Author Picture

মুক্তিযুদ্ধ : স্বার্থের অভিঘাতে সাম্য বহুদূর

সৈয়দা সালমা খায়ের

এই বইটি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হলেও, একটু ভিন্ন ধরনের। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরোধী ছিলেন; তারাও মুক্তিযোদ্ধা। যারা নানাভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগীতা করেছেন, যে মা তার সন্তানকে যুদ্ধে যেতে বাঁধা দেননি… তারা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা। (বইয়ের ফ্ল্যাপ থেকে)

মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও এর গোড়াপত্তন হয়েছিল অনেক আগেই। একুশের ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে বীজ রোপিত হয়েছিল তারই ধারাবাহিকতায় স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু। এদেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে দেশকে উদ্ধার করে। বীর মুক্তিযোদ্ধারা যখন দেখেন, যে তিনটি বিষয়কে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন -সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার প্রতি মূহুর্তে ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, তখন তাদের বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হয় বৈকি। (লেখকের লেখা ভূমিকা থেকে)।

আমার পাঠপ্রতিক্রিয়াঃ

সাহিত্য ভালো লাগে। ভালো কোন গল্প উপন্যাস গোগ্রাসে গিলে ফেলি। তবে প্রবন্ধ নিবন্ধের মতো খটোমটো বিষয়গুলো ক্ষুদ্র মাথা ঠিকঠাক বোঝে না। যদিও ইতিহাস সমৃদ্ধ লেখাগুলো খুব টানে আমায়। বিশেষ করে এদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানার আগ্রহ আমার চিরকালের।

‘মুক্তিযুদ্ধ ব্যক্তিসার্থের হাতিয়ার ছিল না ‘ বইটি হাতে পেয়ে মনে করেছিলাম ধীরে ধীরে বইটা পড়ে ফেলব। কিন্তু কিছু কিছু বই একটানা পড়ে ফেলতে মন চায়। আমি মনে করি, এটি সে ধরনের একটি বই। মাত্র আট মাস বিশ দিনের যুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদ দুই লাখ মা বোনের সম্ভ্রমহানীর বিনিময়ে অর্জিত আমাদের স্বাধীনতা নিয়ে ঝরঝরে গদ্যে লেখা এই বইয়ে নিবন্ধের সংখ্যা ২৪টি।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা একেএম শামসুদ্দিনের গবেষণার ফসল এই বইটিতে নাম না জানা অনেক মুক্তিযোদ্ধা, তাদের অবদানের কথা আমি প্রথম জানতে পেরেছি। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবদান, যা কোন অংশেই কম নয়। এমনি একজন মুক্তিযোদ্ধা শংকু সমজদার। মাত্র বারো বছরের এক কিশোর। সেও ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার বিরুদ্ধে মিছিলে অংশ নিয়েছিল। “ইয়াহিয়ার মুখে লাথি মারো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো,’ তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা,মেঘনা,যমুনা’ ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা মানি না, মানবো না। ”

মুক্তিযুদ্ধ ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার ছিলোনা । একেএম শামসুদ্দিন
প্রবন্ধ । প্রকাশক: সৃজন । প্রচ্ছদ: দেওয়ান আতিকুর রহমান । প্রথম প্রকাশ: বইমেলা-২০২৩ । মুদ্রিত মূল্য: ৪০০টাকা
ঘরে বসে বইটি সংগ্রহ করতে মেসেজ করুন ‘সৃজন’-এর ফেসবুক পেইজে— fb.com/srijon2017
রকমারি ডটকম থেকে অর্ডার করতে— www.rokomari.com/book/289430
কল করুন +৮৮ ০১৯১৪ ৬৯৬৬৫৮

শংকু সমজদার রাস্তার পাশেই একজন অবাঙালি ব্যবসায়ী সরফরাজ খানের বাড়িতে উর্দুতে লেখা একটা সাইনবোর্ড নামিয়ে আনতে গেলে ওই বাড়ি থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হলে শংকু সমজদার গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই তার মৃত্যু হয়। এভাবে মৃত্যু মেনে নেয়া খুব কষ্টের।

মুক্তিযোদ্ধা শাহেদ আলী কসাই, ওনার মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার কথাও বইটি পারে জানতে পেরেছি। হানাদার বাহিনীকে উচিত শিক্ষা দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও তার শেষ রক্ষা হয়নি। আমজাদ নামের এক বাঙালি বিশ্বাসঘাতক তাকে ধরিয়ে দেয়। অতঃপর নৃশংস ভাবে তার মৃত্যুতেও হৃদয় ভেঙে যায়।

প্রকৌশলী বুদ্ধিজীবী মো: ফজলুর রহমান, ছোট ভাই মোঃ রফিকুল ইসলাম, ভাগ্নে মোঃ আনোয়ার হোসেনকে পাক সেনা সদস্যরা নৃশংসভাবে হত্যা করে। সৈয়দপুর সেনানিবাসের এক গনকবরে তাদের স্থান হয়। পরে ফজলুর রহমানের ছেলে তার বাবার কবর খুঁজে পায় কেন্দ্রীয় ডাস্টবিনের নিচে। একজন মুক্তিযোদ্ধার এতবড় অসম্মান মেনে নেয়া যায় কী?

তাছাড়া ভয়াল ১৩ জুনের গোলাহাট গনহত্যার বর্ণনা পড়ে আমি কান্না সংবরণ করতে পারিনি। ব্যবসায়ী, শিশু,মহিলা, বৃদ্ধ কেউই এই নৃশংসতার হাত থেকে রেহাই পায়নি। এটা ছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একটা বিশ্বাসঘাতকতার দলিল।

সমাজের স্বার্থান্বেষী মহল যখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নিজেদের উন্নতির পথে নানাভাবে ব্যবহারে ব্যাস্ত তখন একেএম শামসুদ্দিনের সাহসী বই ‘মুক্তিযুদ্ধ ব্যক্তিসার্থের হাতিয়ার ছিল না’ পাঠককে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে প্রকৃত ইতিহাসের ক্লাসরুমে

মুক্তিযোদ্ধা জগতজ্যোতির অবদান। মুক্তিযুদ্ধের পর কষ্টময় জীবন। তার ছেলের চাকরি, চাকরি জীবনে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানের চরম অসম্মান ভীষণ হৃদয় ছোঁয়া। তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জর্জ দাসের শেষ জীবনও দারিদ্র্যের কষাঘাতে  জর্জরিত ছিল। এমনি অনেক নাম জানা, না জানা মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে আমরা তারামন বিবির নামটিও দেখতে পাই। ১৪/১৫ বছরের এক কিশোরীর যুদ্ধে অবদানও কম নয়। শেষ বয়সে যদিও তিনি কিছুটা সম্মানে সম্মানিত হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও তার আক্ষেপ ছিল। “সবাই না দেশজুড়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ‘মুক্তিযুদ্ধ’ বলে চিল্লাচিল্লি করে! মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে…তাহলে এখন মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এত বৈষম্য কেন? যুদ্ধের সময় তো আমরা সবাই এক ছিলাম। এখন কেন এমন হ’ল? সরল প্রশ্ন ছিল মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবির।

একেএম শামসুদ্দিন তাঁর বইয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত বীরদের খোঁজার চেষ্টা করেছেন যত্নের সঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা আজ অবধি হয়নি, রাজাকারদের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে পড়ে। ফলশ্রুতিতে মুক্তিযোদ্ধারা কষ্ট পায়।

তাছাড়া ১৯৭১, মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখকের বয়স ছিল আট কি নয় বছর। কিছু স্মৃতির কথা বইটিতে তিনি তুলে ধরেছেন। তার দুই ভাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা তার বড় বোনের স্বামীকে হত্যা করে। কষ্টকর স্মৃতি। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে তরুণরা ইতিহাস চর্চা করে কম। তাদের আড্ডায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টি আসে না। যেটা সমাজ ও জাতির প্রতি দায়বদ্ধ লেখক একেএম শামসুদ্দিনকে প্রচণ্ড আহত করে।

সমাজের স্বার্থান্বেষী মহল যখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে নিজেদের উন্নতির পথে নানাভাবে ব্যবহারে ব্যাস্ত তখন একেএম শামসুদ্দিনের সাহসী বই ‘মুক্তিযুদ্ধ ব্যক্তিসার্থের হাতিয়ার ছিল না’ পাঠককে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে প্রকৃত ইতিহাসের ক্লাসরুমে।

সৃজন প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এই বইটির প্রচ্ছদ করেছেন দেওয়ান আতিকুর রহমান। প্রকাশকাল মাঘ ১৪২৯, ফেব্রুয়ারি২০২৩। অনলাইন পরিবেশকঃ রকমারি ডট কম।

আরো পড়তে পারেন

কুদরত-ই-হুদার ‘জসীমউদদীন’ ও আমাদের জসীমউদদীন চর্চা

প্রাবন্ধিক ও সাহিত্য সমালোচক ড. কুদরত-ই-হুদা দীর্ঘসময় ধরে বাংলা সাহিত্যের তথা বাংলাদেশের সাহিত্যের পট পরিবর্তনে অগ্রণী ব্যাক্তিত্ব ও মেধাবী সাহিত্যিকদের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করে আসছেন। অন্যান্য দিকপাল কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে কবি জসীমউদদীনের জীবন ও কর্ম নিয়ে তাঁর আগ্রহের জায়গাটি যতটা না পেশাগত তার চেয়ে বেশী আবেগ তাড়িত। চিরায়ত বাংলার ধারক, কবি জসীমউদদীনের জন্মস্থান….

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনার বাতিঘর

এমনটি হতে পারে এবং হয়েছে সে বিষয়ে বিদগ্ধ লেখক প্রশ্ন তুলেছেন এবং সংশ্লিষ্টদের কাজের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেছেন। দেখুন, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের চেতনার বাতিঘর। আমাদের অস্তিত্ব। সেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সেভাবে কথা বলা যায় না; মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কিংবা পরবর্তীকালে যেসব ষড়যন্ত্র হয়েছে কিংবা এখনও হচ্ছে তা নিয়ে কথা বলার মানুষের সত্যিকার অভাব রয়েছে। সেখানে মুক্তিযুদ্ধ পরিবারের সন্তান….

মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর

‘মুক্তিযুদ্ধ ব্যক্তিস্বার্থের হাতিয়ার ছিল না’ নামে একেএম শামসুদ্দিনের এই প্রবন্ধ সঙ্কলনটির কেন্দ্রস্থলে যে মুক্তিযুদ্ধ রয়েছে সে-সংবাদটি বইয়ের নামকরণেরই উপস্থিত। লেখক নিজে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য। তাঁর আপন দুই ভাই যুদ্ধে গেছেন, ভগ্নিপতি প্রাণ হারিয়েছেন পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাতে। যুদ্ধের সময়ে তাঁর বয়স ছিল অল্প, মাত্র ছয়-সাত বছর, নাহলে তিনিও যুদ্ধে যেতেন; সে-মনোভাব সঙ্কলনের প্রতিটি রচনায় প্রতিফলিত। যুদ্ধের সময় তিনি অনেক….

error: Content is protected !!