Author Picture

মাহমুদ দারবিশের ডায়েরি ‘নদী মরে যায় পিপাসায়’— (পর্ব: ৩)

এনামূল হক পলাশ

শত্রু

এক মাস আগে আমি সেখানে ছিলাম। এক বছর আগেও আমি সেখানে ছিলাম। সবসময় আমি সেখানে ছিলাম যেন আমি অন্য কোথাও ছিলাম না। এখন যা ঘটছে তা ১৯৮২ সালেও আমাদের সাথে ঘটেছিল। যে নরকের মুখোমুখি হয়েছিলাম তার বিরুদ্ধে আমরা অবরুদ্ধ হয়ে খুন হয়েছিলাম আর যুদ্ধ করেছিলাম। হতাহতরা বা শহীদরা একজন আরেকজনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। তাদের প্রত্যেকের শরীর আর বৈশিষ্ট্য আলাদা। তাদের চোখ, নাম আর বয়স ভিন্ন ভিন্ন। খুনিরা দেখতে সবাই একই রকম । তারা এক হয়ে বিভিন্ন ধাতব অংশ ছড়িয়ে দিচ্ছে, ইলেকট্রনিক বোতাম টিপে হত্যা করছে আর বিলুপ্ত করে দিচ্ছে । সে আমাদের দেখে কিন্তু আমরা তাকে দেখতে পাই না, কারণ সে ভূত নয়। সে একটি ইস্পাতের মুখোশের ধারণা – সে অবয়বহীন, চক্ষুহীন, বয়সহীন আর নামহীন। তার একটিই নাম আছে: শত্রু।

 

নিরো

লেবানন জ্বলতে দেখে নিরোর মনে কী চলছে? তার চোখ উচ্ছ্বসিত আর পায়চারি করছে যেন কেউ বিয়ের অনুষ্ঠানে নাচছে: আমি ভাল করেই জানি, এই পাগলামি আমার নিজস্ব, তাই তাদেরকে আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে সবকিছু আলোকিত করতে দাও। শিশুদের শিখতে হবে তাদের আচরণ আর আমার সুর বাজানোর সময় চিৎকার চেচামেচি বন্ধ করতে হবে!

ইরাক জ্বলতে দেখে নিরোর মনে কী চলছে? এটা কি তাকে তৃপ্ত করে যে সে জঙ্গলি ইতিহাসের স্মৃতি জাগিয়ে হামুরাব্বি আর গিলগামেশ আর আবু নুওয়াসের শত্রু হিসাবে তার নামটি বাচিয়ে রাখে: আমার আইন সমস্ত আইনের মা, আমার ক্ষেতে অনন্তকালের ফুল ফুটেছে আর কবিতা -ওটার মানে কি?

ফিলিস্তিনকে পুড়তে দেখে নিরোর মনে কী চলে? এটা কি তাকে আনন্দিত করে যে তার নাম একজন আল্লাহর দূত হিসাবে তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে যা আগে কেউ বিশ্বাস করেনি? হত্যার একজন দূত যাকে আল্লাহ স্বর্গীয় বইয়ের অগণিত ভুল সংশোধনের দায়িত্ব দিয়েছেন: আমিও আল্লাহর মুখপত্র!

পৃথিবীকে জ্বলতে দেখে নিরোর মনে কী চলে? আমি শেষ বিচারের দিনের মালিক। তারপর সে ক্যামেরা বন্ধ করার নির্দেশ দেয়, কারণ সে চায় না কেউ দেখুক এই দীর্ঘ আমেরিকান সিনেমার শেষে আগুনের উপর তার আঙুল!

 

অরণ্য

অরণ্যে আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না, যদিও অরণ্য পশুর ক্ষুধা থেকে মুক্ত ছিল আর সেনাবাহিনী পরাজিত বা বিজয়ী হয়েছিল – এর মধ্যে কোনও পার্থক্য নেই – অজ্ঞাত মৃতদের ছিন্ন ভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ব্যারাকে অথবা সিংহাসনে ফিরে এসেছিলো আর আমি অরণ্যে আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না, যদিও বাতাস তাকে আমার কাছে নিয়ে এসেছিলো আর আমাকে বলেছিলো: ‘এটি তোমার কণ্ঠস্বর।’  আমি তা শুনতে পেলাম না।

অরণ্যে আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না, যদিও নেকড়েটি তার পিছনের পায়ে দাঁড়িয়ে আমাকে উচ্চস্বরে জানিয়েছিলো: আমি তোমার কণ্ঠস্বর শুনতে পাই, তাই আমাকে তোমার আদেশ জানাও!’ আর আমি বললাম: অরণ্যের ভেতরে অরণ্য পিতা নেকড়ে নেই,  হে আমার পুত্র!’

অরণ্য আমার থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমি আমার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম না। তারপর আমি অরণ্যের নীরবতা থেকে মুক্ত হলাম।

 

ঘুঘু

শহরের ধ্বংসস্তূপের উপরে ধূসর আর খন্ড খন্ড নীলে চক্কর দিয়ে আমাদের মনে করিয়ে দেয় এখনও সৌন্দর্যের অস্তিত্ব আছে। যেহেতু এটি আমাদের প্রতিশ্রুতি দেয় সেহেতু অস্তিত্বহীনতা আমাদের সম্পূর্ণ বোকা বানাচ্ছে না ।  তাই আমরা ভাবতে চাই, কীভাবে অস্তিত্ব শূন্যতা থেকে আলাদা হয়ে উন্মোচিত হয়। যুদ্ধে কেউ ব্যথা অনুভব করলে আমরা মনে করিনা সে মারা গেছে। মৃত্যুর পূর্ব মুহুর্তের যন্ত্রণা যেন যুদ্ধের এক আশীর্বাদ। তিন মাস পর পর মৃত্যুদন্ডের স্থগিতাদেশ আসে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ভুলে অস্তিত্বহীনতায় উড়ন্ত ঘুঘুদের চক্করে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় সে। আমি লেবাননের আকাশে অনেক ঘুঘুকে পরম শূন্যতা থেকে উত্থিত ধোঁয়ার সাথে খেলতে দেখি।

 

বিধ্বস্ত বাড়ি

মিনিটের মধ্যে একটি বাড়ির পুরো জীবন শেষ হয়ে যায়। বাসিন্দাহীন বা খালি হলেও বিধ্বস্ত বাড়িটিও যেন এক গণহত্যা। এটি নির্মাণ সামগ্রীর একটি গণকবর, কিংবা এটি যুদ্ধের সময় গুরুত্বহীন একটি কবিতা।

বিধ্বস্ত বাড়িটি যেন সম্পর্ক আর অনুভূতির এক বিচ্ছেদ। তারপর দুঃখের প্রয়োজনীয় অলঙ্কার নির্দেশিত হয় জীবনের লক্ষ্যকে দেখিয়ে দিতে। প্রতিটি বস্তুর মধ্যে আছে এক গোপন বেদনা – আঙ্গুলের স্মৃতি,  নিজস্ব গন্ধ আর একটি চিত্র। আর বাড়িগুলিকে তাদের বাসিন্দাদের মতোই হত্যা করা হয়। আর নির্মাণ সামগ্রীর স্মৃতিকে হত্যা করা হয়: পাথর, কাঠ, কাচ, লোহা, সিমেন্ট ভাঙা টুকরোয় ছড়িয়ে পড়ে যেন তারা জীবিত প্রাণী। তুলা, সিল্ক, লিনেন, কাগজপত্র আর বইগুলো নিষিদ্ধ শব্দের মত টুকরো টুকরো করা হয়। প্লেট, চামচ, খেলনা, রেকর্ড, ট্যাপ, পাইপ, দরজার হাতল, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, ফুলদানি, জলপাইয়ের বয়াম আর আচার এমনকি টিনজাত খাবার সবই তাদের মালিকের মতো ভেঙে যায়। লবণ, চিনি, মশলা, ম্যাচের বাক্স, বড়ি, গর্ভনিরোধক, অ্যান্টিডিপ্রেসেন্টস, রসুনের স্ট্রিং, পেঁয়াজ, টমেটো, শুকনো ওকড়া, চাল আর মসুর ডাল তাদের মালিকদের মতোই টুকরো টুকরো করা হয়। ভাড়ার চুক্তি, বিয়ের কাগজপত্র, জন্ম সনদ, পানি ও বিদ্যুৎ বিল, পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, প্রেমপত্র এসব তাদের মালিকের হৃদয়ের মতো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে। ফটোগ্রাফ, টুথব্রাশ, চিরুনি, প্রসাধনী, জুতা, আন্ডারওয়্যার, চাদর, তোয়ালে সব দিকে উড়ে বেড়ায় আর পারিবারিক গোপনীয়তা প্রকাশ্যে চলে আসে। এই সমস্ত জিনিসগুলি সেই লোকেদের স্মৃতি যাদের কাছে আর সেগুলো নেই। সেগুলো সেই সমস্ত বস্তুর স্মৃতি যা মানুষের কাছে আর নেই যা এক মিনিটের মধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাদের ব্যবহারের জিনিসগুলি আমাদের মতো মরে, কিন্তু সেগুলি আমাদের সাথে সমাহিত হয় না।

আরো পড়তে পারেন

চোখ মানুষের জীবনের গল্প ধারণ করে: বেরিশা আলিসদোত্তি

দক্ষ ছায়াপুতুল নাচিয়ের জন্য অন্ধকারই প্রধান প্রেক্ষাপট। আলো সেখানে এক ‘ভাইটাল নেগেটিভ’। আলবেনিয়ান নারীবাদী চিত্রশিল্পী ফিতোরে বেরিশা আলিসদোত্তি তেমনি। নিজে নারী স্বাধীনতা ভোগ করলেও নির্যাতনের অন্ধকারে বন্দি নারীই তার শিল্পের বিষয়বস্তু। যদিও নিঃসঙ্গতার ‘মুদ্রাদোষ’ তার ছিল; তবুও সমাজের চোখরাঙানিকে অগ্রাহ্য করে নির্মাণ করে যাচ্ছেন অন্য এক সাঁকো। যেন প্রতিবাদের ‘এন্টিবডি’ ছড়িয়ে দিচ্ছেন সমাজের শিরায়। আর….

তরুন ইউসুফের একগুচ্ছ কবিতা

বহ্ন্যুৎসব কত কিছু পুড়ল! গাড়ি পুড়ল বাড়ি পুড়ল দম্ভের দালান পুড়ে ক্ষার জলপাই সবুজ ট্যাংক নামল পুড়ল বই গল্প রূপকথার বেলুন হাতে পুড়তে পুড়তে ফানুস হয়ে উড়ে গেল বালক মায়ের আঁচল পুড়ল পুড়ল বুকের কাছের লোক যুবকের বুক পোড়াতে পোড়াতে পুড়ে গেল বন্দুক, থানার সেপাই কারো কারো স্বপ্ন পুড়ল আমিও পোড়ার গন্ধ পাই- আমার পুড়ল….

মুখোমুখি: আন্দ্রেজ আল-আসাদি

১৯৯৭ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করা আন্দ্রেজ আল-আসাদি বর্তমান সময়ে মেসিডোনিয়ান ভাষায় লেখালেখি করা প্রধানতম তরুণ কবিদের অন্যতম। তার বহুসাংস্কৃতিক পটভূমি এবং তার ও অন্যান্য সমসাময়িক মেসিডোনিয়ান কবিদের কাজকে অনুপ্রাণিত করার প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন ব্রিটিশ-আমেরিকান সাহিত্যিক অনুবাদক পিটার কনস্টানটাইনের সাথে। ওয়ার্ল্ড লিটারেচার টুডে কর্তৃক প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদ্দিন আপনার জন্ম লন্ডনে, আপনার….

error: Content is protected !!