Author Picture

মাহমুদ দারবিশের ডায়েরি ‘নদী মরে যায় পিপাসায়’— (পর্ব: ২)

এনামূল হক পলাশ

মেয়েটি আর তার চিৎকার

সমুদ্রতীরের মেয়েটি, যার একটি পরিবার আছে আর সেই পরিবারটির একটি বাড়িও আছে। বাড়িটির মধ্যে দুটি জানালা আর একটি দরজা আছে। সমুদ্রে একটি যুদ্ধজাহাজ মজার ছলে তীরে হাটাহাটি করতে থাকা লোকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে: চার, পাঁচ, সাত জন বালির উপর পড়ে যায়। একটি অস্পষ্ট ঐশ্বরিক হাতের সাহায্যে মেয়েটি কিছুক্ষণের জন্য কোন প্রকারে রক্ষা পেয়ে বাবাকে ডাকে: ‘বাবা বাবা! চলো বাড়ি যাই, সাগর আমাদের মতো মানুষের জন্য নয়!’ তার বাবা উত্তর দেয় না, সূর্যাস্তের বাতাসের দিকে তার ছায়া পড়ে থাকে যেন পাম গাছে রক্তের ছোপ, মেঘের ভেলায় রক্তের ছোপ।

মেয়েটির চিৎকার তাকে সমুদ্রতীরের চেয়ে অনেক উঁচুতে নিয়ে যায়। মেয়েটি রাতে মাটির উপর দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠে কিন্তু সেই ধ্বনির কোনো প্রতিধ্বনি হয় নি। ব্রেকিং নিউজ হয়ে উঠতে সে অবিরাম চিৎকার করতে থাকে কিন্তু সেটি আর ব্রেকিং নিউজ হয়ে উঠেনি যখন দুটি জানালা আর একটি দরজা সহ একটি বাড়িতে বিমানটি বোমা মারতে ফিরে এসেছিলো।

 

সবুজ মাছি

দৃশ্যটা বরাবরের মতোই স্বাভাবিক।
গ্রীষ্ম আর ঘামের কল্পনা দিগন্তের ওপার থেকে
দেখতে পাওয়া যায় না।
আগামীকালের চেয়ে আজকের দিনটি চমৎকার।
কিন্তু মৃতরা কি নতুন।
তারা প্রতিদিন জন্ম নেয় আর
ঘুমানোর চেষ্টা করার সময়
মৃত্যু তাদের তন্দ্রা থেকে
দূরে নিয়ে যায় স্বপ্নহীন ঘুমে।
তাদের গণনা করাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়।
তাদের মধ্যে কেউ কারো কাছে সাহায্য চায় না।
কণ্ঠস্বরগুলি ফাঁকা জায়গায় শব্দের সন্ধান করে
আর আহত প্রতিধ্বনি স্পষ্ট ফিরে আসে:
‘এখানে কেউ নেই।’
কিন্তু এমন কেউ আছে যে বলছে:
‘হত্যাকারীর প্রবৃত্তিকে রক্ষা করা খুনির অধিকার’।
যখন মৃতরা অন্ধকারে পতিত হয়ে বলে:
‘আত্মরক্ষার জন্য চিৎকার করা মজলুমের অধিকার।’
প্রার্থনার ডাক আসে একই রকম শেষকৃত্যের সাথে:
কফিনগুলি দ্রুত বাতাসে ভেসে উঠে,
তাড়াহুড়ো করে কবর দেওয়া হয় –
আচার সম্পাদনের সময় নেই,
বিমানের গোলায় আক্রান্ত অন্যান্য স্থান থেকে
আরও মৃতদেহ দ্রুত গতিতে আসছে,
একজন করে বা দলবদ্ধ হয়ে,
অথবা একটি সম্পূর্ণ পরিবার যে রেখে যায়নি
কোনো এতিম বা শোকার্ত পিতামাতা।
আকাশ সীসার মতো ধূসর
আর সমুদ্র নীলাভ ধূসর,
কিন্তু রক্তের রঙ ক্যামেরা থেকে লুকিয়ে আছে
সবুজ মাছির ঝাঁকের আড়ালে।

 

গদ্য কবিতার মতো

পাহাড়ে শরতের গ্রীষ্ম যেন গদ্য কবিতা। হাওয়ার মৃদু ছন্দ অনুভবে দোলা দেয় কিন্তু শান্ত ছোট ছোট গাছে তা শুনতে পাই না। হলুদ গাছগুলি বিচিত্র ছাল ছাড়ছে আর সুনিপুন উপমাগুলো উস্কে দেয় উত্তেজক ভাষন। কারণে অকারণে জীবন্ত চড়ুইদের উড়ে বেড়ানোর মধ্যে যাপিত হয় এই পাহাড়ি পথ। ডুমুর, আঙ্গুর আর ডালিম না পাকা পর্যন্ত বা বিস্মৃত বৃষ্টির বাসনা জাগিয়ে তোলা পর্যন্ত প্রকৃতি হচ্ছে তুচ্ছ অলঙ্করণ থেকে বিচ্ছিন্ন এক শরীর। যদি কবিতার জন্য রহস্য প্রয়োজন না থাকত, তবে আমার কিছুই লাগবে না। কবি বলেছেন, উদ্যম কমে গেছে বলে তার ভুলগুলো ঘন ঘন ফিরে আসে না। তিনি হাঁটেন কারণ ডাক্তাররা তাকে হাঁটার পরামর্শ দিয়েছেন। উদ্দেশ্যহীন হাঁটেন হৃদযন্ত্রকে প্রশিক্ষণ দিতে। উদাসীনতায় হাঁটেন প্রয়োজনীয় সুস্বাস্থ্যের জন্য। তার কাছে আসা যে কোনো ধারণা সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক হবে। গ্রীষ্ম খুব কমই নিজেকে ধার দেয় কবিতায়। গ্রীষ্ম একটি গদ্য কবিতা যা অনেক উপরে চক্কর দেয়া ঈগলের প্রতি কোন আগ্রহ দেখায় না।

 

আমি যদি শুধুমাত্র পাথর হতাম

আমি গতকাল পার করার জন্য আকুল হব না।আগামীকাল আর আসবে না। বর্তমান অগ্রসর হবে না বা পিছু হটবে না। অর্থাৎ আমার কিছুই হচ্ছে না! যদি আমি শুধুমাত্র পাথর হতাম – আমি বললাম – ওহ যদি আমি এমন কিছু পাথর হতাম যাতে পানি আমাকে সবুজ, হলুদে রাঙিয়ে দিত – আমাকে ভাস্কর্যের মতো একটি ঘরে স্থাপন করা হত। যদি আমি ভাস্কর্যের অনুশীলনে বা প্রয়োজনীয় বিস্ফোরণের উপাদান হতাম নিরর্থক মূর্খতা থেকে। যদি আমি একটি পাথর হতাম যেন কিছুর জন্য আকুল হতে পারি!

 

পরিচয়ের বাইরে

আমি টেলিভিশনের সামনে বসে থাকি, যেহেতু আমি আর কিছুই করতে পারি না। সেখানে, টেলিভিশনের সামনে, আমি নিজের ভেতরের অনুভূতি আবিস্কার করি আর দেখি আমার সাথে কী ঘটছে। আমার ভেতর থেকে ধোঁয়া উঠছে আর অনেক শরীর থেকে আমার বিক্ষিপ্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তুলে নিতে আমার বিচ্ছিন্ন হাত বাড়িয়ে দেই, অথচ আমি সেগুলি খুঁজে পাচ্ছি না। আমি তাদের থেকে পালিয়ে যাই না কারণ ব্যথারও আলাদা আকর্ষণ আছে। স্থল, আকাশ, সমুদ্র আর ভাষা দ্বারা আমি অবরুদ্ধ। শেষ বিমানটি বৈরুত বিমানবন্দর ছেড়ে উড়ে গেছে আর আমার মৃত্যুর শেষ অংশের সাক্ষী হতে আমাকে টেলিভিশনের সামনে বসিয়ে রেখেছে লক্ষ লক্ষ দর্শকদের সাথে। দার্শনিক ডেসকার্টস যেমন বলেন, ভাবনার ভেতর প্রমাণিত হয়না আমার অস্তিত্ব, বরং যখন আমাকে বলিদান করা হয়, এখন লেবাননে। টেলিভিশনে ঢুকলাম, আমি আর জানোয়ার। আমি জানি বিমান আর পাখির মধ্যে লড়াইয়ে জানোয়ারটি আমার চেয়ে শক্তিশালী। সম্ভবত আমার যতটুকু থাকা উচিত ছিল তার চেয়েও বেশি আসক্ত হয়ে পড়েছি কাল্পনিক বীরত্বে : জানোয়ার আমাকে গিলে ফেলেছে কিন্তু হজম করতে পারে নি। আমি একাধিকবার অক্ষত আবির্ভূত হয়েছি। আমার আত্মা, যা জানোয়ারের পেটে বিভ্রান্ত ছিল তা হালকা আর শক্তিশালী হয়ে আরও একটি শরীরে অধিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু এখন আমি জানি না আমি কোথায় আছি: টেলিভিশনের সামনে নাকি ভিতরে। যেখানে আমি দেখতে পাচ্ছি আমার হৃদয় লেবাননের পাহাড় থেকে রাফাহ পর্যন্ত পাইন ফলের মতো গড়িয়ে যাচ্ছে!

আরো পড়তে পারেন

তরুন ইউসুফের একগুচ্ছ কবিতা

বহ্ন্যুৎসব কত কিছু পুড়ল! গাড়ি পুড়ল বাড়ি পুড়ল দম্ভের দালান পুড়ে ক্ষার জলপাই সবুজ ট্যাংক নামল পুড়ল বই গল্প রূপকথার বেলুন হাতে পুড়তে পুড়তে ফানুস হয়ে উড়ে গেল বালক মায়ের আঁচল পুড়ল পুড়ল বুকের কাছের লোক যুবকের বুক পোড়াতে পোড়াতে পুড়ে গেল বন্দুক, থানার সেপাই কারো কারো স্বপ্ন পুড়ল আমিও পোড়ার গন্ধ পাই- আমার পুড়ল….

মুখোমুখি: আন্দ্রেজ আল-আসাদি

১৯৯৭ সালে লন্ডনে জন্মগ্রহণ করা আন্দ্রেজ আল-আসাদি বর্তমান সময়ে মেসিডোনিয়ান ভাষায় লেখালেখি করা প্রধানতম তরুণ কবিদের অন্যতম। তার বহুসাংস্কৃতিক পটভূমি এবং তার ও অন্যান্য সমসাময়িক মেসিডোনিয়ান কবিদের কাজকে অনুপ্রাণিত করার প্রভাব নিয়ে কথা বলেছেন ব্রিটিশ-আমেরিকান সাহিত্যিক অনুবাদক পিটার কনস্টানটাইনের সাথে। ওয়ার্ল্ড লিটারেচার টুডে কর্তৃক প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারটি অনুবাদ করেছেন মেজবাহ উদ্দিন আপনার জন্ম লন্ডনে, আপনার….

আজাদুর রহমান-এর একগুচ্ছ কবিতা

বাবা আপনার ব্যর্থ শরীর জানত নিরাময় উড়ে গেছে আসমানে, আপনার মৃত্যু হবে। শেষবেলায় আপনি বড় নিঃস্ব, ঈশ্বরের মত নিদারুন, একমাত্র একা। সেকারনেই আপনি লুকিয়ে লুকিয়ে ভেন্টোলিন সিরাপ খেতেন, অ্যাসমা’র বড়ি গিলে সারা রাত কাঁশতেন। আপনার কফ গলানো কাঁশির শব্দে কোন কোন রাতে আমাদের কাঁচা ঘুম ছিঁড়ে যেত, আমরা বিরক্ত হতাম। তারপর, আপনার জবুথবু মুখের দিকে….

error: Content is protected !!