Author Picture

ঝালকাঠি জেলার পেয়ারা বাগান ও এশিয়ার একমাত্র ভাসমান হাট বাজার

মু আল আমীন বাকলাই

‘এখানে প্রাণের স্রোত আসে যায় -সন্ধ্যায় ঘুমায় নিরবে / মাটির ভিটের পরে— লেগে থাকে অন্ধকার ধুলোর আঘ্রান/ তাহাদের চোখে মুখে’— জীবনানন্দ দাশের এই কবিতার মতো ঝালকাঠির নিভৃত পল্লীর পেয়ারা গ্রাম। ব্যবসা বাণিজ্যে ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ঝালকাঠিকে ‘দ্বিতীয় কলকাতা’ বা ‘ছোট কলকাতা’ বলা হতো ব্রিটিশ আমলে। সেই অতীত ঐতিহ্যের সাথে ঝালকাঠির পেয়ারা বাগান, পেয়ারার ভাসমান বাজার আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পেয়ারা বাগানের বেদনাবিদুর ও গৌরবময় স্মৃতি ঝালকাঠিকে নবরূপে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে জাতির ইতিহাসে।

‘পেয়ারা আর শীতল পাটি এই নিয়ে ঝালকাঠি’- এটি জেলার ব্রাইন্ডিং লোগোর স্লোগান। ঝালকাঠি বরিশাল পিরোজপুর এই তিন জেলার সীমানার কাছাকাছি ৩৬ টি গ্রাম জুড়ে প্রায় ৩১ হাজার একর জমিতে পেয়ারা চাষীদের বংশপরম্পরায় পেয়ারার চাষ। বহু পূর্ব থেকে এখানে হিন্দু জনগোষ্ঠীর বসতি।এই হিন্দুদের আদি পেশা সর্জন পদ্ধতিতে চাষাবাদ যা স্থানীয় ভাষায় ‘কান্দি’ নামে পরিচিত। অত্র অঞ্চল মূলত ছোট ছোট খাল দ্বারা পরিবেষ্টিত নিম্নভুমি। বর্ষা কালে খালের পানি বৃদ্ধি পেয়ে তলিয়ে যায় কৃষি ফসল। তাই কান্দি কেটে চলে চাষাবাদ। এই কান্দিতে বহু পূর্ব থেকেই অত্যন্ত সুস্বাদু ভিটামিন ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন স্থানীয় ভাষায় ‘গইয়া’ নামক এই ফলটির চাষাবাদ।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় আর দর্শনীয় মনোমুগ্ধকর অভিনবত্বব হলো এর বিক্রয় স্থান ও বিক্রয় পদ্ধতি। একই আকৃতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডিঙ্গি নৌকায় চাষিরা বাগানে বাগানে ঘুরে পেয়ারে তুলে আনে— তারপর সে পেয়ারা বিক্রির জন্য একত্রিত হয় ভাসমান পেয়ারা বাজার ভীমরুলিতে

ঝালকাঠি জেলার কৃত্তিপাশা ও নবগ্রাম ইউনিয়নের ২৪টি গ্রামের প্রায় ১৮৫০ একর জমিতে বর্তমানে পেয়ারা চাষ হয়। ৬৫০০ টন পেয়ারা এখানে উৎপাদিত হয়। কৃষকপল্লীর নারী পুরুষ সকলেই বংশপরম্পরায় পেয়ারা উৎপাদনকে প্রধান পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছে। অন্তত সাড়ে ৫ হাজার পরিবার পেয়ারা চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। কৃষি বিভাগের হিসাব মতে দেশে উৎপাদিত পেয়ারার ৭০ থেকে ৮০ ভাগ এখানে উৎপাদিত হয়। গ্রামের পর গ্রাম সবুজের সমারোহ। একই জাতের ফল আর সে ফলের নিচে ছোট ছোট লাম্বা আকৃতির জলাশয়— স্থানীয় ভাষায় যাকে ‘ব্যার’বলা হয়। খুবই দৃষ্টিনন্দন মনমুগ্ধকর নয়নাবিরাম এই পেয়ারা বাগান ইতোমধ্যে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সাধারণত বর্ষা মৌসুমে আষাঢ় শ্রাবণ মাসে পেয়ারা তোলার উপযোগী হয়।

সবচেয়ে আকর্ষণীয় আর দর্শনীয় মনোমুগ্ধকর অভিনবত্বব হলো এর বিক্রয় স্থান ও বিক্রয় পদ্ধতি। একই আকৃতির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ডিঙ্গি নৌকায় চাষিরা বাগানে বাগানে ঘুরে পেয়ারে তুলে আনে— তারপর সে পেয়ারা বিক্রির জন্য একত্রিত হয় ভাসমান পেয়ারা বাজার ভীমরুলিতে। অনেকগুলি ছোট ছোট খালের মিলনে সৃষ্ট একটু অপেক্ষাকৃত বড় খালে এই ভাসমান বাজার। শত শত ছোট ছোট নৌকা সবুজ আর হলুদ রংয়ের কাঁচা পাকা পেয়ারা নিয়ে ভাসমান বাজারে উপস্থিত হয়। কলআলা নৌকা নিয়ে আসে পাইকাররা। তারা দরদাম করে ট্রলারে তুলে সে পেয়ারা নিয়ে ছোটে রাজধানী ঢাকা-চট্টগ্রাম সিলেট সহ দেশের বড় বড় জেলা শহরে। ‘বরিশালের গইয়া’ নামে এই পেয়ারা এখন সারা দেশে রপ্তানি হয়। ভীমরুলি বাজারের পেয়ারার এই ভাসমান বাজারের দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য পর্যটকের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে দিনে দিনে। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ থেকে বহু দর্শনার্থী পর্যটক ভিড় করে এই বাজারে। বাংলাদেশ দূতাবাস ছাড়াও বিদেশি বহু মেহমান প্রায়ই এই পর্যটন কেন্দ্রে উপস্থিত হয়। ঝালকাঠি শহর থেকে কীর্ত্তিপাশা মোড় হয়ে অথবা কলেজ মোড় থেকে মাত্র ২৫ টাকা ভাড়ায় আপনি এখানে পৌঁছতে পারেন। বাগানের ভিতরেই রয়েছে সুন্দর সুন্দর রিসোর্ট এবং হোটেল। দুপুরে ইলিশ চিংড়ি দিয়ে খাওয়ার সুন্দর ব্যবস্থা আছে। সারাদিন পেয়ারা বাগানে ঘুরে ঘুরে পেয়ারা খেতে পারেন মাত্র ৩০ টাকায়।

আরো পড়তে পারেন

আর্কটিক থেকে উপসাগর পর্যন্ত: কানাডা ও বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিপূর্ণ হুমকি

এটি শুধু একটি ভৌগলিক বা স্থানিক ব্যাপ্তির  বর্ণনা নয় , যা আর্কটিক অঞ্চল থেকে উপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভ্রমণ বা পরিসরের পরামর্শ দেয়। আর্কটিক বলতে পৃথিবীর সবচেয়ে উত্তরের অংশকে বোঝায়, যা আর্কটিক মহাসাগর এবং আশেপাশের ল্যান্ডস্ক্যাপ জুড়ে রয়েছে। অন্যদিকে উপসাগর জলের শুধু একটি অংশ নয় যা ভূমি দ্বারা আংশিকভাবে ঘেরা ও একটি প্রশস্ত মুখ দিয়ে সামনে….

ভালোবাসা প্রতিদিন

প্রতিবারের মতো এবারও আমি রিমান আর রোমান পুরো গ্রামটা পায়ে হেঁটে দেখার প্রস্তুতি নিয়ে বেরিয়েছি। সামনে পরীক্ষা তাই রায়হান সঙ্গে থাকতে পারেনি। বছরের শেষ দিনগুলিতে উত্তর পশ্চিম স্পেনের এই অঞ্চলে আসা এখন আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মনে হয়, বছর শেষে এখানে আমার সময়বাঁধা আছে। প্রতি বছর পাহাড়বেষ্টিত ছোটো ছোটো গ্রামের সমন্বয়ে এই পরিবেশ আমার মধ্যে….

পরিবেশ পুরস্কারের ভালো-মন্দ

আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশের সরকারগুলো পরিবেশ রক্ষায় কাজ করছে কেমন? জবাব হচ্ছে, করছে না, যা করছে তা খুবই সামান্য। ‘এনভায়রনমেন্টাল পারফরম্যান্স ইনডেক্স’ গবেষণার গত ২০১৮ সালে প্রকাশিত ফলাফলে দেখা গেল পরিবেশগত ঝুঁকি কমাতে তৎপর রাষ্ট্রগুলোর তালিকায় ভারতীয় উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলোর অবস্থান একদম নিচের দিকে। গবেষণার নানা সূচক মিলে মোট ১০০ মার্কসের মধ্যে বাংলাদেশ, নেপাল ও ইন্ডিয়া….

error: Content is protected !!