদছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। পিতৃশোকে মানুষ যেমন করে, যতটা এলোমেলো হয়ে যায়।
বাঙালির ক্রিকেট প্রেম বড় বিষম বস্তু। যার হয়, তার হয়। প্রেমিকার হাত ছাড়লেও, ক্রিকেটের হাত ছাড়া যায় না। তাই তো দেশের ক্রিকেটের কাব্যে উপেক্ষিত হয়ে থাকা সমর্থকরা আগামী খেলায় আবার বসে যাবে টিভিসেটের সামনে।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আফগানিস্তানের অনেক আগেই পদচারণা শুরু বাংলাদেশের। ১৯৯৭ সালে আইসিসি ট্রফি জিতে নিজেদের উত্থানের ঘোষণা দেয়া বাংলাদেশ ১৯৯৯ সালে প্রথমবারের মতো ওয়ানডে বিশ্বকাপ খেলে। ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাসও পেয়ে যায় টাইগাররা। কিন্তু এরপর থেকে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সাফল্যের খতিয়ান যৎসামান্য। ওয়ানডে বিশ্বকাপে একবার কোয়ার্টার ফাইনাল ও সুপার এইট এবং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দুবার সুপার এইটে খেলাটাই সর্বোচ্চ সাফল্য। অনেক পরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পথচলা শুরু করা যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানও দ্রুতই বাংলাদেশকে পেছনে ফেলছে নৈপুণ্যে। এবারের বিশ্বকাপে মোট সাতটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ । তার মধ্যে তিন ম্যাচে জয়, বাকি চারটিতেই হার।
বাংলাদেশ দলের পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক। ভক্তরা হতাশ হয়েছেন ক্রিকেটারদের ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সেও। চলুন এক নজরে দেখে নেয়া যাক বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কার পারফরম্যান্স কেমন ছিল।
লিটন কুমার দাস : বিশ্বকাপে রানের চেয়ে বল বেশি খরচ করেছেন বাংলাদেশের এই উইকেটরক্ষক ব্যাটার। টুর্নামেন্টে সাতটি ম্যাচ খেলেছেন এই ওপেনার। ৭ ম্যাচে লিটন খেলেছেন মোট ১৪৯ বল; রান করেছেন মাত্র ১৩৯। টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে যা একেবারেই বেমানান। পুরো টুর্নামেন্টে লিটন চার মেরেছেন মাত্র ১২ টি, ছয় মেরেছেন ৩ টি। ৪৯ শতাংশ বল তিনি ডট করেছেন। তার স্ট্রাইকরেট মাত্র ৯৩.৩।
তানজিদ হাসান তামিম : তরুণ ওপেনার তানজিদ হাসান তামিমের খেলার স্টাইল খুব একটা খারাপ না। তাকে নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেটের মাতামাতিও কম ছিল না। অথচ বিশ্বকাপে ৭ ম্যাচের তিনটিতেই ডাক মেরেছেন! এক ম্যাচে ৩৫ ও আরেক ম্যাচে ২৯ ছাড়া আর কোনো ম্যাচেই ভালো খেলতে পারেননি ওপেনার। ৭ ম্যাচে খেলেছেন মোট ৭৯ বল; রান মাত্র ৭৬। ১১ চারের বিপরীতে মেরেছেন একটি ছক্কা। স্ট্রাইকরেট মাত্র ৯৬.২।
নাজমুল হোসেন শান্ত : বিশ্বকাপের আগে হঠাৎ করেই তিন ফরম্যাটেই অধিনায়ক করা হয় নাজমুল হোসেন শান্তকে। তার নেতৃত্বেই এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অংশ নেয় বাংলাদেশ। তবে অধিনায়ক হিসেবে তার যতটুকু দায়িত্ব নেয়ার কথা, তার কতটুকু তিনি পালন করেছেন তা তার পারফরম্যান্সেই স্পষ্ট। বিশ্বকাপে ৭ ম্যাচ খেলে মোট বল খরচ করেছেন ১১৭ টি; রান করেছেন মাত্র ১১২। বাউন্ডারি মেরেছেন ৭টি আর ওভার বাউন্ডারি ৫টি। শান্ত’র স্ট্রাইকরেট মাত্র ৯৫.৭।
সাকিব আল হাসান : বাংলাদেশের ক্রিকেটের পোস্টারবয় সাকিব আল হাসান। বিশ্বকাপে ৭ ম্যাচে মোট বল খেলেছেন ১০৪ টি; রান করেছেন ১১১। এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রান ৬৪। স্ট্রাইকরেট ১০৬.৭। তবে বল হাতেও খুব একটা ভালো ছিল না সাকিবের পারফরম্যান্স। ১৭.২ ওভার হাত ঘুরিয়ে খরচ করেছেন মোট ১৩০ রান। বিপরীতে উইকেট পেয়েছেন মাত্র ৩টি।
তাওহীদ হৃদয় : বিপিএলে বেশ ভালো পারফরম্যান্স করেছেন তরুণ এই ব্যাটার। এরপর জাতীয় দলেও নিজেকে প্রমাণ করেছেন। এই অল্প সময়েই ধীরে ধীরে দলের একজন নির্ভরযোগ্য ব্যাটার হয়ে ওঠেন এই তরুণ ক্রিকেটার। চলতি বিশ্বকাপেও আস্থার প্রতিদান দিয়েছেন এই ব্যাটার। ৭ ম্যাচে তিনি বল খেলেছেন ১১৯ টি; বিপরীতে তার রান ১৫৩। এক ইনিংসে সর্বোচ্চ করেছেন ৪০ রান। স্ট্রাইকরেট ১২৮.৬।
জাকের আলী অনিক : সবশেষ বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে বেশ ভালোই খেলেছেন জাকের আলী। হাতে জোর আছে, মারতে পারেন। তাইতো তাকে নেওয়া হয়েছিল দলে। বিশ্বকাপে সুযোগ দেওয়া হয়েছিল মোট চার ম্যাচে। তবে আস্থার প্রতিদান এতটুকুও তিনি দিতে পারেননি। এক ম্যাচে সর্বোচ্চ ১৪ রান করেছেন জাকের। চার ম্যাচে ৪৬ বল খরচ করে রান করেছেন মোটে ৩৫। তার স্ট্রাইকরেট মাত্র ৭৬.১।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ : মাঝে একবার মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে বাদ দিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছিল বিসিবি। তবে এবারের বিশ্বকাপে ঠিকই দলে ছিলেন এই নির্ভরযোগ্য ক্রিকেটার। তবে শেষ পর্যন্ত তিনিও পারেননি। ৭ ম্যাচে বল খেলেছেন ১০১ টি; মোট রান মাত্র ৯৫। এক ইনিংসে তার সর্বোচ্চ রান ২৫; স্ট্রাইকরেট ৯৪.১। বল হাতেও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। ৯ ওভার হাত ঘুরিয়ে ৫০ রান খরচে উইকেট নিয়েছেন মাত্র একটি।
সৌম্য সরকার : এই বিশ্বকাপে মাত্র দুটি ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন সৌম্য সরকার। প্রথম ম্যাচে ডাক মেরেছেন, পরের ম্যাচে সবশেষ আফগানদের বিপক্ষে রান করেছেন ১০ বলে ১০। সব মিলিয়ে দুই ম্যাচে ১২ বল খেলে তার রান ১০।
তাই বলা যায় হেরে গিয়েও জিতে গেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এবং ক্রিকেটাররা। আর পোয়েটিক জাস্টিস না পাওয়া এদেশের ভক্ত-সমর্থকদের জন্য থাকলো অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাস!
রিশাদ হোসেন : রিশাদ হোসেন, জাতীয় দলে প্রায় নতুন। আর দলে সুযোগ পেয়েই নিজেকে প্রমাণ করে যাচ্ছেন প্রায় প্রতিটি ম্যাচেই। বাংলাদেশ দলে একজন লেগ স্পিনারের অভাব ছিল দীর্ঘদিনের। সেই অভাব এবার ঘুচেছে। বিশ্বকাপেও তার পারফরম্যান্স সবার থেকে ভালো। ৭ ম্যাচে উইকেট নিয়েছেন ১৪ টি; যা কি-না বাংলাদেশের হয়ে এক বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ উইকেট নেয়ার রেকর্ড। ব্যাট হাতেও ছিলেন মারমুখী। যখনই ব্যাটিংয়ে সুযোগ পেয়েছেন তখনই নিজেকে প্রমাণ করেছেন। বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচেই ব্যাটিং করার সুযোগ পেয়েছেন এই লেগ স্পিনার। মোট ২৬ বল খেলে রান করেছেন ৪০। তার স্ট্রাইকরেট ১৫৩.৮। যেটা এবারের বিশ্বকাপে বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
তানজিম সাকিব : ৭ ম্যাচে বল করেছেন মোট ২৪ ওভার। ইকোনমি রেট খুব একটা খারাপ নয় (৬.২১)। এই বিশ্বকাপে নিজের ঝুলিতে উইকেট পুরেছেন মোট ১১ টি। যা কি-না বাংলাদেশের হয়ে এক বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এই তালিকায় সাকিব আল হাসানও রয়েছেন। তবে ব্যাট হাতে সুযোগ পেলেও খুব একটা ভালো করতে পারেননি। ৫ ম্যাচে ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছিলেন। মোট ২৩ বল থেকে তিনি রান করেছেন ১২।
মোস্তাফিজুর রহমান : বাংলাদেশের পেসারদের মধ্যে বর্তমানে অন্যতম সেরা বোলার এখন মোস্তাফিজুর রহমান। বল করার সময় রান যেন তিনি একেবারেই খরচ করতে চান না। বলতে গেলে কিপ্টেমিতে তিনি সেরা। এবারের বিশ্বকাপে হাত ঘুরিয়েছেন মোট ২৬ ওভার। তার ইকোনমি রেট ৫.৪৬। উইকেট নিয়েছেন ৮ টি।
তাসকিন আহমেদ : বাংলাদেশের আরেক পেসার তাসকিন আহমেদ। এবারের বিশ্বকাপে দলের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন ৬টি ম্যাচে। ২১.২ ওভার হাত ঘুরিয়ে তার ঝুলিতেও রয়েছে ৮ উইকেট। ব্যাটিং করার সুযোগ পেয়েছিলেন ৫ ম্যাচে। মোট ৩৩ বল খেলে করেছেন ২৮ রান।
শেখ মাহেদী হাসান : অলরাউন্ডার হিসেবে খেলেতে যাওয়া ডানহাতি মাহেদী হাসান দুই ম্যাচে খেলার সুযোগ পেলেও ভালো করতে পারেননি। দুই ম্যাচের একটিতে শূণ্য এবং অন্যটিতে ৫ রান করার পাশাপাশি আট ওভার বল করে ৫০ রান দিয়ে ছিলেন উইকেট শূণ্য।
টুর্নামেন্টে বাংলাদেশের প্রদর্শনী যেমনই থাকুক না কেন, সুপার এইটে জায়গা করে নেওয়া দলগুলোর জন্য ন্যুনতম প্রাইজমানির ৩ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ ডলার বাংলাদেশ প্রাইজমানি হিসেবে পাচ্ছে। যা বাংলাদেশি টাকায় ৪ কোটি ৪৯ লাখ ২৬ হাজার টাকারও বেশি। এছাড়া এবারের বিশ্বকাপে প্রতিটি ম্যাচ জয়ের জন্য দলগুলো পাচ্ছে ৩১ হাজার ১৫৪ ডলার। সে হিসেবে তিন ম্যাচ জেতা বাংলাদেশ পাচ্ছে ৯৩ হাজার ৪৬২ ডলার, যা বাংলাদেশি টাকায় ১ কোটি ৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬৫৩ টাকার সমান। সব মিলিয়ে বিশ্বকাপ থেকে বাংলাদেশের আয় ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৯৬২ ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকারও বেশি।
তাই বলা যায় হেরে গিয়েও জিতে গেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড এবং ক্রিকেটাররা। আর পোয়েটিক জাস্টিস না পাওয়া এদেশের ভক্ত-সমর্থকদের জন্য থাকলো অপেক্ষার দীর্ঘশ্বাস!