Author Picture

আজাদুর রহমান-এর একগুচ্ছ কবিতা

আজাদুর রহমান

বাবা

আপনার ব্যর্থ শরীর জানত
নিরাময় উড়ে গেছে আসমানে,
আপনার মৃত্যু হবে।
শেষবেলায় আপনি বড় নিঃস্ব,
ঈশ্বরের মত নিদারুন,
একমাত্র একা।
সেকারনেই আপনি লুকিয়ে লুকিয়ে
ভেন্টোলিন সিরাপ খেতেন,
অ্যাসমা’র বড়ি গিলে সারা রাত কাঁশতেন।
আপনার কফ গলানো কাঁশির শব্দে
কোন কোন রাতে আমাদের কাঁচা ঘুম
ছিঁড়ে যেত, আমরা বিরক্ত হতাম। তারপর,
আপনার জবুথবু মুখের দিকে তাকাতে তাকাতে
আমাদের ভ্রুগুলো একদা কুঁচকে যেত।
আমরা পাশ ফিরে শুয়ে থাকতাম!
কেউ কোন কথা বলতাম না,
যেন আর মাত্র তো ক’টা দিন! এরপর আমরা,
সকলে আরাম করে ঘুমোতে পারব।
আপনি, শুধু আপনিই জানতেন,
আপনি মারা যাবেন।
আকাশের দুর্বল তারাদের মত
টুপ করে পৃথিবী থেকে খসে পড়বেন।
সে কারণেই আপনি বালিশের নিচে
মারনাস্ত্রের সতর্কতায় ইনহেলার রাখতেন।
আমরা কেউ ই আপনাকে পাত্তা দেই নি
অথচ আপনি তখনও মারা যাচ্ছিলেন।

 

শস্যের জন্য, ফুলের জন্য

আমাকে নিজের গ্রামেই যেতে হবে—
এমন কোন কথা নেই
গ্রাম পেলেই আমি
হুবহু ঢুকে যাচ্ছি এখন,
দ্রব্যগুনে ভিজে থাকা মাটি বেয়ে
আমার বাবা যেমন নেমে যেতেন
শ্যামল গাছেদের গায়ে হাত বোলাতেন
তেমন কৃষিজীবি মনের আশায়
নরম জলের কাছে বসে পড়ছি।
দুপুরের ধ্যানীবটের গাঢ় মক্তবে
নিভে থাকা স্মৃতিচন্দন কিংবা
সাতসকালের ঘ্রাণ-ফসল ফেলে
বৃদ্ধের অপ্রয়োজনীয় ইচ্ছে যেমন
একলা উড়ে যায়, তেমন করে
ভক্ত হচ্ছে এ হৃদয় এখন, ফুলের জন্য
শস্যের জন্য, চারদিক থেকে
নীরবতা নেমে আসছে-সব গ্রামে।

 

বাবা

আমি মারা গেছি-এরকম একটা ফালতু সংবাদ
পথে পথে প্রচার হলে আমার চেয়ে বেশি
আর কেউ লজ্জিত হবে না,
বাবা বেঁচে থাকলে অবশ্য অন্য কথা ছিল,
তিনি মুখে চো চো শব্দ তুলে নিশ্চুপ হয়ে যেতেন,
তার চোখ থাকত না, তিনি অন্ধ হতেন,
পৃথিবীর সমস্ত ভার নিয়ে তিনি পাথর হয়ে যেতেন।

 

অন্যকেউ

অফিসে যেতে যেতে
সংসার চালাতে চালাতে
বাজার করতে করতে
আপনি একদিন আপনাকে হারিয়ে ফেলবেন।
দেখবেন, আপনি আসলে আপনি না!
আপনার বদলে অন্যকেউ দাঁড়িয়ে আছে,
যিনি কি না আপনার হ’য়ে অফিসের জন্য,
সংসারের জন্য, বাজারের জন্য ছুটছেন।
আপনি তখন সেই অন্যকাউকে কাপড় পরাবেন,
লাইনঅফিসে নিয়ে যাবেন, সংসারে খেতে দেবেন,
ঘুমুতে দেবেন।
এভাবে দিনের পর দিন আপনার মত অন্যকাউকে দিয়ে
এই সব করাতে করাতে,
একদা আপনার অভ্যেস হয়ে যাবে,
সবকিছু সবার কাছে তখন স্বাভাবিক মনে হবে।
তারপর কোন একদিন ঘুম ভেংগে গেলে দেখবেন,
উদোম শরীর, আপনার গ্রামের বিছানায়।
কোথাও কেউ নাই।
বুধবার বৃষ্টি হচ্ছে।
বাইরে শীতকাল।

 

অভ্যেস

গাছের প্রথম পাতাটি ঝরে যাবার সময়
তার শরীর কেঁপে ওঠে,
চোখে শোকের ছায়া পড়ে,
মরতে তার বড় ভয় করে তখন।
তারপর আজ কাল পড়শু,
যখন একের পর এক,
দুই থেকে চার, আট অথবা বত্রিশ,
এ ডাল, ও ডাল, ডাইনে বায়ে
সমস্ত ডাল থেকে টুপ টাপ করে
অনবরত পাতা খসে পড়তেই থাকে-
তখন অজস্র মৃত্যুর ভিতর থেকে থেকে,
একদিন
তার আর মরতে ভয় করে না ।
—মরতে মরতে মানুষের মত
তারও অভ্যেস হয়ে যায়।

আরো পড়তে পারেন

মাহমুদ দারবিশের ডায়েরি ‘নদী মরে যায় পিপাসায়’— (পর্ব: ৩)

শত্রু এক মাস আগে আমি সেখানে ছিলাম। এক বছর আগেও আমি সেখানে ছিলাম। সবসময় আমি সেখানে ছিলাম যেন আমি অন্য কোথাও ছিলাম না। এখন যা ঘটছে তা ১৯৮২ সালেও আমাদের সাথে ঘটেছিল। যে নরকের মুখোমুখি হয়েছিলাম তার বিরুদ্ধে আমরা অবরুদ্ধ হয়ে খুন হয়েছিলাম আর যুদ্ধ করেছিলাম। হতাহতরা বা শহীদরা একজন আরেকজনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। তাদের….

তরুন ইউসুফের একগুচ্ছ কবিতা

বহ্ন্যুৎসব কত কিছু পুড়ল! গাড়ি পুড়ল বাড়ি পুড়ল দম্ভের দালান পুড়ে ক্ষার জলপাই সবুজ ট্যাংক নামল পুড়ল বই গল্প রূপকথার বেলুন হাতে পুড়তে পুড়তে ফানুস হয়ে উড়ে গেল বালক মায়ের আঁচল পুড়ল পুড়ল বুকের কাছের লোক যুবকের বুক পোড়াতে পোড়াতে পুড়ে গেল বন্দুক, থানার সেপাই কারো কারো স্বপ্ন পুড়ল আমিও পোড়ার গন্ধ পাই- আমার পুড়ল….

মাহমুদ দারবিশের ডায়েরি ‘নদী মরে যায় পিপাসায়’— (পর্ব: ২)

মেয়েটি আর তার চিৎকার সমুদ্রতীরের মেয়েটি, যার একটি পরিবার আছে আর সেই পরিবারটির একটি বাড়িও আছে। বাড়িটির মধ্যে দুটি জানালা আর একটি দরজা আছে। সমুদ্রে একটি যুদ্ধজাহাজ মজার ছলে তীরে হাটাহাটি করতে থাকা লোকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে: চার, পাঁচ, সাত জন বালির উপর পড়ে যায়। একটি অস্পষ্ট ঐশ্বরিক হাতের সাহায্যে মেয়েটি কিছুক্ষণের জন্য কোন প্রকারে….

error: Content is protected !!