Author Picture

শহীদ সাবেরের ‘আরেক দুনিয়া’ (পর্ব-৩)

মযহারুল ইসলাম বাবলা

প্রথমে বুদ্ধিজীবীটির কথাই ধরা যাক। গণিত শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি ছিল-গণিতের বইও প্রকাশ করেছেন। জন্মগ্রহণ করেছেন এক গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে। কিন্তু আশৈশব কাটিয়েছেন এমন আর এক পরিবারের সঙ্গে যার প্রতিটি লোক কোনো না কোনো ধরনের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তিনি নিজে রাজনীতি করেন সেই অনুশীলন-যুগান্তরের দিন থেকে। ১৯৩৮ সালের শুরু থেকে মার্কসবাদী-লেনিনবাদী চিন্তাধারার সঙ্গে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৪২ সালে সরাসরি রাজনীতিতে আত্মনিয়োগ করেন।

বুদ্ধিবৃত্তি অত্যন্ত তীক্ষ্ণ। সমস্যাগুলো তুলে ধরতে পারেন খুব চমৎকার। মজুরদের মধ্যে কাজ করেছেন। এবং তার মধ্যে দিয়ে বুদ্ধিজীবীসুলভ অহমিকা গেছে কেটে। শান্ত ধীর বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন একজন কর্মী। নাম ধরা যাক চক্রবর্তী।

জেলে তার স্থান খুব উঁচুতে। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমস্ত ব্যাপারে আলাপ-আলোচনার ভার হচ্ছে তার ওপরে। তিনি হচ্ছেন আপিস প্রতিনিধি। কারও একটা সাবান দরকার তিনি আপিসে চিরকুট দেবেন। চিঠির কাগজ আনানো, ঠিক এলো কিনা দেখা ইত্যাদি তার কাজ।

তারপর ধরা যাক ভূতপূর্ব সন্ত্রাসবাদী বন্দিটিকে। অ্যান্ডারসনী বাংলার নিপীড়ন আর অত্যাচারের আগুনে পুড়ে খাঁটি হয়েছেন যে সমস্ত লোক, তিনি তাদেরই একজন। বহু জেল খেটেছেন। বাংলাদেশের সমস্ত কারাকক্ষগুলো তার অতি পরিচিত। আন্দামানে বহুদিন জেল খেটেছেন। কারাভ্যন্তরে তার যৌবনের মূল্যবান দিনগুলো কেটেছে। স্বদেশী ডাকাতি করেছেন, গুন্ডা দমন করেছেন, দেশবাসীর শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন। আন্দামানে মার্কসবাদী হন। মুক্তিলাভের পর সাম্যবাদী আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করেন। আবার ধরা পড়েছেন এক বছরের ওপর। বাংলা ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন; নেতৃত্ব দিয়েছেন। কম কথা বলেন, অমায়িক লোক। কিন্তু দোষ-ত্রুটির সমালোচনায় অত্যন্ত কঠোর। বিশাল শরীর। এর নাম হতে পারে গুপ্ত। গুপ্ত ভালো রান্না জানেন বলে তাকে সবাই সম্মান করে।

কৃষকটির নাম দেয়া যাক ওসমান। জেলার কৃষক আন্দোলনে তার দান অতুলনীয়। অসংখ্য কৃষক তার এলাকায় তার ওপরে আস্থা রাখেন। জমিদারি উচ্ছেদ, জমির লড়াই ও খাদ্যের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি তার এলাকায়। কৃষক সমাজের মধ্যে থেকে তিনি সম্প্রতি মজুর, বুদ্ধিজীবী, ছাত্রের শহুরে প্রবণতার মধ্যে এসে পড়েছেন। আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন মানিয়ে নিতে। রাজনীতির দিক দিয়ে সবার মত ও পথ অভিন্ন। সবাই একই জীবনদর্শনে বিশ্বাসী। ব্যক্তিগত জীবনে গ্রাম্য ছাপ তার গায়ে পরিস্ফুট। মজুর শ্রেণীর প্রতি তার শ্রদ্ধার কমতি নেই। গরিবের ঘরের ছেলে; মনের মধ্যে শাসকশ্রেণীর বিরুদ্ধে অত্যন্ত ঘৃণা। দিনের মধ্যে অধিকাংশ সময় তার কাটে ইংরেজি শিক্ষার কাজে। ইংরেজি পত্রিকাখানি নিজে নিজে পড়ে কখন বুঝতে পারবেন, সেদিকে লক্ষ্য রাখেন।

ছাত্ররা সাধারণত একটু বেশি অনুভূতিপ্রবণ হয়ে থাকে। ছাত্রটির বেলায় তার ব্যতিক্রম নেই। তবে এ মার্কসবাদী ছাত্র। তাই ইদানীং মনে করছে কিছু কম অনুভূতিপ্রবণ হবে। কারণ তাতে কাজের ব্যাঘাত ঘটে। বনেদী মুসলমান পরিবারে ভাঙন ধরেছে। সে ভাঙনের তরঙ্গের আঘাত তাকে এনে দাঁড় করিয়েছে সংগ্রামী ছাত্র সংগঠনের মধ্যে। গল্প লেখে। কবিতা লেখে। লেখা শেষ হলেই পড়ে শোনায় সবাইকে। ইদানীং খেলাধুলা এবং সাহিত্য চর্চার দিকে মেতে উঠেছে। সবচেয়ে বয়সে ছোট। তাই সবার সঙ্গে সম্পর্কও আলাদা এবং সহজ। এর নাম হতে পারে টুলু।

কারাগারের ভেতরেও সূর্য ওঠে। শীতের সকালে কুয়াশাচ্ছন্ন সবুজ চিরকুটের ঘাসের ফালিতে কুয়াশা পড়ে। ধীরে ধীরে আলো ফুটতে থাকে। সান্ত্রী বদলি হয়ে গেছে। ভোর রাতের সান্ত্রী এসে ওয়ার্ডের লক আপ খুলে দিয়ে যায়। জমাদার খাতা হাতে মাথা গুনতি করে যায়। তারপর আবার দুয়ারটা ঠেকিয়ে রাখে। মিনিট দশেক পরে ঢং ঢং করে ঘণ্টা পড়ে। গুনতি মিলেছে। দুয়ারটা খুলে যায়। আবার সন্ধ্যা নাগাদের জন্য।

মিলের মজুরটির একটি হাত মেশিনে কাটা পড়েছে। মজুর ইউনিয়নের সংগঠক ছিলেন। কথাবার্তা অত্যন্ত কর্কশ এবং জোরে জোরে কথা বলেন। নিজের কথায় জোর দেয়ার জন্য? জোরে জোরে হাত নাড়েন। অসম্ভব চা ভালোবাসেন। কালো কুচকুচে শরীরের রং।

তারপর আছেন এমন একজন, যার নাম হতে পারে করিম। ভদ্রলোক গ্রামের লোক। ব্যবহারে সামাজিকতাটুকু বেশ পরিস্ফুট। অশোভন কিছু কখনও করে না। নিজের ব্যবহার ও পরের ব্যবহার সম্বন্ধে খুব সচেতন ও অত্যন্ত হিসেবী। প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি জিনিসের প্রতি অত্যন্ত সংরক্ষণশীল। গুছিয়ে কাজ করার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি অন্যদের গোছালো স্বভাবের জন্য নিন্দা করেন। ছাত্রটি তার নাম দিয়েছে- ‘ফুফু আম্মা।’

একটি বাংলা বই প্রকাশকের জেলা শাখার পরিচালক আছে একজন। শহরে আইনসঙ্গত বইয়ের দোকান ছিল তার কিন্তু আজকের দিনে প্রগতিশীল সব কিছুই-আইনসঙ্গতই হোক আর বে-আইনি হোক-তার ওপর সরকারি কোপ-দৃষ্টি পড়েছে। তার ফলে ভদ্রলোক গ্রেফতার হয়েছেন আজ দু’বছরের কাছাকাছি।

তারপর দাশগুপ্ত… মামলার আসামি ছিলেন। আট বছর বন্দিজীবন কেটেছে তার বকসার আর হিজলীর আটকখানায়। শান্ত, ধীর আর চোখে সৌম্য ভাব পরিস্ফুট। সূক্ষ্ম বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন লোককে কাছে টানার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। আলাপি লোক। কার সঙ্গে কি কথা বলতে হবে সেটা বোঝেন খুব পরিষ্কার। এ ধরনের লোককে দিয়ে ‘নেগোসিয়েশন’ চালানো খুব ভালো হয়।

কারাগারের ভেতরেও সূর্য ওঠে। শীতের সকালে কুয়াশাচ্ছন্ন সবুজ চিরকুটের ঘাসের ফালিতে কুয়াশা পড়ে। ধীরে ধীরে আলো ফুটতে থাকে। সান্ত্রী বদলি হয়ে গেছে। ভোর রাতের সান্ত্রী এসে ওয়ার্ডের লক আপ খুলে দিয়ে যায়। জমাদার খাতা হাতে মাথা গুনতি করে যায়। তারপর আবার দুয়ারটা ঠেকিয়ে রাখে। মিনিট দশেক পরে ঢং ঢং করে ঘণ্টা পড়ে। গুনতি মিলেছে। দুয়ারটা খুলে যায়। আবার সন্ধ্যা নাগাদের জন্য।

কৃষক কমরেডটি সবার আগে উঠে পড়ে মগ দিয়ে পায়খানায় ছোটে। আস্তে আস্তে পরিষ্কার আলো ফুটে ওঠে।

সুলতান চায়ের জল চড়িয়ে দিয়েছে। দুধ আছে গতকালের। বিস্কুট আছে। গতকাল সন্ধ্যায় ওয়ার্ডার দিয়ে গেছে। সবার ঘুম ভাঙার আগেই চা এসে পড়ে। চায়ের বরাদ্দ আছে মাত্র দশজন ‘নিরাপত্তা’ বন্দির জন্য। কিন্তু হয়ে যায় জনা বত্রিশ। ওয়ার্ডের কয়েদি হাজতি এবং সান্ত্রী সবাই বসে যায় চায়ের মগ হাতে।

রাজবন্দি ওয়ার্ডে চা খাওয়া সান্ত্রীদের বারণ। কিন্তু সমাজের নিচের দিককার লোকের কাছে কর্তৃপক্ষের চেয়ে রাজবন্দিরা অনেক বেশি আপনার লোক। তার ওপর ভোর রাত থেকে বেলা বারোটা পর্যন্ত ডিউটি দিতে হবে। অতএব এমন শীতের সকালে এক কাপ চা, তার ওপর রাজবন্দিদের সহানুভূতিসূচক ব্যবহার সে প্রত্যাখ্যান করতে পারে না। একটু শ্রদ্ধাও হয়, কেউ হয়তো বাইরে প্রফেসর ছিলেন, ছাত্র ছিলেন। শিক্ষিতদের প্রতি সাধারণ মানুষের যে শ্রদ্ধা, সেটুকু তার রাজবন্দিদের দেয়। কেউ কেউ এর চেয়ে আরও একটু বেশি এগোয়। তখন তারা রাজনৈতিকভাবে সহানুভূতি পোষণ করে। মার্কসবাদীদের আদর্শ তারা বোঝে না। কেবল এটুকু বোঝে যে এরা গরিবের খাওয়া-পরা বাঁচার জন্য কথা বলে। তারই জন্য জেলে এসেছে। এটাও বুঝেছে যে বর্তমান সরকার গরিবের প্রতি আর যাই হোক, মিত্রভাবাপন্ন নয়। সান্ত্রীরা মনে করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে আর ন্যায়ের জন্য যারা কথা বলেন, তারা সবাই কমিউনিস্ট। যেমন ভাসানী মওলানা সাহেবও কমিউনিস্ট। হোন না তিনি ‘আওয়ামী’। তবুও।

চায়ের সঙ্গে সঙ্গে গল্প জমে ওঠে। মাছের গল্প। চালের গল্প কাকে কে দলে এনেছে তার গল্প হাসির গল্প। ছোটখাটো হিউমার।

‘লিয়াকত আলী মার্কিন দেশ ভ্রমণে যাওয়ার সময়ে সঙ্গে কি নিয়েছিলেন জানো  তো?’ চক্রবর্তী ছাত্রটিকে শুধোন।

টুলু জবা দেয়, ‘১৩৫টি সিগারেট লাইটার।’

চক্রবর্তী ঘাড় নাড়েন। ‘না, সঙ্গে নিয়েছিলেন একখানা লিস্ট। পাকিস্তানের সমস্ত নিরাপত্তা বন্দিদের নামের তালিকাখানা তিনি নিশ্চিয়ই সঙ্গে নিয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট ট্র–ম্যানকে দেখিয়ে বলেছেন, এই দেখ এত কমিউনিস্ট ধরে রেখেছি।’ সবাই শুনে হাসে। এটা হল চুটকির আসর। এ ধরনের ছোটখাটো হিউমার আর হাসির গল্পে এ বেলাটা বেশ কাটে। সব দিনই কিন্তু চুটকির আসর বসে না।

এ মাসের জন্য ম্যানেজার হলেন চক্রবর্তী। ম্যানেজার মোট দু’জন। একজন রান্নার জন্য। অন্যজন সংগ্রহের জন্য। গুদাম থেকে নিয়মিত রেশন আনা তার কাজ। গুদাম ঘরটি ওয়ার্ডের বাইরে। পাহারার সঙ্গে চক্রবর্তী বেরিয়ে যান গুদাম থেকে রেশন আনতে। অন্য ম্যানেজার মজুর বন্দিটি।

সাড়ে আটটার মধ্যে চক্রবর্তী গুদাম থেকে ফিরে আসেন রেশন নিয়ে। ইতিমধ্যে রান্নার কাজ শুরু হয়ে গেছে। এখন বয়স্করা নানা কাজে ব্যস্ত। যেমন দাশগুপ্ত এখন উর্দু শিখছেন। ‘উর্দু কি তিসরি কিতাব’ ধরে ছোট ছেলের মতো উর্দু পড়তে দেখলে, বহিরাগত উর্দুভাষীদের বেশ মজা লাগবে। হাতের লেখা ইতিমধ্যে বেশ সুন্দর করে এনেছেন। পড়তে পড়তে হঠাৎ কোথাও আটকে গেলেন।

‘ইনকিলাব মানে কি হে টুলু’- দাশগুপ্ত শুধোন।

‘আজাদী’ জবাব দেয় ছাত্রটি।

দাশগুপ্ত আবার পড়তে থাকেন। এ মাসের মধ্যে তাকে ‘উর্দু কি তিসরি কিতাব’ শেষ করতে হবে। দ্রুত পাঠ আয়ত্ত করতে হবে। শিগগির উর্দু সাহিত্য ও কাব্য বোঝার পর্যায়ে চলে যেতে হবে। সর্দার জাফরীর ‘নয়া দুনিয়া কো লাল সেলাম’ উর্দু ভাষায় পড়তে হবে। কিষণ চন্দ্ররের উর্দু গল্প পড়তে হবে। ইংরেজি থেকে অনুবাদে হাত পাকিয়েছেন ইতিমধ্যে। এবার উর্দু থেকে অনুবাদের দিকে ঝোঁক চেপেছে। রোদ চাড়া দিয়ে উঠতে থাকে। শীতের সকালের আয়ু খুবই ক্ষণস্থায়ী। স্নানের সময় হয়ে আসে। তেল মেখে স্নান সারতে হবে। করিম সবার আগে স্নান সেরে নেন। সবার শেষে আসেন ওসমান। স্নানের সময় তার কিছু খেয়াল থাকে না। কেউ স্মরণ করিয়ে দিলে, শুধু বলেন- ‘ও’।

স্নানের সময়েও গল্প চলে এক-আধটু। অতীত দিনের ছোট্ট কোনো ঘটনা হয়তো মনে পড়ে যায়। সেটা ব্যক্ত না করে থাকা যায় না। কীই বা আছে আর বলার। আড়াল নেই এখানে কোথাও। সবই একই পথের যাত্রী।

এগারোটা নাগাদ রান্না হয়ে যায়। সারি সারি সবাই বসে যায় কম্বল পেতে, থালা-বাটি নিয়ে খেতে। পরিবেশন করেন ম্যানেজাররাই। কৃষকরা খায় খুব। ওসমানের খাওয়া দেখলে ‘ভদ্রসন্তান’দের অনেকেই নাক সিটকাবেন। ডিসপেপসিয়াগ্রস্ত রোগীর সহ্য হবে না এত খাওয়া চোখে দেখা।

তরকারি, মাছ অথবা ডিম আর ডাল এই বেলার খাওয়া। বিনা বিচারে আটকরা দৈনিক এক ছটাক মাছ পেতে পারেন। অতএব দশজনের মাছ প্রায় ২২ জন লোককে খেতে হয়। সবার রান্না একসঙ্গেই হয়। নিজেদের রান্না। অতএব খাওয়াটা ভালোই হয় কোনো কোনোদিন। মানুষের স্বাস্থ্য বজায় রাখার দিক থেকে বরাদ্দ খাদ্য কোনো ক্রমেই পর্যাপ্ত নয়। কিন্তু রান্না ও বিতরণ ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে একটা সামঞ্জস্য বিধানের চেষ্টা লক্ষ্য করা যায় ম্যানেজারদের তরফ থেকে অপর্যাপ্ত খাওয়া। কিন্তু গুণগত ও পরিমাণগতভাবে তার মধ্যেই একটা ব্যবস্থা করা কিচেন কমিটির লক্ষ্য। রান্নার ব্যাপারে সহজ পাচ্যতার দিকে লক্ষ্য রাখেন ম্যানেজাররা।

খাওয়ার ব্যাপার নিয়ে তাই ছোটখাটো গোলমাল হয়। কোনোদিন হয়তো মাছ আসতে আসতে বেলা বারোটা পেরিয়ে যায়। তারপর রান্না শেষ হতে দেড়টা খেতে খেতে দুটো। অতএব রুটিন থাকে না। আপিস প্রতিনিধি চিরকুট পাঠান অপিসে-

ডেপুটি জেলার সমীপেষু,

মাছ আসে নাই। এ রকম দেরি আজকাল প্রায়ই হচ্ছে। আশা করি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, যাতে আর না হয়। ইতি-চক্রবর্তী কমিউনিস্ট ওয়ার্ড।

ধরা যাক ভূতপূর্ব সন্ত্রাসবাদী বন্দিটিকে। অ্যান্ডারসনী বাংলার নিপীড়ন আর অত্যাচারের আগুনে পুড়ে খাঁটি হয়েছেন যে সমস্ত লোক, তিনি তাদেরই একজন। বহু জেল খেটেছেন। বাংলাদেশের সমস্ত কারাকক্ষগুলো তার অতি পরিচিত। আন্দামানে বহুদিন জেল খেটেছেন। কারাভ্যন্তরে তার যৌবনের মূল্যবান দিনগুলো কেটেছে।

সকাল বেলায় কোনোদিন ডাক্তার আসেন। ইদানীং ডাক্তার পরিবর্তন হয়েছে। এ জেলারই লোক। এককালে তথাকথিত ছাত্রনেতা ছিলেন। ‘ডেমাগগ’দের পকেটে পকেটে বিচরণ করতেন। কিন্তু আগের ডাক্তারটি ভালোই ছিলেন। দুনিয়াব্যাপী সংকটের ধাক্কা ডাক্তার সমাজের গায়েও এসে লেগেছে। স্বল্প বেতন অথচ বৃহৎ কর্তব্যের মাঝে পড়ে আগের ভদ্রলোকটি হাঁপিয়ে উঠেছিলেন ওয়ার্ডে। রোগী দেখতে এসে খুব করে একদিন সরকারের সমালোচনা করলেন। ছাত্রটি বলল- ‘স্ট্রাইক করলেই পারেন।’ ডাক্তার বললেন-হ্যাঁ, করছি তো। এবার বোধহয় আমাদের বড় রকমের একটা লড়াই হবে।

মোল্লাকে নিয়ে কথা ওঠে। মোল্লা এসে বলল- ‘দেখুন, আপনি যদিও কমিউনিস্ট! যাওয়ার সময়ে ডাক্তার বলে গেলেন, আপনাদের প্রতি সহানুভূতি আছে। ‘আপনারা বিনা বিচারে বন্দি, তাই ডাক্তার সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা করতে হয়, তবে আপনার চিকিৎসার সম্ভাবনা শতকরা ৭৫ ভাগ কমে গেল। কিন্তু যদি মুসলমান কমিউনিস্ট হন তবে শতকরা ২৫ ভাগ সম্ভাবনা পুনরুদ্ধার করলেন। আবার যদি হিন্দু হন তবে তাও হারালেন।’

সবাই হাসে। তবু ভালোয়-মন্দায় মিলে ডাক্তাররা চিকিৎসা বিভাগের লোক। রাজনীতির বাইরে আজ আর মানবতাবাদের অস্তিত্ব নেই। কিন্তু তার রেশটুকু আছে, এখনও ডাক্তারদের মানবিক দৃষ্টির অবশিষ্টাংশ কারাপ্রাচীরের অন্তরালে বন্দিদের একটি প্রধান মিত্রশক্তি।

খাওয়ার পর বয়স্করা শুয়ে পড়েন। অল্প বয়স্করা তাস খেলে। ‘পেসেন্স’ খেলে। দাবা নিয়ে বসে কেউ কেউ। ছাত্রটি কখনও কখনও পড়াশোনা করে। দাশগুপ্তের দেখাদেখি আজকাল চক্রবর্তীও উর্দু শিখছেন। মজুরদের মধ্যে কাজ করার সুবিধা হবে বলে। দুপুর বেলায় তিনি হাতবাক্স করেন।

এখন খর রোদ্দুর এসে পড়েছে। বাইরে ধু ধু করছে সব কিছু। বাঁ পাশের সিনেমার দিক থেকে নারী কণ্ঠের অদ্ভুত উর্দু গান শোনা যায়। মহল সিনেমাতে রেকর্ডের গান শুরু হয়েছে। কয়েদি ও পাহারা তাস খেলতে বসেছে। কবি সাহেব ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কখন সংবাদপত্রটি আসবে।

পত্রিকা আসতে আসতে খাওয়ার পর একটু ঘুমানোর পালা শেষ হয়ে আসে। সবার আগে আসবে ‘এজিদ’ (আজাদ) পত্রিকাখানা। তারপর আসবে ‘পরিদর্শক’ (পাকিস্তান অবজার্ভার) সবার শেষে কলকাতার বিদেশি পুঁজির ধাই-মা ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকা। ইদানীং প্রদেশে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার নিয়ে ভালো আন্দোলন হচ্ছে। পাকিস্তান অবজার্ভার খবর দিয়েছে- কেন্দ্রীয় গণপরিষদের মূলনীতি কমিটির রিপোর্টে বন্দিদের হেবিয়াস কার্পাসের অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে। মিটিং বসে তাই নিয়ে। সরকারের কাছে দরখাস্ত যোগে প্রতিবাদ জানানো হয়। প্রতিবাদে সবাই এক বেলা অনশন করেন।

কোরিয়ার যুদ্ধের পর থেকে সংবাদপত্রে প্রধান কলম হয়ে দাঁড়িয়েছে-যুদ্ধ সংবাদ। কবি অধীর প্রতীক্ষায় অপেক্ষা করতে থাকেন। ম্যাকআর্থার ১০ মাইল হেঁটে গেলে তার উল্লাসের অন্ত নেই। নর্থ কোরিয়ান বাহিনীর সিউল দখলের দিন উৎসব করেন বন্দিরা।

পশ্চিমবঙ্গে রাজবন্দিরা ছাড়া পেয়েছেন। এখানেও বন্দিদের মনে তার ছায়া পড়ে। নিশ্চয়ই জনসাধারণ আমাদের মুক্তি দাবি করেছে। ব্যক্তি স্বাধীনতার আন্দোলন নিশ্চয়ই তীব্র হচ্ছে। এবারে আমরা মুক্ত হব। এ ধরনের আশা ইতিমধ্যে জেগে উঠছে অনেকের মনে।

বৈকালিকা চা খেতে আলাপ চলছিল-পাঞ্জাবি-বাঙালি বিদ্বেষ নিয়ে। কথাটা তুলেছিলেন ওসমান। কেরানি থেকে জেলখানার সান্ত্রী, প্রত্যেকের মনে একটা প্রবল বিদ্বেষ রয়েছে জেলখানার অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। কারণ ভদ্রলোক পাঞ্জাবি। বাধা দিয়ে চক্রবর্তী বলে ওঠেন-

‘না, তার চেয়ে বড় কথা হল, সে পূর্ববঙ্গে ইস্পাহানিদের পক্ষ থেকে শোষণ চালাতে এসেছে। কই সাধারণ দুঃখী মানুষের মধ্যে মজুরদের মধ্যে তো পাঞ্জাবি বিদ্বেষ জাগে না। ইংরেজি প্রবণতার বিরুদ্ধে ভারতীয়েরা আন্দোলন করেছিল, সে ইংরেজি বলে নয়। শেকসপিয়রকে তো কেউ ঘৃণা করে না। তারা ইংরেজি ভাষায় সাহায্যে আমাদের শোষণ করেছিল। মাড়োয়ারীদের প্রতি আমাদের কোনো বিদ্বেষ থাকত না, যদি তারা আমাদের শোষণ না করত। সবাই বোঝেন এটা। আলোচনা চলতে চলতে এক সময় বাইরে থেকে হঠাৎ গর্জন ভেসে আসে কানে। উদগ্রীব হয়ে কান পাতেন সবাই বাইরের দুনিয়ার আওয়াজ শোনার আগ্রহে। ছাত্রটি হেসে বলে- নিশ্চয়ই ছাত্ররা আমাদের মুক্তির দাবি নিয়ে শোভাযাত্রা করছে।

কৃষক বন্দিটি কান খাড়া করে শুনছিলেন। বললেন- ‘না, ওরা আবার একটু হেসে বলে- ওই শুনুন ওরা বলছে-ইনকিলাব….’

সত্যি বাইরে শোভাযাত্রাকারীরা বলছে ‘আল্লাহু আকবর।’ সবটা শোনা না গেলেও এটা বেশ পরিষ্কার শোনা যায়। ওসমান আবার বললেন- আল্লাহু আকবর। চক্রবর্তী শুনছিলেন দু’জনের কথা।

বললেন- আল্লাহু আকবরের মধ্যে ইনকিলাব আছে।

হঠাৎ বুঝতে পারে না কেউ। তিনি পরিষ্কার করেন- আজকে আল্লাহু আকবরের ধ্বনির মধ্যে দিয়ে গড়ে উঠেছে যে বিশ্বাস, সংঘশক্তি- সে তো উড়ে যাবে না। সংকটের দিনে, ধাক্কা খেয়ে এই সংঘশক্তিই মানুষকে নিয়ে যাবে বিপ্লবের দিকে, ইনকিলাবের দিকে।

খুব বড় তত্ত্ব নয় এটা- তবু যেন এর আশাবাদের মধ্যে বলিষ্ঠতার অন্ত নেই। এ হচ্ছে চরম আশাবাদ। অন্ধকারের রাজ্যে এই আশাবাদই ইন্ধন জোগায়- ভাবনা ও চিন্তার ইঞ্জিনে।

চলবে…

আরো পড়তে পারেন

ভাষা আন্দোলন ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতি (সব পর্ব)

ভাষা আন্দোলন ও আত্মপরিচয়ের রাজনীতি ভাষা আন্দোলনের পর্যায় বিশ্লেষণ সূচনা ও বিকাশ পর্ব (১৯৪৭-১৯৪৮) বায়ান্নর প্রস্তুতি পর্ব (১৯৪৯-১৯৫১) বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

হারুন আল রশিদের সৃষ্টির ভুবনে ‘রুদেবিশ শেকাবের ব্যতিক্রমী জীবন’

হারুন আল রশিদ দুই দশকের বেশি সময় ধরে গদ্য সাহিত্য রচনার আধুনিক কলা-কৌশল রপ্ত করেছেন। বিশ্ব সাহিত্যে স্থায়ী অবদান রাখা শতাধিক লেখকের উপন্যাস তিনি নিবিড়ভাবে অধ্যয়ন করেছেন। ইংরেজিতে লেখা তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহৎ উপন্যাস, The Memoirs of An Unrequited Love ও The River Flows Upstream, নতুন আঙ্গিকে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। ইংরেজি ভাষায় এ যাবৎ….

রাজীব সরকারের সৃষ্টির ভুবন

রাজীব সরকার এই সময়ের শক্তিমান লেখক। প্রাবন্ধিক হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও, সাহিত্যের অন্যান্য শাখায় তার কাজগুলোও সমান গুরুত্বের দাবি রাখে। বিতর্ক বিষয়ে রাজীব সরকারের একাধিক বই মেধাবী তরুণদের প্রয়োজন মিটিয়েছে। খুব অল্পসময়ের মধ্যেই তার রম্যরচনার আলাদা পাঠকশ্রেণি গড়ে উঠেছে। গল্প ভ্রমণকাহিনি ও লিখেছেন। চলমান বিষয়ে দৈনিক পত্রিকায় মতামতধর্মী কলামও লিখে থাকেন বিভিন্ন সময়ে। জন্ম কিশোরগঞ্জ….

error: Content is protected !!