Author Picture

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক পটভূমি: পর্ব-১

এ কে এম শামসুদ্দিন

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস শুধু একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার ইতিহাস নয়, একটি জনপদের মানুষের সকল প্রতিকুলতা উপরে ফেলে ধীরে ধীরে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ইতিহাস, পশ্চাদমুখি এই জনপদের আর্থসামাজিক, সংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিবর্তন ও উথ্থানের ইতিহাস। জাতীয় শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি উন্নয়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবদান সবচেয়ে বেশী। এদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক জগৎকে নিয়ন্ত্রণ করছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। ভাষা আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের গৌরবোজ্জল ভূমিকা ছিল তুলনাহীন। একারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে লিখতে গেলে অল্প কথায় লেখা সম্ভব নয়। দু’একটি পর্বে হয়তো সম্ভব হবে। আজ প্রথম পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক পটভূমি সম্পর্কে জানবো। বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে যে সকল তথ্য উপাত্ত এখানে সন্নিবেশিত করা হলো তার অধিকাংশই বিভিন্ন সূত্র যেমন বই, পুরাতন সংবাদপত্র-ম্যাগাজিন এবং ওয়েবসাইটে সহজলভ্য। আমি শুধু বিভিন্ন সূত্র হতে প্রাপ্ত তথ্যগুলো সন্নিবেশিত করেছি:

ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর স্বল্পশিক্ষিত ইংরেজ তরুণ কর্মচারীদের ভারতবর্ষের প্রশাসন চালানোর উপযোগী করে তোলার জন্য ১৮০০ সালে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রশাসনিক প্রয়োজনে এসব কর্মচারীদের এ দেশের ভাষা, আচার-ব্যবহার ও ধর্মীয় রীতিনীতি সম্পর্কে ধারণা তৈরী করে দেওয়াই ছিল কলেজ প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য। পাশাপাশি ভারতীয়দের ইংরেজি শিক্ষাগ্রহনেরও সুযোগ রাখা হয়। ইংরেজরা মনে করতেন, এ দেশের অসভ্য, অশিক্ষিত-অমার্জিত মানুষগুলোকে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান করে গড়ে তুলতে উচ্চশিক্ষার ভিত্তি স্থাপন করা প্রয়োজন। তৎকালে বাংলা, সংস্কৃত ও ফারসিতে শিক্ষিত মানুষ ছিল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। উল্লেখ্য, তখন ভারতবর্ষের রাজভাষা ছিল ফারসি। ভারতে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার সূচনা হয় উনিশ শতকের শুরু থেকেই। কিন্তু উনিশ শতকের ত্রিশের দশকে রাজভাষা ফারসির পরিবর্তে সরকারি ভাষা করা হয় ইংরেজি। তাতে ফারসি ভাষায় শিক্ষিতদের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে, বিশেষ করে শিক্ষিত মুসলমানদের। হিন্দু ধর্মালম্বীরা অবিলম্বে ইংরেজি শেখার আগ্রহ দেখায়। পরবর্তিতে ইংরেজিই উচ্চশিক্ষার একমাত্র মাধ্যম হয়ে ওঠে।

ভারতে আধুনিক ইংরেজি শিক্ষার সূচনা হয় উনিশ শতকের শুরু থেকেই। কিন্তু উনিশ শতকের ত্রিশের দশকে রাজভাষা ফারসির পরিবর্তে সরকারি ভাষা করা হয় ইংরেজি। তাতে ফারসি ভাষায় শিক্ষিতদের ভাগ্যবিপর্যয় ঘটে

১৮১৭ সালে কলকাতার ভদ্র হিন্দু ঘরের সন্তানদের ইংরেজি ও ভারতীয় ভাষাসমূহ, ইউরোপ ও এশিয়ার সাহিত্য ও বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য নিয়ে কলকাতা হিন্দু কলেজ স্থাপিত হয়। একইসাথে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরসহ বহূ হিন্দু ধর্মীয় নেতা ও সংস্কারক হিন্দু সমাজকে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে সামনে এগিয়ে নেওয়ায় অবদান রাখেন। ফলে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু সম্প্রদায়ই বেশি উপকৃত হয় এবং পশ্চিমাদের সাথে তাল মিলিয়ে অতি দ্রুত এগিয়ে যায়। অপরদিকে যোগ্য ধর্মীয় নেতা বা সংস্কারক না থাকায় নানারকম কুসংস্কার ও বিধিনিষেধের জালে জড়িয়ে বাঙালী মুসলমান সমাজ বাংলা ও ইংরেজী দুই ভাষারই চর্চায় বিরত থেকে হিন্দু প্রতিবেশীদের চেয়ে অতি দ্রুত পিছিয়ে পড়ে।

১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি ভারতের প্রথম আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অধিভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বা Affiliated University – যার অন্তর্ভুক্ত এলাকা ছিল- কলকাতাসহ পশ্চিমে পাটনা, বারানসী, এলাহাবাদ, লক্ষ্মৌ, কানপুর, বেরেলী, জয়পুর, ইন্দোর, আজমীর, আগ্রা, দিল্লি, পাতিয়ালা, লাহোর, সিমলা ও অমৃতসর, পূর্বে ঢাকা, গৌহাটি ও মিয়ানমারের রেঙ্গুন, দক্ষিণে কটক, সওগর ও নাগপুর এবং এর বাইরে শ্রীলঙ্কার কান্ডি ও কলম্বো পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। পরবর্তিতে বোম্বে ও মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে দাক্ষিণাত্য ও সুদূর দক্ষিণের অধিকাংশ অঞ্চলের দায়িত্ব এই দুটি বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহন করে। তখন সমস্ত ভারতবর্ষে এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রতিষ্ঠিত ছিল। উল্লেখ্য যে, সে সময় কোনো শিক্ষাবোর্ড ছিলনা। Entrance-পরে Matriculation (এসএসসি) পরীক্ষা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রহন করত। এব্যবস্থা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত চালু ছিল।

উচ্চশিক্ষা উঁচু আসন ও সামাজিক মর্যাদা প্রাপ্তিতে সহায়ক বুঝতে পেরে হিন্দু ছাত্ররা উচ্চশিক্ষায় ঝুঁকে পড়ে। কুড়ি শতকের শুরু থেকে মুসলমান সমাজে অতি ধীরে ধীরে উচ্চ শিক্ষার প্রসার ঘটতে থাকে। এক্ষেত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলেও মুসলমান ছাত্রদের বুদ্ধিবৃত্তিচর্চায় সহায়ক ভুমিকা পালনে সক্ষম হয়নি। কারণ মুসলমান শিক্ষার্থী- বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলার মুসলমান শিক্ষার্থীদের জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মীয় ও সামাজিক পরিবেশ অনুকূল ছিলনা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তখন হিন্দু প্রভাবিত একটি হিন্দুবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিনত হয়ে পড়েছিল। শিক্ষার বিষয়বস্তুতে হিন্দুধর্ম প্রাধান্য, বিশেষ করে শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মের ও হিন্দুসমাজের আদর্শ নিয়ে লিখিত রচনা, বিশ্ববিদ্যালয়ে হিন্দু শিক্ষকদের একাধিপত্য অর্থাৎ Facultyগুলোতে হিন্দু শিক্ষকদের সংক্ষাধিক্য, পরীক্ষাপত্রে শিক্ষার্থীদের নাম লেখার নিয়মের কারণে মুসলমান শিক্ষার্থীদের প্রতি অমুসলিম পরীক্ষকের সম্ভাব্য বৈষম্যমূলক আচরণ, State Scholarship selection এর দায়িত্ব হিন্দু শিক্ষকদের হাতেই ন্যাস্ত থাকাতে মেধাবী মুসলমান শিক্ষার্থীদের নিশ্চিত Scholarship হতে বঞ্চিত, আরবী ও ফারসির তুলনায় সংস্কৃত-প্রধান কঠিন বাংলা ব্যবহার ইত্যাদি নানা কারণে মুসলমান শিক্ষার্থীদের ভেতর ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। উল্লেখ্য ১৯১৩ সালে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলা সরকারের জনশিক্ষা পরিচালক ডব্লিউ হর্ননিল কর্তৃক গঠিত উচ্চশিক্ষায় মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার কারণ অনুসন্ধান কমিটির The Education Resolution of 1913 নামে এক প্রতিবেদনে উপরে উল্লেখিত কারণসমূহ বেড়িয়ে আসে।

১৯১৩ সালে মুসলমান শিক্ষার্থীদের প্রতি উল্লেখিত বৈষম্যমূলক আচরনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও এর শুরু হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে

১৯১৩ সালে মুসলমান শিক্ষার্থীদের প্রতি উল্লেখিত বৈষম্যমূলক আচরনের প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও এর শুরু হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে। এধরনের বৈষম্য শুধু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিন অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও পরিলক্ষিত হয়। এসব কারণসহ আরো অন্যান্য বিষয় উল্লেখপূর্বক মুসলমানদের পক্ষ থেকে পূর্ব বাংলায় অনুরূপ আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপিত হয়। ১৯০৫ সালে পূর্ব বাংলা ও আসামকে অন্তর্ভুক্ত করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন প্রদেশ গঠিত হবার পর ১৯০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত ‘মোহামেডান এডুকেশন কনফারেন্সে’র ২০তম অধিবেশনে এই দাবিটি প্রথম উচ্চারিত হয়। অধিবেশনে কনফারেন্সের জয়েন্ট সেক্রেটারি ব্যারিস্টার আফতাব আহমেদ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। ১৯০৮ সালেও ‘পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রাদেশিক মুসলিম শিক্ষা সমিতি’র দ্বিবার্ষিক অধিবেশনে সমিতির সম্পাদক টাঙ্গাইলের ধনবাড়ীর জমিদার নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী পুনরায় ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবি করেন। বিভিন্ন রিপোর্ট এবং তখনকার পত্র-পত্রিকা থেকে জানা যায়, নতুন প্রাদেশিক সরকার ১৯০৯-১৯১০ অর্থ বছরে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহন করে একটি সম্ভাব্যতা যাচাই কমিটি গঠন করেছিল।

১৯১০ সালের ৫ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ ও আসাম আইন পরিষদের সদস্য অনঙ্গমোহন নাহা ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের দাবী করেন। নাহার এই প্রস্তাবটি গৃহীত হয়নি। এর পর ১৯১১ সালের ১১ আগষ্ট পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের বিদায়ী লে: গভর্নর হেয়ারকে বিদায় এবং নতুন লে: গভর্নর স্যার চার্লস বেইলিকে স্বাগত জানাতে এক অনুষ্ঠানে নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে মুসলমান নেতারা ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করার দাবির পুনরুল্লেখ করলে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের নতুন লে: গভর্নর বেইলি ১৯১১ সালের ২৯ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় ও হাইকোর্ট স্থাপনের জন্য দিল্লি সরকারের কাছে একটি প্রস্তাব পাঠায়। নীতিগতভাবে দিল্লি সরকার ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। উল্লেখ্য, পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের এই দুই লে: গভর্নরের নামেই বর্তমান ঢাকার মন্ত্রী পাড়ার বেইলি রোড ও হেয়ার রোড নামকরণ করা হয়েছিল।

বাঙ্গালী হিন্দু জমিদার, ব্যবসায়ী ও আইনজীবিরা নতুন প্রদেশকে মেনে নিতে পারেনি। তাঁরা তীব্র প্রতিবাদ জানান

১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর নতুন প্রদেশ যাত্রার শুরু থেকেই আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক স্বার্থে বাঙ্গালী হিন্দু জমিদার, ব্যবসায়ী ও আইনজীবিরা নতুন প্রদেশকে মেনে নিতে পারেনি। তাঁরা তীব্র প্রতিবাদ জানান। শুধু প্রতিবাদ নয়, তাঁরা এর বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেন। একপর্যায়ে এ আন্দোলন সরকারবিরোধী জাতীয়দাবাদী আন্দোলনে রূপ নেয়। নতুন প্রদেশ গঠনের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার শ্রমজীবী ও নিম্নমধ্যবিত্ত হিন্দুরা স্বাগত জানান এবং যখন নতুন প্রদেশ বাতিল হলো, পূর্ব বাংলার হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ সকলেই হতাশ হন। কারণ নতুন প্রদেশ গঠনের পর সরকার শিক্ষা ক্ষেত্রে বরাদ্ধ বাড়ায় এবং নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। এতে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলেই উপকৃত হয়, বিশেষ করে আগে থেকে এগিয়ে থাকা পূর্ব বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ উপকৃত হয়েছে বেশী।

এই বক্তব্যের স্বপক্ষে ১০০ বছর পর ২০০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি কলকাতার ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত দীনেশচন্দ্র সিংহের একটি প্রতিবেদনে পাওয়া যায়: ‘নতুন প্রদেশ গঠিত হবার পর শিক্ষাক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশে প্রভূত উন্নতি সাধন হতে দেখা যায়। পূর্ববঙ্গ যে লেখাপড়ায় সারাদেশের মধ্যে অগ্রগামী ছিল, তার মূলে ছিল তথাকার সংখ্যালঘু হিন্দুদের অবদান’।

১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর বঙ্গভঙ্গ বাতিল হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ ভাইসরয় লর্ড হার্ডিন্জকে একটি চিঠি দেন। দুইদিন পর ২০ ডিসেম্বর তিনি তাঁর বেদনা ও হতাশা প্রকাশ করে আরও একটি চিঠি দেন। চিঠিতে তিনি পূর্ব বাংলার পিছিয়ে থাকা অবহেলিত মুসলমানদের শিক্ষার জন্য বিশেষ সংস্কারের প্রস্তাব করেন। নবাব সলিমুল্লাহর চিঠিকে ভাইসরয় খুবই গুরুত্ব দেন এবং মুসলমান ছাত্রদের জন্য ছাত্রাবাসসহ ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সরকারের উদ্যোগ গ্রহনে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য তাঁর শিক্ষা পরিষদের সদস্য স্যার এইচ বাটলারের মতামত জানাতে বলেন। অত:পর সরকার নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেন যে ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা যৌক্তিক ও সময়ের দাবী এবং এ জন্য সরকারকে আন্তরিকভাবেই ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।

২৯ জানুয়ারি ১৯১২ সালে লর্ড হার্ডিন্জ ঢাকায় সফরে এলে নবাব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে একটি মুসলমান প্রতিনিধিদল ৩১ জানুয়ারি তাঁর সাথে দেখা করেন। প্রতিনিধি দলে ছিলেন নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ, নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী এবং এ.কে ফজলুল হক। এর দুদিন পর ২ ফেব্রুয়ারি এক সরকারি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেওয়া হয়। ঘোষণার পর পর কলকাতার তথাকথিত হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে বিরোধীতা শুরু হয়। তাঁরা শঙ্কিত হন এইভেবে যে, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থহানি ঘটবে। পূর্ববঙ্গের উঠতি প্রজন্মের ওপর থেকে তাঁদের প্রভাব কমে যাবে। ঢাকায় উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা হলে এখানকার তরুণেরা আর কলকাতায় পড়তে যাবেনা, তাতে কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ও কমে যাবে। ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফি থেকে যে আয় হতো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সে আয়ও কমে যাবে, কারণ পূর্ববঙ্গের ছাত্রদের পরীক্ষা গ্রহনের দায়িত্ব পাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফি থেকে যে আয় হতো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে সে আয়ও কমে যাবে, কারণ পূর্ববঙ্গের ছাত্রদের পরীক্ষা গ্রহনের দায়িত্ব পাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষিত মুসলমান বেরিয়ে এলে এখানকার শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তের স্বার্থে ব্যাঘাত ঘটবে। পদস্থ সরকারী কর্মকর্তা ও আইনজীবী প্রভৃতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই তৈরী করবে। ‘দেশ’ পত্রিকায় দীনেশচন্দ্র সিংহের প্রতিবেদনেও তারই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়: ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিন হাইস্কুলগুলির দুই-তৃতীয়াংশই ছিল পূর্ববঙ্গে। তারাই ছাত্রদের ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষার ফি থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচের সিংহভাগ জোগাত। তাই নতুন প্রদেশের এলাকাধীন স্কুল ও কলেজগুলিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পূর্ববঙ্গে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় গড়া হলে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় দিব্যি ভাতে মারা যাবে’।

মুসলমান প্রতিনিধিদলের সাক্ষাতের পর ১৯১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মধ্যপন্থি কংগ্রেস সদস্য ও বিশিষ্ঠ আইনজীবী রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি হিন্দু বুদ্ধিজীবী প্রতিনিধিদল লর্ড হার্ডিন্জের সাথে সাক্ষাত করে বোঝাবার আপ্রান চেষ্টা করেন যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে তা ‘বাঙালি জাতি’র কোনো উপকারে আসবে না। যে উদ্দেশ্যে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নতুন প্রদেশ বাতিল করা হলো, তা অর্থহীন হয়ে যাবে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় ‘মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠিত হলে তা হবে একধরনের ‘অভ্যন্তরীণ বঙ্গ বিভাগ’। লর্ড হার্ডিন্জ তাঁদের আশ্বস্ত করেন এই বলে যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে একটি সম্পূর্ণ অসম্প্রদায়িক বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে সকল ধর্মের শিক্ষার্থীরা শিক্ষার সমান সুযোগ পাবে।

হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা আশ্বস্ত তো হলেনই না বরং অসন্তোষ্ট চিত্তে ফিরে গেলেন। তখন সবচেয়ে ন্যক্কারজনক কাজ করেছিলেন ঢাকার প্রভাবশালী কংগ্রেস নেতারা। তাঁরা ঢাকার প্রায় দুশত বিশিষ্ট হিন্দুদের স্বাক্ষরসংবলিত একটি স্মারকপত্র ভাইসরয়ের কাছে পাঠান, তাতে তাঁরা ঢাকার অধিবাসি হয়েও তাঁদের অভিমত দেন যে পূর্ব বাংলায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রয়োজন নেই। তাঁরা বিকল্প প্রস্তাব দিয়ে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে সরকার এখানে একটি কারিগরি বিদ্যালয় অথবা প্যারা-মেডিক্যাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে পারে। যাদের সঙ্গতি আছে এবং উচ্চশিক্ষা গ্রহনে আগ্রহী তারা তো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে লেখাপড়া করতে পারবে। এ অঞ্চলে কৃষকের সন্তানই বেশী, লাখ টাকা খরচ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অপচয় না করে এখানে বরং একটি কৃষি বিদ্যালয় করলেই ভাল হবে। কৃষিকাজ শিখলে কৃষকের সন্তানরাই উপকৃত হবে। কিন্তু সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্তে অটল থাকেন।

ঢাকার প্রায় দুশত বিশিষ্ট হিন্দুদের স্বাক্ষরসংবলিত একটি স্মারকপত্র ভাইসরয়ের কাছে পাঠান, তাতে তাঁরা ঢাকার অধিবাসি হয়েও তাঁদের অভিমত দেন যে পূর্ব বাংলায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রয়োজন নেই

এ প্রসঙ্গে আরো একটি উদাহরণ উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করি, তা হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র ও পরে বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক আশুতোষ ভট্টাচার্যের উক্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির আমন্ত্রণে কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে তাঁর দীর্ঘ স্মৃতিবিজারিত প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাকালে হিন্দু সম্প্রদায়ের তীব্র বিরোধিতা সম্পর্কে বলেন, ‘তাঁরা সেদিন সম্প্রদায়ের স্বার্থে নয়, ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থ থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার যে বিরোধিতা করেছিলেন, তা ছিল মারাত্মক ভুল’। তাঁর নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি আরো বলেন, ‘হিন্দু বুদ্ধিজীবীগণ নোংরামির একটি খারাপ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, ধর্মীয় ও জাতিগত বিদ্বেষের বিষয়টিও তাঁরা সেদিন টেনে এনেছিলেন’। আশুতোষ বলেন, ‘কলকাতার নেতারা বলে বেড়াতেন এই ‘মক্কা’, ‘ফাক্কা’, ‘ঢাক্কা’ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কারসাজি হলো তিন ইহুদির। এরা হলেন উপাচার্য হার্টগ, গভর্নর জেনারেল লর্ড রিডিং এবং সরকারের সচিব ই মন্টেগু। এই বিশ্ববিদ্যালয় টিকবে না। এইভাবে ইহূদি প্রসঙ্গ টেনে এনে মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা থেকে সরে আসার ব্যাপারে মুসলমানদের ঐক্যে ফাটল ধরাবার চেষ্টা করে। উল্লেখ্য, এঁদের তিনজনের সবাই যে ইহূদি ছিলেন, তার কোনো প্রমান পাওয়া যায়নি”।

এত বাঁধা বিপত্তির পরও সরকার ছিল অনড়। অতএব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ এগিয়ে নেওয়ার জন্য ১৯১২ সালের ২৭ মে রবার্ট নাথানকে সভাপতি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ১৩ সদস্যের কমিটি গঠিত হয়। ছয় মাসের মধ্যে এই কমিটি একটি সুচিন্তিত পরিকল্পনা সরকারের কাছে প্রতিবেদন আকারে পেশ করে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, সরকার কর্তৃক গঠিত The Education Resolution of 1913 প্রকাশ করার সময় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার ব্যাপারে একটি কমিশন গঠনের পরিকল্পনা করে। এছাড়া Commission on London University নামে আরো একটি কমিশন গঠিত হয়েছিল কিন্তু আরো অনেক কারণসহ প্রথম মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় এই কমিশনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।

যাহোক, যুদ্ধ শেষ হলে ১৯১৭ সালে সরকার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজ উপাচার্য মাইকেল স্যাডলারের নেতৃত্বে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন গঠন করে। সতেরো মাস অক্লান্ত পরিশ্রম করে কমিশনের সদস্যরা The Dacca University Act, 1920 নামে তেরো খন্ডে তাঁদের প্রতিবেদন জমা দেন। অত:পর Indian Legislative Council এর অনুমোদনের পর ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ গভর্নর জেনারেল এই আইনে স্বাক্ষর দেন। এ আইনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে তৎকালীন বাংলার গভর্নর লর্ড লিটনের একটি মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য: A splendid Imperial compensation. নতুন প্রদেশ বাতিল করায় পূর্ব বাংলার মুসলমানরা যে ক্ষতিগ্রস্ত ও ক্ষুব্ধ হয়েছে, তার প্রতিকারস্বরূপ বৃটিশ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়; অর্থাৎ বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আরো পড়তে পারেন

একাত্তরের গণহত্যা প্রতিহত করা কি সম্ভব ছিল?

২৫ মার্চ কালরাতে বাঙালি জাতির স্বাধিকারের দাবিকে চিরতরে মুছে দিতে পাকিস্তানি নরঘাতকেরা যে নৃশংস হত্যাকান্ড চালিয়েছিল, তা বিশ্ব ইতিহাসে চিরকাল কলঙ্কময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ওই এক রাতেই শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই ৭ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। গ্রেফতার করা হয় প্রায় তিন হাজার। এর আগে ওই দিন সন্ধ্যায়, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সমঝোতা আলোচনা একতরফাভাবে….

ভাষা আন্দোলনে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনা

আগের পর্বে পড়ুন— চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল) ভাষা আন্দোলন পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদ ও একটি সার্থক গণআন্দোলন। এই গণআন্দোলনের মূল চেতনা বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হলো দেশপ্রেম থেকে জাত সেই অনুভূতি, যার একটি রাজনৈতিক প্রকাশ রয়েছে। আর, বাঙালি জাতিসত্তাবোধের প্রথম রাজনৈতিক প্রকাশ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের ফলে দুই হাজার মাইল দূরত্বের….

চূড়ান্ত পর্যায় (১৯৫৩-১৯৫৬ সাল)

আগের পর্বে পড়ুন— বায়ান্নর ঘটনা প্রবাহ একুশের আবেগ সংহত থাকে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দেও। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আতাউর রহমান খান এক বিবৃতিতে ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেন। আওয়ামি লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানও ২১ শে ফেব্রুয়ারিকে শহিদ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির সদস্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র….

error: Content is protected !!