[ চট্টগ্রামে জেলে বসেই বন্দি জীবনের কাহিনী নিয়ে লিখেছিলেন আরেক দুনিয়া থেকে নামক রোজনামচাটি। লেখাটি গোপনে জেল থেকে পাচার হয়ে কলকাতা থেকে প্রকাশিত নতুন সাহিত্যের চৈত্র ১৩৫৭ বঙ্গাব্দ সংখ্যায় ছাপা হয়। লেখাটি নিয়ে চারদিকে সাড়া পড়েছিল। কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হয়ে পত্রিকার সম্পাদককে চিঠি লিখে এই নতুন প্রতিভার আগমনকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। নিরাপত্তা বন্দি বলেই স্বনামে লেখা ছাপানোর অধিকার তার ছিল না। আরেক দুনিয়া থেকে ছাপা হয়েছিল ‘জামিল হোসেন’ ছন্দনামে। ]
পূর্ব বাংলার সবচেয়ে দক্ষিণের শহরটিতে কোর্ট রোড নামে একটি রাস্তা আছে। এই রাস্তা ধরে এগিয়ে গেলে বাঁ ধারে চোখে পড়বে বিরাট লাল রংয়ের একটি প্রাসাদ। কোনোকালে দালানটি পর্তুগিজ দস্যুদের মালখানা ছিল। তার শক্ত গাঁথুনিতে ও যুগের ছাপ পরিস্ফুট। যেমন পরিস্ফুট তার দেয়ালে অত্যাচার আর লুটের চিহ্ন। এককালে এটা ছিল জুলুমবাজির আড্ডা, আজকে এটা বিচারালয়ে পরিণত হয়েছে। এককালে যেখানে রাখা হতো লুটের আশরফি আজকে সেখানে বিচারক বসেন ধ্যানগম্ভীর মূর্তিতে। বিশাল দালানটা পাহাড়ের ওপর থেকে শকুনির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে শহরের দিকে। কোথায় কে পকেট কাটল তা এর চোখকে ফাঁকি দেয়ার জো নেই। যত রাজ্যের পাপী, তাপী, ভণ্ড জোচ্চোর সবাইকে আসতে হবে এখানে। আসতে হবে রাজনৈতিক অপরাধীদেরও।
বিচারালয়ের সামনেই আর একটি পাহাড়। তার ওপরে রয়েছে সরকারের ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের (আই-বি) কার্যালয়। এককালে মূল ঘর ছিল এটা। এ পাহাড়ের গায়েই আর একটি উঁচু টিবির ওপর রয়েছে দণ্ডাগার-কয়েদখানা। কেউ বলে জেলখানা। এককালে এখানে বাঘ ভালুক থাকত-বন্য পশুপক্ষী বিচরণ করত নির্ভয়ে। কথিত আছে যে, এক শাহ সাহেব থাকতেন এখানে। নির্জনে পরমার্থিক সাধনার সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা ছিল এটি।
আজকে কিন্তু এর ভোলই গেছে বদলে। সমস্ত পাহাড়টার মাটি কেটে সমতল করা হয়েছে। ঠিক যেন একটা বিশাল গোলাকার বেদি। চার ধারে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের ঠিক পাশ দিয়ে সদর সড়ক। সড়ক দিয়ে ঢুকে এগিয়ে গেলে দেখতে পাবেন দু-পাশের উঁচু দেয়াল এসে মিশেছে একটি ছোট ঘরের দেয়ালে। সেখানে সাইনবোর্ড ঝুলছে ‘… ডিস্ট্রিক্ট জেল।’ ওপরে চাঁদ-তারকাখচিত সবুজ পতাকাখানি পতপত করছে। সামনে রাইফেলধারী চারজন সান্ত্রী। লোহার গেটটা সব সময়েই বন্ধ থাকে। খোলা হয় কেবল নিন্ত্রমণ ও অন্তর্ভুক্তির বেলায়।
লোহার গেটটার সামনে আদালতের প্রিজন ভ্যান এসে দাঁড়াল। বন্দিরা নেমে এলো সারি সারি। লোহার গেট খুলে গেল। ছোট একটা প্যাসেজ। এখানে ফাইল অর্ডারে বসিয়ে দেয়া হল আগন্তুকদের। দুটো সারি। নতুন আর পুরনো।
‘আমদানি কত?’ গেটের সান্ত্রী হাঁকল। পঁয়তাল্লিশ, পঞ্চাশ কি ষাট এমনি একটা কিছু হবে। নতুন আমদানি হল তারা, যারা সদ্য গ্রেফতার হয়েছে এবং বিচারালয় পাঠিয়ে দিয়েছে জিম্মেদারিতে (কাস্টডি)। পুরনোরা জেলেই যাবে। তারা পনেরো দিন অন্তর কোর্টে যাবে বিচারের দিন অনুসারে। শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীও আছে এর মধ্যে, যাদের আরও দু’একটা কেস আছে। জামিন পায়নি যারা তারাই আছে। এরা হাজতি। শাস্তিপ্রাপ্তদের বলা হবে সাজাওয়ালা। ভালো বাংলায় কয়েদি।
যাইহোক, আপিসের প্যাসেজে এক দুই করে মাথা গুনতি হবে- লিস্টিবদ্ধ করা হবে সবার নাম। তারপর পুরনোরা ভেতরে চলে যাবে। নতুন আমদানিরা থাকবে। কারণ তাদের মাথা গুনতি ছাড়াও আরও কিছু করণীয় রয়েছে। নতুনদের হাতের, পায়ের, দেহের দাগ, বা বিশেষ ক্ষতচিহ্ন আছে কিনা দেখা হবে, যাতে শনাক্ত করার সুবিধা হয়। বিশেষ করে জেল-পালানো আসামি ধরার বেলা এসব খুবই কাজ দেয়।
প্যাসেজের দেয়ালে রকমারি অলংকার ঝুলছে। এগুলোকে জেলের ভাষায় বলা হবে বেড়ি। বেড়ি রয়েছে বহু রকমের। ডাণ্ডা বেড়ি, শিকল বেড়ি তার মধ্যে প্রধান। ভারী লোহার তৈরি এসব বেড়ি। এ হচ্ছে উপরি সাজা। জেলের মধ্যে নিয়মভঙ্গকারীদের প্রতি এগুলো প্রযোজ্য। অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে নির্ণীত হবে কে কোন বেড়ি পরবে। নবাগতদের প্রাণে এগুলো স্বভাবতই ভয়ের উদ্রেক করে। কিন্তু পরে সে ভয় আর থাকে না তেমন। সাধারণত সন্ধ্যার সময়েই আমদানি আসে। আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্ম সারতে সারতে কয়েক ঘণ্টা কেটে যাবে। তারপর পশ্চিমা সাহেবদের সঙ্গে পরিচয় লাভের সুযোগ ঘটবে।
‘এই শালা লোক উঠো’। অনভ্যস্তরা চমকে যাবেন, কিন্তু হুকুম তামিল করবেন ঠিকই।
এককালে এটা ছিল জুলুমবাজির আড্ডা, আজকে এটা বিচারালয়ে পরিণত হয়েছে। এককালে যেখানে রাখা হতো লুটের আশরফি আজকে সেখানে বিচারক বসেন ধ্যানগম্ভীর মূর্তিতে। বিশাল দালানটা পাহাড়ের ওপর থেকে শকুনির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে শহরের দিকে। কোথায় কে পকেট কাটল তা এর চোখকে ফাঁকি দেয়ার জো নেই। যত রাজ্যের পাপী, তাপী, ভণ্ড জোচ্চোর সবাইকে আসতে হবে এখানে। আসতে হবে রাজনৈতিক অপরাধীদেরও।
এতক্ষণ পর্যন্ত কেবল কয়েদখানার আপিস ঘরটার কথাই বলেছি কিন্তু আপিস ঘরটি কয়েদখানা নয়। ওটা বাইরের দুনিয়ার অন্তর্গত। আপিসের যারা প্রাণী তারা বাইরের দুনিয়ার মানুষ। ভেতরের সঙ্গে সম্পর্ক নেই তাদের।
আপিস ঘরের প্যাসেজটুকু পার হয়ে দ্বিতীয় গেট অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে হবে আপনি আলাদা দুনিয়ায় পা দিয়েছেন। সে আরেক পৃথিবী। সাধারণত এখানে যারা আসে তারাও দ্বিতীয় দুয়ার অতিক্রান্তির অর্থ তখনি ধরতে পারে না। পাবে বহু পরে।
আগেই বলেছি সন্ধ্যার পর নবাগতরা আসে। দ্বিতীয় গেট পার হতে রাত হয়ে যাবে। আদালত আপনাকে খাইয়ে দিয়েছে ছ-আনা পয়সায়। অতএব রাতের খাবারের জন্য ভাবনা নেই। দ্বিতীয় গেট অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের মধ্যেও পরিষ্কার দেখা যাবে সারি সারি কয়েকটি দালান। এক নং, দুই নং, তিন নং, চার নং, পাঁচ নং ওয়ার্ড। হ্যাঁ, এটি হচ্ছে নবাগতদের জায়গা। দু নম্বরের ঠিক পাশেই এক বিশাল চাঁপা ফুলের গাছ। গোড়াটা তার ইট দিয়ে বাঁধানো। সারিবদ্ধ বন্দিরা এখানে এলেই থমকে দাঁড়াবে। এটা প্রসিদ্ধ চাঁপাতলা। সান্ত্রীদের প্রধান ব্যক্তি বড় জমাদার এক মুখ দাড়ি, গাট্টা গোট্টা চেহারা। লণ্ঠনটা তুলে সবার মুখে এক এক করে আলো ফেলে।
খক খক করে কাশছিল এক লোক। জমাদার ধাক্কা দিয়ে বলল, পাঁচ নম্বর। সরে দাঁড়াল সে। বাচ্চা আর মহিলা ছাড়া আর সবাই যাবে পাঁচ নম্বরে। মহিলারা যাবেন জানানা ফাটকে। বাচ্চারা যাবে ছোকরা ফাইলে। জমাদার ইচ্ছে করলে ছোকরাদের ছোকরা ফাইলে না দিয়ে দু নম্বর অথবা তিন নম্বরেও দিতে পারে।
রাত নটা দশটার সময় লণ্ঠনধারী প্রহরীর পিছু পিছু ছেলেটি যখন দু নম্বর অথবা পাঁচ নম্বরে গিয়ে ঢুকবে, তখন ও জানতেও পারবে না কোথায় চলেছে। সুন্দর ছেলে হলে তো কথাই নেই। একের পর এক ক্রিমিনালরা চালাবে যৌন অত্যাচার। পাহারা প্রভৃতি দাগি আসামিদের সঙ্গে যোগাযোগ ও বন্দোবস্ত থাকে বড় জমাদারের। হয়তো পরদিন জমাদার শুধোবেন, কেমন চলল রাত্রে। পাহারা হাসবে। আর ট্যাঁক থেকে বের করে দেবে টাকা।
এই হল কয়েদখানার প্রথম দিন সম্পর্কে।
রাতে শোয়ার জন্য তিনটি কম্বল। একটি বিছানার জন্য, একটি বালিশ হিসেবে ব্যবহারের জন্য আর একটি গায়ে দেয়ার জন্য। কোনো ওয়ার্ডে হয়তো লেখা আছে ‘১৬ জন থাকিবেন’। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে পঞ্চাশ ষাটজনেরও বেশি লোক থাকে। একজনের ওপর অন্যজনকে শুতে হয়।
সকালে একখানি থালা আসবে, আর আসবে একটি বাটি। কয়েদিরা তাই ছড়া তৈরি করেছে : ‘থালা-বাটি-কম্বল, কয়েদখানার সম্বল’। তাতে প্রথম আগমনের সময়ে খেতে হবে ‘গাইল’ অর্থাৎ গালাগালি। সকালে খেতে বসে পাওয়া যাবে প্রচুর জলো ‘ডাইল’ অর্থাৎ ডাল। আর উঠতে বসতে দিতে হবে সারি-ফাইল। তাই আঞ্চলিক ভাষায় কয়েদিরা ছড়া কেটেছে :
গাইল, ডাইল ফাইল
কয়েদখানার ভাইল।।
‘ভাইল মানে ব্যবস্থা। শুনে চমৎকার লাগে। এমন চমৎকার সংক্ষিপ্তকরণ কি আর হতে পারে? শুধু সংক্ষিপ্তকরণই তো নয়। বলা যেতে পারে সমস্ত জেল ব্যবস্থাটাকে তিনটি কথার মধ্যে প্রকাশ করা।
হোক কয়েদি তারা। তবু তারা সাধারণ। সাধারণ মানুষের বিচার-বুদ্ধি আর চিন্তাধারা সব সময়েই বাস্তব ও প্রকৃত। তাই ছোট এই ছড়াটার মধ্যে পরিচয় পাওয়া যাবে সমস্ত জেল-ব্যবস্থার তিনটি বিশেষ দিক সম্পর্কে।
পাঁচ নম্বরের অধিবাসীদের সংক্ষেপে বলা হয় হাজতি। ভালো বাংলায় বিচারাধীন বন্দি। বিচারালয়ে কেস আছে। দিন পড়বে ঠিক পনেরো দিন পর। যাদের কোর্ট আছে তারা কোর্টে যাবে। কোর্টেও রয়েছে কোর্ট হাজত। পাশে পাঁচ হাত এবং লম্বায় পঁচিশ হাত একটা কুঠরির মধ্যে এক সঙ্গে ভরার পরে পশ্চিমা হাবিলদার যখন লাঠি ঘোরাবে তখন অনিবার্যভাবে মনে পড়ে যাবে অন্ধকূপ হত্যার কাহিনী।
সেদিন দেশবাসীর সামনে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য ইংরেজরা অন্ধকূপ হত্যার কাহিনী রচনা করেছিল; কিন্তু তাদেরই সৃষ্ট বাংলাদেশের কারায় কারায় অসংখ্য অন্ধকূপগুলোর কথা কেউ আর লেখেনি। যাই হোক সারাদিন নিঃশ্বাস রুদ্ধ অবস্থায় কাটানোর পর হাজতিরা ফিরে আসবে আবার জেলে। আবার বুক বেঁধে অপেক্ষা করতে হবে আরও পনেরো দিন।
পাঁচ নম্বরের আলি আহমদকে দেখলেই মনে হবে নেহাৎ বোকা বোকা লোক। কিন্তু জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে, সে তিন বছর ধরে পকেট কাটছে।
ও পকেটমারার কাজটা শেষ পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। জেল খাটার ভয় নেই কারণ বাইরে না খেয়ে মরার চেয়ে, ভেতরে খেয়ে মরা ঢের ভালো। কিন্তু দিনের পর দিন যতই যেতে থাকে তিরিক্ষি হয়ে ওঠে মন। কাঁহাতক আর সত্য করা যায়। মা-বাপ তুলে গাল দেয় আলি আহমদ। গাল শুনে বোঝা যাবে না ওটা কাকে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বিচারক থেকে শুরু করে, সরকার, রাষ্ট্র, জেল কর্তৃপক্ষ কারও মায়ের সম্মানহানি করতে সে ছাড়বে না।
জেলের বাইরে সবাই সাধু। জজের সামনে কেউ নিজেকে অপরাধী বলতে চায় না। এখানে কিন্তু সবাই চোর, সবাই অপরাধী; নিরপরাধ যদি কেউ থাকে তবুও সে নিরপরাধ বলে বেড়াতে পারে না।
আলি আহমদ বলে, ও আজ পনেরো মাস যাবৎ হাজত খাটছে। বিচার শেষ হয়নি। শেষ কেন ধরাই হয়নি তার কেস। সে ঠিক জানে হয়তো দু-বছর তাকে কাটাতে হবে বিচারাধীন জীবন। তারপর একদিন হয়তো ওর কেস শেষ হবে। শান্তি হবে হয়তো দু-মাস কি তিন মাসের।
ও পকেটমারার কাজটা শেষ পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। জেল খাটার ভয় নেই কারণ বাইরে না খেয়ে মরার চেয়ে, ভেতরে খেয়ে মরা ঢের ভালো। কিন্তু দিনের পর দিন যতই যেতে থাকে তিরিক্ষি হয়ে ওঠে মন। কাঁহাতক আর সত্য করা যায়। মা-বাপ তুলে গাল দেয় আলি আহমদ। গাল শুনে বোঝা যাবে না ওটা কাকে দেয়া হচ্ছে। কিন্তু বিচারক থেকে শুরু করে, সরকার, রাষ্ট্র, জেল কর্তৃপক্ষ কারও মায়ের সম্মানহানি করতে সে ছাড়বে না।
সকাল বেলায় ‘লপসি’ আসবে। আধাসিদ্ধ কতগুলো চাল। সপ্তাহে দুদিন এক রত্তি গুড় পাওয়া যাবে লপসির সঙ্গে। অন্যান্য দিন লবণ। তিন মাস যেতে আর সহ্য হবে না। হজম হবে না। শতকরা ৮০ ভাগ লোক ভুগবে পেটের ব্যারামে।
স্নানের জন্য বরাদ্দ আছে সের তিনেক জল। তিন বাটি জলে স্নান সারতে হবে। প্রতিদিন স্নানের জল পাওয়া সম্ভব নয়। তিন মাস স্নান হয়নি এও বহুবার ঘটেছে কয়েদিদের জীবনে। খাবার জলের অভাব তার চেয়েও বেশি। রাত্রে তেষ্টায় গলা ফেটে গেলেও জল পাওয়া যাবে না এক ফোঁটাও।
হাজতিদের খাদ্য এক বেলায় চার ছটাক আধসিদ্ধ চাল। সঙ্গে কিছু তরকারি, কিছু ডাল মিশানো জল আর হপ্তায় একদিন মাছ। রান্না করা তরকারিতে ঘাস পাওয়া যাবে প্রায়ই। বোতাম পাওয়া গেলেও আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই।
কর্তৃপক্ষ কাঠা ঠিক করে দিয়েছে। এক পোর কাঠায় এক এক কাঠা ভাত দেয়া হবে হাজতিদের পাতে। কিন্তু একটু লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে ভেতর থেকে দুমড়ে আনা হয়েছে। বিতরণকারীরা এভাবে ভাত সঞ্চয় করে প্রচুর। গোপনে বিক্রি হয় এগুলো বিড়ির জন্য। চার ছটাকের জায়গায় আড়াই ছটাকের বেশি খুব কম সময়েই পাওয়া যায়। তরকারিও তাই। মাছ? এক ছটাক পাওয়ার কথা; কিন্তু হরিতকির দানার মতো মাছের টুকরোটি দেখে কেউ বলবে না এক কাচ্চার বেশি হবে। বাকি মাছ যায় কোথায় প্রশ্ন উঠতে পারে। কিছু যায় পশ্চিমা জমাদার সাহেবের বাড়ি, বাকিটা নিয়ে ব্যবসা। বিতরণকারীরা জমাদারের নিজের লোক। অতএব অসুবিধা খুব হয় না। জেলের সুপার থেকে শুরু করে সবাই জানেন এসব। কিন্তু জমাদার তার রাজ্যে সার্বভৌম। প্রত্যেক অফিসার ও প্রত্যেক ওয়ার্ডারের নিজের নিজের রাজস্ব আছে।
সেখানে প্রত্যেকেই নিজে নিজে সার্বভৌম। বিচার বিভাগ, বিচারের ক্ষেত্রে। শাসন বিভাগ, শাসনের ক্ষেত্রে। আর দণ্ড দানের বিভাগ, দণ্ড দানের ক্ষেত্রে। খেয়ে পেট ভরে না, আধপেটা খেতে খেতে হাজতিদের ওজন কমে। ওজন কমলে হসপিটাল ডায়েট, খাতায় পত্রে একটু ভালো বটে, কিন্তু আসলে দাঁড়ায় একই। গুণের দিক থেকে ও পরিমাণের দিক থেকে।
এর বিরুদ্ধে বলার সাহস নেই কারও। আলি আহমদ গালাগাল দেয়। সেই ভালো আর কেউ একতার মূল্য বোঝে না। একলা প্রতিবাদ করে লাভ নেই। কারণ চাঁপাতলা রয়েছে। সেখানে বড় জমাদার সমাসীন। ডাণ্ডা মেরে ঠাণ্ডা করার ব্যবস্থা আছে। জেল কোর্ডে দৈহিক শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা নেই। কিন্তু ‘ঠেলার নাম বাবাজি’। আর ‘চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী’। ডাণ্ডা না মারলে ঠাণ্ডা রাখা যাবে কী করে?
বছরের পর বছর এমনি চলতে থাকে। অধৈর্য হয়ে ওঠে মানুষ। হাজতিদের কে একজন গান বেঁধেছে :
‘আমার কপালেতে নাইরে সুখ
অ ভাই দিলের মাঝে নাইরে সুখ
শরীরে না সহ্য ন যার অ ভাই
জেবলখানার দুঃখ
জেবলখানার চাইর দিকে
পোড়ানি দেবাল
এদের মাঝে রাইখ্যে বাঁধিরে ভাই
মনুষ্যেল ছাওয়াল
খানা-পিনা-পানির জ্বালায় রে অ
ভাই কারে বুঝাই উম
কপালের দুঃখ।
শরীরে না সহ্য ন-যায় অ ভাই
জেবলখানার দুঃখ
ইংরেজ আমলেরে ভাই, পরাধীন
ছিলাম, একথা শুনি,
এ বেল চান বাঁওটা টুইক্যা মাথায়
দিয়া রে ভাই হইলাম
পাকিস্তানি।
আঁরার ধন-জন-জান দিলাম রে
অ ভাই,
তবু গেল না কপালের দুঃখ
শরীরে সা স্য ন-যায়…।
আঁরার ছেলে পিলে উয়াসে
মরের;
তারা কতই করের ফন্দি
বিনা দোষে হইলাম রে ভাই
জেবলখানার বন্দি…।’
চলবে…