Author Picture

ফিলিস্তিনী ডায়াস্পোরা সাহিত্য

ওয়াসাম আল-আসাদি
অনুবাদ : নাজিব ওয়াদুদ

[ওয়াসাম আল আসাদি অ্যামেরিকান ইউনিভার্সিটি অফ শারজাহ-র পূর্ণকালীন শিক্ষক। ২০০৪ সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে ট্রান্সলেশন অ্যান্ড ইন্টারপ্রিটেশন বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। যুক্তরাজ্যের এক্সেটার ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অফ অ্যারাব অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ-এর পিএইচডি ডিগ্রিধারী আসাদির পড়াশোনা ও গবেষণার মূল ক্ষেত্র ট্রান্সলেশন স্টাডিজ, ইন্টারকালচারাল স্টাডিজ, জেন্ডার স্টাডিজ এবং পোস্টকলোনিয়াল লিটারেচার।]

১৯৪৮ সাল হচ্ছে আল-গুরবা (নির্বাসন)-এর শুরু এবং আল-নাকবা (ধ্বংস বা বিপর্যয়) হিসেবে চিহ্নিত। শব্দ দুটি ফিলিস্তিনী অভিধানে ভীষণ অনুনাদী। এটা এমন একটা চূড়ান্ত তারিখ, যার সঙ্গে-পূর্ব অথবা-উত্তর প্রত্যয় যোগ করা যায় দিব্যপ্রকাশক মুহূর্তকে চিহ্নিত করতে। এই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অক্ষে একটা নতুন শূন্যতার জগত আকৃত হয়েছে। ১৯৪৮ সালে, বিতাড়ন ও পলায়ন মিলিয়ে, সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনী প্রতিবেশী আরব দেশগুলোয় শরণার্থী হয়েছে। এক লাখ ফিলিস্তিনী থেকে গিয়েছে তাদের ভিটেয়। আর তার পর থেকে ‘ফিলিস্তিনী হওয়া মানে বোঝায়, অংশত লালিত-পালিত হওয়ার সূত্রে, অংশত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতার নিরিখে, পরিব্রাজক, নির্বাসিত, চাঁদে-পাওয়া পাগল হওয়া, যে কিনা অন্যদের থেকে সব সময় কিছু-না-কিছু আলাদা। ১৯৪৮-এর পরে আমরা যে নাম পেয়েছি- বলা হচ্ছে আমাদের কোনও জাতি ছিল না- তা
অস্তিত্ববাদী দৃষ্টিতে ততটা জাতীয়তার পরিচায়ক নয়। [টারকি, এফ. (১৯৯৪)। এক্জাইল্স রিটার্ন : দ্য মেকিং অফ এ প্যালেস্টিনিয়ান অ্যামেরিকান। নিউইয়র্ক : দ্য ফ্রি প্রেস]
দশকের পর দশক জুড়ে ফিলিস্তিনীরা নির্বাসনে (ডায়াস্পোরা) যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে, এডওয়ার্ড সাঈদের ভাষায়, তাদের বর্তমান বাস্তবতার আখ্যান, যা ডালপালা ছড়িয়েছে ফিলিস্তিনে (পরবর্তীকালের ইসরায়েল) এবং ফিলিস্তিন থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার গল্প থেকে, তা নেই কোথাও। তাছাড়া, ফিলিস্তিনীদের স্বায়ত্তশাসন সংগ্রামের একটা লক্ষ্য হচ্ছে ভৌগোলিক সীমান্তের ওপারে ফিলিস্তিনী হিসেবে তাদের যে অভিজ্ঞতা তার সত্যতার কথা জানান দেওয়া। লিসা মাজাজ বলেছেন, প্রত্যাবর্তন মানে স্রেফ পেছনে ফিরে যাওয়া নয়, এর মানে সামনে এগিয়ে যাওয়াও; পুনরুদ্ধৃত অতীতের টুকরোসমষ্টি থেকে একটা নতুন ভবিষ্যত নির্মাণ করা। [মাজাজ, এল. (২০০১)। অন রাইটিং অ্যান্ড রিটার্ন : ফেমিনিজম, রেস অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনালিজম। ইন মেরিডিয়ান্স : ভলিউম ২ নং ১। পৃষ্ঠা ১১৩-২৬]
এডওয়ার্ড সাঈদ এবং অন্য সব ফিলিস্তিনী বুদ্ধিজীবী ব্যক্তিত্বদের মৌলিক ও পান্ডিত্যপূর্ণ গ্রন্থাবলী, আনুষ্ঠানিক গণভাষণ, ক্লাসরুমের শিক্ষাদান ও রাজনৈতিক আলোচনা ফিলিস্তিনী জনগণ এবং ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘর্ষ সম্পর্কে মার্কিন ও সারা বিশ্বের ধারণাকে পালটে দিতে শক্তিশালী ভূমিকা রেখেছে। তাদের ফিলিস্তিনের রাজনীতি, ইতিহাস এবং অর্থনীতি বিষয়ক রচনাবলী মার্কিন রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সাংস্কৃতিক অভিজাত সমাজকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মার্কিনীরা ফিলিস্তিন এবং আরব বিশ্বের অ-রাজনৈতিক গল্প পড়ার সুযোগ পায় না, কারণ এগুলো দুর্লভ, খুঁজে পাওয়া কঠিন। আরব-আমেরিকানদের প্রতিবেদনগুলো সাধারণত একই রকমভাবে উপস্থাপিত হয়: মেদহীন, পরিসংখ্যাণগতভাবে সঠিক রাজনৈতিক প্রতিবেদন যা যে কোনও পেশাদার শিক্ষাবিদ পড়তে পছন্দ করবেন।
মার্কিন জনগণ এবং আরব-আমেরিকানদের নতুন প্রজন্মকে আকর্ষণ করার জন্য ফিলিস্তিনীদের সামষ্টিক অতীতকে সাহিত্যিক রচনার মাধ্যমে উপস্থাপন করা দরকার যার মধ্যে থাকবে ফিলিস্তিনী ট্র্যাজেডির মানবিক রূপায়ণ ও বোধগম্যতা।
অন্যান্য স্মৃতিকথা এবং উপন্যাসের মধ্যে সাঈদের স্মৃতিকথা ‘আউট অফ প্লেস’, শাও দালালের আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘স্ক্যাটার্ড লাইক সিডস’ এবং ইবরাহীম ফাওয়ালের উপন্যাস ‘অন দ্য হিল্স অফ গড’ নির্বাসিত ফিলিস্তিনীদের, বিশেষত আমেরিকায় যারা রয়েছেন তাদের, জাতীয় অসাড়তার চৌকাঠের বাইরে যাওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছে: একটা ভিন্ন বাস্তবতার স্মরণ ও স্বপ্ন দেখার, ইতিহাসের ঐক্যসূত্রে নিজেদের উপস্থাপন করার স্বাধীনতা। এরা ফিলিস্তিনী সাহিত্যের সাম্প্রতিক প্রবণতার প্রতীকস্বরূপ: এদের লেখার মূল নির্বাসনভূমি, কিন্তু থিম ও বিষয় ফিলিস্তিনের।
আত্মপরিচয় ও প্রত্যাবর্তনের থিম আবিষ্কারের মাধ্যমে এরা ফিলিস্তিনী সাহিত্যের সেই পদ্ধতিগুলোকে তুলে ধরেন যাতে আজকের ফিলিস্তিনী নির্বাসনের বাস্তবতা মূর্ত হয়। তারা নির্বাসনভূমি (এইক্ষেত্রে আমেরিকা) এবং ফিলিস্তিনের সঙ্গে নির্বাসিত ফিলিস্তিনী ও তাদের অধঃস্তনদের সম্পর্ককে প্রতীকায়িত করেন। একবিংশ শতাব্দীতে ফিলিস্তিনী আমেরিকানরা যে বাস্তবতার মুখোমুখি হন তার প্রেক্ষাপটে এই সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ; এই বাস্তবতা হচ্ছে একজন নির্বাসিত ব্যক্তির নিজস্ব শারীরীক বা রাজনৈতিক বিচ্ছিন্নতাবোধের কষ্ট, বা বিকল্প হিসেবে, একজন ব্যক্তির অন্তর্গত আস্তিত্বিক দ্বন্দ্বরূপে প্রকাশিত সামষ্টিক যন্ত্রণা। যেহেতু ফিলিস্তিন এখনও একটা জাতি-রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়নি, সেহেতু শারীরীক নির্বাসন, এবং আরও বিশেষভাবে আধুনিকতাবাদী ব্যক্তিগত নির্বাসন, উভয়বিধ
অস্তিত্বমূলক অনুধ্যানের কারণে নামটা পৃথিবীতে অলীক বস্তু হয়ে থাকে। [স্যালাইতা, এস. (২০০৩)। স্ক্যাটার্ড লাইক সিডস: প্যালেস্টিনিয়ান প্রোজ গোজ গ্লোবাল (ক্রিটিক্যাল এসেজ)। ইউএসএ: ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি অফ
পেনসিলভানিয়া প্রেস] ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের ধ্বংসকর সামরিক বিজয়ের পর, রাজনৈতিক প্রপঞ্চকে ব্যক্তি-সংশ্লিষ্ট এবং রূপকে আবৃত করা আরও সর্বসাধারণিক প্রবণতার অংশ হয়ে গেছে। ফিলিস্তিনী নির্বাসনের টুকরো টুকরো ব্যক্তিক বিশিষ্টতার মধ্যে শক্তিশালী আকর্ষণ তৈরি হয়েছে, এবং তার ফলে, সাহিত্যিক আধুনিকতাবাদ, একটা সৌন্দর্যতাত্ত্বিক প্রপঞ্চ, ভূমি এবং সম্পদ নিয়ে ফিলিস্তিনীদের লেখালেখির অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত আঙিকে পরিণত হয়েছে। [স্যালাইতা, এস. (২০০৩)। স্ক্যাটার্ড লাইক সিডস: প্যালেস্টিনিয়ান প্রোজ গোজ গ্লোবাল (ক্রিটিক্যাল এসেজ)। ইউএসএ: ইন্ডিয়ানা ইউনিভার্সিটি অফ
পেনসিলভানিয়া প্রেস]
সাঈদের স্মৃতিকথা আউট অফ প্লেস (Out of Place)
ফিলিস্তিনী ট্র্যাজেডির হৃৎপিন্ড এবং আত্মাকে দক্ষতার সঙ্গে ধারণ করেছে। এতে ফিলিস্তিনীদের দুর্ভোগের শিকার নয়, বরং স্বাভাবিক মানবসত্ত্বা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যাদের ব্যক্তিগত জীবন, ইতিহাস, পরিচিতি এবং নাম ছিল এবং আছে।
আউট অফ প্লেস যৌবনের স্মৃতিকথা; জীবন, পরিবার এবং বন্ধুদের নিয়ে অন্তরঙ্গ জীবনীগ্রন্থ; এতে রয়েছে সাঈদের জেরুসালেমের জন্মস্থান, কায়রোর স্কুল, বৈরুতের পাহাড়ের গ্রীষ্মকাল, এবং আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বোর্ডিং স্কুলের কথা; উন্মোচিত হয়েছে সমৃদ্ধ ও বর্ণিল চরিত্র এবং প্রাচীয় ভূপ্রকৃতির অকল্পনীয় জগত। এর ভেতরে গেঁথে দেওয়া হয়েছে তরুণ সাঈদের আত্মপরিচয়ের সংকটকে, তিনি যার মুখোমুখি হয়েছেন আমেরিকান নাগরিক, খ্রীষ্টান এবং ফিলিস্তিনী (শেষ পর্যন্ত হয়েছেন আসলে একজন দলছুট) হতে গিয়ে। জন্মের পর থেকেই সাঈদ বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক ও বহুভাষী পরিবেশে বাস করেছেন। তার স্মরণে নেই তিনি ইংলিশ না আরবী, কোন ভাষায় প্রথম কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছেন যে, এই দুইটি (ভাষা) সব সময়ই আমার সঙ্গে ছিল, একটার মধ্যে আরেকটা প্রতিধ্বনিত হতো, কখনও ব্যাঙ্গাত্মকভাবে, কখনও স্মৃতিকাতরতার সাথে, প্রায়শঃই পরস্পরকে সংশোধন করত, পরস্পরের ওপর মন্তব্য করত। [সাঈদ, এ. (১৯৯৯)। আউট অফ প্লেস। নিউইয়র্ক: কèফ] স্থানচ্যুতির বিষয়ে তার অনুভূতি বর্ণনা করতে গিয়ে সাঈদ উচ্চারণ করেন:
‘আমার হঠাৎ-হঠাৎ নিজেকে বহমান স্রোতের গুচ্ছ বলে মনে হয়। একটা নিরেট সত্ত্বার ধারণার চেয়ে আমি এই ধারণাকেই বেশি পছন্দ করি… এই স্রোতধারাগুলোকে… তাদের সর্বোত্তম রূপে; তাদের কোনও পুনর্মিলন বা ঐকতান প্রয়োজন নেই। তারা ‘দূরবর্তী’, এবং স্থানচ্যুতও হতে পারে, কিন্তু নিদেনপক্ষে তারা সব সময় গতিমান।’ [সাঈদ, এ. (১৯৯৯)। আউট অফ প্লেস। নিউইয়র্ক: কèফ]
সাঈদের স্মৃতিকথা পড়তে গিয়ে যে কেউ তার মধ্যে আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীসৃষ্ট রাজনৈতিক সংকটের উপস্থিতি খুঁজে পাবেন। তিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে ভূ-রাজনীতি এবং আমেরিকার বিদেশনীতির সমালোচনার সঙ্গে যুক্ত করেন।
স্ক্যাটার্ড লাইক সিডস (Scattered Like Seeds) একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। জাফর আলম নামের এক ফিলিস্তিনী আইনজীবী ও আণবিক পদার্থবিদের মধ্যপ্রাচ্যে ফেরার গল্প বলার মধ্য দিয়ে এতে নির্বাসিত ফিলিস্তিনীদের আত্মপরিচয়ের সংকটকে আবিষ্কার করা হয়েছে। তার স্ত্রী মেরি প্যাট একজন আইরিশ আমেরিকান, তাদের চার ছেলেমেয়ে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে আরবদের পরাজয়ের পর আমেরিকান সমাজে তার আত্মীকরণ প্রশ্নের সম্মুখিন হয় এবং একজন ফিলিস্তিনী হিসেবে তার পরিচয়ের সঙ্গে তাকে পুনরায় আবশ্যিকভাবে দ্বন্দ্বে নামতে হয়।
অ্যালেনবাই ব্রিজে (পশ্চিম তীরের অধিকৃত এলাকা এবং জর্দানের মধ্যকার সীমান্ত পার হওয়ার সময়) জাফরকে উলঙ্গ করে পরীক্ষা করার পর পশ্চিম তীরে তার মাকে দেখতে যাওয়ার অনুমতি দিতে অস্বীকার করা হয়। এই ভ্রমণ জাফরের আদর্শিক রূপান্তরের বাঁকবদল সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। আরব বিশ্বের বাস্তবতার সঙ্গে ভালভাবে খাপ খাওয়ানোর জন্য তাকে ক্রমান্বয়ে তার দর্শন বদলে নিতে হয়। একজন ফিলিস্তিনী জাতীয়তাবাদীর নতুন অবস্থানে চূড়ান্ত পর্যবসনের আগে জাফর এই রাজনৈতিকীকরণের বিরোধিতা করেছে।
“ওই (অ্যালেনবাই) ব্রিজে যা ঘটেছে তাই তোমাকে বদলে দিয়েছে, তুমি জানো সেটা… এর শুরু বৈরুতে, শরণার্থী শিবিরে… তারপর সুহাইলিয়ার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ, তোমার স্বদেশী সে, তোমার মধ্যেকার ঘুমন্ত প্রেমাবেগ জাগিয়ে তোলে। কিন্তু ব্রিজের ওই অপমান এবং মাকে দেখতে যেতে না পারাটাই তোমাকে চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছে। [দালাল, এস. (১৯৯৮)। স্ক্যাটার্ড লাইক সিডস। সাইরাকিউজ : সাইরাকিউজ ইউনিভার্সিটি প্রেস]
অবশ্য আত্মপরিচয় এবং সংগ্রামে তার ভূমিকার ব্যাপারে তার মধ্যে সংশয় থেকে যায়। ফিলিস্তিনী-আমেরিকান জীবনের বিবেচনায় জাফরের অভিজ্ঞতার তুলনায় তার সন্তানদের লড়াই বরং আরও প্রতীকী। ক্রমান্বয়ে, উপন্যাসে তাদের ভূমিকা ইঙ্গিত দেয় নির্বাসন ফিলিস্তিনীদের কীভাবে পরিবর্তিত করে দিয়েছে। এটা বিস্ময়ের ব্যাপার নয় যে, কলেজছাত্র কলিন এবং অ্যান্ড্রু আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে যাওয়াকে অগ্রাধিকার দেয়, এবং কিশোরবয়সী ক্যাথারিন এবং সিয়ান মধ্যপ্রাচ্যে জীবন কাটাতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রে তাদের বিনিয়োগ এখনও এমন যথেষ্ট নয় যে সেটাকে জীবনযাপনের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ভাবতে হবে। (স্যালাইতা, ঐ) আরও গুরুতর বিষয় এই যে, তাদের কর্মকান্ডে প্রকাশ পায় যে ফিলিস্তিনী অভিবাসী এবং আমেরিকায় জন্ম নেওয়া ফিলিস্তিনীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক পার্থক্য রয়েছে।
সমস্ত ফিলিস্তিনী সাহিত্যের মতোই স্ক্যাটার্ড লাইক সিডস এবং অন দ্য হিল্স অফ গড (On the Hills of God)-এও ভূমি মূখ্য হয়ে ওঠে। সুহাইলার দেহে ফিলিস্তিনকে আরোপ করেন দালাল, এইভাবে রূপকের আশ্রয়ে তাকে উপস্থাপন করেন। জাফর ফিলিস্তিনের প্রতি তার নবায়িত অঙ্গীকারকে সূত্রায়িত করে সুহাইলার সঙ্গে তার সম্পর্কের মাধ্যমে। এই সচেতনতা কীভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে তা বোঝার জন্য নিচের উদ্ধৃতাংশটুকু পাঠ করা যাক-
“(জাফর) শুতে পারে না। এটা যেন এমন যে সে তার স্বদেশভূমিকে আলিঙ্গন করছে। (সুহাইলার) শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনে সে স্বস্তি অনুভব করে, তার উপস্থিতি তাকে নিরাপত্তার অনুভূতি দেয়। তার স্তনযুগল স্মরণ করিয়ে দেয় তার মাতৃভূমির সুস্নিগ্ধ পাহাড়ের কথা, তার মসৃণ কোমল ত্বক যেন তার গাছপালা, তার দীঘল হালকা বাদামী চুল তার সূর্যের রশ্মির কথা মনে করিয়ে দেয়।” [দালাল, এস. (১৯৯৮)। স্ক্যাটার্ড লাইক সিডস। সাইরাকিউজ : সাইরাকিউজ ইউনিভার্সিটি প্রেস]
দেহের সঙ্গে ভূপ্রকৃতিকে মেলানো পুরুষ ফিলিস্তিনী লেখকদের দীর্ঘদিনের কৌশল। লেখকরা প্রায়শঃই নারীদেহকে বেছে নিয়েছেন বাসভূমিকে উপস্থাপন করতে যেখান থেকে ফিলিস্তিনীদের নির্বাসিত করা হয়েছে, এটা তাদের কাছে এমন এক নিষিদ্ধ কাক্সিক্ষত জিনিস যা তাদের প্রত্যাবর্তনের আকাক্সক্ষাকে উসকে দেয়; দূরে দুর্ভোগে নিপতিত ফিলিস্তিনীদের গৌরব ও সম্মানের ধারক এই ভূমি যার ভেতর ঢুকে পড়েছে বিদেশী শক্তি। [হারকুর্ট, জে. (১৯৯৮)। ফোরওয়ার্ড, স্ক্যাটার্ড লাইক সিডস। বাই শ জে। দালাল। সাইরাকিউজ : সাইরাকিউজ ইউনিভার্সিটি প্রেস]
ফাওয়ালও, সালওয়াকে নিয়ে, একইরকম কাজ করেছেন তার উপন্যাস অন দ্য হিল্স অফ গড-এ, তবে আরও সূক্ষ্মভাবে। ইউসেফ-এর সঙ্গে তার প্রেম শৈশব কাল থেকে, কিন্তু আরব সমাজের রক্ষণশীলতা তাদেরকে রোম্যান্টিক সম্পর্ক স্থাপনের সুযোগ দেয়নি। একসময় সালওয়ার সাহিত্যিক যৌক্তিকতা একটা নীতিগত নিষেধাজ্ঞা হয়ে দাঁড়ায়, তাকে শিগগিরই রাষ্ট্রসংগ্রামের প্রতীকী মূর্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। তার পিতা যখন হোটেল ম্যানেজার আবদেল ফারহাত-এর সঙ্গে তার বিয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করে, তখন সালওয়া আরও নিষিদ্ধ এবং অপ্রাপনীয় হয়ে ওঠে, তাতে ইউসেফ আরও অধিকতর শক্তি নিয়ে তাকে অর্জন করার চেষ্টা করে। ফাওয়াল যে রূপক এখানে বাছাই করেন তা বেশ জটিল। সালওয়া যদি হয় ঝুঁকিগ্রস্ত ভূমি, যা ফিলিস্তিনীদের আকাঙ্ক্ষার বস্তু, তাহলে আবদেল ফারহাত হচ্ছে সেই বিদেশী শক্তি যে তাদের প্রেমের দৈহিক সত্ত্বার ওপর আগ্রাসন চালাচ্ছে। ইউসেফ বাগদান ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য ভয়ঙ্কর লড়াই চালায়, এবং শেষ পর্যন্ত সক্ষম হয় এবং উপন্যাসের অন্তে সে সালওয়াকে বিয়ে করে। স্বদেশভূমির সাথে ফিলিস্তিনীদের আবেগগত আসক্তি এইভাবেই রূপ লাভ করে। বিয়েটা ইঙ্গিত দেয় যে ফিলিস্তিন এবং তার জনগণ সবসময় প্রতীকীভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকবে।
ফাওয়ালের উপন্যাস আমাদের ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের শেষ বছরের ফিলিস্তিনে নিয়ে যায়, ফাওয়াল যাকে বলেছেন ফিলিস্তিনের সুখের শেষ গ্রীষ্ম। [ফাওয়াল, আই. (১৯৯৮)। অন দ্য হিল্স অফ গড। মন্টগোমারি, এএল: দ্য ব্ল্যাক বেল্ট প্রেস]
দালালের স্ক্যাটার্ড লাইক সিডস-এর বিপরীতে, ফাওয়াল আরব-আমেরিকান থিমের বিশদ বর্ণনা এড়িয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাসের প্রকল্পনা করেছেন যা পূর্ণতঃ ফিলিস্তিনীদের ওপরেই আলোকপাত করে। তার ফলে, অন দ্য হিল্স অফ গড একটা সমালোচনামূলক কাঠামোর মধ্যে স্ক্যাটার্ড লাইক সিডস-এর পূরকবিশেষ; দুটোই পৃথক কিন্তু সমান গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা নিয়ে কাজ করে, তাদের প্রস্থানবিন্দু একই, সেটা ফিলিস্তিন।
১৯৪৮ সালের যুদ্ধ অন দ্য হিল্স অফ গড-এর প্রাথমিক থিম। একেবারে প্রথম দিককার প্লটগুলো এগোয় খ্রিষ্টান ইউসেফ, তার প্রিয় দুই বন্ধু- ইহুদী আইজ্যাক শ্যালন ও মুসলিম আমিনের কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে। ফাওয়াল এই ত্রিমুখী ধর্মীয় কর্মধারা প্রয়োগ করেন ম্যান্ডেটরি ফিলিস্তিনের জনমিতিকে প্রতিফলিত করার জন্য, এবং তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, এটা দেখাতে যে তৎকালীন সমাজে ধর্মীয় বিভেদের ওপরে একটা জাতীয় সংস্কৃতি প্রাধান্যশীল ছিল।
অন দ্য হিল্স অফ গড-এ, ইহুদীবাদ ফিলিস্তিনীদের জীবন ধ্বংসকারী বিদেশাগত ইহুদী শক্তি নয়, বরং বহিরাগত ইউরোপীয় শক্তি যা মধ্যপ্রাচ্যের জীবনকে ধ্বংস করেছে, ফিলিস্তিনী ইহুদীরাও তার অন্তর্ভূক্ত। সাফিরা, শ্যালনরা, এবং আর্দাল্লার অন্যান্য অধিবাসীরা আখ্যানের চরিত্র বটে, কিন্তু কাহিনীটা ইহুদীবাদের। [স্যালাইতা, ঐ]
উপন্যাস শেষ হয় আর্দাল্লা গ্রামের অধিবাসীদের ছত্রভঙ্গ হওয়ার ভেতর দিয়ে। ইউসেফ এবং তার মাকে তাদের দীর্ঘকালের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়, তারা ট্রান্সজর্দানমুখি মরুযাত্রীদলের সঙ্গী হয়। পথিমধ্যে সালওয়া হারিয়ে যায়। সে তাকে খুঁজে বের করার শপথ নেয়, আর সেটা করতে গিয়ে, নিহিতার্থে, সে ফিলিস্তিনে ফিরে যায়। আইজ্যাক পরে একজন ইহুদীবাদী গুপ্তচর এবং জমির আমিন হিসেবে আবির্ভূত হয়। সে দলবলসহ সশস্ত্র যোদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে এবং নিহত হয়। নিজের প্রিয় বন্ধুর মৃত্যু প্রত্যক্ষ করে ইউসেফ এই যুদ্ধ নিয়ে তার কূটনৈতিক তৎপরতা আরও বাড়িয়ে দেয়। তার জ্ঞাতিভাই বাসিম এর বিরোধিতা করে, সে স্বাধীনতা এবং আত্মপরিচয় সংরক্ষণে সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী। ফাওয়াল এইসব পরস্পরবিরোধী দর্শনের কোনও সমাধান খোঁজেন না কখনও। তার পরিবর্তে তিনি তার কাহিনীকে শেষ হতে দেন বাসিম ও ইউসেফকে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিরোধপন্থার প্রতি অনুগত থাকতে দিয়ে। এই প্রতিবেদনে সম্ভবত সবচেয়ে স্পষ্ট অগ্রগতি অহিংস পন্থা এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যকার দ্বন্দ্ব।
ফাওয়াল যে তার উপন্যাসের সেটিংকে পুরোপুরি ফিলিস্তিনী কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ করেছেন তার তাৎপর্য এই যে, ‘এই উপন্যাসের ঐতিহাসিক বৈশিষ্ট্য, এর আমেরিকান প্রকাশনা এবং আমেরিকান পাঠকসমাজ মিলে প্রমাণ করে যে ফিলিস্তিনী সমাজের সাংস্কৃতিক গতিময়তা এখন অভিবাসন-ভূমিগুলোতে শেকড় গেড়ে দিয়েছে।’ [মাইকেল, এল. (১৯৯৯)। অন দ্য হিল্স অফ গড, বাই ইবরাহীম ফাওয়াল। ওয়াশিংটন রিপোর্ট অন মিডলইস্ট অ্যাফেয়ার্স। পৃষ্ঠা ১২৩-২৪]
আল-নাকবার পর ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনের প্রশ্নটি সাধারণ আমেরিকানদের বোধগম্যতার বাইরে থেকে গিয়েছে এবং অধিকৃত ফিলিস্তিনের অভ্যন্তরে এবং নির্বাসনে ফিলিস্তিনীরা যে দুর্ভোগের শিকার তার মানবিক দিকগুলো অস্বীকৃত হয়ে আসছে, তার কারণ ফিলিস্তিনী প্রশ্নটি অবিরাম আলোচিত হয়ে আসছে কঠোর, নীরস এবং বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক প্রতিবেদন এবং অভিজাত একাডেমিক গবেষণার আকারে।
সম্প্রতি কিছু সংখ্যক ইংরেজিভাষী এবং ফিলিস্তিনী-আমেরিকান লেখক অনুধাবন করেছেন যে, ফিলিস্তিনী প্রশ্নকে প্রাণ ও আত্মা দেওয়ার জন্য স্মৃতিকথা এবং উপন্যাসের ভূমিকা অপিরিসীম। ভৌগোলিক ও ভাষিক সীমানা ছাড়িয়ে নির্বাসনে থাকা
ফিলিস্তিনীরা বাস্তুচ্যুতির যে অভিজ্ঞতা লাভ করেছে তাকে সরাসরি বর্ণনা করার কাজে আমেরিকান-ফিলিস্তিনী লেখকরা সাহিত্যের কৌশল ও সৌন্দর্যকে ব্যবহার করেছেন। প্রায় সবগুলো রচনায় একই থিমের পুনরাবৃত্তি দেখিয়েছে কীভাবে নির্বাসিত সমাজ ফিলিস্তিনী হিসেবে তাদের আত্মপরিচয়কে ধারণ করে আছে, যদিও পেরিয়ে গেছে ষাটটি বছর এবং তারা থাকে ভিন্ন ভিন্ন ভৌগোলিক ভূমিতে।
নির্বাসনে বাস-করা ফিলিস্তিনীরা তাদের আখ্যানে হারিয়ে-যাওয়া স্বদেশকে সমবেতভাবে শনাক্ত এবং স্মরণ করে। তাদের শৈল্পিক রচনাগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে একটা প্রধান বিষয় বেরিয়ে আসে, সেটা হলো, তারা তাদের সৃষ্টিকর্মে
ফিলিস্তিনীদের একটা সামষ্টিক পরিচয় হিসেবে প্রতীকায়িত করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনী পরিচয় ধারণ নির্বাসনের প্রমাণচিহ্ন; এর ছদ্মাবরণে রচিত সাহিত্য দ্বিমুখি আধুনিক ফিলিস্তিনী অবস্থাকে মূর্ত করে। নির্বাসনী রচনা আমেরিকান সাহিত্যরীতি গ্রহণ করেছে, আমেরিকার সাংস্কৃতিক ভূমির জটিলতাকে আবিষ্কার করেছে, কিন্তু একইসঙ্গে ফিলিস্তিন হয়েছে তাদের অনুপ্রেরণার মূল উৎস। এরকম আখ্যানিক বিকাশ হচ্ছে বাস্তুচ্যুতির বিশিষ্ট ফল। যদিও ফিলিস্তিনের ওপর গুরুত্ব প্রদানের ব্যাপারটা পুনরুজ্জীবিত রাজনৈতিক সচেতনতার ফল। ফিলিস্তিন সুতরাং রয়ে যাচ্ছে সতত পরিভ্রমণের মধ্যে, এটা বয়ে চলেছে পৃথিবীর এমন সব এলাকাতেই, যেখানে তার সন্তানরা বসত গড়ে তুলেছে।

আরো পড়তে পারেন

সৈয়দা সালমা খায়েরের নতুন বই ‘মা’

এবারের বইমেলায় বেরিয়েছে কথাসাহিত্যিক সৈয়দা সালমা খায়েরের উপন্যাস ‘মা’। বইটি প্রকাশ করেছে সৃজন প্রকাশনি। পাওয়া যাবে বইমেলায় মাত্রাপ্রকাশের ৪৬৬ নাম্বার স্টলে এবং ঐতিহ্যের ২৫ নাম্বার প্যাভিলিয়নে। মা পৃথিবীর সবচাইতে আপন শব্দ। পৃথিবীর দীর্ঘতম স্নেহময় শব্দ। এই মায়ের সুখ-দুঃখ এবং জীবন-যন্ত্রণা নিয়ে লেখা ‘মা’ উপন্যাসে উঠে এসেছে একজন মায়ের করুণ কাহিনি। সন্তানের প্রতি মায়ের ত্যাগ, এই….

পিরোজপুর সাহিত্য পরিষদের অভিষেক ও দুটি কাব্যগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন

গত শনিবার (২৭ জানুয়ারি) বিকেলে পিরোজপুর সরকারি গণগ্রন্থাগারে পিরোজপুর সাহিত্য পরিষদের ২০২৪ সালের কার্যনির্বাহী পরিষদের অভিষেক ও দুইজন লেখকের প্রকাশিত বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়েছে। অনুষ্ঠানে পিরোজপুর সাহিত্য পরিষদের ২০২৪ সালের কার্যনির্বাহী সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন কবি দেলোয়ার হোসেন আলম ও কার্যনির্বাহী সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন কবি নজরুল ইসলাম এ সময় হাছিবুর রহমানের প্রথম লেখা কাব্যগ্রন্থ ‘ফিলিস্তিনের কান্না‘….

‘বাঙালি’ সাহিত্য পুরস্কার পেলেন শরাফত হোসেন

‘বাঙালি’ সাহিত্য পুরস্কার পেলেন কবি শরাফত হোসেন। শুক্রবার (২৫ নভেম্বর) জাতীয় জাদুঘরে আয়োজিত ‘বাঙালি’ সাহিত্য উৎসবে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শিল্পী হাশেম খান পুরস্কার তুলে দেন। অনুষ্ঠান উদ্বোধন করেন কথাশিল্পী হরিশংকর জলদাস। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ড. রতন সিদ্দিকী। অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. সরকার আবদুল মান্নান, কথাসাহিত্যিক রফিকুর রশীদ, কথাসাহিত্যিক….

error: Content is protected !!