Author Picture

ভাষার ফেরিওয়ালী

ফারজানা অনন্যা

মধ্য দুপুরের সূর্যের উত্তাপ মন্দ লাগছিলো না অগ্নিলার কাছে। ফেব্রুয়ারির ফাল্গুনী রোদ, গ্রীষ্মের প্রখরতার মতো অতোটা নির্দয় নয়। এ রোদ যেন খানিকটা মায়ের হাতের শীল নোড়ায় পেষা কাঁচা হলুদের মতো, এর মিষ্টতা সারা শরীরে তাড়িয়ে তাড়িয়ে মাখতে ইচ্ছে হয়। রাস্তা দিয়ে ব্যাগ কাঁধে এলোমেলো চুলে হাঁটতে হাঁটতে অগ্নিলা ভাবছিলো, ফেব্রুয়ারি মাসটা ওর নিজের কাছে কেন এতো ভালো লাগে? প্রতিটা বছরের শেষদিকে ও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে এ মাসটির জন্য। ‘অপেক্ষা’ করে নাকি ‘প্রতীক্ষা’? ‘ধুর ছাই! কী যে ভাবি!’ নিজের মনেই হাসে। রফিক আজাদ অগ্নিলার প্রিয় কবি। রফিক আজাদের কবিতার ভাব ও ভাষা নিজের অজান্তেই আপন চিন্তায় আটপৌরে রঙে জড়িয়ে ফেলেছে জীবন বুনন সুতোয়। তাই ‘দুঃখ-কষ্ট’ কিংবা ‘অপেক্ষা-প্রতীক্ষা’ শব্দগুলোর পার্থক্য মাঝে মধ্যেই ঘোরাফেরা করে ওর ওই বোহেমিয়ান পাগল পাগল মাথাটায়।

অগ্নিলা বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী। বাংলা ভাষাকে ভালোবাসে আপন সত্তার চাইতেও বেশি। অন্যান্য জনপ্রিয় বিষয়ে ভর্তির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ও যখন স্বেচ্ছায় ভর্তি হলো, তখন অনেকেই উপহাস করেছিলো। পাত্তা দেয়নি সে!
তবে মূল সমস্যা বাঁধলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর। যে চোখভরা স্বপ্ন নিয়ে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে পছন্দের বিষয়ে পড়তে এসেছিলো অগ্নিলা, দেখলো সেখানেই বাংলা ভাষা পদে পদে বিকৃত ও অপমানিত হচ্ছে। বু্কভরা বিশ্বাস আস্তে আস্তে ফিকে হতে শুরু করলো। তবে দমে যাওয়ার পাত্রী নয় সে৷ ওকে থামিয়ে কিংবা দমিয়ে দেয় এমন সাধ্য বুঝি বিধাতারও নেই! ভুল বানানে বাংলা লেখা, বিকৃত উচ্চারণ, সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য নির্মিত টিভি নাটকে ভাষার বিকৃতকরণ, এফ.এম রেডিওর আরজেদের অদ্ভুত উচ্চারণে বাংলা ইংরেজির মিশ্রণে কথা বলা, ইত্যাদি বিষয়ে ও একাই সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করছে। এসব করতে গিয়ে ওকে হাসি-ঠাট্টার শিকারও কম হতে হয়নি!

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্কের ধার ঘেষে হাঁটতে হাঁটতেই অগ্নিলার চোখ পড়লো কৃষ্ণচূড়া আর সোনালু ফুলের দুটো গাছের দিকে! প্রতিদিন অগ্নিলা ইচ্ছে করেই ঘুরপথে এদিক দিয়ে বাসায় যায়। যাতে ফেরার পথের দূরত্ব বেশি হলেও এই ফুলের শোভা ওর আপন চোখে মেখে নিতে পারে। অগ্নিলার কাছে এই ফুলগুলোকে ফেব্রুয়ারি মাসের অনন্য প্রতীক মনে হয়। সোনালুর হলুদ আভা মনে করিয়ে দেয় ফেব্রুয়ারির সৌন্দর্যকে আর কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম রঙ স্মরণ করায় ভাষা শহিদদের আত্মত্যাগকে।

হাঁটতে হাঁটতেই শুনলো কে যেন ওর নাম ধরে ডাকছে। একটু দাঁড়িয়ে পেছনে ফিরতেই দেখলো রফিক হাঁপাতে হাঁপাতে ওর দিকেই দ্রুত হেঁটে আসছে। ‘কী ব্যাপার?’ কাছে আসতেই অগ্নিলার সামনে শার্টের কলার ঠিক করতে করতে ভদ্র হওয়ার বৃথা চেষ্টা নিয়ে রফিক খুব উৎসাহ মাখা কণ্ঠে বললো,
“ওদিককার খবর কিছু শুনেছিস? ব্যাপার তো পুরোই ফাটাফাটি!”

রফিক এমনই! খুব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে হইচই করে সকলকে মাতিয়ে রাখা ওর স্বভাব। তাই অগ্নিলা খুব বেশি কৌতুহল দেখালো না। কৌতুহল দেখালে আর রক্ষে নেই! কথা বলতে বলতে অগ্নিলার কানের পোকা বের করে ছাড়বে রফিক। আরেকটা কারণ হলো, ঘটনা হয়তো খুবই তুচ্ছ! দেখা যাবে, সেই ‘ফাটাফাটি ঘটনা’টি হলো, ক্যান্টিনের বিরিয়ানি আজ খুব ভালো হয়েছে। কিংবা বিপিএল এ রফিকের প্রিয় দল জিতেছে। অগ্নিলা একটু অদ্ভুত ধরণের মেয়ে। ‘ভাষা’ যার অন্তঃপ্রাণ, যার কাছে রূপের চেয়ে কথা ভীষণ দামি, সে নিজেই বেশি কথা বলতে ভালোবাসে না এবং বেশিক্ষণ কথা শুনতেও ভালোবাসে না৷ অন্তর্মুখী অগ্নিলার মনোভাব হলো, কথা হবে অল্প, কিন্তু যার শান হবে হীরের থেকেও ধারালো। স্ফুলিঙ্গের মতো উত্তপ্ত!

হঠাৎ কথা বলতে বলতেই অগ্নিলার চোখে চোখ পড়লো রফিকের। এ চোখ যেন ‘তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ’ টাইপের। তবে এই সর্বনাশের কথা অগ্নিলা জানলে সর্বনাশটা যে সত্যি সত্যি হবে সেটা রফিক ভালোভাবে জানে

যাই হোক, অগ্নিলার ভাবলেশহীন অভিব্যক্তি রফিককে দমাতে পারলো না। আজ বিভাগের নোটিশ বোর্ডে নোটিশ এসেছে একুশে ফেব্রুয়ারি উপলক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তঃবিভাগীয় বারোয়ারি বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে— এটাই মূল ঘটনা। এবার অগ্নিলার ভিতরে একটা চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো৷ বরাবরই অগ্নিলার আগ্রহ এসব বিষয়ে। মাতৃভাষা, ভাষাকেন্দ্রিক যে কোনো বিষয়। আর তাই এতো তড়িঘড়ি করে রফিক জানাতে এলো৷ হলুদ বিকেলে পার্কের বেঞ্চে বসে ধোঁয়া ওঠা আদা চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ওরা দুজন অনেকক্ষণ কথা বললো। কী কী বিষয় আনা যায় বির্তকে! যেহেতু ‘বারোয়ারি বিতর্ক’, তাই দুজন আলাদা আলাদা বিষয়ে কথা বলার সুযোগ পাবে।
হঠাৎ কথা বলতে বলতেই অগ্নিলার চোখে চোখ পড়লো রফিকের। এ চোখ যেন ‘তোমার চোখে দেখেছিলাম আমার সর্বনাশ’ টাইপের। তবে এই সর্বনাশের কথা অগ্নিলা জানলে সর্বনাশটা যে সত্যি সত্যি হবে সেটা রফিক ভালোভাবে জানে।
রফিক তো মোটামুটি পাগল, অগ্নিলা তার থেকেও বড় পাগলী৷ রফিক সর্বনাশের আবেশ ঢেকে বিতর্ক বিষয়ে অগ্নিলার আলোচনাগুলো চুপচাপ শুনে যায়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে। যার যার নীড়ে ফেরে পাখি হয়ে যাওয়া দুটি প্রাণ।

পরেরদিন সকাল সকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে অগ্নিলা জানার চেষ্টা করে বির্তক আয়োজন বিষয়ে বিস্তারিত। আর মাত্র দুদিন রয়েছে বিতর্ক প্রতিযোগিতার। পড়াশোনা, প্রস্তুতি কিছুই নেই।
একটু পড়েই শুরু হয় কবিতার ক্লাস। চতুর্থ বর্ষ দ্বিতীয় সেমিস্টারে অগ্নিলাদের ‘বাংলা কবিতা – ৬’ বিষয়টিতে চারজন কবির চারটি কাব্যগ্রন্থ পাঠ্য। হাসান হাফিজুর রহমান, রফিক আজাদ, আবুল হাসান এবং নির্মলেন্দু গুণের কবিতা। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের কথাগুলো তন্ময় হয়ে শোনে অগ্নিলা। শোনে হাসান হাফিজুর রহমানের সংগ্রামের কথা। যিনি সমকালীন বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক, সাহিত্যিক বিমুখ প্রান্তরে কবিতার পঙ্‌ক্তিমালায় বপন করেছিলেন আশার বীজ। কথিত আছে হাসান হাফিজুর রহমান নিজের জমি বিক্রি করে একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মত্যাগের স্মৃতিকে অমলিন করে রাখতে সম্পাদনা করেছিলেন একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’। বিমুখ প্রান্তর কাব্যের কবিতার শব্দগুচ্ছ অগ্নিলার মস্তিষ্কে সৃষ্টি করে পরাবাস্তবতার।
“মরা মাটি ফুঁড়ে ওঠে জীবনের কায়া
লাল ত্বকে সবুজাভ ক্ষীণ তরু
হলুদ বসন্ত ওরে দেখা দিবি
নাকি এই বিমুখ প্রান্তরে ”

ধূ ধূ করা এক রুক্ষ প্রান্তরে সবুজ গাছের পাতায় অলস দুপুরে ঝরে পড়ে অবিনাশী বর্ণমালা। অগ্নিলা হাত ভর্তি করে কুড়িয়ে নেয়। গলে গলে পড়ে রবীন্দ্রনাথের গানের সুর, ভেসে যায় শুদ্ধ স্বরে। অগ্নিলা স্নাত হয়। হঠাৎ পাশের সহপাঠীর কনুয়েই ধাক্কায় ঘোর কাটে অগ্নিলার। শিক্ষক উপস্থিতি নিচ্ছেন।

আড়ালে অনেকেই ওর বাচনভঙ্গি নিয়ে উপহাস করে৷ বাংলা বানান নিয়েও অগ্নিলার খুঁতখুঁতে স্বভাব। যদিও সে নিজেই প্রচুর বানান ভুল করে। নির্ভুল বানান শেখার চেষ্টা করছে প্রতিনিয়ত। অগ্নিলা ভেবেই পায় না, একটা স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থীরা কীভাবে এরকম একটা বিষয় নিয়ে উপহাস করতে পারে। অগ্নিলা এসব কিছু গায়ে মাখে না। কারণ সে জানে তার বসবাস বিমুখ প্রান্তরে। এই বিমুখ প্রান্তরে সবুজাভ বৃক্ষের বীজ বপন এবং তাকে সযত্নে লালন করার ভার তার ও তার মতো অনেকের। যুদ্ধটা হেরে যাওয়ার জন্য নয়।

ক্লাস শেষে রোজই অগ্নিলা বিজ্ঞান অনুষদের বটতলায় একটু বসে, একা, কেবলই একা, নিজের সাথে নিজে স্বগতোক্তি করে। তবে আজ রফিক সাথে সাথে রাজ্যের কথার ফুলঝুড়ি নিয়ে হাঁটছিলো অগ্নিলার সাথে। বটতলার কাছে পৌঁছে অগ্নিলা দেখে একজন ভদ্রলোক চুপচাপ আনমনে ছবি আঁকছেন। এলোমেলো চুল, ভারি চশমায় রাজ্যের একাগ্রতা শুধুই চিত্রপটের দিকে।

চৈত্রের কাঠফাটা রোদে অগ্নিলার মনে হচ্ছিলো ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন এখনো শেষ হয়নি। আরেকটা বিপ্লব দরকার৷ ভাষার ফেরিওয়ালী আত্মজার হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে হাঁটতে থাকে চৈত্রের গনগনে রোদে! যে রোদের তীব্রতা বায়ান্নোর একুশ তারিখের মতোই বিদ্রোহী!

ওরা দুজন বেঞ্চের এক কোণে বসে বারোয়ারি বতর্ক নিয়ে আলোচনা করছিলো। সামাজিকভাবে বাংলা বিষয়টিকে তুলনামূলকভাবে কম গুরুত্ব দেওয়া, ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশুনা করে বাংলা সঠিকভাবে বলতে না পারা, চাকরির ক্ষেত্রে বাংলার চাইতে ইংরেজি ভাষার দক্ষতার ওপর অধিক গুরুত্বারোপ ইত্যাদি বিষয়গুলোর জন্যই যে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা আজ আমাদের মুখে মুখে এতোটা নিগৃহীত ও নিষ্পেষিত সে বিষয়গুলোই আলোচনা করছিলো ওরা। অগ্নিলার হাতের একটা ছোট খাতা। কথার ফাঁকে ফাঁকে অগ্নিলা লিখে লিখে রাখছিলো। হঠাৎ চিত্রপটের দিকে নিবিষ্ট ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ‘পৃথিবীর সবচাইতে মিষ্টি ভাষা কোনটি জানেন?’ অগ্নিলা জানতো। জাতিসংঘের সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক অধিসংস্থা ইউনেস্কো পরিচালিত ২০১০ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, ‘বাংলা’ বিশ্বের সবচেয়ে মিষ্টি ভাষা। ” ‘বাংলা ভাষার এই এক মাধুর্য, আসছি বলে স্বাচ্ছন্দে চলে যাওয়া যায়’ – সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের মতো এমন করে পৃথিবীর কোনো ভাষার কবি লিখতে পারবে বলেন? এই দেশে না জন্মালে প্রতিদিন প্রভাতে রবীন্দ্রনাথের সুরে স্নান করতে পারতাম? বাংলা বর্ণমালার সৌন্দর্য ধারণ করতে পারতাম? এই দেশে জন্মে আমার নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবান মনে হয়, কেবল ভাষার জন্য! “- ভদ্রলোকের কথাগুলো অগ্নিলার কানে যেন জলতরঙ্গের সৃষ্টি করলো। এই যুগেও এমন একজন তরুণ আপন ভাষাকে এতোটা নিজের মধ্যে এভাবে জড়িয়ে রাখতে পারে? কথাগুলো শোনার সময়ে অগ্নিলা কেবল ভদ্রলোকের চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলো, চোখজোড়া যেন কোনো এক আবেশে সিক্ত। সে আবেশ ভাষার প্রতি, দেশের প্রতি, নিজের আত্মপরিচয় আর শেকড়ের প্রতি!
ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন। ভদ্রলোকের নাম মৃন্ময় রাফসান। চারুকলা বিভাগের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রভাষক। কথা বলে বোঝা গেল, বাংলা ভাষাকে তিনি প্রাণের মতোই ভালোবাসেন, যেমন ভালোবাসেন রং-তুলি- ক্যানভাসের অবয়বকে।

বিতর্ক অনুষ্ঠানের দিনে অগ্নিলা আর রফিক আলাদা আলাদাভাবে দুজনই চমৎকার করে মাতৃভাষার প্রতি তাদের মনোভাব তুলে ধরলো৷ শ’ খানেক শিক্ষার্থীদের মাঝে অগ্নিলা দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলো। অনুষ্ঠান শেষে অগ্নিলা আর রফিক চা খাচ্ছিলো টিএসসিতে৷ কিছু শিক্ষার্থীদের নিয়ে মৃন্ময় রাফসানকেও দেখা গেলো একটু পরই৷ চোখে চোখ পড়তেই অগ্নিলাকে নম্র ভাষায় অভিনন্দন জানালেন। টিএসসির প্রতিটি দোকানে ভুল বানানে শব্দ লেখা। প্রতিটি দোকানের নাম ও নির্দেশনাতেই কোনো না কোনো বানান ভুল আছে। গল্পের ফাঁকে অগ্নিলা ওর একটা ইচ্ছের কথা জানালো। “ইশ! আমার যদি লোকবল আর ক্ষমতা থাকতো তাহলে আমি ঢাকা শহরের প্রতিটি দেয়াল, দোকানের গায়ে ভুল বানানে লেখা শব্দগুলো সঠিক বানানে লিখতাম। বাংলাদেশের বুকে একটা শহর; যে শহরের শরীরে বর্ণমালায় অলংকৃত প্রতিটি শব্দগুচ্ছ নির্ভুল, কী চমৎকার না বিষয়টা? আর সবার আগে আমাদের ভবনের নাম ভাষা শহীদ রফিক ভবন পরিবর্তন করে ‘ভাষা শহিদ রফিক ভবন’ করতাম।” মৃন্ময় রাফসান জানালেন এই স্বপ্নটা তাঁরও। রং তুলি আঁচড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি তাঁর ক্যাম্পাসের বহু ভুল বানানকে নির্ভুল রূপ দিয়েছেন এভাবে। ওরা সকলে মিলে একটা দল গঠন করলো। পুরান ঢাকার দোকান ও দেয়ালগুলোর বানানকে নির্ভুল করাই যার মূল উদ্দ্যেশ্য। একদল পাগলাটে তরুণ-তরুণীর হাত ধরে ঢাকার বুকে প্রথম অঙ্কুরিত হলো ‘রেঁনেসা” দলের৷ যে বিপ্লব ভাষার, যে বিপ্লব চিন্তারাজ্যের!

রমনার সবুজ সিঁড়িতে মৃন্ময়ের হাতে হাত রেখে শরতের আকাশে রংধনু দেখতে দেখতে হঠাৎ অগ্নিলার প্রশ্ন,” বলো তো, পৃথিবীর রংধনু কী?” মৃন্ময়ের সহজ স্বীকারোক্তি, “জানি না! বলো।”
“পৃথিবীর রংধনু হলো প্রজাপতি। দেখো না, কেমন ডানায় রং নিয়ে ছটফটিয়ে উড়ে চলে। ওই আকাশের অনেক কিছুই এই ধরণীতে আছে। আমরা কেবল খুঁজে পাই না। অধরা ওই আকাশের সৌন্দর্যকে ছুঁতে পাই না বলে আক্ষেপ করি। অথচ আমাদের এই মৃন্ময়ী পৃথিবী যে তার বুকে কতো সৌন্দর্য লুকিয়ে রেখেছে, তা ভাবি? ভাবি না! এই যে শরৎকন্যা কাশফুলের গায়ে লেগে আছে মেঘের সাদার মায়া, যেন মেঘের শুভ্রতাকে সে গায়ে মেখে নিয়ে এসেছে পৃথিবীতে।”
কথারা ভালোবাসা হয়ে ঝরছে হৃদয়ে। মৃন্ময় বহুক্ষণ তাকিয়ে রইলো! তাঁর কাছে মনে হচ্ছিলো বিকেলের ম্লান হলুদ রোদে এমন একটা মুখের দিকে তাকিয়ে এই কথাগুলো শুনতে শুনতেই কাটিয়ে দেয়া যায় সাতটা জনম।

বহু বহুদিন পর মৃন্ময় আর অগ্নিলা মৃন্ময়ীকে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। অগ্নিলা আর মৃন্ময়ের জীবনের প্রথম জীবন্ত পুতুল ‘মৃন্ময়ী’। মাটির তৈরি, মাটির মতোই সরল যে মানবী। স্কুলে যাওয়ার পর অভিভাবক সাক্ষাৎকারে ওদের প্রতি যে প্রশ্নগুলো করা হচ্ছিলো তার সবই ইংরেজি ভাষাতে। প্রধান শিক্ষিকার কথা যেন বাংলা – ইংরেজির মিশ্রণে এক চমৎকার জগাখিচুড়ি! হঠাৎ অগ্নিলা প্রশ্ন করে বসলো, “এটি একটি বাংলা ভাষায় পরিচালিত বাংলা মাধ্যম বিদ্যালয়। বিনা কারণে, অপ্রয়োজনে আমাকে কেন ইংরেজি ভাষাতে প্রশ্ন করা হচ্ছে?” মৃন্ময় আর মৃন্ময়ীর হাত ধরে বেড়িয়ে এলো স্কুল থেকে৷ চৈত্রের কাঠফাটা রোদে অগ্নিলার মনে হচ্ছিলো ভাষার প্রশ্নে আন্দোলন এখনো শেষ হয়নি। আরেকটা বিপ্লব দরকার৷ ভাষার ফেরিওয়ালী আত্মজার হাতের মুঠো শক্ত করে ধরে হাঁটতে থাকে চৈত্রের গনগনে রোদে! যে রোদের তীব্রতা বায়ান্নোর একুশ তারিখের মতোই বিদ্রোহী!

আরো পড়তে পারেন

স্বর্ণবোয়াল

মোবারক তার কন্যার পাতে তরকারি তুলে দেয় আর বলে, আইজ কয় পদের মাছ খাইতেছ সেইটা খাবা আর বলবা মা! দেখি তুমি কেমুন মাছ চিনো! ময়না তার গোলগাল তামাটে মুখে একটা মধুর হাসি ফুটিয়ে উল্লসিত হয়ে ওঠে এই প্রতিযোগিতায় নামার জন্য। যদিও পুরষ্কার ফুরষ্কারের কোন তোয়াক্কা নাই। খাবার সময় বাপবেটির এইসব ফুড়ুৎ-ফাড়ুৎ খেলা আজকাল নিয়মিত কারবার।….

প্রতিদান

‘আমাকে আপনার মনে নেই। থাকার কথাও নয়। সে জন্য দোষও দেব না। এত ব্যস্ত মানুষ আপনি, আমার মত কত জনের সঙ্গেই হঠাৎ চেনা-জানা। কেনইবা মনে রাখবেন তাদের সবাইকে?’ বেশ শান্ত গলায় বললেন মিসেস অঙ্কিতা। টেবিল থেকে কি যেন একটা নিলেন তিনি। পিটপিট করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সাফরাব। একটা ইনজেকশন, একটা ছোট টেস্টটিউবের মতো ভায়াল,….

লিলিথ

শাওয়ার বন্ধ করে দিতেই পানির হালকা ঝিরঝিরে শব্দটা বন্ধ হয়ে যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে ঝরনার শব্দ আজকাল বাসাতেই শোনা যাচ্ছে। আর এ শব্দটা অদ্ভুত সুন্দর। কেমন যেন মোলায়েম। সাদা তুলতুলে মেঘের মতো। অনেক দূর থেকে ভেসে ভেসে এসে জড়িয়ে ধরে। চোখের পাতাগুলোয় ঠান্ডা আমেজ ছড়িয়ে ঘাড় বেয়ে নামতে থাকে। আরামে চোখ বুজে আসে আমার। রিলাক্স হতে….

error: Content is protected !!