‘আমাকে আপনার মনে নেই। থাকার কথাও নয়। সে জন্য দোষও দেব না। এত ব্যস্ত মানুষ আপনি, আমার মত কত জনের সঙ্গেই হঠাৎ চেনা-জানা। কেনইবা মনে রাখবেন তাদের সবাইকে?’ বেশ শান্ত গলায় বললেন মিসেস অঙ্কিতা। টেবিল থেকে কি যেন একটা নিলেন তিনি। পিটপিট করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সাফরাব। একটা ইনজেকশন, একটা ছোট টেস্টটিউবের মতো ভায়াল, তার ভেতর বেগুনী রঙের একটা জেলির মত পদার্থ। ভায়াল থেকে সিরিঞ্জে ওই বেগুনী জিনিসটা নিতে নিতেই কথা বলে উঠলেন মিসেস অঙ্কিতা।

‘তবে আমার কিন্তু আপনাকে খুব ভালো করে মনে আছে। দিনের পর দিন আপনাদের অফিসে গিয়ে বসেছিলাম। আপনি একজন পিএসকে পাঠিয়ে দিতেন আমার সঙ্গে কথা বলতে। ঔ মেয়েটি বেশ ভালো ছিল, একটু বোকা গোছের। গল্প করতো এসে। কি সব জানি আপনাদের কোম্পানি পলিসি, এটা সেটা বোঝাতে চাইতো। কি জানেন আমি বুঝতামও। কিন্তু মন মানতো না। তাই নির্লজ্জের মতো আবার ছুটে যেতাম প্রতি সপ্তাহে রবিবার সকাল ১০:০০ টায়, আপনাদের টিম মিটিং এর আগে, যদি আপনার দেখা পাওয়া যায় সে আশায়। টানা তিন মাস। একটা সপ্তাহও বাদ দেইনি।’ একই সিরিঞ্জের আরেকটা কি জানি বাদামি রঙের পদার্থ নিতে নিতে বললেন অঙ্কিতা।

সাফরাব একবার চিৎকার করে উঠতে চাইলো ‘আপনি আসলে কে? কেন বেঁধে রেখেছেন আমাকে? এসব গালগল্পের মানে কি? ছেড়ে দিন, না হলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।’

তবে গলা দিয়ে স্বর বের হলো না তার। কথা বলতে গেলেই জিভ কেমন জানি জড়িয়ে যাচ্ছে আর প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট। মনে হচ্ছে গলার কাছে একদলা কফ যেন আটকে আছে।

‘আপনি খামোখা কথা বলার চেষ্টা করছেন কেন বলুনতো? ওতে আপনার কষ্ট আরও বাড়বে। চুপ থাকুন’ হাসলেন মিসেস অঙ্কিতা। ৫০-উর্ধ্ব মহিলার মুখে আপাতদৃষ্টিতে নিষ্পাপ সরল হাসি, তাতে মধুরতা আছে, জীবন আছে, খুব খেয়াল করে দেখলে খানিকটা করুণাও আছে। তবে সেসব ছাড়িয়ে ভেতরে কোথায় একটা খ্যাপাটে মানুষও আছে লুকিয়ে। একপাশে একটা ইলেকট্রিক স্টিভে কেটলির পানি গরম হয়ে গেছে, টগবগ করে পানি ফোটার শব্দ। হাতের কাজটা সেরে মিসেস অঙ্কিতা গেলেন ওদিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখলো সাফরাব।

মাথাটা এখনো ঘুরছে। কেটলি। চা। এক চায়ের দাওয়াত থেকেই এখন সে বন্দি এখানে। মাথার ভেতরে তখন আগের কিছু মুহূর্ত ঘুরছে।

এক কাপ চায়ের দাওয়াতেই সে এসেছিলো মিসেস অঙ্কিতা মানে ‘শিশুচিত্র’ নামের বেশ নাম-ডাকওয়ালা সামাজিক সংগঠনটির ব্যবস্থাপকের কাছে। এসব খাতে বিনিয়োগ বা ত্রাণে এখন ট্যাক্স অনেকটা মওকুফ হয়। কোম্পানি তাই বেশ আগ্রহী আর তাছাড়া বাইরে থেকে ফান্ড আসছে, বেশ কিছু ক্লায়েন্টও আগ্রহী এসব ব্যপারে পার্টনার হতে। শিশুচিত্র’র একটা দারুণ ব্যাপার হচ্ছে এটি শুধু দান নয়, বরং বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানের এগ্রিগেটর হিসাবে কাজ করে। একটা ই-কমার্সের মতো ওয়েবসাইট আছে। সেখানে কোম্পানিগুলো কোন জায়গাতে কিভাবে কাকে কত দান করবে ঠিক করতে পারে। নতুন নতুন দানের উৎস সেখানে তৈরি হয়। সমাজের সুবিধাবঞ্চিতরা ব্যক্তিগতভাবেও সেখানে নিজেদের চাহিদা লিখতে পারে। এরকম একটা সিস্টেম করার কারণে মহিলা দেশে-বিদেশে বেশ কিছু পুরস্কারও জিতেছেন। নামডাক বেশ ভালো। তার সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করলে প্রতিষ্ঠানেরও ভালো পিআর হয়। আর তাছাড়া সাফরাব তো শুধু একজন আপাদমস্তক ব্যবসায়ী নন, সঙ্গে বিনোদন জগতেও তার মুখ অনেকেই চেনে। ছোটবেলা থেকেই টুকটাক অভিনয় আর তারপর চাচার এজেন্সির মাধ্যমে বেশ কতগুলো অ্যাডভার্টাইজের ফ্রন্ট ফেস। বেশ ভালো ফ্যান ফলোয়িংও আছে তার। এ ধরনের সামাজিক কাজ তাই কেবল প্রতিষ্ঠান নয়, নিজের জন্যও ভালো।

মিসেস অঙ্কিতার সঙ্গে সেরকমই একটা যৌথ ব্যবস্থাপনার সামাজিক কাজ করা যায় কিনা সেসব নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা বেশ অনেকদিন ধরে ঝুলে আছে দেখে সাফরাব নিজেই এসেছিলেন সব ঠিকঠাক করতে। টিমের দোষ নয়, ভদ্রমহিলা নিজেই সময় দিতে পারছিলেন না। তেমনটাই ইমরান বলেছিলো।

‘তোমরা নাকি সময় পাওনা? কই, আমার এক ফোনে তো উনি রাজি হয়ে গেলেন’ ধমকেছিলেন তিনি অ্যাসিস্টেন্ট ম্যানেজার ইমরানকে। মুখ নিচু করে ইমরান মনে হয় ভাবছিলো, ‘আপনি ফোন দিলে তো রাজি হবেই, আপনি কোন চেয়ারে বসে আছেন সেটা দেখতে হবে না?’

এরপর কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে বলতে পারবেনা। জেগে প্রথমে বোঝেনা কোথায় এসেছে। চোখ একটু সয়ে আসতে বুঝতে পারে অন্ধকার একটা ঘরে পুরানো স্ট্রেচারে হাত-পা বেধে রেখে দেওয়া হয়েছে তাকে। ওপরে তাকালে একটা সে আদ্যিকালের টিমটিমে হলুদ বাল্ব  ঝুলতেই দেখা যায়। ঘরটায় আর কিছু নেই। না কোনো বিছানা, কোনো আলমারি। কোনো জানালাও নেই। শুধু একটা অদ্ভুত রকমের দরজা

তবে সেটা অনুক্তই রয়ে যায়। কিছুক্ষণ ভাবেন সাফরাব মহিলার গলার স্বর এতো চেনা চেনা লাগছে কেনো। নিজে থেকে আগে তো কখনো কথা বলেননি তিনি ওনার সঙ্গে। আর কি অদ্ভুত শর্ত মহিলার। বাইরে কোথাও দেখা করবেন না, তার বাড়িতে বিকালে চায়ের দাওয়াতে যেতে হবে। সঙ্গে আর কাওকে আনা যাবে না, বেশি মানুষজন তার পছন্দ নয়।

যাই হোক, সময়-সুযোগ মিলিয়ে সাফরাব এসেছিলেন, খানিক আলাপের পর ভদ্রমহিলা চা দিলেন খেতে। কফি কালচারে অভ্যস্ত সাফরাব ভেবেছিলো না করবে; তারপর মিসেস অঙ্কিতা আবার অপমানিত বোধ করেন কিনা ভেবে হাতে তুলে নিয়েছিলো ধবধবে সাদা চায়ের কাপটা। আর তাছাড়া বেশ সুন্দর একটা ঘি-দারচিনির মিষ্টি গন্ধ আসছিলো তখন ঘন মালাই-চা  থেকে, ওপরে সর ভাসছে, এমন চা বহুদিন খাওয়া হয়নি। একবার মাথায় একটা ফালতু রসিকতা খেলেছিলো তখন, নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়, ভিডিও দেখেছে সে একটা টক-শোর। উপস্থাপক প্রশ্ন করলেন ‘দুধের ওপর যা থাকে ওটাকে কি বলে?’ উত্তর এলো-‘সর’। ‘না হয়নি’ উপস্থাপক একটা গা-জ্বালানো টিপ্পনিমার্কা হাসি দিয়ে বললেন-সঠিক উত্তর হলো ‘ব্রেসিয়ার’। তারপরেই দর্শকদের কি তুমুল করতালি। বেশ ভাইরাল হয়েছিলো ভিডিওটা। উপস্থাপককেও চেনে সাফরাব। সানহীর কামাল। ওর সঙ্গে এরপরেই কর্পোরেট কমেডি শো স্পন্সরশীপটা ফাইনাল হলো,  সানহীরের সঙ্গে সেখানে হাত মেলাতে একটু অস্বস্তিই লাগছিলো সাফরাবের। ছেলেটা কেমন করে যেন তাকায়, চাউনি দেখলে নিজেকে ন্যাংটো ন্যাংটো লাগে। ঝেড়ে ফেলেছিলেন সে চিন্তা একটু পরে, কে কিরকম তাতে কি এসে যায়। এগুলো তো প্রফেশনাল রিলেশন।

‘কিছু ভাবছেন?’ বলেছিলেন মিসেস অঙ্কিতা, নরম ধূসর চোখদুটো চা হাতে বসে থাকা সাফরাবের ওপর স্থির। একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো সাফরাবের। ভদ্রমহিলা যেনো তাকিয়েই ভেতরের সব কথা পড়ে নিচ্ছেন। অস্বস্তি কমাতেই পরপর দুবার চুমুক দিয়ে বসলো সাফরাব চায়ের কাপে। আসলেই ভালো চা।

‘চা বেশ মজার। মানে আপনার হাতে আসলে জাদু আছে। আজকাল কেউ এরকম চা বানাতেই পারেনা।’ একটু হেসে মুখ তুলেছিলো সে। মিসেস অঙ্কিতা হেসে তাকিয়ে ছিলেন শুধু। কতক্ষণ বলতে পারে না সাফরাব। মাথা ঘুরছিল। চোখের পাতা আপনি বন্ধ হয়ে আসছে, ঠোঁট আটকে যাচ্ছে। শেষে মনে পড়ে হাত থেকে চায়ের কাপটা পড়ে গেল মেঝেতে। মালাই-চায়ের সোনালি বাদামি রঙ মেঝেতে গড়াচ্ছে। আশ্চর্য, কাপটা ভাঙেনি। কেন ভাঙলোনা? হুশ হারানোর আগে সেটাই শেষ চিন্তা ছিলো সাফরাবের।

এরপর কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে বলতে পারবেনা। জেগে প্রথমে বোঝেনা কোথায় এসেছে। চোখ একটু সয়ে আসতে বুঝতে পারে অন্ধকার একটা ঘরে পুরানো স্ট্রেচারে হাত-পা বেধে রেখে দেওয়া হয়েছে তাকে। ওপরে তাকালে একটা সে আদ্যিকালের টিমটিমে হলুদ বাল্ব  ঝুলতেই দেখা যায়। ঘরটায় আর কিছু নেই। না কোনো বিছানা, কোনো আলমারি। কোনো জানালাও নেই। শুধু একটা অদ্ভুত রকমের দরজা। অদ্ভুত কারণ সাধারণ দরজার চেয়ে উচ্চতায় অর্ধেকেরও কম হবে ওটা। একটা বড় সাইজের কুকুর ঢুকতে পারে এরকম দরজা। ভাবতেই একটু ভয় লাগলো সাফরাবের। কুকুর ঢুকতে পারে এমন দরজা কেনো? আচ্ছা কুকুরের কথাই মনে হল কেন? তিনদিন আগে গাড়ি চালানোর সময় রাস্তায় শুয়ে থাকা একটা কুকুরকে বাড়ি মেরে গিয়েছিল তার ড্রাইভার – কিন্তু সেটাতো দেশি সরাইল। ওরকম একটু-আধটু না মরলে তো কুকুরেই ভরে যেত দেশ।

তাকিয়ে থাকতে পারছিলো না সাফরাব বেশিক্ষণ, মাথা ধরে আছে। চোখ বন্ধ করে অপেক্ষা করে সে কিছু একটা হবার, এমন অদ্ভুত নীরবতা আর ভালো লাগছে না। কিডন্যাপড হয়েছে সে। কিন্তু কেন? তাকে আটকে রেখে মিসেস অঙ্কিতার লাভ কি? কিছুদিন আগে দেখে একটা সিনেমার কথা মনে পড়ে হঠাৎ। একটা রেস্টুরেন্টে মানুষ মেরে তাদের মাংস খাওয়ানো হত। সেরকম কিছু কি করতে চান উনি? আর ভাবতে চায় না সাফরাব। যা চাইবে দিয়ে দেবে সে, প্রাণে বাঁচা দিয়ে কথা। প্রায় ৩০ বছরের ক্যারিয়ার তার, টাকা-পয়সা কম নেই। সেখান থেকে একটা মোটা অঙ্ক না হয় লিখেই দেবে এই মহিলাকে। এভাবেই উঠেছে বোঝা যাচ্ছে এ এনজিওটা। নাহলে ৫ বছর আগেও কে জানতো মিসেস অঙ্কিতার নাম? মাথায় একটা গালি আসে সাফরাবের, মুখ খুলে বলতে পারেনা যদিও। ক্লান্তিতে আবার চোখ বন্ধ হয়ে আসে তার।

‘তাহলে ভাবুন তো আমার তোফার কেমন লাগছিলো? ওটুকু মেয়ে, তার সারাগায়ে জ্বলুনি। চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। কি ভিষণ বাজে অসুখ। গাদা গাদা টাকা খরচ করা ছাড়া তার প্রতিকার নেই। একলা মেয়েটিকে হাসপাতালে আমার বোনের কাছে রেখে আমি ছুটে বেড়িয়েছি। নিয়ম করে এ কোম্পানির হেড অফিস, ওই কোম্পানির ফ্যাক্টরি, কত সংবাদপত্রের অফিসের সিড়িতে। সবাই মিলে একটু সাহায্য করলে হয়তো আরেকটু চিকিৎসা হতো’

‘তুমি সাফরাব?’ একটা রিনরিনে গলা বলে হঠাৎ কানের পাশে। চমকে চোখ খোলে সে। একটা ১০-১২ বছরের মেয়ে দাঁড়িয়ে, গায়ে নার্সের মত পোশাক, হাতে একটা রেজিস্ট্রী বই। বেশ গুরুগম্ভীর স্বরে বলেছে মেয়েটি। উত্তর দিতে চায় সাফরাব, তবে জিভ তার এখনো জড়িয়ে আসছে। শুধু ‘উম্মা উম্মা সুফফারুবরুব’ গোছের একটা শব্দ বের হয় তার মুখ দিয়ে। খুব বুঝেছে এমন চেহারা করে ছোট মেয়েটি কাদের যেন নির্দেশ দেয় ‘ওনাকে ওটিতে নিয়ে যাও’। তখনি খেয়াল করে, আরও চারজন সমবয়সী বাচ্চা তার চারপাশে। সবাই মিলে স্ট্রেচারটা নীচু করতে করতে প্রায় মাটিতে লাগিয়ে ফেলে এবং তারপর টেনে টেনে বের করে ছোট দরজাটা দিয়ে। এ করিডর, সে করিডোর পার করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় আরেকটা ঘরে। স্ট্রেচার থেকে ট্রান্সফার করা হলো একটা তুলতুলে নরম বিছানায়। এত আরাম যার কাছে ম্যাডিশন হোটেলের বিছানাও পাত্তা পাবেনা। তবে সে আরাম উপভোগ  করার মত মানসিক অবস্থা নেই সাফরাবের। অপেক্ষা করতে থাকে সে; কি হবে কি হবে করে। তখন থেকে মনে হয় পাক্কা আধঘন্টা পার হয়ে গেছে। নিজের শরীর নাড়িয়ে বাধন খুলবার চেষ্টা করেছে সাফরাব। পরে বুঝেছে না বাধলেও পালানোর জো তার নেই, শরীর চলছেনা, হাত-পায়ে কোনো জোর নেই। নির্বাক তাকিয়ে থাকে সে মিসেস অঙ্কিতার দিকে।

বাচ্চাদের বিদায় দিয়ে সে তখন থেকে ঘরে রাখা টেস্টটিউব আর বিকার নিয়ে কি সব যেন করলেন। সাফরাব যে ঘরে আছে সেদিকে অনেকক্ষণ খেয়ালই ছিলোনা তার। কি চায় মহিলা?

‘ভাবছেন কি চাই তাইনা?’ বলেন মিসেস অঙ্কিতা। সিরিঞ্জের বাদামি তরলটির পর একটা হলুদ রঙের জেলিও ভরেছেন তিনি। কাজ শেষ এমন মুখ করে সেটা নিয়ে ধীরেসুস্থে এসে বসলেন, একটা ট্রে হাতে, তাতে আরও দু’কাপ চা। আর পাশে একটা সিরিঞ্জ। বিভিন্ন রঙের তরলে তা অদ্ভুত লাগছে। মিসেস অঙ্কিতা ট্রেটা সাবধানে রাখেন পাশের ছোট্ট টেবিলটায়।

‘ভাবছেন কি হচ্ছে এসব তাইনা? ভয় হচ্ছে যে আপনার জীবন এখানেই শেষ? কিংবা সারাজীবন এইভাবেই আটকে থাকতে হবে? অথবা আরও ভয়ংকর কিছু? সারাক্ষণ যন্ত্রনা, সব বুঝছেন, কিন্তু খড়কুটোটি নাড়াবার শক্তি নেই এমন? অসহায় লাগছে নিজেকে?’ বলেন তিনি।

প্রমোদ গোণে সাফরাব। কি আছে তার কপালে? মহিলা নিশ্চয়ই বদ্ধ পাগল। পাগলে কি না করে?

‘তাহলে ভাবুন তো আমার তোফার কেমন লাগছিলো? ওটুকু মেয়ে, তার সারাগায়ে জ্বলুনি। চামড়া পুড়ে যাচ্ছে। কি ভিষণ বাজে অসুখ। গাদা গাদা টাকা খরচ করা ছাড়া তার প্রতিকার নেই। একলা মেয়েটিকে হাসপাতালে আমার বোনের কাছে রেখে আমি ছুটে বেড়িয়েছি। নিয়ম করে এ কোম্পানির হেড অফিস, ওই কোম্পানির ফ্যাক্টরি, কত সংবাদপত্রের অফিসের সিড়িতে। সবাই মিলে একটু সাহায্য করলে হয়তো আরেকটু চিকিৎসা হতো।’ নিজের মনেই বলে চলেন মিসেস অঙ্কিতা, চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে। ‘মিথ্যে বলবোনা, অনেকেই সাহায্য করেছে, ব্যক্তিগত ভাবে। তবে তাতে আর কতটা  হয়? আর তাছাড়া আমার মেয়ে একাই তো আর রোগী নয়। আরও কতজন হয়তো আরও কত জায়গায় দান করছে। আমার বাড়ানো হাতে তবে আর কতজনই বা হাত রাখতে পারে। বুঝতাম। মানতাম। বারবার তাও আশায় বুক বেঁধে আপনাদের অফিসে ছুটে গিয়েছি। হয়তো এবার আপনাদের মন গলবে। এতটুকু হলেও হাত বাড়াবেন। তিন মাস কেটে গেলো। তোফাও চলে গেলো। চলে যাবে বুঝেছিলাম, তাই তাতেও খুব একটা বিচলিত হইনি। সবই আমার কপাল বলে চুপচাপ ছিলাম। নিজের মত। একাকী, এখানে। কিন্তু শান্তিতে থাকতে দিলেন কোথায়?’ স্বর ক্ষীপ্ত এবার তার।

প্রমোদ গোণে সাফরাব। এখন মনে পড়েছে এনাকে আগে কোথায় দেখেছেন। আলুথালু চুল, কেঁদে ফুলে ওঠা চোখ আর ইস্ত্রি না করা কুঁচকে থাকা শাড়ি পরা সেই পাগল গরিব বোটানিস্ট মহিলা, কতবারই না এড়িয়ে গেছে ওনাকে তখন। আজকের এই শান্ত,  স্নিগ্ধ কিন্তু দৃঢ়চেতা ভয়ংকর মহিলার সঙ্গে তাকে মেলানো মুশকিল।

‘আমাকে আপনার ওই পিএস মেয়েটি শেষে কি বলেছিলো জানেন? আপনাদের ডোনেশনের বাজেট আগে থেকে লকড, ব্যক্তিস্বার্থে দানের নিয়ম নেই আপনাদের। অথচ দেখুন তো আমার তোফা মারা যাওয়ার ঠিক ৪ মাস পরে কি সুন্দর আপনারাই তিনজন ছাত্রকে পাঠালেন ফ্রান্সে ট্যুরিজম নিয়ে পড়াশুনা করতে। ৬ মাসের কোর্স ফুল ফান্ডেড, ফ্লাইটসহ। এতে নাকি দেশের অর্থনীতিতে গতি আসবে, লং টার্ম ইনভেস্টমেন্ট, তাছাড়া শিক্ষাখাতে আপনাদের অবদান দেখানো যাবে। ট্যাক্স রিবেট তো আছেই। ওটা ব্যক্তিস্বার্থ ছিলোনা তাইনা সাফরাব?’ আহত ক্রদ্ধ চোখে তাকিয়ে মিসেস অঙ্কিতা।

কি বলবে বোঝেনা সাফরাব। ‘আই উই’ ছাড়া আর কিছু বলার অবস্থা নেই তার এমনিতেও।

কথা চালিয়ে যান মিসেস অঙ্কিতা ‘একটা মারাত্নক বিষ আছে এখানে, আমার নিজের তৈরি। প্রাণে মারবে না। তবে সঠিক সময়ে অ্যান্টিডোট না নিলে আপনাকে পুরো প্যারালাইজড করে দেবে। অ্যান্টিডোটটা আবার প্রতি মাসে নিতে হয় বুঝলেন? খুব একটা অ্যাভাইলেবল না। তবে ডেলিভারি দেই আমরা, আপনার লোকেশন ট্র্যাক করে আশেপাশের কোনো না কোনো চায়ের দোকানে

তাছাড়া উত্তর শোনার অপেক্ষা করছেন না সামনে বসে থাকা মধ্যবয়স্কা মহিলাটি, শুনতে চানও না সেটা ব্যবহার থেকে স্পষ্ট। ‘তখন থেকেই বুঝলেন’ আবার কথা বলা শুরু করলেন  মিসেস অঙ্কিতা ‘তখন থেকেই বুঝলাম যে এইভাবে একা একা দৌড়াদৌড়ি করে লাভ নেই। যা কিছু করার প্রাতিষ্ঠানিকভাবেই করতে হবে। শিশুচিত্র হলো সেভাবে। তবে সেটা করেও যে টাকা আসে তা নয়। সব বদলালেও আপনাদের মত লোক পালটায় না, আপনারা যেখানে বসে থাকেন সে কোম্পানিও পালটায় না। নিজের ভালো ছাড়া আর কিছু বোঝেন না আপনারা, দয়া-মায়া, আদর্শ এসব কেবল কোথাও বক্তৃতা দিতে গেলে কাজে লাগে, আর কিছুতে নয়। তাই, আমিও ঠিক করলাম সোজা আঙুলে ঘি না উঠিয়ে আঙুল বাঁকা করতে হবে।’ সিরিঞ্জটি এবার তুলে নেন তিনি হাতে। বিস্ফারিত চোখে তাকায় সাফরাব। তার হাত ধরে শিরা খুঁজছেন মিসেস অঙ্কিতা। বিস্ফারিত চোখে দেখে সাফরাব সিরিঞ্জের সূঁচটা তার শিরার ভেতরে ঢুকে গেল, নানা রঙের তরলটা ঢুকছে তার শরীরে ‘এই যে যেটা আপনাকে দিচ্ছি। এটা হল সে বাঁকা আঙুল বুঝলেন।’

কথা চালিয়ে যান মিসেস অঙ্কিতা ‘একটা মারাত্নক বিষ আছে এখানে, আমার নিজের তৈরি। প্রাণে মারবে না। তবে সঠিক সময়ে অ্যান্টিডোট না নিলে আপনাকে পুরো প্যারালাইজড করে দেবে। অ্যান্টিডোটটা আবার প্রতি মাসে নিতে হয় বুঝলেন? খুব একটা অ্যাভাইলেবল না। তবে ডেলিভারি দেই আমরা, আপনার লোকেশন ট্র্যাক করে আশেপাশের কোনো না কোনো চায়ের দোকানে। মাসে যে পরিমাণ দান চাইবো সেটা দিলে অ্যান্টিডোট আপনার বাড়িতে বা অফিসে পৌঁছে যাবে। আর ঠিকমতো দান না করলে কি হবে সেটা বুঝতে পারছেন। আপনি চাইলে কাওকে বলতে পারেন। কেউ হয়তো বিশ্বাস করবে না। আর বিশ্বাস করলে অ্যান্টিডোট আর আসবে না। বুঝতেই পারছেন আপনার কি করা উচিত।’ খালি সিরিঞ্জটা ওয়েস্টপেপার বাস্কেটে ফেলে দেন মিসেস অঙ্কিতা। আবার চা খাচ্ছেন তিনি।

সেটুকুই মনে আছে সাফরাবের। আবার সবকিছু অন্ধকার হয়ে যায় তার।

‘কি হলো? কিছু বলছেন না? কফি অর্ডার দিই? কি নেবেন আপনি? মোকা, ল্যাটে, ক্যাপাচিনো নাকি অ্যামেরিকানো? একটা চীজ কেক বলবো নাকি আর্লি ডিনার করবেন?’ হঠাৎ কথা শুনে টনক নড়ে তার। এইতো তিনি ঝলমলে ডেবেকার কফি হাউসে। কয়েকমাস আগে ঘটে যাওয়া স্মৃতি এখনো হঠাৎ মনে পড়ে চা বা কফি দেখলেই।

তাকে প্রশ্ন করেছিলো সামনে বসা লাবন্যময়ী তরুণী আলিশা। সাফরাবের এক কো-ডিরেক্টরের আত্মীয় হয়। কি নিয়ে জানি কথা বলতে এসেছে? ওহ, হ্যা একটা মেট গালা হাই-অ্যান্ড ফ্যাশন ফেস্টিভ্যাল করতে চায়, তার স্পন্সরশীপ মিনিমাম ৩০ লাখ টাকা দিতে হবে। পরনে টাইট কালো টপস মেয়েটির, ইচ্ছে করেই ঝুঁকে বসেছে কিনা কে জানে, গলা পেরিয়ে আরও বেশ খানিকটা দেখা যায়। নিয়মিত যত্নে শরীর চকচকে মাখনের মতন উজ্জ্বল, একবারে জিরো ফিগার, প্রথম দেখায় ককেশিয়ান বলে ভূল হয়।

‘নাহ, কফি খাবোনা। আমি আজকাল একটু ক্যাফেইন কন্ট্রোল করছি। রং চা খাই, সেটা তো আর এখানে পাওয়া যাবে না। তবে আলিশা একটা কথা বলি। আমি আমার কোম্পানি থেকে ওই মেট গালার জন্য একটা টাকাও কিন্তু দিতে পারবো না।’

আলিশা মনে হয় হঠাৎ এটা শুনে একটু হকচকিয়ে যায়, পরে নিজেকে সামলে সাফরাবের জন্য এটা কত জরুরি বোঝানোর চেষ্টা করে ‘আপনি কত মাইলেজ পাবেন জাস্ট থিংক!’

‘মাইলেজই সব নয়, আমি মোরালী এসব ব্যপারে আর ইনভল্ভড হতে চাইনা। হ্যা, আগে থাকতাম তা বলে সবসময়ই থাকা লাগবে এমন কোনো কথা নেই। কোম্পানি পলিসিও অনেক বদলেছে এখন। ওসবে আর আমাদের ইন্টারেস্ট নেই।’ বলে চুপ করে চেয়ে থাকেন তিনি আলিশার হতাশ মুখ দেখে। কিছু করার নেই। এমনিতে এ মাসের অ্যান্টিডোটটা এখনো ডেলিভারি হয়নি। উলটাপালটা জায়গায় টাকা দিলে হয়তো আর আসবেই না। জান বাঁচানো ফরজ।

আরো পড়তে পারেন

মহামায়া (পর্ব-২)

পড়ুন—  মহামায়া (পর্ব-১) ৩. কাঁচা রাস্তায় উঠতে উঠতে কাপড় ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। পায়ের সাথে কাপড় জড়িয়ে যাচ্ছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। সবার আগে মনিশঙ্কর হাঁটছে। তার হাতে মাথায় খাবারের টিন। একটা কাপড়ের ট্রাঙ্ক। সকলের হাতেই কাপড়ের পুটুলি। এতটুকু আসতেই হাপিয়ে উঠেছে। আরো অনেকটা দূর যেতে হবে হেঁটে। তারপর নৌকায় সীমানার কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায়।….

মহামায়া (পর্ব-১)

১. সূর্য উঠতে এখনো অনেকটা দেরি। আকাশে কোনো তারা নেই। পুরোটা আকাশ মেঘে ঢাকা। রাতের অন্ধকারটা আজকে আরও বেশি চোখে লাগছে। বাতাস হচ্ছে। মাঝে মাঝে মেঘের আলোতে দেবীপুর গ্রামটা দেখা যাচ্ছে। মুহুর্তের জন্য অন্ধকার সরে আলোয় ভেসে যাচ্ছে। রাধাশঙ্করের ভিটাবাড়ি, ধান ক্ষেত, বাঁশঝাড় হাইস্কুল আলোয় ভেসে যাচ্ছে মুহূর্তের জন্য। মহামায়া আর মনিশঙ্করের ঘরে হারিকেন জ্বলছে।….

স্বর্ণবোয়াল

মোবারক তার কন্যার পাতে তরকারি তুলে দেয় আর বলে, আইজ কয় পদের মাছ খাইতেছ সেইটা খাবা আর বলবা মা! দেখি তুমি কেমুন মাছ চিনো! ময়না তার গোলগাল তামাটে মুখে একটা মধুর হাসি ফুটিয়ে উল্লসিত হয়ে ওঠে এই প্রতিযোগিতায় নামার জন্য। যদিও পুরষ্কার ফুরষ্কারের কোন তোয়াক্কা নাই। খাবার সময় বাপবেটির এইসব ফুড়ুৎ-ফাড়ুৎ খেলা আজকাল নিয়মিত কারবার।….

error: Content is protected !!