Author Picture

জ্যাক রায়ান : হলিউড নেশন ও প্রপাগান্ডা মেশিন

জাহেদ সরওয়ার

স্পাই থ্রিলার ও পলিটিকাল থ্রিলার বলে যে দুটো ক্যাটাগরি আছে হলিউড মুভি জগতে এই দুই ক্যাটাগরিভরা সিনেমাগুলো বেশিরভাগই প্রপাগান্ডা ও আমেরিকান বুদ্ধিজীবীরা যাদেরকে শত্রু মনে করে তাদের বিরুদ্ধে কুৎসা। সিনেমাগুলো বেশ ব্যয়বহুল এগুলোতে সরকার ভর্তুকি দেয় কিনা জানি না তবে ছবিগুলো বেশ সাসপেন্সে ভরা। টানটান উত্তেজনা। ব্যবসা সফলও অধিকাংশ সিনেমাগুলো। যেগুলোর অধিকাংশের ভিলেন হয় রাশিয়ান, আফ্রিকান অথবা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম। সম্প্রতি এই ঘরাণার একটা ছবি দেখলাম জ্যাক রায়ান: শ্যাডো রিক্রুট নামে। এই ছবির প্রধান আকর্ষণ কেভিন কাস্টনার ও কায়রা নাইটলি। মার্কিন বুদ্ধিজীবীরা যারা মনে করে রাশিয়া দেশটি তাদের সারাজনমের শত্রু এই ঘরাণার বহু বহু ছবি তৈরি হয়েছে এই হলিউডে। কতরকমভাবে রাশিয়া দেশটিকে খারাপ হিসাবে তুলে আনা যায় তাদের কাহিনিতে সেটার জন্য বিশেষ কৌশল অবলম্বন করা যায়। আমার মনে হয় হোমো সেপিয়েন্সের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ জিনগুলো সবই আমেরিকায় বাস করে। কারণ শুরু থেকেই যদি দেখি আজকে যারা নিজেদের মার্কিনী মনে করে তারা যখন আমেরিকায় গমন করেন তখন তারা সেখানে কী করেছিল তা ‘আমারে কবর দিও হাটুভাঙ্গার বাকে’ সহ ডী ব্রাউনের অন্যান্য ইতিহাসের বই ও এই বিষয়ে নানা ইতিহাসের বইগুলো পড়লে বুঝা যায়। হাজার হাজার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের তারা নির্বিচারে হত্যা করেছে। ধ্বংশ করেছে তাদের বসতবাড়ি, চাষের জমি, গবাদিপশু। ধর্ষণ করেছে নারীদের। তাদের তাড়িয়ে নিয়ে গেছে আমেরিকার নির্জনতম স্থানে। এছাড়াও টুইনটাওয়ার ট্রাজেডির পরে মার্কিনীরা ইরাক আফগানিস্তানে চারলক্ষেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। ভিয়েতনাম ইরাক ইত্যাদি বিষয়ে তাদের ভুল সিদ্ধান্ত ও মিথ্যাচার ইতিমধ্যে স্বীকৃত। এছাড়াও আফ্রিকা লাতিন আমেরিকায় তাদের আধিপত্য ও সম্পদ সংগ্রহের জন্য প্রতিনিয়ত অজস্র মানুষকে তারা হত্যা করছে এবং হত্যায় সহায়তা করে চলেছে। আজকে গোটা দুনিয়া জুড়ে মানবিকতার যে বিপর্যয় তার পেছনে সবচাইতে বড় ভূমিকা মার্কিন ডেমোক্রেসির।

আমার মনে হয় হোমো সেপিয়েন্সের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ জিনগুলো সবই আমেরিকায় বাস করে। কারণ শুরু থেকেই যদি দেখি আজকে যারা নিজেদের মার্কিনী মনে করে তারা যখন আমেরিকায় গমন করেন তখন তারা সেখানে কী করেছিল তা ‘আমারে কবর দিও হাটুভাঙ্গার বাকে’ সহ ডী ব্রাউনের অন্যান্য ইতিহাসের বই ও এই বিষয়ে নানা ইতিহাসের বইগুলো পড়লে বুঝা যায়।

অন্যদিকে রাশিয়ার ইতিহাসের দিকে যদি আমরা তাকাই। শত শত বছর ধরে এসব চাষী পরিশ্রমী সেপিয়েন্স তিল তিল ত্যাগের মাধ্যমে গড়ে তুলেছে এই রাশিয়া। রাশিয়ার সংস্কৃতি সাহিত্য চলচ্চিত্র ইত্যাদি গোটা দুনিয়া জুড়ে ব্যাপকহারে চর্চিত ও অনুকৃত হয়। আমেরিকার সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বয়স রাশিয়ার অর্ধেকও হবে না। আমেরিকার সংস্কৃতিতে একটাও তলস্তয় নাই, দস্তইয়েভস্কি নাই, পুশকিন নাই, লেরমন্তভ নাই। আমেরিকার সিনেমায় কী আইজেনস্টাইন, মার্ক দনোস্কয় বা তারকোভস্কি আছে? এর জবাব বোদ্ধাদের কাছে আছে নিশ্চয়ই। রাশিয়ানরা সারাজীবন মানবজাতির কল্যাণের কথা চিন্তা করেছে। এই জন্য সমাজতন্ত্র রাশিয়াতেই সম্ভব ছিল। রাশিয়া আবার অর্থনৈতিকভাবেও সম্মৃদ্ধশালী। তাদের নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ও তেলের খনি আছে। তাদের ব্যাপক চাষাবাদ ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা আছে।

অন্যদিকে দুনিয়ার সব চোরবাটপার, সিরিয়াল কিলার, আগ্রাসী মাফিয়া, সারাদুনিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ লুণ্ঠনকারী অস্ত্রকারখানার মালিক আর চোরাকারবারীতে ভর্তি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। এই সমাজের বিকাশও ঘটেছে সেভাবেই। কিছুদিন পরপর দেখা যায় আমেরিকার বিভিন্ন স্কুলে বা বারে বা সাংস্কৃতিক পরিবেশে নির্বিচারে গুলি করে মানুষ মারা হয়। এ হচ্ছে অন্তসার শূন্য সমাজের বহিপ্রকাশ। তো এরা কেন রাশিয়াকে শত্রু মনে করে? কারণ রাশিয়া লুম্বেন পুঁজিবাদের সমর্থক নয়। আমেরিকার মত ডেভিল, লেভিয়াথানদের যে কোন চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্তে সর্বাগ্রে প্রতিবাদ আসে রাশিয়া থেকেই। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেছে সত্য কিন্তু এই সোভিয়েত ইউনিয়নের কলিজাই ছিল রাশিয়া। এই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গার পেছনেও তো সবচেয়ে বেশি ষড়যন্ত্র ছিল খোদ আমেরিকারই। গণতন্ত্রের নামে সারা দুনিয়া লুঠছে আজ আমেরিকাই। অথচ তাদের সে সব দোষ তারা ক্রমাগত চাপিয়ে দিচ্ছে রাশিয়ার উপর, লাতিন আমেরিকার উপর, মধ্যপ্রাচ্যের উপর। এই সিনেমাতেও সেরকম একটা পরিস্থিতি আছে নায়ক জ্যাক রায়ান যখন সিআইয়ের বিশেষ অ্যাজেন্ট হয়ে মস্কো অভিযানে যায় সেখানে রাশিয়ান ভিলেনের সাথে তার কথোপথন হয়। জ্যাক অনেক নবীন তিনি বলেন তিনি আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেছেন। রাশিয়ান ভিলেনও বলে তিনিও আফগানিস্তানে যুদ্ধ করেছেন মুজাহিদিনের সাথে যে সব মুজাহিদিনকে আমেরিকা অস্ত্র দিয়েছিল।

এসব আষাড়ে গল্প কারা বিশ্বাস করে? কারা এর ভোক্তা? কাদের জন্য এই ছবি? হলিউড নেশন। সিনেমা, কার্টুন, গেইমসের ভেতর দিয়ে যে অজস্র ভোক্তা দর্শক দিনের পর দিন তাদের অবসর বিনোদনের জন্য হলিউডের উপর নির্ভর করে চলেছেন। হলিউডের চমৎকার সিনেমা প্রযুক্তি যাদেরকে বিমোহিত করে রেখেছে দিনের পর দিন। এরাই হলিউড নেশন। এদের নির্দিষ্ট কোন দেশ নাই। পৃথিবীর সব দেশেই আছে এই হলিউড নেশন।

এই ছবিতে রাশিয়ান ভিলেনকে দেখানো হয়েছে যারা একই সাথে আমেরিকায় গুপ্তচর পাঠিয়ে বিভিন্ন স্থাপনা উড়িয়ে দেয়ার জন্য বোমা ফিট করে রেখেছে। অন্য দিকে ওয়ালস্ট্রীট শেয়ার মার্কেট থেকে সমস্ত টাকা লুটে নেয়ার জন্য বেনামে অনেকগুলো অ্যাকাউন্ট দিয়ে লেনদেন করছে। একই সাথে অর্থমার্কেট লুটে নেবে ও আমেরিকার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গা তারা ধ্বংশ করে দেবে আর এর ভেতর দিয়ে তারা আমেরিকাকে একটা অর্থনীতিহীন দেশে পরিণত করার ষড়যন্ত্র করেছে। এরকমই একটা গাজাখূরী গল্প দিয়ে সিনেমাটা। আর তাই নায়কগণ মস্কোতে গিয়ে হলিউডি বীরত্বের সাথে সেই রাশিয়ান মাফিয়া ভিলেনকে ধ্বংশ করে আসে।

এসব আষাড়ে গল্প কারা বিশ্বাস করে? কারা এর ভোক্তা? কাদের জন্য এই ছবি? হলিউড নেশন। সিনেমা, কার্টুন, গেইমসের ভেতর দিয়ে যে অজস্র ভোক্তা দর্শক দিনের পর দিন তাদের অবসর বিনোদনের জন্য হলিউডের উপর নির্ভর করে চলেছেন। হলিউডের চমৎকার সিনেমা প্রযুক্তি যাদেরকে বিমোহিত করে রেখেছে দিনের পর দিন। এরাই হলিউড নেশন। এদের নির্দিষ্ট কোন দেশ নাই। পৃথিবীর সব দেশেই আছে এই হলিউড নেশন। হলিউডি সিনেমা দর্শন এদের মগজ ধোলাই করেছে। হলিউডি তৃতীয় শ্রেণির ধাপ্পাবাজ চিত্র পরিচালকরাই এদের কাছে ইতিহাস নির্মাতা। যারা মূলত আমেরিকার ধাচে ইতিহাস বিকৃত করে। হলিউডে তৈরি এসব স্পাই মুভি দেখলে মনে হবে গোটা দুনিয়াজুড়ে তাদের শত্রু যারা শুধু আমেরিকাতে স্পাই পাঠিয়ে তাদের ধ্বংশ করার তালে থাকে। যেন তারা কোথাও স্পাই পাঠায় না। এ নিয়ে স্পিলবার্গ একটা ছবি বানিয়েছেন ব্রিজ অফ স্পাই নামে ওখানে তিনি দেখিয়েছেন সোভিয়েত স্পাইকে অনেক ভয়ংকর করে দেখানো হচ্ছে কিন্তু স্পাইগিরি খারাপ জানা সত্তেও তারাই আবার সোভিয়েতে স্পাই পাঠাচ্ছে।

আসলে এরা একটা আলাদা বাস্তবতা তৈরি করে। সেই বাস্তবতায় প্রথমে কল্পনার রঙে আঁকা হয় কিন্তু পরে এটা অতি প্রচারে একটা আলাদা বাস্তবতায় পর্যবসিত হয়। মাঝে মাঝে হলিউডের বিশাল ইন্ডাস্ট্রির দিকে তাকালে মনে হয় এটা একটা কুৎসা আর প্রপাগান্ডার মেশিন। এই মেশিন দিয়ে তারা গোটা দুনিয়া জুড়ে একটা হলিউড নেশন তৈরি করছে যারা নির্দিধায় তাদের রঙ্গীন মিথ্যাকে বিশ্বাস করে, তার তৈরি করছে মর্ডানিজমের দোহাই দিয়ে তাদের তৈরি চিন্তা পণ্যের ভোক্তা সমাজ। এই চিন্তাপণ্যর হাত ধরে তাদের চাপিয়ে দেয়া নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডারকে মেনে নেয়ার পথ তৈরি হয়। এই ধরণের অজস্র মিথ্যায় ভরা সিনেমাজগত হচ্ছে হলিউডের সিনেমা জগত।

আরো পড়তে পারেন

দ্য পিয়ানিস্ট ইয়ানী

পাঁচ তারকা হোটেলের সবচেয়ে ফাইন ডাইন রেস্টুরেন্টে অতিথিকে স্বাগত জানানোর জন্য বসে আছি। বিশ্বের অন্যতম উন্নত, সবুজ শহরের প্রতিনিধি আমাদের আমন্ত্রণে আজ সকালে দেশে এসে পৌঁছেছেন, কাল আমাদের আয়োজিত সেমিনারে বক্তব্য রাখবেন, অনুষ্ঠানের পূর্ববর্তী সৌজন্য ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে যেখানে আমার অফিসের শীর্ষ পদের ব্যক্তিবর্গ এবং একই কমিউনিটির বাংলাদেশের আরও কিছু ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।….

সেকুলার নির্মাতা ইসমত চুগতাই

স্বতন্ত্র স্বর ও নিজস্ব স্টাইলে উর্দূ সাহিত্য ইতিহাসে ইসমত চুগতাই (১৯১৫-১৯৯১) অনন্য উজ্জ্বল এক নাম। ধ্রুবতারা’র মতোই জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল তার শ্রেষ্ঠ সব সৃষ্টিকর্ম। বহুলপ্রজ এ ছোটগল্পকার শিল্প-সাহিত্যে বিশেষ অবদানে অর্জন করেছেন ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী পুরস্কারসহ নানাসব বৃহৎ সম্মাননা। কিন্তু ভারতীয় সিনেমায় তার বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্পর্কে কতটুকু জানি আমরা! কখনো আলোচনা হয় কি….

মেট্রোপলিশ ও আমাদের বস্ত্রকারখানার অস্থিরতা

মেট্রোপলিশ ছবির পরিচালক ফ্রিৎস ল্যাঙকে জার্মান চলচ্চিত্রকার ও তার সব ছবিকে জার্মানির প্রথমার্ধের চলচ্চিত্রের অর্ন্তভুক্ত হিসাবে ধরলেও তিনি জন্ম নিয়েছিলেন অষ্ট্রিয়ায়। অস্থিরতাই বুঝি শিল্পীর নিয়তি ও স্বভাব। কারণ সব সময় একজন শিল্পীকে সৃজনবেদনা তাড়িয়ে বেড়ায়। নতুন কিছু করবার যন্ত্রণায় শিল্পী দগ্ধ হতে থাকে অহরহ। তেমনি অনেক ঘাটের জল খেয়েই তিনি থিতু হয়েছিলেন জার্মানিতে। মেট্রোপলিশ সম্পর্কে….

error: Content is protected !!