পড়ুন— নীলুর প্রেমের দিন রাত্রি (পর্ব: ৩)
৫.
— ময়ী, দোষ আমারও ছিল। আমি একটু সাহসী হতে পারতাম। কি হতো? কত দিন আর আটকে রাখতো? আমিও তো সাহস করে তোমাকে বলতে পারতাম চলো পালিয়ে যাই।
ময়ী হো হো করে হেসে উঠলো। ‘তা পারতে। কিন্তু তা হলে এতো নামি সার্জন হতে পারতে?’
— না হতাম। কি হতো, তুমি তো থাকতে।
— কি জানি, নিয়তি এইভাবেই লেখা ছিলো, তোমার আর আমার।
— জানো ময়ী, অপেক্ষা করেছি সেটা যেমন সত্যি, তেমনি এটাও সত্যি একসময় রাগে অভিমানে মন থেকে তোমার অনিষ্ট চাইতাম। চাইতাম তুমি এলোমেলো হয়ে যাও। কিন্তু যখন জানলাম তোমার ডিভোর্স হয়েছে, তুমি একলা দারুণ কষ্ট করছো, তখন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। মনে মনে বলেছিলাম ময়ীর এমন হোক আমি চাইনি।
— কবে জেনেছিলে?
— এইতো কিছুদিন আগে। বছর খানেক হবে।
— কার কাছে?
— তোমার মার কাছেই। উনি এসেছিলেন আমার চেম্বারে। অনুশোচনায় এতোটুকু হয়েছিলেন। উনিই বলেছিলেন, কিভাবে তোমাকে বিয়ে দেয়া হয়েছিলো। তারপর তোমার স্ট্রাগল, ডিভোর্স, এইসব।
— মা তার স্ট্যাটাস, ইগো এইসব রক্ষা করে জিতে গিয়ছিলেন। তুমি অভিমান করে ছিলে। খোঁজ নাওনি আর। আমাকে দেখে তুমি বোঝোনি কি ঝড় যাচ্ছে আমার ওপর দিয়ে। তাই অশ্রুর কাছেই আত্মসমর্পণ করেছিলাম। বাদ দাও ,পুরোনো কথা। আমার ইমেজ তোমার কাছে খারাপ হয়েই থাকুক। আমার একটা নষ্ট জীবন নষ্ট হয়েই থাক। তুমি বিয়ে করো নীলু। বয়স এখনো তেমন হয়নি। বাইরে এই বয়সে জীবন শুরু করে। ইউ আর নাউ ভেরি এলিজেবল ব্যাচেলর। টাকা আছে। নাম আছে। দেখলে বোঝাই যায় না বয়স চল্লিশ পার হয়েছে। বিয়ে করবে বলে দেখো, অনেক মেয়েই রাজি হবে।
— আমাকে বিশ বছর আগের ময়ী এনে দাও।
— সেই ময়ী হেরে গিয়েছিল বিশ বছর আগেই। এখন হারিয়ে গেছে সময়ের কাছে। নিয়তির কাছে। সত্যিই নীলু তুমি বিয়ে করো। বয়স এমন কিছু হয়নি। এম্নিতেই আমি যন্ত্রণায় আছি। বাকি জীবন তোমার একাকীত্ব আমাকে আরো যন্ত্রণা দিবে।
— করবো, একজন ভালো কারো দেখা পেলেই করবো।
সেই ময়ী হেরে গিয়েছিল বিশ বছর আগেই। এখন হারিয়ে গেছে সময়ের কাছে। নিয়তির কাছে। সত্যিই নীলু তুমি বিয়ে করো। বয়স এমন কিছু হয়নি। এম্নিতেই আমি যন্ত্রণায় আছি। বাকি জীবন তোমার একাকীত্ব আমাকে আরো যন্ত্রণা দিবে
দুপুর পেরিয়ে বিকেলের সোনালী রঙ ছড়িয়ে পড়ছে চারিদিকে। ‘নীলু বাইরে না খেয়ে তোমার বাসায় বরং ভালো হয়েছে। তোমার বাবুর্চির রান্না দুর্দান্ত। অনেক দিন পর ভালো খেলাম। একা এত বড় ফ্ল্যাট না কিনলেই পারতে। সাজিয়েছো সুন্দর।’
— চল ঘুরে দেখাই।
সাজানো শুন্য রুমগুলো হাহাকার করছে। ময়ীর মনে হলো এর জন্য সে-ই দায়ী। এই শুন্যতা, এই হাহাকার, এই অপেক্ষা সব তার জন্যেই হয়েছে। এত অনুশোচনা নিয়ে জীবন কাটানো কষ্টের। মাস্টার বেড রুমে বড় দুটো জানালা। মেঝে অব্দি। একটা জানালার পিছনে বড় টবে লাগানো হাস্নাহেনার ঝোপ। জানালার পাশের দেয়ালে বিশ বছর আগের ময়ীর একটা ছবি টানানো। পাশ থেকে তোলা। শেষ বিকেলের রোদ এসে পরেছে ঠোঁটের কোণায়, চোখে। চুল বাঁধা।
— এই ছবিটার কথা মনে আছে তোমার ময়ী? আমি তুলেছিলাম। মইনের ক্যামেরা চেয়ে এনেছিলাম।
— মনে আছে।
ময়ী ভাবছিল, মানুষের এতো ভালবাসার ক্ষমতা। সে সত্যি মানুষটাকেই ভালোবেসেছিলো। শুধু পাওয়া হলো না। বুকের ভিতরে যে দীর্ঘশ্বাস তা লুকিয়েই থাকুক। অশ্রুর কাছে আশ্রয় চাইতে চাইতে চোখ শুকনো এখন। একবার তাকালো নীলুর দিকে। এত মায়া নিয়ে কাটিয়ে দিলো এতোটা সময়। অনেক দিন পর ময়ীর শুকনো চোখ আর্দ্র হল। তারপর আর বাঁধ মানলো না। অল্প অল্প মেঘ জমে জমে ঘন কালো হয়েই ছিল। জমানো অভিমান কষ্ট আজ আর ধরে রাখা যাবে না। নীলু যাতে দেখতে না পায়, ময়ী অন্য দিকে মুখ ফেরালো।
অন্ধকার ফুড়ে হু হু করে গাড়ি ছুটে চলেছে। এই গতিতে অস্থিরতা নেই। মনে হচ্ছে ভিতরের মানুষ দুজন বহুবছর পর শান্ত স্থির হয়ে বসে আছে। দুজন ছুটে চলা ক্লান্ত মানুষের মনে আশ্চর্য রকম প্রাশান্তি ছেয়ে আছে। তীব্র ভালবাসায় পাওয়া আর না পাওয়ার হিসেব কে মেলায়? হার জিত কেমন করে হয় নীলু জানে না। শুধু জানে সে পরাজিত হয়নি
বিকেলের আলো মুছে গিয়ে সন্ধ্যা হয়েছে। নীলু চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক দিন আগের ময়ীদের ছাদের ঘরে ময়ীর কান্না নীলু দেখেনি। আজ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে বেশ বুঝতে পারছে নীলু, ময়ী আকুল হয়ে কাঁদছে।
— তুমি বিয়ে করার পর ছবিটা তো এই ঘরে রাখতে পারবে না। আমাকে দিয়ে দিও।
— দিয়ে দিবো।
— আলো জ্বালো। আর তোমার ড্রাইভারকে বলো, আমাকে নামিয়ে দিয়ে আসতে। বাসায় যাই। মা একা। আর শরীরটাও ভালো না।
— আমিই তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আসি। কাছেই তো।
— চেম্বারে যাবা না আজ?
— দেখি, কিছু বলিনাই…
গাড়ি ধানমণ্ডির ময়ীদের বাসার সেই পুরোনো পথে ছুটছে।
— তুমি ভালো ড্রাইভ করো নীলু। বাসার কাছাকাছি এসে গাড়ি নতুন পথে উঠলো। এই রাস্তা অচেনা। কিন্তু কতোদিন মন চেয়েছে এই পথে যাই।
— নীলু রাস্তা ভুল করছো।
— না ঠিকই আছি। চলো।
ময়ী আর কিছু বলল না।
ব্যাস্ত শহরের অলিগলি ছেড়ে গাড়ি হাইওয়েতে উঠলো। রবীন্দ্রনাথের গান বাজছে, ‘চরণ ধরিতে দিয়ো গো আমারে, নিয়ো না, নিয়ো না সরায়ে………… শেষ জয়ে যেন হয় সে বিজয়ী তোমারি কাছেতে হারিয়া’
— তুমি রবীন্দ্রনাথের গান শোনো?
— হুম, ভালো লাগে। মনে হয় ঠাঁই মিলে, আশ্রয় পাই।
— কোথায় যাচ্ছি নীলু?
— মাসীর কাছে। বিশ বছর আগে মাসী বলেছিল তোমাকে একদিন নিয়ে যেতে। আজ যাই।
অন্ধকার ফুড়ে হু হু করে গাড়ি ছুটে চলেছে। এই গতিতে অস্থিরতা নেই। মনে হচ্ছে ভিতরের মানুষ দুজন বহুবছর পর শান্ত স্থির হয়ে বসে আছে। দুজন ছুটে চলা ক্লান্ত মানুষের মনে আশ্চর্য রকম প্রাশান্তি ছেয়ে আছে। তীব্র ভালবাসায় পাওয়া আর না পাওয়ার হিসেব কে মেলায়? হার জিত কেমন করে হয় নীলু জানে না। শুধু জানে সে পরাজিত হয়নি।
সমাপ্ত