Author Picture

নীলুর প্রেমের দিন রাত্রি (পর্ব: ৩)

অনুপ মোস্তফা

পড়ুন— নীলুর প্রেমের দিন রাত্রি (পর্ব: ২)

৪.

আজ বিশ বছর পর দেখা হলো। অনেক অভিমান, অনেক কথা জমে জমে পাহাড় হয়েছে। নিভৃতচারী নীলুর সব কথা অনেক অপেক্ষার পর ক্লান্ত। কথা বলতে পারবে কিনা জানে না। যা জানার ইচ্ছা ছিল তা এখন আর জানতে ইচ্ছা করছে না। একবার মনে হচ্ছে দেখা না হলেই ভাল হতো। আরেকবার মন বলছে এতো দীর্ঘ অপেক্ষা কার জন্য তবে? একসাথে বসে পড়ার কথা মনে পড়ছে। দুপুরের রোদের কথা মনে পরছে। যে পথ মিলবে না মেনেও অপেক্ষা করে ছিলো। আকড়ে ধরে ছিলো। সেই পথ আপনা হতে এসেছে আজ। মিলবে কি মিলবে না তা জানে না, কিন্তু পথের দেখা তো পাওয়া হলো।

অনেক অপেক্ষার অন্ধকার রাত্রিরা আজ আলোয় উদ্ভাসিত। মন খারাপের কত দিন রাত্রি আজ কি পাবে জানে না, হারিয়েছে সব কত আগে, তাও উল্লাসিত। মনের এই অবস্থা ব্যখ্যাতীত। যে অনুভুতি হতে পারতো প্রথম পড়ার দিন। যৌবন তখন দীপ্যমান, প্রখর প্রেমে পড়ার বয়স ছিল সেই প্রথম দিন যে ময়ীকে দেখে প্রেমে পরেনি, তার জন্যেই এত দীর্ঘ অপেক্ষা। তার জন্যেই এই মধ্য বয়সে মনের মধ্যে কেমন করছে। মায়া কি একটুও কমেনি। অভিমান, অপেক্ষা, আত্মসমর্পন সব এক হয়ে মনের যে ভিন্ন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তা বোঝার আর বোঝানোর সাধ্য কারো নেই।

চুপচাপ কিছু সময় পার হয়েছে। ময়ীর বয়স বেড়েছে। চেহাড়ায় ভাঁজ অতি সূক্ষ্ম। কিন্তু ভালো লাগা কমেনি। সেই একই রকম ভালো লাগল।

— তুমি খুব বদলাওনি ময়ী। দেখতে ভালো লাগছে।

— তুমি কেমন আছ নীলু?

— চলে যাচ্ছে। একবারেই এসেছ বললে?

— হুম, তাই ভেবেছিলাম। মা অসুস্থ। বাবা মারা গেছেন চার বছর হলো। কিন্তু এখানে জব কি করব বুঝতে পারছি না। আরেকটা সিস্টেমে অভ্যস্ত হয়ে গেছি, এখানে নতুন করে এডাপ্ট করতে পারব কিনা জানি না। কনফিউজড।

— করপোরেট হসপিটালগুলোতে সিভি দাও। ওখানে কয়েকদিন করে দেখো।

— সেটাই ভাবছি। দুটো হাসপাতালের সাথে কথা হয়েছে।

— তোমার ভাই কোথায়?

— ও কানাডা। ঢাকায় এসে শুনলাম বিয়ে করোনি এখনো। আগে জানতাম সৃজার সাথে রিলেশন হয়েছে। বিয়ে করবে, এরকম কিছু। তোমার কিছু খবর পেতাম। এখানে যারা আছে তাদের সাথেও তোমার যোগাযোগ হয় না?

— হয়। অত বেশি না। সবাই নিজের জায়গায় ব্যস্ত।

— তোমার কথা বলো ময়ী।

— আমার কথা কি শুনবে? বলার মত কিছু নেই। আমার পোস্ট গ্রাজুয়েশন অনেক দেরি হয়েছে। এখান থেকে যাওয়ার পর পরই জয়ী হল। আমার মেয়ে । আই ডিডন্ট এনরোল্ড দেন । চাকরি করিনি তখন। মেয়ে নিয়েই ব্যস্ত ছিলাম।

আজ বিশ বছর পর দেখা হলো। অনেক অভিমান, অনেক কথা জমে জমে পাহাড় হয়েছে। নিভৃতচারী নীলুর সব কথা অনেক অপেক্ষার পর ক্লান্ত। কথা বলতে পারবে কিনা জানে না। যা জানার ইচ্ছা ছিল তা এখন আর জানতে ইচ্ছা করছে না। একবার মনে হচ্ছে দেখা না হলেই ভাল হতো। আরেকবার মন বলছে এতো দীর্ঘ অপেক্ষা কার জন্য তবে?

— তোমার মেয়ে অনেক বড় হয়ে গেছে?

— হুম, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হবে আগামী বছর।

— রায়হান কি করেছিলো?

— ও চাকরি পেয়েছিলো। পরে জিপি হয়েছে।

— তোমার সংসার?

— সব একবারেই শুনতে চাচ্ছ?

— তোমার ইচ্ছা ময়ী। বলতে না চাইলে থাক।

— রায়হানের সাথে আমার মিলবে না জানাই ছিল। বছর চারেক ছিলাম একসাথে। তারপর আলাদা থাকা শুরু করলাম। মেয়ে আর আমি। চাকরি আর মেয়ে সামলে আমি একা পারছিলাম না।

— তখন দেশে এসে পড়তে?

— মা গিয়েছিলো। চেষ্টা করেছিল মেয়ের সংসার ঠিক করার। কিন্তু যা হওয়ার নয়, তা হয়নি। মা আমাকে নিয়ে আসতে চেয়েছিলো। বলল, বেশি সময় নষ্ট হয়নি, চল আমার সাথে ওখানে গিয়ে শুরু করবি। আমার কাছে থাকবি, সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি বললাম, আমার এই পাঁচ বছর ফিরিয়ে দাও, তাহলে যাবো। তত দিনে পাঁচ ছয় বছর পার হয়েছে। আমি পালিয়ে থাকতেই চাইছিলাম। সবার কাছ থেকে। আসিনি। চাইছিলাম মা কষ্ট পাক। আমার হেরে যাওয়া দেখুক। আমার ভেঙ্গে যাওয়া দেখুক। মায়ের স্ট্যটাস, ইগো তার মেয়েকে পথে নামিয়ে দিয়েছে এটা মা উপলব্ধি করুক।

— তখন ডিভোর্স নিয়েছিলে?

— না। আরও বছর তিনেক রায়হানের সাথে টানাপোড়েন চললো। তারপর ডিভোর্স হলো। তখন ঢাকায় ফিরে আসলে আরো বেশি ডিপ্রেসসড হতাম। বন্ধুরা সব সেটেল্ড এন্ড হ্যপি। আমি ডিভোর্সি । আনহ্যাপি, প্রতারক একজন। তোমার কাছে তো প্রতারকই, তাই না? মেয়েকে নিয়ে, নিজেকে নিয়ে ক্যারিয়ার নিয়ে একাই যুদ্ধ করে গেলাম। মা’র সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলাম। মা এদেশ থেকে টাকা পাঠাতে চেয়েছিলো। বলেছিলো ডিগ্রীটা কর। আমি ফাইনেনসিয়াল সাপোর্ট দিচ্ছি। নিইনি। আমি আমার মত স্ট্রাগল করেছি। ওখানে একাই লড়েছি। প্রতিটি দিন প্রতিটি রাত্রি আমার কাছে অনেক বড় মনে হতো। পোস্ট গ্রাজুয়েশন হচ্ছিলো না। আরো ডিপ্রেসড হয়ে গেলাম। ওখানে জব করে মেয়েকে সামলে পড়ালেখা করা কতটা কঠিন যে এইসবের মধ্য দিয়ে যায় সে জানে। এমআরসিপি করেছি বেশিদিন হয়নি। বাবা মারা যাওয়ার সময় আসতে পারিনি।

— কেন?

— পরীক্ষা চলছিলো। এমনি এতো পিছিয়েছি যে আর পরীক্ষা না দেওয়ার সাহস করিনি। সেই যে বিকেলে তোমার রুম থেকে ছুটে বের হয়ে গেলাম, মনে হলো আমি ছুটেই চলেছি। ছুটেই চলেছি। আমার বিশ্রাম নেই। এমআরসিপি করার পর আর একটা ভালো জব পেয়ে মনে হয়েছিল এবার বিশ্রাম নিই। অনেক হয়েছে।

— ময়ী, আমি কখনো তো বলিনি তুমি প্রতারক।

— বলোনি। কিন্তু চোখের ভাষায় তো বহুবার বুঝিয়েছো। পরীক্ষার আগে এবং ইন্টার্নির পুরোটা সময় আমাদের দেখা তো হয়েছে। তোমার চোখের ঘৃণা আমাকে তোমার কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। আমার অবস্থাটা তুমি বুঝতে পারোনি। আমাকে তুমি ভালোবেসেছিলে সেটা সত্যি, কিন্তু আমার অসহায়ত্বের জায়গাটা তুমি বুঝতে পারোনি। আমি তোমাকে দোষ দিই না। আমার নিজের দোষ। কিন্তু কতটুকু প্রতারণা করেছিলাম সেটা তোমার জানা উচিৎ।

সেই যে বিকেলে তোমার রুম থেকে ছুটে বের হয়ে গেলাম, মনে হলো আমি ছুটেই চলেছি। ছুটেই চলেছি। আমার বিশ্রাম নেই। এমআরসিপি করার পর আর একটা ভালো জব পেয়ে মনে হয়েছিল এবার বিশ্রাম নিই। অনেক হয়েছে

রায়হানের কাছ থেকে ছাড়া পেতে আমি তোমার কাছে এসেছিলাম। আমি তোমাকে বলেছিলাম রায়হানের সাথে আমার কিছু ছিলো না। বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করে রেখেছিল। আমার ইচ্ছা বা অনিচ্ছা কিছু ছিলো না। আমরা একসাথে বড় হয়েছিলাম। যখন একসাথে পড়া শুরু করলাম, আমার মনে হলো রায়হানের সাথে আমার মিলবে না। ও নিজেও কনফিউজড ছিলো। আমি মাকে বললাম। মা বলল, ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক চলছিল না। রায়হান ক্রমাগত চাপ দিচ্ছিল ঘনিষ্ঠ হওয়ার জন্য। আমি কাউকে বলতে পারছিলাম না। একদিন সে আমাকে এসল্ট করলো। আমি একেবারেই ভেংগে পরেছিলাম। আমি মেনে নিতে পারছিলাম না।  আমি তারপর তোমার সাথে পড়া শুরু করেছিলাম। আমার বারবার মনে হচ্ছিলো আমার এই সম্পর্ক থেকে বের হতে হবে। আমি তোমার সাথে পড়তে চাইলাম। প্রথম দিকে তুমি দেখেছো আমি ডিস্টার্বড ছিলাম। কিন্তু তোমাকে আমার ভালোলেগেছিলো। আমার প্রতি তোমার মুগ্ধতা তোমার সততা আমার ভালোলেগেছিলো। সেই সন্ধ্যায় আমি দেখতে চেয়েছিলাম সবাই রায়হানের মত না কেউ কেউ নীলুও হয়।

— কি পেয়েছিলে ময়ী?

— যা পেয়েছিলাম তা তুমি বোঝোনি। মানুষ ভালোবেসে সর্বোস্ব দেয়। আর আমি সব দিয়ে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু আমার ভুল হয়েছিলো। অনেক বড় ভুল। সেই সন্ধ্যাটা একটা ভুলের সন্ধ্যা। তুমিও ভুল বুঝলে। ভাবলে আমি এমনি। স্লাট এন্ড ডার্টি।

— না ময়ী, এভাবে বলো না।

— তবে বড় ভুলটা ছিল আমার কনসেপশনে। আমার প্ল্যানিং এ। তোমার সাথে আমার শেয়ার করা উচিত ছিল আগেই। কিন্তু আমি এত ডিস্টার্বড ছিলাম যে ঠিকভাবে তোমাকে বুঝাতে পারিনি। আমি তোমার দোষ দিই না। যখন দেখলাম সবাই রায়হানের মতো নয়, কেউ কেউ নীলুর মত হয় তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। অথবা বলতে পারো ধরে রাখতে চাইনি। কিন্তু সেই ঘটনার ইম্প্যাক্ট যে এতো খারাপ হবে বুঝিনি। ভেবেছিলাম রায়হান জানলে আমাকে বিয়ে করতে রাজি হবে না। আর মা’ও বাধ্য হয়ে তোমাকে মেনে নিবে।

— ময়ী তখন আমার সাথে তুমি শেয়ার করতে পারতে। এটলিস্ট আমাকে তোমার ভালোবাসার কথাটা বলতে পারতে ময়ী।

— কেন নীলু? তুমি বুঝতে পারোনি? পরীক্ষার পর আমার বদলে যাওয়া, আমার চোখের ভাষা পড়তে পারোনি?

— পেরেছিলাম। পেরেছিলাম বলেই অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়েছে।

— দেখো ভেবেছিলাম কি, আর হলো কি?

— বাসা থেকে তোমার আর আমার সম্পর্কের কথা জেনে গিয়েছিলো সবাই। রায়হানের ইগোতে লাগলো। সে ক্ষমা চাওয়ার মিথ্যা অভিনয় করে গেলো। আর মা সব রেডি করে রেখেছিলো। সেদিন বিকেলে আমি তো তোমার কাছেই গিয়েছিলাম। কিন্তু তুমি আমাকে ক্ষত বিক্ষত করছিলে, বেছে নাও, বেছে নাও। আমার বেছে নেয়ার কিছু ছিলো না। সব বিসর্জন দিয়ে আমার ভালোবাসার শুরু হয়েছিলো। আমি সেদিনও সব হারিয়েছিলাম। আজও আমি রিক্ত। আমি রাগ করে বেরিয়ে গিয়েছিলাম ঠিকই। কিন্তু সেই যাওয়াই যে শেষ যাওয়া হবে ভাবিনি। বাসায় গিয়ে দেখি মা বিয়ের সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। আমি আটকে গেলাম ।

— কিন্তু তুমি ফিরতে পারতে, পারতে চলে আসতে। আমি বলেছিলাম চলো দু’জন বসি। কথা বলি।

— পারতাম। কিন্তু আমি চাইনি আমার জন্য তোমার ফাইনাল ইয়ারে এসে আটকে যাও। তোমার ডিগ্রী নিয়ে ঝামেলা হোক। মা চাইলে পারতো তোমাকে আটকে রাখতে। প্রথমবার তোমার মেডিসিন খারাপ হলো। আমি আরো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তোমাকে ইচ্ছে করেই ফেল করানো হল কিনা? আমি অনুশোচনায় মরে যাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল আমার জন্যই তোমার ক্ষতি হলো। আরো পরে জানলাম তুমি আর সৃজা ভালো আছো। আর তুমিই বলো অতো ঘৃণার কাছে ফেরা যায়?

— ময়ী কখনোই আমি তোমাকে ঘৃণা করিনি। অভিমান ছিলো, রাগ ছিলো। আমি তোমার বিয়ের পরদিন তোমার মায়ের চেম্বারে গিয়েছিলাম। আমাকেও সেরকম ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে আমাকে ইচ্ছে করে ফেল করায়নি। মেন্টালি ডিস্টার্ব ছিলাম, তাই পরীক্ষা খারাপ হয়েছিলো। রিটেন। তাই আমি খুব একটা ঘাবড়াই নাই। ফেলটা করে জেদ চেপে গিয়েছিল। তারপর আমাকে আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

— তুমি খুব ব্রাইট ছিলা। শুধু ভাইভাতে একটু প্রব্লেম হতো। তাও কেটে গিয়েছিলো।

 

চলবে… 

আরো পড়তে পারেন

নীলুর প্রেমের দিন রাত্রি (শেষ পর্ব)

পড়ুন— নীলুর প্রেমের দিন রাত্রি (পর্ব: ৩) ৫. — ময়ী, দোষ আমারও ছিল। আমি একটু সাহসী হতে পারতাম। কি হতো? কত দিন আর আটকে রাখতো? আমিও তো সাহস করে তোমাকে বলতে পারতাম চলো পালিয়ে যাই। ময়ী হো হো করে হেসে উঠলো। ‘তা পারতে। কিন্তু তা হলে এতো নামি সার্জন হতে পারতে?’ — না হতাম। কি….

নীলুর প্রেমের দিন রাত্রি (পর্ব: ২)

পড়ুন— নীলুর প্রেমের দিন রাত্রি (পর্ব: ১) ৩. — নীলু পরীক্ষা তো শেষ, বাড়ি যাবা নাকি? — যাব। কিছুদিন সৃজাকে পড়াতে হবে। পরীক্ষার জন্য অনেক দিন পড়ানো হয়নি। একটানা কিছুদিন পড়াব। তুমি কোথাও যাবা ঘুরতে? — ঠিক নেই। দেখি, যেতেও পারি। নীলুর মনে হলো এই প্রথম ময়ীর চশমার পিছনের চোখে মায়া। নিলুর জন্য মায়া। কিছু….

নীলুর প্রেমের দিন রাত্রি (পর্ব: ১)

১.  — হ্যালো নীলু বলছো?? — হুম.. — কে ময়ী?? ফোনের ঐপাশে এক মুহুর্ত নিরবতা। মনে হল একটু আশ্চর্য হয়েছে। —হুম। চিনে ফেল্লে?? একবার গলা শুনেই চিনে ফেললে। অনেক বছর তো হলো। বিশ বছরের বেশি হবে। আর তোমার সাথে ফোনে কোনদিনই কথা হয়নি। — হ্যাঁ, তা হবে। মাঝখানে একবার তোমার ভাই ফোন করেছিল। তোমার মায়ের….

error: Content is protected !!