Author Picture

প্রায়শ্চিত্ত

মাহবুবা হোসেইন

বাইরে ঝাঁঝাঁ রোদ, ডাইনিংএ খেয়ে এসে রূপা ভাবল একটু গড়িয়ে নিবে, বিকেলে ডিশেক্সন ক্লাস, সেকেন্ড প্রুফ পরীক্ষা সামনে, সকালে গোছল সেরে গেছে, এখন আর ঐ ঝামেলা নেই। গাইনি বইটা নিয়ে বিছানায় শুয়েছে মাত্র, দারোয়ান এসে খবর দিল ‘ আফা আপনের ভিজিটর’
অবাক হল রূপা। এই সময় আবার কে? এই দুপুরে? আশ্চর্য তো?
তাড়াতাড়ি আয়নায় মাথাটা আঁচড়ে নিয়ে শাড়ীটার দিকে তাকাল, একবার ভাবল পাল্টে নিবে, তারপর ভাবল থাক, ওটাকেই একটু গুছিয়ে নিয়ে সেন্ডেল পায়ে বেরিয়ে গেল।
গেটের কাছে ভিজিটর রুম, সেখানে কেউ নেই, গেটের বাইরে ডানে বামে তাকিয়েও কাউকে দেখা গেল না। বাইরে এত রোদ চোখে তাকানো যায় না ঝাঁঝাঁ করে। দাড়োয়ান ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সামনের রাস্তার শেষ মাথায় কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে দেখিয়ে দিল। রূপা দেখল গাছটার নীচে আর্মির একটা জীপ, গাড়িতে হেলান দেয়া একটা লোক। দূর থেকে তীক্ষ্ণ ফর্সা মুখের আভাস পাওয়া যাচ্ছে কিন্তু বুঝা যাচ্ছেনা কে। চিনতে চেষ্টা করল রূপা কিন্তু চিনতে পারল না।
কাছে গিয়ে চমকে উঠল রূপা, বিস্ময়ে মুখ দিয়ে চাপা একটা আওয়াজ বেরিয়ে গেল,
-হারূন তুমি?
সেই সাথে ঘৃনা আর তীব্র অভিমানে কণ্ঠ রোধ হয়ে এল রূপার, সে আর কোন কথা বলতে পারল না।
লোকটা কয়েক পা এগিয়ে এল,
-হ্যাঁ রূপা আমি। বিরম্বিত ভাগ্য আমাকে তোমার কাছে টেনে এনেছে।
মনে মনে হাসল রূপা, বিদ্রুপের হাসি। ‘হু বিরম্বিতই বটে,’ মনে মনে বলল ‘একটুও তো বদলাওনি, সামান্য মোটা হয়েছ এই যা। সেই চোখ, সেই চৌম্বিক ব্যক্তিত্ব যার আকর্ষনে মেয়েরা মুহূর্তে প্রেমে ঝাঁপিয়ে পড়ে তারপর পুড়ে যেতেও সময় লাগেনা।’
কিন্তু এই মুহূর্তে হারূনের মুখে গভীর একটা বেদনার ছাপ যেন নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতিত একজন মানুষ যা ঘৃনার আগুনে অন্ধ রূপার চোখও এড়াল না।
এত দিনের তীব্র কষ্ট ও অপমানের কথা মুহূর্তে ভুলে গেল রূপা। সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল,
-কি হয়েছে তোমার? এমন দেখাচ্ছে কেন?
-বলব,তোমাকে সব বলব, তাই তো এত দূরে ছুটে এসেছি।
পারিপার্শিকতা ভুলে এগিয়ে এসে রূপার হাত ধরল হারূন।

মধ্য দুপুর। গ্রীষ্মকাল। বাইরে ঝাঁঝাঁ রোদ। বাসার সবাই দিবানিদ্রায় আচ্ছন্ন, ঘুম নেই শুধু বাসার চঞ্চল মেয়েটির চোখে, বারান্দার চেয়ারে বসে কবিতার একটা বই হাতে মৃদুমৃদু পা দোলাচ্ছে, বইটা সে পড়তে চেষ্টা করছে কিন্তু মনোযোগ দিতে পরছে না

মেয়েটা ছোটখাট হাসিখুশি, চোখ হাসছে সব সময়, নাম রূপা, এইচএসসি সেকেন্ড ইয়ারে পরে, ক্লাসটাকে মাতিয়ে রাখে একেবারে, যেখানেই সে সেখানেই হাহাহিহি। নাটক কবিতা খেলাধুলা সবই তার দখলে, পড়াশোনা তো আছেই আড্ডা থেকে কলেজ সংসদ কোনটাই তাকে ছাড়া চলে না। ক্লাসের সব তার বন্ধু, ছেলে মেয়ে সব। মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ তাকে ঈর্ষা করে কিন্তু সমিহ না করেও পারেনা, চেষ্টা করে যে রূপা হওয়া যায়না তা ওরা জানে, ওর গুনগুলো ঈশ্বর প্রদত্ত। ছেলেদের মধ্যে অনেকেই গভীরভাবে ভালবাসে কিন্তু রূপা এত সহজে মিশে যে প্রেম নিবেদন করা কঠিন, অগ্যতা কেউ কউ ইদানিং কবিতা লিখতে শুরু করেছে।
শুধু বন্ধুরা নয় বাইরের মানুষও মেয়েটার আকর্ষন এড়াতে পারে না। হরগঙ্গা কলেজে একবার কবি সম্মেলনে হল, ঢাকার প্রতিথযশা চল্লিশ জন কবিকে নিমন্ত্রন করল কলেজ সংসদ, রূপার বন্ধুরা মিলে আয়োজনটা করেছিল। মুন্সিগঞ্জ শহরে এত সুন্দর কবি সম্মেলন আগে কখনও হয়নি। রূপার উপস্হিতি, সঞ্চালনা, পরিশিলিত চাঞ্চল্য মুগ্ধ করল অতিথিদের। কবি আবুল হেসেন আকর্ষনীয় এই মেয়েটিকে দেখে এতটাই মুগ্ধ হলেন যে বিদায় কালে ‘ শুধু তোমাকেই রূপা’ কবিতাটি উপহার দিয়ে গেলেন। কিছুদিন পর কবির মৃত্যু হয়, হয়তো এটিই কবির অগ্রন্থিত শেষ কবিতা। রূপার কাছে কি আছে কবিতাটি এখনও?
শুধু বাইরে নয় ঘরেও রূপা একই রকম জনপ্রিয়। বাবা মা তো আছেই, দশ ভাইবোন সবাই তার বন্ধু। বড়রা স্নেহ করে, ছোটরা করে অনুকরণ। ছোট মফস্বল শহরে তাকে সবাই চেনে, প্রতিবেশীরা সস্নেহে ডাকে ‘পাগলী’।

রূপার বাবা থানার সার্কেল অফিসার। সামনে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। তত্ত্বাবধানকারি আর্মিদের থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। সার্কেল অফিসার সাহেব তাদের থাকা খাওয়া, পানি-ল্যাট্রিন নিয়ে ছুটাছুটি করে অস্থির, নিজেতো অস্থিরই অন্যদেরও অস্থির করে তুলছেন। নটা-সাড়ে নটা নাগাদ এক বহর আর্মির গাড়ি এসে উপস্হিত। সামনের গাড়ি থেকে স্বভাব সুলভ ক্ষীপ্রতায় লাফ দিয়ে নামল চব্বিশ-পঁচিশ বৎসরের এক সুদর্শন যুবক। নামবার এবং অধঃস্থনদের নির্দেশ দেয়ার ভঙ্গি থেকে বুঝা যায় সেই দলনেতা এবং সম্ভবত এবারই প্রথম গুরু দায়ীত্বপ্রাপ্ত।
নেমেই গুরু পায়ে অফিটি ঘুরেঘুরে দেখতে লাগল, ব্যবস্থার অপর্যাপ্ততায় ক্ষুব্ধ হয়ে সার্কেল অফিসারকে লাগাল এক ধমক, সে অবশ্য তখনও জানত না তার জন্য পরে তাকে কতখানি অনুশোচনা পোহাতে হবে।
নিজের লোকদের মুটামুটি ভদ্রস্থ একটা ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়ে সে ঘুরে দোতলার বারান্দয় গিয়ে দাঁড়াল। বারান্দার নিচেই চোখে পড়ল বৌঁচি খেলতে থাকা দুইবেনী করা একটি আঠার-ঊনিশ বৎসরের উজ্জল মেয়েকে। মেয়েটি অনবরত ‘চি’ উচ্চারণ করতে করতে ছুটে গিয়ে নয়-দশ বৎসরের একটি মেয়ের বেনী টেনে দিয়ে খেলা ভঙ্গ করে পুকুর পাড়ে শামুক কুড়োতে থাকা মেয়েদেরকে শামুক কুড়িয়ে দিতে লাগল। মেয়েটির স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত চঞ্চলতার লাবন্যে সে মুগ্ধ হয়ে গেল। অফিসের পিয়নটিকে ডেকে তখনই জানতে পারল একটু আগে যে বুড়ো সার্কেল অফিসারকে ধমক দিয়েছে সে তারই মেয়ে, নাম রূপা, ঐ সামনের বাসায়ই থাকে। ধমক দেয়ায় জন্য এখন তার খুব অনুশোচনা হতে লাগল। কেন যে ধমক দিতে গেল? ভাবল ভদ্রলোকের কাছে মাফ চেয়ে নিতে হবে।

সেদিন, তারপর দিন, তারপর দিন এখানে সেখানে প্রায় সর্বত্র মেয়েটির চকিত উপস্হিতি ছেলেটির মুগ্ধতা বাড়িয়ে দিল, তার সাথে পরিচিত হবার জন্য অস্থির হয়ে উঠল সে। সুযোগ খুঁজতে লাগল। কেমন করে মিলেও গেল হঠাৎ, অফিসের ফোনটা নষ্ট হয়ে গেল। আর্মি হেডকোয়ার্টরে জরুরি ম্যাসেজ পাঠাতে হবে, অগ্যতা অথবা ইচ্ছে করেই সিদ্ধান্ত নিল সার্কেল অফিসারের বাসায় গিয়ে ফোন করবে।

মধ্য দুপুর। গ্রীষ্মকাল। বাইরে ঝাঁঝাঁ রোদ। বাসার সবাই দিবানিদ্রায় আচ্ছন্ন, ঘুম নেই শুধু বাসার চঞ্চল মেয়েটির চোখে, বারান্দার চেয়ারে বসে কবিতার একটা বই হাতে মৃদুমৃদু পা দোলাচ্ছে, বইটা সে পড়তে চেষ্টা করছে কিন্তু মনোযোগ দিতে পরছে না, কি একটা অনুপস্থিতির শূন্যতা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, অনাস্বাদিত এই বোধটার অর্থ ধরতে পারছেনা বলে তার অস্বস্তি হচ্ছে। অনুভূতিটা তার স্বভাব বিরুদ্ধ, এমন তো কখনও হয় না। এই সময় ‘টুকটুকটুক’ নীচের দরজায় তিনটি শব্দ। কানখাড়া করল রূপা ‘টুক’ একটা মাত্র শব্দ, দৌড়ে নীচে গিয়ে দরজা খুলতেই হঠাৎ থমকে গেল রূপা, সামনে অত্যন্ত সুদর্শন এক যুবক। লম্বা, সুঠাম স্বাস্থ্য, ঝকঝকে ফর্সা মুখ, ধুসর নীল চোখ, পিছনে ছোট করে ছাটা চুল, সামনের সামান্য বড় চুল কপালের মাঝ বরাবর পাঁক খেয়ে উপরে উঠে গেছে। ক্ষণকাল মাত্র। তারপর একটি স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিক হাসি ছড়িয়ে গেল রূপার মুখে যেন বলতে চাইল, ‘ও আপনি!’ দূর থেকে তাকে আগেও দেখেছে, আর্মির ইউনিফর্ম পরা, সাধারণ ড্রেসে তাকে এখন অন্য রকম লাগছে, আরো সুন্দর।
ছেলেটি ভরাট ভদ্র গলায় বলল, ‘ আমি হারূন, আর্মির সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। আমি কি একটা ফোন করতে পারি?’

রূপাদের মফস্বলের মধ্যবিত্ত আটপৌরে পরিবারে হরূন সত্যি অপ্রত্যাশিত, তার বাবা ঢাকার নবাব পরিবারের ছেলে, বর্তমানে হাইকোর্টের জাজ, একমাত্র ছেলেকে করাচির ক্যাডেট কলেজে রেখে পড়ালেখা শিখিয়েছেন

‘অবশ্যই’- চটপট উত্তর দিল রূপা। ঘুরে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে এল। হারূন পিছু পিছু দোতলায় এলে। ফোনটা দেখিয়ে দিল রূপা। অপরিচিত কণ্ঠ শুলে সিও সাহেব ঘুম থেকে উঠে এলেন, হারুনকে দেখে সন্ত্রস্ত হলেন একটু, রূপাকে বললেন,’ একটা চেয়ার এনে দে মা।’ রূপা চেয়ার নিয়ে এলে হারুনকে ইশারায় বললেন, ‘বসে কথা বল বাবা।’
তারপর কয়েকদিনের মধ্যে হারুন রূপাদের পরিবারেই যেন একজন হয়ে গেল। যদিও রূপাদের মফস্বলের মধ্যবিত্ত আটপৌরে পরিবারে হরূন সত্যি অপ্রত্যাশিত, তার বাবা ঢাকার নবাব পরিবারের ছেলে, বর্তমানে হাইকোর্টের জাজ, একমাত্র ছেলেকে করাচির ক্যাডেট কলেজে রেখে পড়ালেখা শিখিয়েছেন। সে অত্যন্ত মেধাবী, মিলিটারী একাডেমীর ‘সোর্ড অব অনার’ পাওয়া, সম্ভ্রান্ত ঝকঝকে তকতকে। ভাল আবৃতি করে, গান গায়, ছবি আঁকে, যদিও চিত্তাকর্ষক তবুও চোখ ধাঁধাঁনো, বিচ্ছুরিত, দূরঅতিক্রম্য, এক কথায় এলেগেন্ট। তবে তার মিশবার ক্ষমতা অসীম, ছোট বড় সবার সাথে সুন্দর গল্প করতে পারে, স্মার্ট বন্ধুত্বপূর্ণ আন্তরিক ব্যবহার। কিছুদিনের মধ্যেই তার উপস্থিতি রূপাদের পরিবারের ছোট বড় সবার কাছে আনন্দের কেন্দ্রে পরিণত হল, তার সান্নিধ্য সবার কাম্য। রূপা, রূপার বড় ভাই আরিফ, ছোট ভাই কাজল, মামাত ভাই বাবু, চাচাত ভাই মঞ্জু ও হারূন মিলে ছোটখাট একটা টিম হয়ে গেল। কাজের অবসরে ওরা ঘুরে বেড়ায়, ছাদে বসে আড্ডা দেয়, তাশ পিটায়, একে অপরের পিছু লাগে। বন্ধুত্ব হয়না শুধু রূপার চাচাত ভাই ফিরোজের সাথে- সে রূপাকে ভালবাসে, বিয়ে করতে চায়। রূপাও সেটা জানে।
হারূন রূপার কাছে এক ‘বিপন্ন বিস্ময়’, বিপন্নই বটে- কি এক দুর্নিবার আকর্ষণ রূপাকে নিয়ে যাচ্ছে হারূনের দিকে, সে প্রানপন চেষ্টা করছে নিজেকে বাঁচাতে কিন্তু পারছে না। হৃদয়ে শুধুই রক্তক্ষরণ হচ্ছে, সে জানে না এর শেষ কোথায়,তবে তার মন বলছে-এ শুভ নয়, কিছুতেই শুভ নয়।

সোনা মাখা বিকেল, হারূনরা তাশ নিয়ে বসেছে ছাদে। রূপা খেয়াল করল হরূন ভুল পাস দিতে যাচ্ছে, সে ঈশারা করতেই পারস্পরিক দৃষ্টি মুগ্ধতার লাবন্যে ক্ষণকাল স্তব্ধ হয়ে রইল, মুহূর্ত মাত্র, তারপর চোখ সরিয়ে নিল দুজনেই কিন্তু দুজনেই জেনে গেল যা জানার, যা কথার অতীত, কোন কথাই যাকে ধারন করতে শিখেনি।
নির্বচনের রাত, বারটা বেজে গেছে, এখনও হারুনরা ফিরনি। দুটি চোখে ঘুম নেই, রূপা আর তার বাবার। কি এক কারনে ভদ্রলোক ছেলেটার প্রতি আপত্য স্নেহ বোধ করেন। কর্তব্যবোধ তো আছেই, তাদের কিছু হলে তাকেই তো জবাবদিহি করতে হবে তারপরও কি যেন একটা আছে।
রূপার হৃদয়ে একান্ত আপনজন হারানের বেদনা। গভীর রাতে তাদের ফিরবার আওয়াজেই কেবল দুটি হৃদয় স্বস্তি ফিরে পেল।

হারূনরা একদিন ফিরে গেল, রূপা হাফ ছেড়ে বাঁচল, যা হারাবার তাকে পাবার আশার কষ্টের তুলনা কি? তারপরেও তীব্র বেদনার সূক্ষ্ম একটা কাঁটা বিঁধে রইল রূপার মনে।

হারূন একদিন নিজ হাতে খরগোশ, কচি ঘাস, আর নীল আকাশ আঁকা প্যাডে চিঠি লিখল। দুই ছত্র মাত্র,
– রূপা তোমার বিচ্ছেদ দুঃসহ। আবার দেখতে চাই। ভালবাসার দাবীতেই’-হারূন।
এই আহ্বান দুর্নিবার। এইচএসসি পরীক্ষার পর রূপা অস্থির হয়ে উঠল, ‘যেতে হবে, তাকে যেতেই হবে ঢাকায়, যে করেই হোক।’
ঢাকায় বড় বোন বোনের বাসা থেকে একদিন ফোন করল রূপা ‘ কেমন আছ হারূন?’
-ওয়াও, তুমি? ঠিকানা দাও।’

তারপর হারূন হুন্ডার পিছনে রূপাকে নিয়ে সাঁইসাঁই করে ঘুরে বেরাল কয়েকটা দিন। রমনা পার্ক, অফিসার্স মেস, এমন কি নিজেদের বাসা পর্যন্ত। দিনগুলো যেন উড়েই গেল। ফিরে যাবার দিন রূপার গভীর চোখে চুমু খেয়ে বলল, ‘আমি তোমাকে চাই, শুধু তোমাকে, আমার জন্য অপেক্ষা করো সোনা।’
বিশ্বাস করেছিল রূপা, অপেক্ষা করেছিল স্বচ্ছ ছলনাহীন হৃদয়ে।
কিন্তু একদিন হারূনের অপ্রত্যাশিত চিঠি এল। বিস্মিত হৃদয়ে পড়তে লাগল রূপা,
– জানিনা ক্ষমা চাওয়ার যোগ্যতা আমার আছে কিনা, তবু তোমার মহৎ হৃদয়ের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি, তোমাকে দেয়া আমার কথা রাখতে পারছিনা রূপা। লবন্যকে আমি বিয়ে করছি, বিয়ে করছি না বলে বলা ভাল বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছি। ওর বাবা আমার বস, আর আমার ভবিষ্যৎ তাঁর হাতে, আমার হৃদয় চিরদিন তোমার জন্য শূন্য হয়ে রইল’-হারূন।
ঘৃনা, অপমান আর অব্যর্থ কান্নায় বাঁধ দিতে দিতে রূপা চিঠিটা কুটি কুটি করে ছিড়ল, তারপর শিশুসুলভ একটা প্রতিশোধের সিদ্ধান্ত নিল-জীবনে বিয়েই করবে না কখনও।

হারূনকে নিয়ে ক্যান্টিনে এল রূপা। এই দুপুরে ক্যান্টিন একদম ফাঁকা। কোনার দিকে একটা টেবিলে বসল ওরা। রূপা চুপ করে আছে, কোন কথা বলছেনা। কিছুক্ষণ চুপ থেকে হারূন আর্তঃস্বরে বলল, ‘রূপা আমার মেয়েটা কাল পানিতে ডুবে মারা গেছে।’
আমুল চমকে তাকাল রূপা, এমন পরিস্থিতির জন্য সে মোটেই প্রস্তুত ছিল না।
– তাকে কবর দিয়েই চিটাগাং থেকে তোমার কাছে ছুটে এসেছি শুধু ক্ষমা চাইবার জন্য।’
পারিপার্শ্বিকতা ভুলে রূপার সামনে হঠাৎ হাটু গেড়ে বসে পড়ল হারূন। হাত দিয়ে মুখ ডেকে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, ‘ আমাকে ক্ষমা কর, ক্ষমা কর রূপা, যথেষ্ট প্রায়চিত্ত হয়েছে আমার, একবার শুধু বল আমাকে ক্ষমা করেছ?’
অতি কষ্টে নিজেকে সামলে রাখল রূপা, সে শুধু বলতে পারল, ‘আমি সব ভুলে গেছি হারূন, কিছুই মনে রাখিনি।’
নিজেকে আর ধরে রাখতে পারল না রূপা, ছুটে গিয়ে বিছানায় পড়ে কাঁদতে লাগল। এক সময় উঠে চোখ মুছল, তারপর টেবিলে বসে চিঠি প্যাড টেনে নিয়ে লিখল, ‘ফিরোজ আমি ঠিক করেছি তোমাকেই বিয়ে করব।’

আরো পড়তে পারেন

স্বর্ণবোয়াল

মোবারক তার কন্যার পাতে তরকারি তুলে দেয় আর বলে, আইজ কয় পদের মাছ খাইতেছ সেইটা খাবা আর বলবা মা! দেখি তুমি কেমুন মাছ চিনো! ময়না তার গোলগাল তামাটে মুখে একটা মধুর হাসি ফুটিয়ে উল্লসিত হয়ে ওঠে এই প্রতিযোগিতায় নামার জন্য। যদিও পুরষ্কার ফুরষ্কারের কোন তোয়াক্কা নাই। খাবার সময় বাপবেটির এইসব ফুড়ুৎ-ফাড়ুৎ খেলা আজকাল নিয়মিত কারবার।….

প্রতিদান

‘আমাকে আপনার মনে নেই। থাকার কথাও নয়। সে জন্য দোষও দেব না। এত ব্যস্ত মানুষ আপনি, আমার মত কত জনের সঙ্গেই হঠাৎ চেনা-জানা। কেনইবা মনে রাখবেন তাদের সবাইকে?’ বেশ শান্ত গলায় বললেন মিসেস অঙ্কিতা। টেবিল থেকে কি যেন একটা নিলেন তিনি। পিটপিট করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সাফরাব। একটা ইনজেকশন, একটা ছোট টেস্টটিউবের মতো ভায়াল,….

লিলিথ

শাওয়ার বন্ধ করে দিতেই পানির হালকা ঝিরঝিরে শব্দটা বন্ধ হয়ে যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে ঝরনার শব্দ আজকাল বাসাতেই শোনা যাচ্ছে। আর এ শব্দটা অদ্ভুত সুন্দর। কেমন যেন মোলায়েম। সাদা তুলতুলে মেঘের মতো। অনেক দূর থেকে ভেসে ভেসে এসে জড়িয়ে ধরে। চোখের পাতাগুলোয় ঠান্ডা আমেজ ছড়িয়ে ঘাড় বেয়ে নামতে থাকে। আরামে চোখ বুজে আসে আমার। রিলাক্স হতে….

error: Content is protected !!