Author Picture

একটি কথার দ্বিধা থরথর চূড়ে

আনেয়ারুল হক

টাউনহল মঞ্চে মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে উজ্জ্বল আলোর নিচে চোখ সয়ে এলে দর্শক সাড়িতে কে বসে আছে বুঝা যায়। প্রথম সাড়িতে সোজা চোখ পড়তেই তার বুকের ভিতরে ধক্ করে যে আওয়াজ হলো, তা শুনতে পেলো ইয়ামিন। শোনা তো অনেক সময় শরীরে মনে ক্রিয়া করে না। কিন্তু তার সামনে যে বসে আছে তাকে এখানে দেখা এবং তার প্রতিক্রিয়া অন্যরকম বলেই বুকের ভিতরের ডিপ ডিপ শব্দটা ইয়ামিনের সাড়া শরীরে ক্রিয়া করলো। মৃদু কাঁপন তুলে বুকের শব্দটা উঠে এসে তার গলা এবং ঠোঁট শুকিয়ে দিল। যার ফলে সে আর কোন কথা বলার ক্ষমতা পেল না। যতবার সে কথা বলতে চায়, ততবার ময়নার চোখের উপর চোখ পড়ে যায় আর তার গলা শুকায়।

আলো ঝলমলে খোলা মঞ্চ, কুমিল্লা টাউন হল ভর্তি নাটক দেখতে আসা দর্শক তাকিয়ে আছে ইয়ামিনের দিকে। আর ইয়ামিন বোবার মত তাকিয়ে আছে সামনের প্রথম দর্শক সাড়িতে বসে থাকা ঠিক তার সোজা ময়নার দিকে। যাকে কলেজের করিডোরে, বিপনি বিতানে, রাস্তায় হুড তোলা রিক্সায় দেখলে তার গলা শুকায়, কথা আটকে আসে গলায়, যদিও সে তার বন্ধু বটে। অথচ এই ইয়ামিন সর্বত্র বাকপটু হিসেবে পরিচিত। বিতার্কিক। ভিক্টোরিয়া কলেজের যে কোন বিতর্কে তার পারফরমেন্স সবসময় সেরা। নিজের তৈরি একটি নাট্যগোষ্ঠির প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক। কিন্তু যেদিন থেকে তাকে সে কলেজের করিডোরে, পরিচয়ের পরে নিজের নাট্যগোষ্ঠিতে পেলো সেদিন থেকেই ইয়ামিন ধীরে ধীরে টের পেতে শুরু করলো, ময়না নামের মেয়েটি দলের রিহার্সেলে হোক আর একা, কিংবা কোথাও আড্ডায় সামনে থাকলে ওর মুখ থেকে কথা সরে না।

আজ এদিকে অনুষ্ঠান ঘোষক একটু আগে ঘোষণা দিয়েছে, সুধিমণ্ডলী, আজকের নাটকের লেখক এবং পরিচালক ইয়ামিন হক আপনাদের স্বাগত বক্তব্য দেবে এবং তারপরই শুরু হরে নাটক ‘দেখা না দেখা’, মিউজিক্যাল ড্রামা। কুমিল্লার মঞ্চে এই প্রথম আধুনিক আঙ্গিকের মিউজিক্যাল ড্রামা। এই ঘোষণার আগে ইয়ামিন প্রস্তুত হয়েই ছিল, কী বলবে সেটা মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল। তাই ধীর পায়ে এসে স্বভাবসুলভ দাঁড়িয়েছে মাইকের সামনে। অনতিদীর্ঘ শ্যামলা গয়ের রংয়ের যুবক ইয়ামিন। নীল সাদা পাঞ্জাবি পাজামা পড়া। গলায় খাদি ঘরের উরনি। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা কালো চুলের সুদর্শন। বন্ধু মহলের প্রিয় সে। সপ্রতিভ। কিন্তু সে কি জানতো যে, এই গলা ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ময়নাকে দেখার পর থেকে বারবার ঘটতে থাকবে !

বিষয়টি ইয়ামিন টের পেয়েছে মাস ছয়েক আগে। অনুভব করার পর থেকে ইয়ামিন খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে, ময়না অবসরে তার মনোয়োগও কেড়ে নিয়েছে অনেকখানি। যে সময়ে সে বই পড়তো, গান শুনতো, আড্ডায় যেতো, লিখে সেই সময়গুলোর অনেকখানি এখন আর তার দখলে নেই। নাটক, কবিতা যাই লিখুক না কেন, তার মনের আয়নার সামনে ময়না এসে দাঁড়িয়ে থাকে।

মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে ইয়ামিন চুপ করে ইতিউতি করছে দেখে উইংন্সের পাশে দাঁড়ানো নাদিম মাইক ঠিক করে দেবার উছিলায় দৌড়ে সামনে এসে চোখের ইশারায় তাকে সজাগ করতে চেষ্টা করলো। নাদিমকে দেখে ইয়ামিন সম্বিত ফিরে পেয়ে বুক জোড়া শ্বাস নিল। গলা মৃদু খাকড়ি দিয়ে আবার তৈরি হলো। চোখের ইশারায় ঠিক আছি বলে সে নাদিমকে যেতে বললো। নিজের উপর জোর খাটলো। ভাবলো, সামনে বসা ময়নার দিকে সে তাকাবে না। সেই মত, হল ভর্তি দর্শকের জোড়া গোড়া চোখ দেখতে দেখতে দর্শকদের কেবল শুভেচ্ছা জানালো। সম্বোধন শেষে নাটকের নাম, দেখা না দেখা’ বলা শেষ করেই আবার চোখ পড়লো ময়নার চোখের উপর।

দর্শক সাড়িতে ময়না হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ইয়ামিনের দিকে। চোখ দেখে মঞ্চ থেকে বুঝা যাচ্ছে না ঐ চোখে নিছক তার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কোন মোহ লুকিয়ে আছে কি না ! ইয়ামিন দেখলো, সে তাকিয়ে আছে দেখে ময়না সোত্সাহে হেসে হাত নাড়লো। কিন্তু গিয়ার আপ হওয়ার বদলে তাতে যেন ইয়ামিনের আরো বেশি করে পানির তেষ্টা পেলো। মাঝামাঝি দর্শক সাড়িতে বসা সাত আটজন বন্ধু সপ্রতিভ ইয়ামিনের থমকে থাকা, কথা হাতড়ানোর ব্যাপারটা টের পেয়ে বেশ উপভোগ করেই সমস্বরে শ্লোগানের মত আওয়াজ তুললো,
ইয়ামিন. আই মিন। ইয়ামিন, আই মিন। মিথ্যে নয়, আই মিন’ এই বাক্য ইয়ামিন তার বক্তৃতায় অহরহ ব্যবহার করে। এটা লক্ষ করে তার কাছের বন্ধুরা তাকে ইয়ামিন না ডেকে আড়ালে আই মিন বলে ডাকে। হাসাহাসি করে। ইয়ামিন জানে। আঁতে ঘা লাগার মতো বন্ধুদের এই শ্লোগান তাকে সচেতন করতে সাহায্য করলো। তারপর কোন রকমে ঘামতে ঘামতে সে দর্শকদের নাটক দেখার আমন্ত্রণ জানিয়ে বক্তৃতা শেষ করে মঞ্চ ত্যাগ করলো না বলে বলা ভালো, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।

দুই
মঞ্চে নাটক শুরু হয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। ফাঁকা করিডোরে একটু ধাতস্থ হয়ে চোখে অন্ধকার লাগা হল রুমে ঢুকে প্রথম সাড়িতে দুইজনের একটি সোফায় জায়গা পেয়ে ইয়ামিন বসেই দেখতে পেলো পাশে ময়না। ভাললাগা এবং অস্বস্থি দুটোই হলো তার। যাকে দেখলে সে আনমনা হয়, গলা শুকায়, বুক ঢিপ ঢিপ করে তাকে পাশে পেলে ভালো না লাগার প্রশ্নই উঠে না। তবে একটু আগে মঞ্চে মাইকের সামনে যার জন্যে স্বতস্ফূর্ত কথা বলা গেল না তাকে হতের কাছে পেয়ে রাগ হবে না, তাও ঠিক নয় ! কিন্তু ময়নার পড়নের শাড়ি থেকে মৃদু জেসমিনের গন্ধ না কি গন্ধটাই অন্যরকম একটা কিছু তার মগজের উপর নরম হাত বুলিয়ে দিয়ে ইয়ামিনকে নমনীয় করে দিল।
ময়না পাশ ফিরে ইয়ামিনকে দেখে খুশি হয়ে মৃদু স্বরে তাকে শুভেচ্ছা জানালো।
ইয়ামিন খুশি হলো কি না বুঝা গেল না। সে মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-নাটক দেখতে এলে যে ! তোমার না ঢাকা যাওয়া কথা ?
-যাইনি। বাতিল করেছি। আজ আমি নাটক দেখবো বলে বাবাকে রাজি করিয়েছি, ঢাকা কাল সকালে যাবো। ঠিক করেছি না ! কি বলো ? খুশিতে ঝলমল করছে ময়না।
ঠিক তা উল্টো মুখ চোখা করে জবাব দিল ইয়ামিন, না, ঠিক হয়নি।
প্রায় আহতের স্বরে ময়না পাশে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করে,
কেন, ঠিক হয়নি কেন বলতো ?

এর জবাব কী দেবে ইয়মিন !
তার কোন অনুষ্ঠানে প্রেমিকা সামনের সারিতে উপস্থিত থাকলে জগতের সব প্রেমিক খুশি হয় ।
আর কী আজব ! এই নব্য প্রেমিক অখুশির ভাব দেখাচ্ছে ! ময়নার বান্ধবী রীতাকে ইয়ামিন সকালে ফোন করে কনফার্ম হয়েছে, জেনেছে- ময়না আজ বিকেলে ঢাকা যাবে। ফলে ইয়ামিন মনে মনে নিশ্চিত ছিল, যাক বাবা, বাঁচা গেল ! কোন সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা নেই ! সে শান্তিতে কথা বলতে পারবে।
হলো না। যা হবার তাই হলো। তাও যদি ময়না দর্শক সাড়িতে এমন জায়গায় বসতো যে, ভীড়ে ওর দিকে চোখ পড়লো না, তাহলেও তো হতো ! তা না, একবারে সামনের সাড়িতে মুখোমুখি বসে আছেন !

ময়না আবারো মৃদু স্বরে ধমকে উঠলো, বললে না, কেন নাটক দেখতে আসা ঠিক হয়নি ? না বললে কিন্তু আমি এখুনি উঠে চলে যাবো। নাটক দেখবো না।
ইয়ামিন এবার বিব্রত হলো। অস্বস্তি হলো এমন কথা বলে ফেলে। কোন রকম প্রলেপ দিল, না না আমি তা বলিনি। বলছিলাম- আবার ইয়ামিনের গলা ঠোঁট শুকাতে শুরু করলো। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো, নাটক দেখতে হলে মাঝামাঝি জায়গাটাই তো দেখতে আরাম। সেখানে বসলে পারতে। বন্ধুদের ফেলে এখানে একা বসে আছো। তোমার খারাপ লাগছে না ?
-তাতে তোমার সমস্যা কি ?
ইয়ামিন মনে মনে বললো, সমস্যার তুমি কি বুঝবি ! যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। মুখে বললো, সমস্যা নেই। সমস্যা আবার কি ! তবে- মঞ্চের আলোতে হলে পাশাপাশি বসে থাকা মানুষের মুখ একসময় স্পষ্ট হয়ে উঠে। দেখা যায়। ময়না ইয়ামিনের মুখের দিকে পলকহীন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তার চোখ বলে দিচ্ছে, সে জানতে আগ্রহী, একটি মাত্র শব্দের দোলায় ময়না আবারো ছায়াবিহীন আয়না হয়ে উঠেছে। চোখের কোণে ময়নার অভিব্যক্তি, আধোআলো-আধাঁরে ওর পাশ ফিরে কোমর বাঁকিয়ে তাকিয়ে থাকার ভঙ্গিতে যে কাতরতা ফুটে উঠেছে, তাতে ইয়ামিন মুগ্ধ হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে কিছুক্ষণ ময়নাকে দেখে।
আজকাল মেয়েরা শাড়ি পড়েই না। কিন্তু ময়না নিয়মিত ভিন্ন পাড়ের শাদা শাড়ি পড়ে। তাকে শাড়িতে মানায় ভালো। কলেজে, বিয়েতে নিমন্ত্রণে, অনুষ্ঠানে ময়না ঋতু, দিবস মিলিয়ে শাড়ি পড়ে। ভিক্টোরিয়া কলেজে বাংলা সাহিত্যে অনার্স পড়ার শুরু থেকেই সবাই দেখেছে, জেনেছে এই মেয়ে গতানুগতিক নয়। একটু অন্যরকম। মাননাসই সাজগোজ, দৃষ্টি নন্দন তার বেশভূষণ। ঋতু লাগে না। প্রতিদিন ময়না শিউলি ফুল হয়ে ফোটে।
ইয়ামিন অর্থনীতিতে ফোর্থ ইয়ার আর ময়না থার্ড ইয়ার। সংস্কৃতি সাহিত্য রুচির কারণেই ইয়ামিনের নাটকের দল গঠন আর তাতে ময়নাও একজন সহযাত্রি হয়ে গেল একদিন। হাসিখুশি সদালাপি ময়নাও সবার পছন্দের বন্ধু। ইয়ামিনেরও। মেয়েরা যেসব বিষয় টের পায় আগেই তার মধ্যে মন দেয়া-নেয়ার গন্ধটা প্রথম। মেয়েদের শরীরই তাদের জানিয়ে দেয় মহুয়া সংবাদ। জানা কথা, সমবয়সী একটি ছেলের চেয়ে একটি মেয়ে আগে প্রাপ্তবয়ষ্ক হয়। ময়না চৌকশ মেয়ে। ইতোমধ্যে সেও প্রায় জেনে গেছে, মনে মনে সে যেন ইয়ামিনের বন্ধুর চেয়েও একটু বেশি। আজকের নাটকের বিষয়বস্তুও যেনো ঠিক সেরকমই ভাবের দিকে থেকে লেখা।

অসত্য নয়, ময়নার বাবা-মায়ের সঙ্গে তাঁদের কী এক জরুরী কাজে আজ ঢাকা যাওয়ার কথা ছিল। অবচেতন মন তাকে যেতে দিল না। নাটকটির প্রথম শো দেখার প্রবল ইচ্ছায় সে বাবাকে ঢাকা যাওয়া একদিন পেছাতে রাজি করিয়েছে। রিহার্সেল দেখে দেখে, তার মনে হয়েছে, নাটকটিতে অন্যরকম কিছু আছে। যা তার মনের কথা। যা সে প্রকাশ করতে পারে না লজ্জ্বায়। সঙ্কোচে, অজানা অনুরাগে। সবাই জানে, সে কুমিল্লায় নেই, ঢাকায়। এজন্যে, কাউকে কিছু না বলে ঘোষণার আগে চুপচাপ নাটকের দর্শক হয়ে সামনের সোফায় জায়গা পেয়ে বসে গেছে। উদ্বোধনের সময় ইয়ামিনের বিব্রত হওয়াটা লক্ষ করেছে। মজা পেয়েছে। তখন কিছু মনে হয়নি। কিন্তু, এখন যেন মনে হচ্ছে, অন্যরকম, অন্যকিছু !

ময়না জোর দিয়ে জানতে চাইল, তবে ? চাপা গলায় প্রায় নি:শ্বাস বন্ধ করে ইয়ামিন বললো, তবে আর কি, এখন নাটক দেখো ! কথা বলো না। পরে বলবো। নাটক দেখতে আর মন বসলো না ময়নার। তবুও চোখ আটকে গেলো তার, মঞ্চে নায়িকার সামনে দাঁড়িয়ে নায়কের আকুতিতে- বুঝিস্ না তুই, তোকে দেখলে আমার নি:শ্বাস আটকে আসে, আমি সবকিছু ভুলে যাই। যা বলতে চাই তা আর বলতে পারি না ! তুই চলে যা, তুই চলে যা আমার সামনে থেকে ! এ সময় দৃশ্য বদল হলো।  মঞ্চ অন্ধকার হলে ময়না সত্যি সত্যি উঠে হলের বাইরে চলে এলো। তার চোখ জ্বালা করছে। হলের ভিতরে এসি থাকলেও দর্শকের নি:শ্বাসে-প্রশ্বাসে ভেতরটা উষ্ণ হয়ে উঠছে ক্রমশ। তার উপর ইয়ামিন তার কথার জবাব না দেওয়াতে ময়নার রাগ হয়েছে। ভিতরে ভিতরে অস্থির হয়ে পড়ছিল সে, যদিও তার স্বভাব এমন নয়। কৌতুহল দমন করতে জানে মযনা। কিন্তু ভদ্রতা ডিঙিয়ে কারো কোন বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করতে সে জানে না।
মনের তাগিদেই সেই সীমারেখাটা সে ডিঙিয়ে ছিল। ইয়ামিন জবাব দিল না।
টের পেল ইয়ামিন টাউনহলের ফাঁকা বারান্দায় তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ময়না তাকে কিছু না বলে কোলাপসিবল গেইটের দিকে হাঁটতে শুরু করলো। ইয়ামিন অগত্যা তাকে জিজ্ঞেস করলো,
কী হলো ময়না, চলে যাচ্ছো যে ! নাটক দেখবে না !
দেখছি তো ! হলের ভিতরে বাইরে তোমার নাটকই তো দেখছি।
কথাটা শেষ না করে আর কোন কথার সুযোগ না দিয়ে ময়না টাউনহলের গেইটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা রিক্সায় উঠে পড়লো। হতভম্ব ইয়ামিনকে পিছনে রেখে হাত নেড়ে আপাতত নাটকের দৃশ্যান্তরে চলে গেল ময়না।

তিন
সপ্তাহ দুই পরে ঢাকা থেকে কুমিল্লা ফিরে এলো এক বোঝা ভাবনার আরেক ময়না।
তার অজান্তেই বিয়ের কথাবার্তা নাকি হয়ে চলছে ওর বাবার বন্ধুর একমাত্র ছেলের সঙ্গে। এজন্যে মেয়ে দেখাতে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া। নিজস্ব আইটি ফার্মের মালিক, ছেলে তাকে দেখে পছন্দ করেছে। মেয়ের ছেলে পছন্দ হয়েছে কি না, এ কথা অবশ্য কেউ তাকে এখনও জিজ্ঞেস করেনি। এত যে সমাজ এগিয়েছে বলা হয়, এখনও অনেক পরিবারে তাদের মেয়েদের পছন্দ-অপছন্দকে অবিভাবকরা পাত্তা দিতে চায় না। মাত্র এক মেয়ে ময়নাদের পরিবার শিক্ষিত বটে তবে তারাও মনে করে বসে আছেন যে, তাদের মেয়ে বাবা মায়ের পছন্দের পাত্রকে অপছন্দ করবে না। তারা যা বলবেন তাতে ময়না রাজি হবে। এই বিশ্বাসে ওর বাবা-মা তাকে কিছু না বলেই পাত্রকে দেখাবার জন্য ঢাকায় ওর খালার বাসায় নিয়ে গেছেন। ঘরোয়া পরিবেশে পাত্র তার বাবা-মা আর ছোট বোনকে নিয়ে দেখতে এসেছে। মধ্যাহ্ন ভোজ শেষে যাবার সময় তারা পাত্রি পছন্দ হয়েছে জানিয়ে দিয়ে গেছে। ময়নার দিক থেকে পাত্র অপছন্দ হওয়ার মতো না হলেও ময়না পাত্রপক্ষের তাকে পছন্দ হয়েছে জানার পর ওর নিজের ওপরই রাগ হলো। কেউ তো তাকে জিজ্ঞেস করলো না পাত্র তার পছন্দ হয়েছে কি না ! কেবল মেয়ে হয়ে জন্মেছে বলেই এই নিয়ম !
আজ যদি সে পাত্র হতো আর ঐ পাত্রটি পাত্রি হতো, তাহলে কি নিজেকে তার ময়নার মতই কোরবানীর হাটে তোলা পশুর মনে হতো ? না, হতো না !
এইসব ভাবতে ভাবতে ময়নার এই গত কয়েকদিন কেবলই ইয়ামিনের মুখটা মনে পড়েছে। তবে ?

তবে বুঝিয়ে বলার সময় হবে কি তার আর ?
এতো মুখচোরা কেন সে ? ‘ভালবাসি’ এই কথাটা মুখ ফুটে বলার সাহস নেই কেন ওর !
নাটকে তো তাই বলে বসে আছে ! মনে মনে রাগ করে আরও দুইদিন ময়না কলেজেই গেল না। অপেক্ষা করলো। কতবার মোবাইল হাতে নিয়েও ইয়ামিন ফোন করলো না বলে রেখে দিলো।
যার জন্যে ময়নার অপেক্ষা সে আর অপেক্ষা করলো না শেষমেষ।
তৃতীয় দিন সকাল দশটার দিকে ইয়ামিন ময়নার ঝাউতলার বাসার দরজার কড়া নাড়লো। মুখ চোখ ম্রিয়মান ময়না দরজা খুলতেই সামনে তাকে দেখে ইয়ামিন যা বলবে বলে ভেবে এসেছিল, তা ভুলে গেল। ঘরে ঢুকে ড্রইংরুমে বসতে বসতে হাসিমুখে জিজ্ঞেস করতে পারলো,
-কি হলো, ঢাকা থেকে এসে কলেজে যাও না, তাই দেখতে এলাম অসুখ বিসুখ হয়নি তো ? নতুন নাটকের রিহার্সেল শুরু হয়েছে। এবারে মেইন রোলটা কিন্তু তুমি করবে।
ইয়ামিনকে দেখে ময়না খুশি হলো কিন্তু নিজেকে প্রকাশ হতে দিলো না। বললো, পারবো না ইয়ামিন ভাই। আমার বিয়ে ঠিক হতে যাচ্ছে । সময় পাবো না বোধ হয় !
কি, কি বললে ? প্রশ্নটা করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে গেল ইয়ামিন।
ময়নার ভিতরটা ইয়ামিনের আঁতকে উঠা দেখে এই প্রথম কী যেন ভাললাগায় নড়েচড়ে উঠলো। আটলান্টিকে ভেসে আসা বৃহত্ বরফের চাঁই যেভাবে টাইটানিকে ধাক্কা খেয়ে গুড়িয়ে দিয়েছিল সম্ভ্রান্ত অহংকারকে, ঠিক তেমনি ময়নার কথার আঘাতে ইয়েমিনের মনের বন্ধ অচলায়তন ধাক্কা খেয়ে ভেঙ্গে পড়লো। হঠাত্ আহত যন্ত্রণার রক্তক্ষরণ দুদিক থেকে দুজনের অন্তরে নেমে এলো গিরিখাত বেয়ে।
কথাটা বলার পর মুখের রঙ বদলাতে লাগলো ময়নার। সে দাঁড়িয়ে ছিল অদূরে। চোখে জল এস গেলো তার।
ইয়ামিন বসতে ভুলে গেছে যেন। বললো, তুমি বসো ইয়ামিন ভাই। আমি আসছি। যেয়ো না কিন্তু !

দ্রুত কাপড় বদলে ঘর থেকে বের হয়ে ধর্মসাগড়ের উত্তর পাড় বকুল তলায় ঘাটের সিঁড়িতে চলে এলো ওরা দুজনে। সিঁড়ির উপরে নজরুল ইন্সটিটিউটের খোলা চত্বরে কোন একটি সংগঠনের গোটা চার পাঁচেক ছাত্র-ছাত্রি আবৃত্তি শিখছে। এ ছাড়া এই মনোরম হেমন্তের সকাল এগারটার দিকে আশেপাশে আর কেউ নেই। সবটুকু সময় অনন্তের হাতে ছেড়ে দিয়ে ওরা দুজন বিশাল জলের আধারের জল সিঁড়িতে অপার হয়ে বসে আছে। কেউ কোন কথা বলছে না। ইয়ামিন কতবার চেষ্টা করেছে, কিছু বলার জন্য। কিন্তু তার মুখ থেকে সব শব্দই যেনো গেছে হারিয়ে। আর ময়নাও যেনো অনন্তকাল ধরে একটি বয়ষ্ক শিশুর কানে কান পেতে বসে আছে সেই কথাটি শোনার জন্য, যে কথাটি শোনার কত কবি, কত শিল্পী বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করে, রাজ্যপাট বিলিয়ে দেয়।

দুপুরের রোদটা তেতে উঠলে ময়না ইয়ামিনকে নিয়ে বকুলের ছায়ায় সরে এলো। নানা জাতের পাখিগুলোর কথোপকথন শুনতে শুনতে একসময় ময়নাই বুকের নিরবতা ভাঙলো, কিছু বলবে না ইয়মিন !
ইয়ামিন ময়নার চোখে চোখ রাখে। বলার জন্য মুখ খুলতে গিয়ে ডান হাতে ঘামে ভেজা মুখ মুছে এদিকে তাকায়, ওদিকে তাকায়। যেনো কোন অবলম্বন খুঁজছে। ময়না ওর হাত ধরে। যেনো অবলম্বন পেলো। সাহস ফিরে পেয়ে কাতর স্বরে বললো, বিয়েটা না করে দিলে হয় না ?

যেনো ভার মুক্ত হলো ময়নার ভারি বুক। তার ভিতর থেকে বকুল বকুল একটা গন্ধ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়লো। দুই চোখ থেকে শিরিষের পাতার নরম কোমলতা শাদা শাড়ির লাল পাড় ছুঁয়ে তার কপোলে এসে জড় হলো। কমনীয় হাতের আঙুল থেকে ঝরে পরলো অপূর্ব স্নিগ্ধতা। বললো, হয়। তবে- ইয়ামিন শ্বাস ফেলতে ভুলে গেল। ময়না ওর হাতের কাঁপুনি টের পেলো ওর হতে। এটা তার ভীষণ ভাল লাগে। মুখে না বলুক, ইন্দ্রিয় তো থেমে নেই। সে তো জানান দিয়েই যায়। যে টের পায় সে টের পায়। ওর হাত থেকে ময়নার হাতে এসে ধর্মসাগরের সমস্ত জল কাঁপে। আর কী বলার আছে, আর কী বলার আছে- বলতে বলতে নাম না জানা একটা পাখি উড়ে কোনদিকে যায়। ইয়ামিন ময়নার মুখটা উঁচু করে তুলে ধরে বলে, তবে! জবাব না দিয়ে ময়না সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কবিতার পংক্তি আওড়ায়,

একটি কথার দ্বিধা থরথর চুঁড়ে
ভর করেছিল সাতটি অমরাবতী ;
একটি নিমেষ দাঁড়াল সরণী জুড়ে
থামিল কালের চির চঞ্চল গতি।-

এই কবিতা শুনে নাট্যকার ইয়ামিনের মুখের বাঁধন বুঝি আজ প্রথমবারের মতো খুলে গেল। ময়নাকে ডান হাতে তার মুখের সামনে ধরে রেখেই সে বললো,
-থাক্ তবে এইটুকু থাক্, না বলা কথায় সব কথা বলা হয়ে যাক।

আরো পড়তে পারেন

স্বর্ণবোয়াল

মোবারক তার কন্যার পাতে তরকারি তুলে দেয় আর বলে, আইজ কয় পদের মাছ খাইতেছ সেইটা খাবা আর বলবা মা! দেখি তুমি কেমুন মাছ চিনো! ময়না তার গোলগাল তামাটে মুখে একটা মধুর হাসি ফুটিয়ে উল্লসিত হয়ে ওঠে এই প্রতিযোগিতায় নামার জন্য। যদিও পুরষ্কার ফুরষ্কারের কোন তোয়াক্কা নাই। খাবার সময় বাপবেটির এইসব ফুড়ুৎ-ফাড়ুৎ খেলা আজকাল নিয়মিত কারবার।….

প্রতিদান

‘আমাকে আপনার মনে নেই। থাকার কথাও নয়। সে জন্য দোষও দেব না। এত ব্যস্ত মানুষ আপনি, আমার মত কত জনের সঙ্গেই হঠাৎ চেনা-জানা। কেনইবা মনে রাখবেন তাদের সবাইকে?’ বেশ শান্ত গলায় বললেন মিসেস অঙ্কিতা। টেবিল থেকে কি যেন একটা নিলেন তিনি। পিটপিট করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সাফরাব। একটা ইনজেকশন, একটা ছোট টেস্টটিউবের মতো ভায়াল,….

লিলিথ

শাওয়ার বন্ধ করে দিতেই পানির হালকা ঝিরঝিরে শব্দটা বন্ধ হয়ে যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে ঝরনার শব্দ আজকাল বাসাতেই শোনা যাচ্ছে। আর এ শব্দটা অদ্ভুত সুন্দর। কেমন যেন মোলায়েম। সাদা তুলতুলে মেঘের মতো। অনেক দূর থেকে ভেসে ভেসে এসে জড়িয়ে ধরে। চোখের পাতাগুলোয় ঠান্ডা আমেজ ছড়িয়ে ঘাড় বেয়ে নামতে থাকে। আরামে চোখ বুজে আসে আমার। রিলাক্স হতে….

error: Content is protected !!