মার্কেস এই বঙ্গদেশে কখনো এসেছিলেন কিনা জানা নেই, তবে কারিবীয় সাগর পাড়ে বসে তিনি বঙ্গোপসাগরের কথা ভেবেছেন। ‘হারানো দিনের সমুদ্র’ উপাখ্যানে কারিবীয় সাগরের পরিবেশ বিপর্যয়কালে আলো ঝলমল বঙ্গোপসাগরের রোদেলা দুপুরের কথা স্মরণ করেছেন তিনি। গল্পের শেষে খানিকটা যাদু বাস্তবতারও দেখা মেলে।
জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে, সাগরটা কেমন ফুঁসে উঠল। সাগরের ঢেউ শহরে ভারী আবর্জনা বয়ে আনছিল। আর কয়েক সপ্তাহ পরে, সাগরের নিদারুণ রুক্ষ মেজাজে সবকিছু দূষিত হয়ে পড়ে। সেসময় থেকে পৃথিবী আর বাসযোগ্য রইল না। এমন পরিস্থিতি অন্তত পরবর্তী ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। সেই বিরূপ পরিবেশে এ শহরে কেউই রাত আটটার পর জেগে থাকত না। কিন্তু যে বছর জনাব এরবের্ত আসেন, সাগর তখনও আমূল বদলে যায়নি। এমনকি ফেব্রুয়ারি মাসেও নয়। তবে মার্চ মাসের দিকে সাগরে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসে। সাগরের বিশাল জলরাশি দিনে দিনে মসৃণ আর আলো ঝলমল হয়ে উঠে। আর মার্চ মাসের প্রথম রাতে সাগর গোলাপের সুরভী ছড়াতে থাকে।
তোবিয়াস প্রথম গন্ধটা পায়। ওর শরীরের রক্ত কাঁকড়াগুলোর আকর্ষণের বিষয়বস্তু। ও রাতের অর্ধেকটা সময় ওগুলোকে বিছানা থেকে তাড়িয়ে পার করে দেয়। এরপর আবার মৃদুমন্দ বাতাস বইতে শুরু করলে সে ঘুমিয়ে পড়ে। জেগে জেগে শুয়ে থাকার এই দীর্ঘ সময়ে ও টের পায় কখন বাতাস পাল্টে যায়। তাই যখনই গোলাপের গন্ধ পায়, তখনই দ্বার না খুলেই বুঝে নেয় গন্ধটা সাগর থেকে আসছে।
তোবিয়াস ঘুম থেকে দেরি করে উঠে। ক্লোতিলদে উঠোনে আগুন ধরাচ্ছে। বাতাসটা হিম হিম আর তারারা সব যে যার জায়গায় জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু সাগর থেকে ভেসে আসা আলোর কারণে দিগন্তের সব তারাগুলোকে গুণে শেষ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। কফি খাওয়ার পর তোবিয়েসের মনে হলো গতরাতের স্বাদটা মুখের তালুর মাঝে পাচ্ছে।
‘কালরাতে একটা বেশ অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে,’ ও বলে।
ক্লোতিলদে অবশ্যই গন্ধটা পায়নি। সে এতো ঘুম ঘুমিয়েছে যে, রাতের স্বপ্নটাও মনে করতে পারছে না।
‘ওটা গোলাপের গন্ধ ছিল,’ তোবিয়াস বলে, ‘আর আমি নিশ্চিত, গন্ধটা সাগর থেকে এসেছে।’
‘গোলাপের গন্ধ কেমন, তাই তো জানি না,’ ক্লোতিলদে বলে।
সে ঠিকই বলেছে। শহরটা রৌদ্রদগ্ধ। এখানকার কঠিন মাটি, যবক্ষারযুক্ত হওয়ায় কুঁচকে আছে। মাঝে মধ্যে কেউ শহরের বাইরে থেকে গোলাপের তোড়া আনে, আর ওগুলো শুকিয়ে গেলে সাগরে ছুড়ে ফেলে দেয়।
‘গন্ধটা গুয়াকামাইয়াল থেকে ভেসে আসা সেই জলে ডোবা মানুষটার মতো,’ তোবিয়াস বলে।
‘বটে,’ ক্লোতিলদে মুচকি হেসে বলল, ‘তবে গন্ধটা ভালো হলেই, তুমি নিশ্চিত হতে পারো না, যে ওটা সাগর থেকে এসেছে।’
সাগরটা আসলেই দিনে দিনে নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। সাগরে জাল ফেললে ভাসমান বর্জ্য ছাড়া কিছুই উঠে আসে না। ভাটির সময় শহরের রাস্তাগুলো মরা মাছে সয়লাব হয়ে যায়, আর ডিনামাইটের সাথে পুরনো আমলে ডুবে যাওয়া জাহাজের লোহা লক্কড় উঠে আসে।
সাগরটা আসলেই দিনে দিনে নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে। সাগরে জাল ফেললে ভাসমান বর্জ্য ছাড়া কিছুই উঠে আসে না। ভাটির সময় শহরের রাস্তাগুলো মরা মাছে সয়লাব হয়ে যায়, আর ডিনামাইটের সাথে পুরনো আমলে ডুবে যাওয়া জাহাজের লোহা লক্কড় উঠে আসে
ক্লোতিলদের মতো কিছু নারী আছে, যাদের এ শহরে ফেলে রাখা হয়েছে, যন্ত্রণায় ছটফট করার জন্য। তাদের মধ্যে বুড়ো খাকবের স্ত্রীও অন্যতম। সে আজ অন্যান্য দিনের তুলনায় সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে। বাড়িঘর গোছগাছ করে নিতান্ত দুখি দুখি চেহারায় খাবারের টেবিলে বসেছে সকালের নাস্তা সারার জন্য।
সে তার স্বামীকে বলে, ‘আমার শেষ ইচ্ছে, আমায় জীবন্ত কবর দিও।’
বুড়ো খাকবের স্ত্রী এমনভাবে বলে যেন, সে মৃত্যুশয্যায় শায়িত। অথচ রীতিমতো খাবার ঘরে টেবিলের সামনে বসে আছে, আর জানালা গলে মার্চের উজ্জ্বল আলো তার গায়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এদিকে, বুড়ো খাকব ক্ষুধা পেটে শান্ত শিষ্ট হয়ে বসে আছে। স্ত্রীকে সে এতো বেশি আর এতদিন ধরে ভালোবাসে যে— জীবনে এমন কোনো যন্ত্রণা খুঁজে পায়নি, যেটা তার স্ত্রীর দ্বারা শুরু হয়নি।
‘আমি এই আশ্বাস নিয়ে মরতে চাই—আমায় আর দশটা লোকের মতো মাটির নিচে কবর দেয়া হবে।’ সে বলতে থাকে। ‘আর এটা নিশ্চিত হবার একটা উপায়ই হলো, লোকজনের কাছে গিয়ে এখনই আমার শেষ ইচ্ছের কথাটা বলা, আর চাঁদা তুলে জীবন্ত কবরের ব্যবস্থা করা।’
‘কাউকে বলতে হবে না,’ বুড়ো খাকব দারুণ শান্তস্বরে বলে। ‘আমি নিজেই তোমাকে মাটির নিচে রাখার ব্যবস্থা করব।’
‘তাহলে এখনই নিয়ে চলো,’ শুনে স্ত্রী বলে, ‘আমি অনেক আগেই মরে গেছি।’
বুড়ো খাকব স্ত্রীর দিকে সতর্ক চোখে তাকায়। তার চোখটাই কেবল এখনও সজীব আছে। তবে হাড়গুলো গাঁটে গাঁটে গিট্টু পাঁকিয়ে গেছে। আর দেখতে একদম চষা জমির মতো এবড়োখেবড়ো। আগেও এমনটি দেখতে ছিল, এখনও তেমনি আছে।
‘তুমি অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন সুস্থ, ভালো আছো,’ বুড়ো খাকব স্ত্রীকে বলল।
‘গতরাতে আমি গোলাপের গন্ধ পেয়েছি,’ স্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে।
‘এসব ভুলে যাও,’ বুড়া খাকব আশ্বস্ত করতে বলল। ‘শুধুমাত্র আমাদের মতো গরিব লোকদের বেলায়ই এমন ঘটছে।’
‘তুমি যা ভাবছো, তেমন কিছু নয়,’ স্ত্রী বলল। ‘আমি সবসময় প্রার্থনা করি—মৃত্যুর সময়টা যেন ঈশ্বর আমাকে আগে ভাগেই জানান দেন, যাতে সাগর থেকে বহুদূরে মরতে পারি। এ শহরে গোলাপের ঘ্রাণ শুধুমাত্র ঈশ্বরের কৃপাই হতে পারে।’
বুড়ো খাকব আজকাল আর বেশিক্ষণ কোনো কিছু নিয়ে ভাবতে পারে না। তবে সে লোক মুখে বলতে শুনেছে—মানুষ তখনই মরে, যখন সে মরতে চায়, অথচ তখন তার মরার সময় নয়। আর তাই বুড়ো স্ত্রীর আশঙ্কার ব্যাপারে শঙ্কিত ছিল। এমনকি সে ভেবে অবাক হয়— স্ত্রীর মৃত্যুর সেই অন্তিম মুহূর্ত এলে কীভাবে তাকে কবর দেবে।
সকাল নয়টায় বুড়ো দোকানের ঝাঁপ খোলে। এরপর দরোজার সামনে দুটো চেয়ার আর একটা চৌখুপী ছককাটা ছোট টেবিল পেতে রাখে। পুরোটা সকাল প্রতিদ্বন্দ্বীর সাথে চেকারবোর্ড খেলাটা খেলে। খেলার ফাঁকে বাড়ি থেকে বিধস্ত শহরের, মাংসের কসাইখানার দিকে তাকায়। সূর্যের তীব্র দহনে দালানগুলোর রং চটে গেছে। রাস্তার মোড়ে এক চিলতে সাগর দেখা যাচ্ছে।
দুপুরে খাওয়ার আগে, অন্য সময়ের মতো বুড়ো খাকব দন মাক্সিমো গোমেসের সাথে খেলে। সে অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীর কথা ভাবতে পারে না। লোকটা দু দুটি গৃহযুদ্ধের পরও টিকে আছে। যুদ্ধে তার একটি চোখ হারিয়েছে, তৃতীয় চক্ষুর বিনিময়ে। ইচ্ছে করে একটা খেলায় হারার পর, আরেকটির দান খেলার জন্য মেরুদন্ড খাড়া করে বসে।
‘আমায় একটা জিনিস বলো, দন মাক্সিমো।’ বুড়ো খাকব জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কি কখনো তোমার স্ত্রীকে জীবন্ত কবর দিতে পারবে?’
‘অবশ্যই,’ দন মাক্সিমো গোমেস বলে। ‘আমি যদি বলি এটা করতে আমার হাত একটুও কাঁপবে না—তবে তুমি আমায় বিশ্বাস করতে পারো।’
বুড়ো খাকব বিস্ময়ে নীরব হয়ে গেল। এরপর খেলায় একটু ঢিলে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে :
‘অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে পেত্রা মরতে বসেছে।’
দন মাক্সিমো মুখের ভাব পরিবর্তন করে না। ‘সে ক্ষেত্রে,’ সে বলল, ‘তাকে জীবন্ত কবর দেবার কোনো কারণ নেই।’ সে চেকার বোর্ডে দুটো গুটি মেরে দিয়ে একটা রাজা বানায়। এরপর প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে চোখ রাখে।
‘কী হয়েছে তার?’
‘গতরাতে,’ বুড়ো খাকব ব্যখ্যা করে, ‘ও গোলাপের গন্ধ পেয়েছে।’
‘তাহলে তো শহরের অর্ধেক লোক মরতে যাচ্ছে,’ দন মাক্সিমো গোমেস বলে। ‘ওটার কথাই তাহলে আজ সকালে তুমি বলছিলে।’
‘বুড়ো খাকবের জন্য তাকে না চটিয়ে হারাটা কঠিন ছিল। সে চেয়ার টেবিল ভিতরে এনে দোকান বন্ধ করে দেয়। এরপর আর কে গন্ধটা পেয়েছে, তা জানার জন্য শহরের সব জায়গায় ঢুঁ মারে। শেষমেশ দেখা গেল গন্ধটার ব্যাপারে একমাত্র তোবিয়াসই নিশ্চিত। বুড়ো খাকব তাকে অনুরোধ করে, সে যেন তার বাড়িতে ভাগ্যক্রমে এসেছে এমন ভালো করে বিষয়টা তাঁর স্ত্রীকে খুলে বলে।
লোকজনের ঘুমন্ত অবস্থায় পৃথিবীতে কী ঘটতে পারে, বিষয়টা ও অবাক হয়ে ভাবে। গভীর রাতে কাঁকড়াদের প্রচন্ড হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে বেড়ানোর শব্দ পেল। ওগুলো বাড়ির খাম্বা বেয়ে উঠার জন্য থাবা মেরে চেষ্টা চালাচ্ছে, যতক্ষণ না পর্যন্ত ক্লান্ত হয়। ও ক্লোতিলদের ঘরে উঁকি দেয়। দেখে, সে সুর তুলে নাক ডাকছে, আর সেই সুরধ্বনি সর্বোচ্চ লয়ে পৌঁছে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর।
তোবিয়াস, দন মাক্সিমো গোমেসের কথা মতো বিকেল চারটায়, রোববারের সেরা কাপড়টা পরে বারান্দায় বুড়ো খাকবের সামনে এসে দাঁড়ায়। এখানে বসে খাকব-গিন্নি মরে যাবার পর বিপত্নীক স্বামী যেসব কাপড়চোপড় পরবে, সেগুলো রিফু করে সময় কাটায়।
তোবিয়াস এতো শান্তভাবে এলো যে খাকব-গিন্নি চমকে উঠে।
‘ক্ষমা করো,’ সে ব্যঙ্গ করে বলে। ‘আমি ভেবেছি মৃত্যুর মহান দেবদূত স্বয়ং গাব্রিয়েলের আগমন ঘটেছে আমার বারান্দায়।’
‘বটে। গাব্রিয়েল যে নয়, তা তো দেখতেই পাচ্ছেন,’ তোবিয়াস বলে। ‘আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। আর আমি কিছু বলতে এসেছি।’
খাকব গিন্নি চশমার কাচটা কাপড় দিয়ে মুছে।
‘আমি জানি এটা কিসের আলামত,’ সে বলে।
‘বাজি ধরতে পারি, আপনি জানেন না,’ তোবিয়াস বলে।
‘আমি জানি, গত রাতে তুমি গোলাপের গন্ধ পেয়েছো।’
‘কীভাবে জানলেন?’ তোবিয়াস বিরস বদনে বলে।
‘আমার এই বুড়ো বয়সে,’ খাকব গিন্নি বলে, ‘একজন মানুষের এতো বেশি ভাবাভাবির সময় আছে যে, সে সহজেই নবী রসুল হয়ে যেতে পারে।’
বুড়ো খাকব দোকানের ভিতরে দেয়ালে কান লাগিয়ে ছিল, স্ত্রীর কথা শুনে লজ্জা পেয়ে উঠে দাঁড়ায়।
‘শোনো গিন্নি তুমি তো দেখতেই পাচ্ছো,’ সে বিরক্ত সহকারে বলে। ‘তুমি যা ভাবো, এটা তা নয়।’
‘ছেলেটা মিথ্যে বলেছে,’ স্ত্রী মাথা না তুলে বলে। ও কোনো কিছুরই গন্ধ পায়নি।’
‘ঘটনাটা ঘটেছিল এগারোটার সময়,’ তোবিয়াস বলে। ‘আমি তখন কাঁকড়া তাড়াচ্ছিলাম।’
বুড়ো খাকবের শার্টের কলারে পট্টি লাগানো শেষ হয়েছে।
‘মিথ্যে,’ সে জোর দিয়ে বলে। ‘সবাই জানে যে, তুমি একজন মিথ্যুক।’
খাকব-গিন্নি দাঁত দিয়ে সুতা কেঁটে, চশমার ফাঁক দিয়ে তোবিয়াসকে দেখে।
‘আমি বুঝতে পারছি না, আমাকে যদি এতোটা অসম্মানই করো তবে কেন তুমি সামনে আসার জন্য চুলে ভ্যাসলিন লাগানো আর জুতো পালিশ করার মতো ঝামেলা করলে।’
তখন থেকে তোবিয়াস সাগরের দিকে নজর রাখে। সে ওর দোল বিছানাটা উঠোনের বারান্দায় ঝুলিয়ে দিয়ে রাতটা সেখানে শুয়ে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে। লোকজনের ঘুমন্ত অবস্থায় পৃথিবীতে কী ঘটতে পারে, বিষয়টা ও অবাক হয়ে ভাবে। গভীর রাতে কাঁকড়াদের প্রচন্ড হামাগুড়ি দিয়ে হেঁটে বেড়ানোর শব্দ পেল। ওগুলো বাড়ির খাম্বা বেয়ে উঠার জন্য থাবা মেরে চেষ্টা চালাচ্ছে, যতক্ষণ না পর্যন্ত ক্লান্ত হয়। ও ক্লোতিলদের ঘরে উঁকি দেয়। দেখে, সে সুর তুলে নাক ডাকছে, আর সেই সুরধ্বনি সর্বোচ্চ লয়ে পৌঁছে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর। জুলাইয়ের তাপমাত্রাটা বেড়ে সবকিছু কেমন অসাড় করে দিয়েছে।
তোবিয়াস সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। এ শহরের অন্যসব লোকদের মতো, সাগরটাকেও ভালো মতো চিনে। ওর চোখ দিগন্তের একটা বিশেষ স্থানে আটকে ছিল। ও জায়গাটার রং বদলে যাওয়া দেখল। আর দেখল— আলো নিভে ফেনিভ আর নোংরা হয়ে ওঠা। অল্প অল্প করে সে সাগরকে পর্যবেক্ষণ করা শিখেছে। এখন শুধুমাত্র জেগে নয়, রাত্রিতে ঘুমিয়েও সে সাগর দেখে।
প্রতিটা রেকর্ড স্মরণ করিয়ে দেয়—ওদের কোনো এক স্বজনকে, যে মারা গেছে। আরো অনেক কিছু তাদের মনে করিয়ে দিলো, যেমন—দীর্ঘ অসুস্থতার পর কোনো খাবারের স্বাদ, অথবা পরের দিন তাদের যে কাজটা করতে হবে—যেটা অনেক বছর ধরে করা হয়নি, কারণ তারা ভুলে গিয়েছিল
বুড়ো খাকবের স্ত্রী আগস্ট মাসে মারা গেল। ঘুমের মধ্যে মারা গেছে বলে, এ শহরের প্রথা অনুযায়ী তাকে অন্যান্যদের মতো ফুলবিহীন সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হলো। তোবিয়াস শহরে কিছু একটা ঘটার অপেক্ষায় রইল। সে এতো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করল যে—একরাতে, যখন ও দোল বিছানায় একটু তন্দ্রা সেরে নিচ্ছে, তখন অনুভব করল বাতাসে কিছু একটা পরিবর্তন ঘটেছে। সাগরে হঠাৎ হঠাৎ ঢেউ উঠছে—যেন জাপানি জাহাজ পোতাশ্রয়ের মুখে পচা পেঁয়াজ ভর্তি একটা মালবাহী জাহাজ খালাস করেছে। গন্ধটা কড়া আর থেকে গেল ভোর হবার আগ পর্যন্ত। তোবিয়াস দোল বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে, ক্লোতিলদের ঘরে গেল। তাকে কয়েকবার ঝাঁকালো।
‘ওটা এখন এখানে,’ খাকব বলে।
ক্লোতিলদে উঠে দাঁড়িয়ে মাকড়শার জালের মতো গন্ধটাকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করে।
‘ঈশ্বরের অভিশাপ,’ সে বলে।
তোবিয়াস দরোজার দিকে লাফিয়ে গেল। এরপর রাস্তার মাঝখান দিয়ে দৌড়ে যেতে যেতে চিৎকার করতে থাকে। সমস্ত শক্তি জড়ো করে সে চিৎকার দেয়। একটু থেমে গভীর শ্বাস নিয়ে আবারোও চিৎকার করে। চারিদিক নীরব নিস্তব্ধ। সে আবারো গভীর শ্বাস নেয়। বুঝলো, সাগরে সেই গন্ধটা এখনো আছে। কিন্তু কেউ তার ডাকে সাড়া দেয় না। এরপর তোবিয়াস বাড়ি বাড়ি গিয়ে দরোজা ধাক্কা দিতে থাকে। এমনকি যে বাড়িতে মালিক ছিল না সে বাড়িতেও ধাক্কা দিতে ভুলল না। তার চিৎকার চ্যাঁচামিচির সাথে কুকুরের ঘেউঘেউ মিলে যে বাজখাই শব্দ হলো তাতে সবাই জেগে উঠে।
অনেকেই গন্ধটা পেল না। কিন্তু অন্যান্যরা, বিশেষত বয়ষ্করা গন্ধটাকে উপভোগ করার জন্য সাগরতীরে চলে যায়। সেখানে গোলাপের গন্ধের সুরভি যেন, অতীতের কোনো এক সময়ের কথা মনে করিয়ে দেয়। কেউ কেউ গন্ধ গায়ে মেখে বাড়ি ফিরে গেল। তবে, বেশির ভাগ লোক রাতের ঘুম সারার জন্য সাগরপাড়ে থেকে যায়। ভোর হওয়ার সাথে সাথে গন্ধটা এতটা কড়া হলো যে—শ্বাস নেয়া রীতিমতো কঠিন হয়ে পড়েছে।
তোবিয়াস দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটায়। ক্লোতিলদে তাকে দুপুরের ঘুমের সময় কাছে টেনে নেয়। বিকেলটা ওরা উঠোনমুখী দরোজা বন্ধ না করেই বিছানায় শরীর নিয়ে নানান খেলা খেলে সময় কাটায়। প্রথমে কেঁচোর মতো, তারপর খরগোশ, আর সবশেষে কচ্ছপের মতো দেহ মিলনে মত্ত থাকল যতোক্ষণ না পর্যন্ত পৃথিবীর সমস্ত বিষণ্নতা রাতের অন্ধকারে তলিয়ে যায়। বাতাসে তখনও গোলাপের সুবাসের ছিঁটেফোটা আছে। মাঝে মাঝে সঙ্গীতের এক মূর্চ্ছনা ঢেউয়ের মতো ওদের শোবার ঘরে এলো।
‘গানটা কাতারিনোর গ্রামোফোন রেকর্ডে বাজছে,’ ক্লোতিলদে বলে। ‘নতুন কেউ অবশ্যই শহরে এসেছে।’
তিনজন পুরুষ আর একজন নারী এসেছে এ শহরে। কাতারিনো ভেবেছে, অন্যান্যরাও পরবর্তীসময়ে আসতে পারে। তাই সে তার ভাঙাচোরা গ্রামোফোনটা লাগানোর চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়ে, পাঞ্চো আপারেসিদোকে ডেকে পাঠায়। পাঞ্চো অন্যের এধরনের কাজে বিশেষে উৎসাহী। কারণ, তার নিজের কিছুই করার নেই। তবে তার এক বাক্স যন্ত্রপাতি আর এক জোড়া বুদ্ধিমান হাত আছে।
কাতারিনোর কাঠের আখড়াটা সাগরের দিকে মুখ করা। সেখানে একটা বড়সড় ঘর আছে যেখানে কিছু বেঞ্চ আর ছোট টেবিল রাখা। আর পিছনে কটি শোবার ঘর। পাঞ্চো আপারেসিদোকে গ্রামোফোন সারার কাজে ব্যস্ত। তিনজন পুরুষ আর একজন নারী কাতারিনোর শুঁড়িখানায় নীরবে বসে মদ পান করছে। ভ্রমণের ক্লান্তিজণিত কারণে ওরা হা করে নিঃশ্বাস ফেলছে।
কয়েকবার চেষ্টার পর গ্রোমোফোনটা বাজতে শুরু করলে, ওরা মদ্যপানের ফাঁকে ফাঁকে গান শুনতে থাকে। দূরে যেসব লোকজন জটলা করছিল, ওরা গ্রামোফোনের শব্দ শুনে গালগপ্পো থামিয়ে থ হয়ে একে অপরের মুখের দিকে তাকায়। তখনই ওরা উপলব্ধি করে, শেষবার যখন গান শুনেছে, তখন থেকে এখন পর্যন্ত তারা কতোটা বুড়িয়ে গেছে।
তোবিয়াস দেখল এ শহরে সবাই এখন রাত নটায়ও জেগে আছে। ওরা দরোজার সামনে বসে কাতারিনোর পুরোনো রেকর্ড শুনতে লাগল। চন্দ্র অথবা সূর্যগ্রহণ দেখার সময় লোকজনের মধ্যে যে শিশুসুলভ ভাব আর অদৃষ্টের ওপর ভরসা দেখতে পাওয়া যায়—ওদের অবস্থা অনেকটা এখন সেরকম। প্রতিটা রেকর্ড স্মরণ করিয়ে দেয়—ওদের কোনো এক স্বজনকে, যে মারা গেছে। আরো অনেক কিছু তাদের মনে করিয়ে দিলো, যেমন—দীর্ঘ অসুস্থতার পর কোনো খাবারের স্বাদ, অথবা পরের দিন তাদের যে কাজটা করতে হবে—যেটা অনেক বছর ধরে করা হয়নি, কারণ তারা ভুলে গিয়েছিল।
রাত এগারোটার দিকে গান বাজনা বন্ধ হয়। অনেকে বিছানায়ও চলে গিয়েছিল। ওরা ভেবেছে—বৃষ্টি হতে যাচ্ছে, কারণ সাগরের ওপর কালো মেঘ ঝুলে আছে। কিন্তু মেঘ অল্প কিছুক্ষণ ভেসে, সাগরে নেমে জলে ডুবে গেল। শুধুমাত্র তারারা উপরে থেকে গেল। কিছুক্ষণ পরেই, শহরে মৃদুমন্দ বাতাস অন্য কোথাও থেকে গোলাপের সুরভি বয়ে নিয়ে এলো।
‘তোমাকে ঠিক যা বলেছি, খাকব,’ দন মাক্সিমো গোমেস আবেগে আহ্লাদিত হয়ে বলে। ‘ওটা আবার এখানে ফিরে এসেছে। আমি নিশ্চিত যে, এখন থেকে প্রতি রাতে আমরা গোলাপের গন্ধ পেতে যাচ্ছি।’
‘ঈশ্বরের নিষেধ ছিল বলে’, বুড়ো খাকব বলে। ‘এই গন্ধটা আমার জীবনের একটা মাত্র জিনিস—যেটা অনেক দেরীতে এসেছে।’
ওরা জনশূন্য দোকানে বসে রেকর্ডের গানের দিকে মনোযোগ না দিয়ে চেকার খেলে যাচ্ছিল। ওদের স্মৃতিগুলো এতোই প্রাচীন যে, আর কোনো রেকর্ডই ছিল না, যেটা স্মৃতিকে নাড়া দিতে পারে।
‘আমার কথা যদি জানতে চাও, তবে বলব, আমি এসবের কোনো কিছুই যথেষ্ট বিশ্বাস করি না,’ দন মাক্সিমো গোমেস ভরাট গলায় বলে। ‘এতগুলো বছর ধুলোবালি খাওয়ার পর, এতগুলা মেয়েছেলের ফুলের গাছ বোনার জন্য একটা ছোট্ট উঠোনের চাহিদার পর এটা এমন আহামরি কোন পাওনা নয় যে, একজন মানুষ জীবনে শেষ প্রান্তে এসে এধরনের গন্ধ পাবে, আর এটাকে সত্যি বলে বিশ্বাসও করবে।’
‘কিন্তু, আমরা নিজেদের নাকে ঘ্রাণ পাচ্ছি,’ বুড়ো খাকব বলে।
‘কোনো বিষয় না,’ দন মাক্সিমো গোমেস বলে। ‘যুদ্ধের সময়, যখন বিপ্লব রীতিমতো পরাস্ত, যখন আমরা মনে প্রাণে এতো বেশি একজন জেনারেলকে চাইছিলাম, যে দেখলাম স্বয়ং মার্লবোরোর ডিউক আমাদের সামনে সশরীরে উপস্থিত। খাকব, আমি তাকে আমার নিজের চর্ম্মচক্ষে দেখেছি।’
মধ্যরাতের পরে, বুড়ো খাকব একা ছিল। সে তার দোকান বন্ধ করে বাতি নিয়ে শোবার ঘরে গেল। তখন জানালার মধ্য দিয়ে, সাগরের আলোক বিচ্ছুরণ রেখার দিকে তাকিয়ে, দূরারোহ পাহাড় দেখতে পায়—যেখান থেকে মৃতদেহ ছুড়ে মারা হয়েছিল।
‘পেত্রা,’ সে কোমল কণ্ঠে বলে উঠে।
পেত্রা তার কণ্ঠ শুনতে পেল না। ওই মুহূর্তে, সে রোদেলা দুপুরে বঙ্গোপসাগরের জলরাশির উপরে ভেসে বেড়াচ্ছে। পেত্রা জলের ভিতর দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখার জন্য মাথাটা একটু উঁচু করে আছে। সাগরগামী জাহাজের আলোকিত কাচের বাক্স থেকে যেন সে পৃথিবীকে দেখছে। কিন্তু সে তার স্বামীকে দেখতে পায়নি। কারণ, তার স্বামী এ মুহূর্তে পৃথিবীর আরেক প্রান্তে আবারো কাতারিনোর গ্রামোফোন শুনতে আরম্ভ করেছে।
‘শুধু চিন্তা করো,’ বুড়ো খাকব বলে। ‘বড় জোর ছয় মাস আগে ওরা ভেবেছিল, তুমি পাগল হয়ে গেছ। আর এখন ওরাই তোমার মৃত্যুর বার্তা বয়ে নিয়ে আসা গোলাপের সুরভীর মাঝে উৎসব শুরু করে দিয়েছে।’
বুড়ো খাকব আলো নিভিয়ে বিছানায় সেধিয়ে গেল। বুড়ো লোকদের মতো বিচ্ছিরি ঘ্যানঘ্যান করে কাঁদতে থাকে। তবে, শিঘ্রই সে ঘুমিয়ে পড়ে।
‘যদি পারতাম, তবে আমি এই শহর ছেড়ে চলে যেতাম,’ এপাশ ওপাশ করতে করতে কঁকিয়ে কেঁদে উঠে বুড়ো। ‘আমি সোজা নরকে অথবা অন্য কোনো জায়গায় চলে যেতাম, যদি একসাথে কুড়ি পেসো পেতাম।’
সে রাত থেকে আরো কয়েক সপ্তাহের জন্য, গন্ধটা সাগরে রয়ে গেল। গন্ধটা বাড়ির কাঠে, খাবারে আর খাবার পানির সাথে মিশে গেল। গন্ধ থেকে মুক্তি পাওয়ার আর কোনো উপায়ই রইল না। অনেকেই তাদের বিছানার চাদরে গন্ধটা পেয়ে চমকে উঠে। চারজন নারী পুরুষ, যারা কাতারিনোর আখড়ায় এসেছে, ওরা এক শুক্রবার চলে গেল, কিন্তু পরের শনিবার একপাল লোকজন নিয়ে ফিরে এলো। আরো কিছু লোক রোববার এসে পৌঁছায়। ওরা পিঁপড়ার মতো ভিতরে বাইরে সর্বত্র খাবারের খোঁজে, ঘুমানোর জায়গার খোঁজে ঘোরাঘুরি করতে থাকে—যতক্ষণ না পর্যন্ত রাস্তায় হাঁটা অসম্ভব হয়ে পড়ল।
আরো লোকজন চলে এসেছে। অতীতে শহরটা যখন মরতে বসেছিল, তখন যে নারীরা চলে গিয়েছিল, ওরা আবার কাতারিনোর কাছে ফিরে এসেছে। ওদের এখন হৃষ্টপুষ্ট শরীর আর মুখে চড়া প্রসাধনী। ওরা বাজার থেকে সবশেষ রেকর্ড কিনলো, যা ওদের অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় না। শহরের পুরনো কিছু বাসিন্দাও ফিরে এসেছে। ওরা কোথাও অবৈধ উপায়ে কোটিপতি হতে চলে গিয়েছিল। ভাগ্য ফিরেছে বলে ফিরে এলেও ওদের পরনে এখন ছেঁড়া কাপড়, যে কাপড় পরে ওরা শহর ছেড়েছিল। এ শহরে অনেক কিছু এলো। সঙ্গীত আর ছোটখাটো প্রদর্শনী এসে পৌঁছালো। আরো এলো ভাগ্যের চাকা, ভবিষ্যৎ বক্তা, বন্দুকধারী আর গলায় সাপ পেঁচানো লোক, যে অনন্ত জীবনের জন্য অমোঘ ঔষধ বিক্রি করে। ওরা অনেক সপ্তাহ ধরে আসতে থাকে, এমনকি প্রথম যেদিন বৃষ্টি হওয়ার পর, সাগর উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠে আর গন্ধ অদৃশ্য হয়; সেদিনের পরেও।
সবার শেষে এলেন একজন পাদ্রি। তিনি চারিদিকে ঘোরাঘুরি করলেন, আর হালকা কফিতে রুটি ভিজিয়ে খেতে লাগলেন। এবং ধীরে ধীরে সব কিছু নিষিদ্ধ করে দিলেন। যেগুলো তাঁর আগে এসেছিল। সুযোগের খেলা, নতুন সঙ্গীত আর সঙ্গীতের তালে তালে নাচ, আর এমনকি ইদানীং সৈকতে ঘুমানোর রীতিটা পর্যন্ত তার নিষেধের তালিকায় ঠাঁই পেল। এক সন্ধ্যায়, মেলাচোরের বাড়িতে, তিনি সাগরে গোলাপের গন্ধ সম্পর্কে একটা ধর্মীয় বক্তৃতাও দিয়ে দিলেন।
‘ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দাও, হে বৎস,’ তিনি বললেন। ‘কারণ এটা স্বর্গের গন্ধ।’
কেউ একজন বাঁধা দেয়।
‘কীভাবে তা বলছেন, পাদ্রে? আপনি নিজেও তো গোলাপের গন্ধ এখনো পাননি।’
‘পবিত্র ধর্মগ্রন্থে,’ তিনি বললেন, ‘এই গন্ধ সম্পর্কে স্পষ্ট বলা আছে। আমরা ঈশ্বর নির্বাচিত গ্রামে বসবাস করছি।’
তোবিয়াস শহরের এই আনন্দ উৎসবে ঘুমের মধ্যে হেঁটে বেড়ানো মানুষের মতো আগু পিছু করছে। সে ক্লোতিলদেকে নিয়ে শহরে বের হয় টাকার সন্ধানে। ওদের বিশ্বাস, ওরা জুয়ায় অনেক টাকার বাজি ধরে, বাজিতে জিতে অনেক টাকা কামাই করবে। সেই টাকা হিসেব নিকেশ করে নিজেদের অতি বড়লোক ভাবতেও শুরু করে দেয়। কিন্তু সেরাতে শুধুমাত্র তারা নয়, পুরো জনতা শহরে ভিড় জমায়। ওরা যা কল্পনা করেছে তার চেয়েও বেশি টাকা এক জায়গায় স্তূপাকারে দেখে।
সে রাতেই জনাব এরবের্ত এসে পৌঁছালেন। তিনি রাস্তার মাঝে একটা টেবিল বসিয়েছেন। টেবিলের উপরে দুটো বড় ট্রাঙ্ক রাখলেন। ট্রাঙ্কগুলো ব্যাঙ্কনোটে কানায় কানায় পূর্ণ। সেখানে এতো বেশি টাকা ছিল যে, তা এ শহরে কেউ প্রথমে বুঝতেই পারেনি। কারণ, এক সাথে এতো টাকা যে কারো কাছে থাকতে পারে, তা তাদের কল্পনার বাইরে। কিন্তু যখন জনাব এরবের্ত হাতের ছোট্ট ঘণ্টা বাজালেন, তখন লোকজনকে বিশ্বস করতে হলো, তার অনেক টাকা।
‘আমি পৃথিবীর সেরা ধনী,’ তিনি বললেন। ‘আমি এতো বেশি টাকা পেয়েছি, যে এগুলোকে রাখার জায়গা পাইনি। এছাড়া, যেহেতু আমার হৃদয়টা এতো বড় যে—তা আমার বক্ষে ধারণ করা যাচ্ছে না। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে, মানবজাতির সমস্যা সমাধান করব।’
ওই মুহূর্তে, সে রোদেলা দুপুরে বঙ্গোপসাগরের জলরাশির উপরে ভেসে বেড়াচ্ছে। পেত্রা জলের ভিতর দিয়ে পৃথিবীটাকে দেখার জন্য মাথাটা একটু উঁচু করে আছে। সাগরগামী জাহাজের আলোকিত কাচের বাক্স থেকে যেন সে পৃথিবীকে দেখছে। কিন্তু সে তার স্বামীকে দেখতে পায়নি
জনাব এরবের্ত বেশ লম্বা-চওড়া আর গায়ের রং লালচে বর্ণের। একটুও না থেমে; বেশ উঁচু স্বরে কথা বলছেন। একই সময়ে তিনি নির্জীব হাতদুটো নাড়ছেন। হাত দুটো দেখে মনে হচ্ছে, এইমাত্র লোম কামানো হয়েছে। জনাব এরবের্ত টানা পনের মিনিট কথা বলে থামলেন। এরপর বেল বাজিয়ে আবারো কথা বলা শুরু করলেন। তাঁর বক্তৃতার মাঝখানে, ভিড়ের মধ্য থেকে কেউ একজন টুপি নাড়িয়ে তাঁর কথায় বাঁধা দেয়। ‘কাজের কথায় আসুন জনাব। বাগাড়ম্বর না করে, টাকাটা সবার হাতে হাতে দিয়ে দিন।’
‘এতো তাড়াতাড়ি নয়,’ জনাব এরবের্ত উত্তর দিলেন। ‘কোনো কারণ ছাড়া, টাকা বিলানো অতিশয় অন্যায্য, যার কোনো মানেই হয় না।’
যে ছেলেটা তাকে বাঁধা দিয়েছিল, তার চোখে চোখ রেখে তাকে সামনে আসার ইশারা করলেন। জনতা সরে গিয়ে তাকে সামনে এগোনোর জায়গা করে দিলো।
‘এদিকে,’ জনাব এরবের্ত বলে গেলেন, ‘আমাদের এই অধৈর্য বন্ধু, সম্পদের সবচেয়ে ন্যায্য বন্টনের প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যার সুযোগ করে দিলো।’ তিনি ছেলেটাকে কাছে আসতে সাহায্য করলেন।
‘নাম কি তোমার?’
‘পাত্রিসিও।’
‘ঠিক আছে, পাত্রিসিও,’ জনাব এরবের্ত বলেন। ‘আর সবার মতো, তোমারও কিছু সমস্যা আছে যা সমাধান করতে পারোনি।’
পাত্রিসিও মাথার টুপিখানা নামিয়ে, মাথা নেড়ে বিষয়টা নিশ্চিত করে।
‘সমস্যাটা কী বলো?’
‘আমার সমস্যা হলো,’ পাত্রিসিও বলে। ‘আমার কোনো টাকা পয়সা নেই।’
‘কতো টাকা তোমার লাগবে?’
‘আটচল্লিশ পেসো।’
জনাব এরবের্ত বিস্মিত হন। ‘আটচল্লিশ পেসো,’ পাত্রিসিও আবারও বলে। জনতা হাততালি দিয়ে ওর পাশে দাঁড়ায়।
‘খুব ভালো কথা, পাত্রিসিও,’ জনাব এরবের্ত বলে গেলেন। ‘এখন, আমাকে একটা জিনিস বলো : তুমি কী কী করতে পারো?’
‘অনেক কিছু।’
‘একটার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নাও,’ জনাব এরবের্ত বলেন। কোন কাজটা তুমি সবচেয়ে ভালো করতে পারো?’
‘আচ্ছা,’ পাত্রিসিও বলে, ‘আমি পাখির ডাক নকল করতে পারি।’
এক মুহূর্ত করতালি দিয়ে, জনাব এরবের্ত জনতার কাছে ফিরে এলেন।
‘তাহলে, সম্মানিত ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ, আমাদের বন্ধু পাত্রিসিও, যে পাখির ডাক নকল করার মতো অসাধারণ কাজ করতে পারে, সে এখন আটচল্লিশটা পাখির ডাক নকল করবে। এর মাধ্যমেই সে জীবনের সবচেয়ে বড় সমস্যার সমাধান করে ফেলবে।’
জনতা অবাক হয়ে কিছুক্ষণ নীরব থাকে। পাত্রিসিও তখনই পাখির মতো ডাক শুরু করে দেয়। কখনো শীষ দিয়ে, কখনো গলার স্বর অনুকরণ করে, সে চেনাজানা পাখির কণ্ঠ নকল করে। অচেনা কিছু পাখির স্বরও নকল করল, যে পাখি কেউ স্মরণ করতে পারে না। শেষ হলে, জনাব এরবের্ত কয়েক দফা হাততালি দিয়ে তাকে আটচল্লিশ পেসো দিলেন।
‘আর এখন,’ তিনি বললেন, ‘একে একে সবাই আসুন। আমি আগামীকাল এই সময় পর্যন্ত, আপনাদের সমস্যা সমাধানের জন্য এখানে আছি।’
বুড়ো খাকব বাড়ির সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকদের মন্তব্য শুনে শহর তোলপাড় করা ঘটনাটা জানতে পারে। খবরের প্রতিটা ক্ষুদ্র অংশই তার হৃদয়কে বড় থেকে বড়তর করছে। এখন এটা ফেটে যাবার উপক্রম হয়েছে।
‘বন্ধু, তুমি এই বিদেশী সম্পর্কে কী ভাবছো?’ সে জিজ্ঞেস করে।
দন মাক্সিমো গোমেস কাঁধ ঝাঁকায়। ‘সে হয়তবা কোনো দানবীর ধরনের লোক হবে।’
‘ইস্স, আমি যদি কিছু একটা করতে পারতাম,’ বুড়ো খাকব আক্ষেপ নিয়ে বলে, ‘আমি আমার ছোট সমস্যার সমাধানটা এখনই করে ফেলতাম। খুব বেশি নয় : কুড়ি পেসো হলেই চলবে।’
‘তুমি ভালো চেকার খেলতে পারো,’ দন মাক্সিমো গোমেস বলে।
বুড়ো খাকবকে কথাটার খুব গুরুত্ব দিতে দেখা গেল না। কিন্তু পরে সে চেকারের বোর্ড আর বাক্সটা খবরের কাগজে মুড়ে নেয় আর জনাব এরবের্তকে চ্যালেঞ্জ করতে ছুটে। মাঝরাত অবধি তাঁর জন্য অপেক্ষা করে। এদিকে জনাব এরবের্ত ট্রাঙ্ক গুছিয়ে নিলেন আর পরের দিন সকাল পর্যন্ত সবাইকে শুভরাত্রি জানালেন।
তিনি ট্রাঙ্ক বহনকারী লোকটিকে নিয়ে কাতারিনোর মদের আখড়ার দিকে হেঁটে আসছেন। জনতা পুরোটা পথ, তাদের সমস্যা নিয়ে পিছু নেয়। কাতারিনোর মদের আখড়ায় পৌঁছে একটু একটু করে তিনি তাদের সমস্যার সমাধান করা চালিয়ে গেলেন। তিনি এত সমস্যা সমাধান করলেন যে, শেষপর্যন্ত দেখা গেল, সেখানে যেসব নারী পুরুষ ছিল, তাদের সকলেরই সমস্যার সমাধান করা হয়ে গেছে। কামরার পিছনে মাত্র একজন নিঃসঙ্গ মেয়ে ছিল যে তার বিজ্ঞাপন কার্ডবোর্ডটা পাখা বানিয়ে বসে বসে নিজেকে বাতাস করছে।
‘তোমার বিষয়টা কি?’ জনাব এরবের্ত গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন। ‘তোমার সমস্যাটা কি?’
সে পাখা নাড়ানো বন্ধ করে।
‘শুনুন বিদেশী, আমাকে আপনার এইসব তামাশার সাথে মিশিয়ে ফেলবেন না,’ সে বেশ উঁচু গলায় বলল। ‘আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি একজন পতিতা, কারণ এটা আমার ভাগ্যের লিখন।’
জনাব এরবের্ত কাঁধ ঝাঁকালেন। তিনি খোলা ট্রাঙ্কের পাশে ঠান্ডা বিয়ার পান করছেন আর অন্যের সমস্যা শোনার জন্য অপেক্ষায় আছেন। তিনি গরমে দরদর করে ঘামছেন। কিছুক্ষণ পরেই, মেয়েটি তাঁর কাছে গিয়ে নিচু গলায় জানায়—তার পাঁচ ’শ পেসো দরকার।
‘তুমি কিভাবে টাকাটা তুলবে’ জনাব এরবের্ত ওকে জিজ্ঞেস করলেন।
‘প্রতি জনে পাঁচ পেসো।’
‘ভাবো একবার,’ জনাব এরবের্ত বললেন। শ’খানেক পুরুষ মানুষ লাগবে।’
‘এটা কোনো ব্যাপার নয়,’ মেয়েটি বলে। ‘আমি যদি সব টাকা পেয়ে যাই, তবে ওরাই হবে আমার জীবনের শেষ একশত পুরুষ।’
তিনি মেয়েটির দিকে তাকালেন। একদম অল্প বয়সি। হাড় জিরজিরে, তবে চোখে কিছু একটা আছে।
‘ঠিক আছে,’ জনাব এরবের্ত বললেন। ‘তোমার কামরায় যাও, আমি প্রতি জনে পাঁচ পেসো করে তোমায় খদ্দের পাঠাচ্ছি।’
জনাব এরবের্ত রাস্তার দিকে দরজায় গিয়ে ছোট ঘণ্টা বাজালেন।
সকাল সাতটায় তোবিয়াস দেখে, কাতারিনোর মদের দোকান খোলা। সব বাতি নেভানো। অর্ধঘুমে আর বিয়ারে চুমুক দিয়ে, জনাব এরবের্ত মেয়েটার কক্ষে পুরুষদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করছেন।
তোবিয়াসও গিয়েছিল। মেয়েটি তাকে চিনে ফেলে। তার কামরায় ওকে দেখে অবাক হলো বেশ।
‘শেষ পর্যন্ত, তুমিও?’
‘ওরা আমাকে ভিতরে আসতে বলেছে,’ তোবিয়াস বলে। ‘আমাকে পাঁচ পেসো দিয়ে বলেছে বেশি সময় না নিতে।’
মেয়েটি ভেজা চাদর উঠিয়ে নেয়। তোবিয়াসকে বলে, চাদরের অন্য প্রান্ত ধরতে। চাদরটা ক্যানভাসের মতো ভারী। ওরা চাদরটা পেঁচিয়ে নিয়ে ঝাঁকি মারতে থাকে, যতক্ষণ না পর্যন্ত কুঁচকে যাওয়া চাদরটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। এরপর তক্তপোষটা উল্টিয়ে ভেজা দিকটা নিচের দিকে দেয়। তোবিয়াস বিছানায় মেয়েটিকে ওর সাধ্যমতো সেরাটা করার চেষ্টা করে। যাবার আগে ও বিছানার পাশে উঁচু হয়ে ঢাঁই করে রাখা টাকার ওপর পাঁচ পেসো রেখে যায়।
‘যদি পারেন সবাইকে পাঠান,’ জনাব এরবের্ত তাকে পরামর্শ দেয়। ‘চলুন দেখি, আমরা দুপুরের আগেই এটা সেরে ফেলতে পারি কিনা।’
মেয়েটি দরোজা ফাঁক করে আর এক গ্লাস ঠান্ডা বিয়ার চাইলো। তখনও কিছু পুরুষ মানুষ অপেক্ষা করছে।
‘আর কজন আছে?’ সে জানতে চায়।
‘ছেষট্টি,’ জনাব এরবের্ত জানালেন।
বুড়ো খাকব জনাব এরবের্তকে সারাটা দিন চেকারবোর্ড নিয়ে অনুসরণ করে। রাত নামার পর তার সময় এলো। সে তার সমস্যা তুলে ধরে। জনাব এরবের্ত সব শুনে তার সাথে চেকারবোর্ড খেলার চ্যালেঞ্জটা গ্রহণ করলেন। রাস্তার মাঝখানে দুটো চেয়ার আর একটা বড় টেবিলের মাথায় ছোট টেবিল রাখা হলো। বুড়ো খাকব তার প্রথম চালটা চালে। খেলায় সে হেরে যায়।
‘চল্লিশ পেসো,’ জনাব এরবের্ত বললেন। ‘আমি তোমাকে দুইবার সুযোগ দেব।’
তিনি আবারও জিতলেন। তাঁর হাত চেকারগুলোকে প্রায় স্পর্শই করছে না। তিনি প্রতিপক্ষের চাল ধারণা করে চোখবেঁধে খেলতে লাগলেন আর জিততেও লাগলেন। দেখতে দেখেতে জনতা ক্লান্ত হয়ে পড়ল। একসময় বুড়ো খাকব হাল ছেড়ে দিয়ে বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেন— ততক্ষণে সে জনাব এরবের্তের কাছে পাঁচ হাজার বিয়াল্লিশ পেসো আর তেইশ সেন্টের দেনা হয়ে গেছে।
তবে বুড়ো, তার মুখভঙ্গি পরিবর্তন করেনি। সে তার পকেট থেকে একটুকরো কাগজ বের করে সব হিসাব নিকাশ টুকে নেয়। এরপর বোর্ডটা ভাঁজ করে, চেকারগুলো বাক্সে ভরে, ওগুলো পত্রিকায় মুড়ে নিলো।
‘আপনি যা ইচ্ছা আমার সাথে করবেন,’ সে বলে, ‘কিন্তু আমাকে এগুলো নিতে দিন। আমি প্রতীজ্ঞা করছি জীবনের বাকি দিনগুলো আপনার পাওনা টাকা উপার্জনের জন্য ব্যয় করব।’
জনাব এরবের্ত ঘড়ির দিকে তাকান।
‘আমি সত্যিই খুব দুঃখিত,’ তিনি বললেন। ‘কুড়ি মিনিটের মধ্যেই আপনার সময় শেষ হয়ে যাবে।’ তিনি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর কোনো সমাধান না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে বললেন। আপনার কি দেবার মতো কিছুই নেই?’
‘মানসম্মানটুকু আছে।’
‘আমি বোঝাতে চাচ্ছি,’ জনাব এরবের্ত ব্যাখ্যা করলেন, ‘দেনার দায় থেকে মুক্তি পাবার জন্য, কিছু আছে কী?’
‘আমার বাড়ি,’ বুড়ো খাকব করুণ গলায় বলে। ‘এটার দাম হয়ত তেমন কিছু নয়, তবে একটা বাড়ি বটে।’
এভাবেই জনাব এরবের্ত বুড়ো খাকবের বাড়ি দখল করে নিলেন। তিনি অন্যান্যরা যারা দেনা পরিশোধ করতে পারেনি, তাদেরটাও দখল করে নেন। কিন্তু, এসবের পাশাপাশি তিনি সপ্তাহব্যাপী সঙ্গীত, আতশবাজি, বাজিকরের খেলা আয়োজনের ঘোষণা দেন। উৎসবের পুরো দায় দায়িত্ব তাঁর।
অবিস্মরণীয় একটা সপ্তাহ। জনাব এরবের্ত জানালেন, এ শহরের জন্য এক অলৌকিক সৌভাগ্য অপেক্ষা করছে। বিষয়টা খোলাসা করতে তিনি শহরের ভবিষ্যতের একটা চিত্র আঁকলেন। দারুণ ঝকঝকে তকতকে কাচের দালানের মাথায় নৃত্যশালা থাকবে। তিনি চিত্রটা জনতাকে দেখালেন। ওরা বিষ্ময়াভিভূত হয়ে দেখে। জনাব এরবের্তের রঙিন চিত্রে—ওরা নিজেদের পথচারি হিসেবে দেখতে পায়, কিন্তু সেখানে এতো ভালো পোশাক পরে আছে যে নিজেদের ওরা চিনতে পর্যন্ত পারলো না। ওরা সেদিন এতো বেশি হেসেছিল যে, অক্টোবরে এসে কাঁদতে হলো। জনাব এরবের্তের ছোট্ট ঘণ্টা বাজানো, আর পার্টি খতম হয়েছে—এ কথাটি জানার আগ পর্যন্ত ওরা আশার ধোঁয়াশায় বাস করতে লাগল। আর জনাব এরবের্ত তখনই বিশ্রামে গেলেন।
‘আপনি যে জীবন যাপন করতেন, সেখান থেকে মৃত্যু বরণ করতে চলেছেন,’ বুড়ো খাকব বলে।
‘আমি এতো অর্থকড়ি পেয়েছি যে, আমার মরে যাবার কোনো কারণ নেই,’ জনাব এরবের্ত বলেন।
তিনি বিছানায় ঘুম দিলেন। সিংহের মতো নাক ডেকে সারাটা দিন ঘুমালেন। এতোগুলো দিন ঘুমিয়ে পার করলেন যে লোকজন তাঁর জন্য অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। ওদের কাঁকড়া খাওয়ার জন্য মাটি খুঁড়তে হলো। কাতারিনোর নতুন রেকর্ডটা এতো পুরাতন হয়ে গেছে যে, কেউ আর ওগুলো শুনতে চাইছে না, আর তাই তাকে তার ব্যবসাটা বন্ধ করে বাড়িতে তালা ঝুলাতে হলো।
ওরা ভেবেছে—বৃষ্টি হতে যাচ্ছে, কারণ সাগরের ওপর কালো মেঘ ঝুলে আছে। কিন্তু মেঘ অল্প কিছুক্ষণ ভেসে, সাগরে নেমে জলে ডুবে গেল। শুধুমাত্র তারারা উপরে থেকে গেল। কিছুক্ষণ পরেই, শহরে মৃদুমন্দ বাতাস অন্য কোথাও থেকে গোলাপের সুরভি বয়ে নিয়ে এলো
জনাব এরবের্তের ঘুমের অতলে হারিয়ে যাবার অনেক দিন পর, পাদ্রি বুড়ো খাকবের দরোজায় কড়া নাড়লেন। বাড়িটা ভিতর থেকে তালা দেয়া।
‘আমি তাঁকে একটা কথা বলতে চাই,’ পাদ্রি বলেন।
‘আপনাকে অপেক্ষা করতে হবে,’ বুড়ো খাকব বলে।
‘আমার হাতে বেশি সময় নেই।’
‘বসুন, পাদ্রে, অপেক্ষা করুন,’ বুড়ো খাকব আবারো বলে। ‘আর অপেক্ষার সময় টুকুতে, দয়া করে আমার সাথে কথা বলুন। আমি অনেক আগে থেকে জানি এ পৃথিবীতে কী ঘটতে যাচ্ছে।’
‘লোকজন সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে,’ পাদ্রি বললেন। ‘আর খুব বেশি সময় লাগবে না, শহরটা ঠিক আগের অবস্থায় ফিরে যেতে।’
‘যখন সাগর গোলাপের গন্ধ ছড়াবে ওরা আবার ফিরে আসবে,’ বুড়ো খাকব বলল।
‘কিন্তু, এরই মধ্যে আমরা যারা বেঁচে থাকার জন্য কিছু নিয়ে থাকতে চাই, তাদের জন্য কিছু মায়াজাল তৈরী করতে হবে,’ ধর্মপ্রচারক বললেন। ‘আমাদের একটা গির্জা বানানো জরুরী হয়ে পড়েছে।’
‘এজন্যই আপনি জনাব এরবের্তকে দেখতে এসেছেন,’ বুড়া খাকব বলল।
‘ঠিক তাই,’ পাদ্রি বললেন। ‘বিদেশীরা অনেক দানবীর হয়।’
‘তাহলে একটু অপেক্ষা করুন, পাদ্রে,’ বুড়া খাকব বলে। ‘তিনি হয়ত এখুনি ঘুম থেকে উঠেছেন।’
বুড়ো খাকব আর পাদ্রি চেকারস খেললো। দীর্ঘ আর কষ্টসাধ্য খেলাটা কয়েক দিন পর্যন্ত চলে। কিন্তু, জনাব এরবের্ত ঘুম থেকে জেগে উঠছেন না।
পাদ্রি নিজেই হতাশ হয়ে গেছেন। এ শহরে একটা গির্জা তৈরীর, তহবিল গঠনের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। তামার থালা হাতে সবার কাছে গেছেন। কিন্তু খুব বেশি কিছু পাননি। তিনি বুঝতে পারলেন, এ শহরে তিনি গির্জা দাঁড় করাতে পারবেন না। এখানকার লোকজনের দান দক্ষিণা করার মতো অবস্থায় নেই। তাই তিনি কাপড় চোপড় একটা সুটকেসে গুছিয়ে, অন্যটিতে সংগৃহিত কিঞ্চিত টাকাপয়সা ভরে নিয়ে, শহরবাসীকে চিরতরে বিদায় জানালেন।
‘গন্ধটা আর ফিরে আসবে না,’ তিনি ওদের বললেন, ‘যারা তাঁকে ফেরানোর চেষ্টা করেছিল। তোমাদের শহরটা সে এক ভয়াবহ পাপের সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। তোমাদের তা মোকাবেলা করতে হবে।’
জনাব এরবের্ত জেগে উঠলেন। এখন শহরটা তেমনই আছে, যেমনটি অনেক আগে ছিল। বৃষ্টিতে আবর্জনায় পচন ধরেছে, জনতা রাস্তা ছেড়ে চলে গেছে আর মাটি আবারো শুষ্ক আর ইটের মতো কঠিন হয়ে গেছে।
‘আমি দীর্ঘ সময় ঘুমিয়ে ছিলাম,’ জনাব এরবের্ত হাই তুলতে তুলতে বলেন।
‘কয়েক ’শ বছর,’ বুড়ো খাকব বলে।
‘মনে হচ্ছে, আমি খিদেয় মরে যাবো।’
‘এ শহরের সকলেই না খেয়ে মারা যাবে,’ বুড়ো খাকব বলে। ‘সাগরের তীরে গিয়ে, কাঁকড়া ধরার জন্য গর্ত খোঁড়া ছাড়া আর কোনো কাজ নেই তাদের।’
তোবিয়াস দেখে, জনাব এরবের্ত বালিতে আঁচড় কাটছেন, মুখে ফেনা উঠছে। আর সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, ধনী লোকেরা যখন অনাহারে থাকে, তাদেরকেও অনেকটা গরিবদের মতো দেখায়। জনাব এরবের্ত খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত কাঁকড়া পেলেন না। রাত নামার পর তিনি তোবিয়াসকে বললেন, ‘চলো সাগরের গভীরে কোনো খাবার আছে কি না তা খোঁজ করে দেখি।
‘শুনুন, জনাব এরবের্ত’ তোবিয়াস সতর্ক করে দেয়, ‘একমাত্র মৃতরাই জানে সাগরের গভীরে কী আছে।’
‘বিজ্ঞানিরাও জানেন,’ জনাব এরবের্ত বললেন। ‘সাগরের নিচে কচ্ছপ দেহে তেতো মাংস নিয়ে ডুব দিয়ে আছে। তোমার কাপড় পাল্টে নাও, চলো আমরা দুজনেই সেখানে যাই।’
ওরা সাগরে গেল। প্রথমে সোজা সাঁতরে সাগরের গভীরে নেমে গেল, যেখানে সূর্যের আলো থেমে গেছে। সাগরের নিজস্ব আলোয়, তলদেশ দৃশ্যমান হতে থাকল। ওরা একটা ডুবন্ত গ্রাম পার হয়ে গেল—যেখানে ঘোড়ার পিঠে করে নর-নারী গানের কিয়স্ক থেকে ফিরে আসছে। সাগরতলে চমৎকার একটা দিন। এখানকার বাড়িঘরের উঠোনে উজ্জ্বল বর্ণের ফুল শোভা পাচ্ছে।
‘সকাল এগারোটায় রোববারটা ডুবে গেল,’ জনাব এরবের্ত বললেন। ‘অবশ্যই কোনো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটেছে।’
তোবিয়াস গ্রামের দিকে ফিরে। কিন্তু, জনাব এরবের্ত তাকে আরো নিচে নামার সংকেত দিলেন।
‘এখানে গোলাপ আছে,’ তোবিয়াস বলে। ‘আমি চাই ক্লোতিলদে জানুক সাগরের সেই গন্ধের উৎস কি।’
‘তুমি অন্য সময়ে এখানে ফিরে আসতে পারো,’ জনাব এরবের্ত বললেন। ‘এ মুহূর্তে আমি খিদেয় মরে যাচ্ছি।’
তিনি অক্টোপাসের মতো ধীরে ধীরে হাত নেড়ে নিচের দিকে গেলেন। তোবিয়াস, চেষ্টা করছিল, যাতে ওর দৃষ্টি তাঁকে না হারায়। ওর মনে হচ্ছিল—ধনী লোকেরা এভাবেই সাতার কাঁটে। অল্প অল্প করে, ওরা সাধারণ সাগর থেকে, মৃত সাগরে প্রবেশ করছিল।
এখানে এতো অসংখ্য মৃতদেহ ভাসছিল যে, তোবিয়াসের মনে হলো পৃথিবীতে এতো লোক দেখেনি সে। ওর থমথমে মুখের উপরে ভাসছিল ওদের ভুলে যাওয়া আত্মার চেহারা।
‘ওরা অনেক অনেক আগে মরেছে,’ জনাব এরবের্ত বললেন। ‘ওদের শতাব্দীর পর শতাব্দী লেগেছে, বিশ্রামের এই অবস্থায় আসতে।’
তোবিয়াস দেখে, জনাব এরবের্ত বালিতে আঁচড় কাটছেন, মুখে ফেনা উঠছে। আর সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করে, ধনী লোকেরা যখন অনাহারে থাকে, তাদেরকেও অনেকটা গরিবদের মতো দেখায়। জনাব এরবের্ত খাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত কাঁকড়া পেলেন না। রাত নামার পর তিনি তোবিয়াসকে বললেন, ‘চলো সাগরের গভীরে কোনো খাবার আছে কি না তা খোঁজ করে দেখি
ইদানীং যারা মরেছে তাদের সাগরের জলে ডুবিয়ে দেয়া হয়েছে, জনাব এরবের্ত থামলেন। তোবিয়াস তাকে মুহূর্তেই ধরে ফেলল। ওদের সামনে দিয়ে এক অল্প বয়সি নারীর মৃতদেহ ভেসে গেল। সেই নারীর চোখ খোলা, ফুলের স্রোত তাকে অনুসরণ করছে।
জনাব এরবের্ত নিজের ঠোঁটের ওপর আঙুল চেপে রাখলেন। শেষ ফুলটা যাওয়া পর্যন্ত তিনি ওভাবেই থাকলেন।
‘আমার সারা জীবনে দেখা সবচেয়ে সুন্দরী নারী,’ তিনি বলেন।
‘উনি বুড়ো জ্যাকবের স্ত্রী,’ তোবিয়াস বলে। ‘উনি অবশ্যই খাকবের পনের বছরের ছোট। এই মৃতদেহটা তার, আমি নিশ্চিত।’
‘উনি অনেক পরিভ্রমণ করেছে,’ জনাব এরবের্ত বলেন। পৃথিবীর সব সাগরে পেছনে ফুল নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’
ওরা সাগরের তলদেশে পৌঁছালো। জনাব এরবের্ত তলদেশের মাটির ওপর কয়েকটি বাঁক নিলেন, যেগুলো দেখতে অনেকটা মসৃণ স্লেটের মতো। তোবিয়াস তাকে অনুসরণ করে। সাগরের গভীরতার আধো আলো আঁধারিতে অভ্যস্ত হয়ে গেলে ওরা দেখে অনেক কচ্ছপ সেখানে। সেগুলো সংখ্যায় হাজারে হাজারে, সাগরের তলদেশে চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে, এতোটা নিথর হয়ে পড়ে আছে যে, দেখে মনে হচ্ছে—ওগুলো যেন-বা কাচের বাক্সে সংরক্ষিত অবস্থায় আছে।
‘কচ্ছপগুলো বেঁচে আছে,’ জনাব এরবের্ত বললেন, ‘কিন্তু লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ঘুমিয়ে আছে।’
তোবিয়াস ঘুরে, আস্তে ছোঁয়া দিয়ে একটাকে উপরের দিকে ঠেলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ঘুমন্ত প্রাণীটা গুটিয়ে রাখা হাত পা ছেড়ে দিয়ে তরতরিয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। তোবিয়াস কচ্ছপটাকে যেতে দিলো। ও সাগরের উপরিভাগে উঠে, পুরো সাগরকে উল্টে দেখে।
‘সবকিছু স্বপ্নের মতোন,’ ও বলল।
‘তোমার নিজের ভালোর জন্য,’ জনাব এরবের্ত বললেন, ‘কাউকে এই জায়গা সম্পর্কে বোলো না। যদি লোকজনে এসব জিনিস দেখতে পায় কী কী বিশৃঙ্খলা হতে পারে তা কল্পনা করে দেখো দেখি।’
যখন ওরা গ্রামে ফিরে এলো, তখন প্রায় মধ্যরাত। ওরা ক্লেতিলেদকে পানি ফুটানোর জন্য ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলল। জনাব এরবের্ত কচ্ছপটা কেটে টুকরা টুকরা করলেন, আর প্রাণীটা ওদের তিনজনকে তাকে ধাওয়া করে এক মুহূর্তে হত্যা করতে দেখল। উঠোনে লাফিয়ে উঠল, যখন ওরা জীবটাকে কেটে ফালা ফালা করছিল। ওরা কচ্ছপের মাংস খেয়ে গেল, যতক্ষণ না পর্যন্ত ওদের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
‘ভালোই তো, তোবিয়াস,’ জনাব এরবের্ত তখন বললেন, ‘আমাদের বাস্তবতা মোকাবেলা করতে হবে।’
‘অবশ্যই।’
‘আর বাস্তবতা বলছে,’ জনাব এরবের্ত বলে চললেন, ‘সেই গোলাপের সুগন্ধ আর ফিরে আসবে না।’
‘ফিরে আসবে।’
‘ফিরে আসবে না।’ ক্লোতিলদে ওদের কথায় নাক গলায় ‘কারণ এটা সত্যিই কখনো ফিরে আসে না। আর আপনিই তিনি, যে এ শহরের সবাইকে কাজ করিয়েছেন।’
‘তুমি নিজেও গোলাপের গন্ধ পেয়েছো,’ তোবিয়াস বলে।
‘সে রাতে আমি কিছুটা হতবুদ্ধি হয়েছিলাম,’ ক্লোতিলদে বলে। ‘তবে এখন, আমি ঠিক নিশ্চিত নই যে সাগরে কিছু একটা হয়েছিল।’
‘সুতরাং, আমি আমার পথে পা বাড়াবো,’ জনাব এরবের্ত বললেন। ‘আর,’ তিনি যোগ করলেন, তোমাদের দুজনকে এই শহর ছাড়তে হবে। এখানে মরে পড়ে থাকার চেয়ে পৃথিবীতে অনেক কিছু করার আছে।’
তিনি চলে গেলেন। তোবিয়াস উঠোনে বসে আকাশে ঝুলে থাকা তারাদের গুণতে থাকে। সে আবিষ্কার করে, গত ডিসেম্বরের চেয়ে তিনটি তারা বেশি। ক্লোতিলদে তাকে শোবার ঘর থেকে ডাকে। কিন্তু সে তার ডাকে সাড়া দেয় না।
‘এখানে এসো, কাঠের পুতুল,’ ক্লোতিলদে গো ধরলো। ‘অনেক বছর হয়ে গেছে আমরা খরগোসের মতো প্রেম করি না।’
তোবিয়াস দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে। শেষ পর্যন্ত যখন সে ঘরের ভিতরে গেল, ক্লোতিলদে ঘুমিয়ে পড়েছে। সে তাকে একটু জাগিয়ে কেঁচোর মতো জড়িয়ে ধরে।
‘তুমি বোকার মতো করছো,’ ক্লোতিলদে অসন্তুষ্ট হয়ে বলে। ‘অন্যকিছু ভাবো।’
‘আমি অন্যকিছু ভাবছি।’
ক্লোতিলদে জানতে চায় সেটা কি। সে তাকে বলে—তেমন কিছু, যেটা শুনে ক্লোতিলদে সে বিষয়ে আর কোনো কথা বলবে না। ক্লোতিলদে প্রতীজ্ঞা করেছে।
‘সাগরের তলদেশে একটা গ্রাম আছে,’ তোবিয়াস বলে, ‘সেখানে সাদা বাড়ি আছে, যে বাড়ির উঠোনে লক্ষ লক্ষ ফুল ফুটে আছে।’
ক্লোতিলদের মাথায় হাত রাখে।
‘ওহ্, তোবিয়াস,’ ও বিস্ময়ে ফেটে পড়ে। ‘ওহ্, তোবিয়াস, ঈশ্বরের ভালোবাসার জন্য, ওসব দিয়ে জীবনটা আবার শুরু করো না।’
তোবিয়াস আর কিছু বলে না। ও বিছানার শেষ প্রান্তে গড়িয়ে গিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে। তবে, ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত ঘুমাতে পারে না। যখন বাতাসটা বদলে গেল, আর কাঁকড়াগুলো ওকে শান্তিতে থাকার জন্য ছেড়ে চলে গেল—তখনই ও ঘুমিয়ে পড়ে।
প্রকাশকাল ১৯৬১