জাতিসংঘের একটি ফুড ক্যাম্পের পাশে একটি অসুস্থ শিশু পড়েছিল। শিশুটির ঠিক পেছনেই একটি শকুন অপেক্ষা করছে, কখন শিশুটি মরবে, কখন সে পাবে মাংসের স্বাদ! কি নিদারুণ দৃশ্য! এই ছবির সমমানের কোনো ছবি পৃথিবীতে আছে কিনা সন্দেহ। ১৯৯৩ সনে ছবিটি তুলেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকান ফটোসাংবাদিক কেভিন কার্টার। একই বছরের ২৬ মার্চ ছবিটি দ্য নিউইয়র্ক টাইমসে ছাপা হয়। ছাপা হওয়ার পরপরই পাঠক ও বোদ্ধা মহলে ছবিটির পক্ষে-বিপক্ষে তুমুল তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়। সুদানের দুর্ভিক্ষের সময় তোলা এই ছবিটির জন্য কেভিন কার্টার ১৯৯৪ সনে পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করেন।
ছবিটি গোটা পৃথিবীকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছিল। কেভিন কার্টার মর্মান্তিক ছবিটি তুললেন, ছাপলেন, শেষে পুরস্কারও পেলেন; কিন্ত শিশুটির কি হলো! সে কি শকুনের আহার হয়েছিল? নাকি বেঁচে গিয়েছিল? ফটোসাংবাদিক কেভিনও তা জানেন না। ছবি তুলেই তিনি সেখান থেকে সরে যান।
ছবিটি ছাপা হওয়ার পর প্রশংসার চেয়ে নিন্দাই বেশি কুড়িয়েছেন কার্টার। তাকেই অনেকে ‘শকুন’ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। সবার একই প্রশ্ন, শিশুটির ভাগ্যে কি ঘটেছিল? এই প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দ্য নিউইয়র্ক টাইমস কর্তৃপক্ষের কাছে তো দূরের কথা, কার্টারের কাছেও ছিল না। নিউ ইয়র্ক টাইমস ৩০ মার্চ একটি সম্পাদকীয় ছাপতে বাধ্য হয়। সে লেখায় তারা জানায়, ‘ফটোসাংবাদিক (কেভিন কার্টার) জানিয়েছেন, শকুনটিকে তাড়িয়ে দেয়ার পর শিশুটি আবার হাঁটা শুরু করেছিল। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছেছিল কিনা তা জানা যায়নি।’ এই জবাব সবার মনঃপূত হয়নি। কার্টারকে আক্রমণ করা অব্যাহত থাকলো। পুলিৎজার প্রাপ্তির দুমাসের মাথায় ১৯৯৪ সনের ২৭ জুলাই কার্টার কার্বন মনোক্সাইড বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
২০১১ সনের আগপর্যন্ত মনে করা হতো শকুনের সামনের শিশুটি ছিল মেয়ে। ২০১১ সালের শিশুর বাবা জানায় শিশুটি ছেলে, তার নাম কং নিয়ং এবং ২০০৭ সনে সে ‘জ্বরে ভুগে’ মারা যায়। কার্টার খবরটি শুনে যেতে পারলেন না। মার্কিন চলচ্চিত্রকার ড্যান ক্রাউস ২০০৪ সনে ‘দ্য ডেথ অব কেভিন কার্টার : ক্যাজুয়াল্টি অব দ্য ব্যাং ব্যাং ক্লাব’ শিরোনামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন। তথ্যচিত্রটি বেশকিছু পুরস্কারসহ অস্কার ও এমি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পায়। এই সিনেমায় নির্মাতা ক্রাউস মূলত কার্টারের আত্মহত্যার কারণ অনুসন্ধান করেছেন। কার্টার কেন আত্মহত্যা করলেন তা আজো পুরোপুরি স্পষ্ট হয়নি। যদিও শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে তিনি একটি চিঠিও রেখে গেছেন। চিঠি থেকে জানা যায় বিবিধ কারণে তিনি বিষণ্ন ছিলেন।
চিঠিতে লিখেছিলেন,
‘‘আমি সত্যি, সত্যি দুঃখিত। আমার কষ্ট আমার আনন্দকে এতোটাই ছাপিয়ে গেছে যে, আনন্দের আর অস্তিত্বই নেই।…বিষণ্ন…ফোন নেই…বাড়িভাড়ার টাকা নেই…সন্তানদের জন্য টাকা নেই…ঋণের জন্য টাকা নেই…টাকা!!!…হত্যা, লাশ, ক্রোধ, যন্ত্রণা…ক্ষুধার্ত অথবা আহত শিশু, পাগল খুনি, মাঝে মাঝে পুলিশ ও জল্লাদের জ্বলজলে স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। আমি কেনের (কেন অস্টারব্রোক) সঙ্গে মিলিত হতে যাচ্ছি, যদি ভাগ্য ভালো থাকে।’’
এর কয়েক মাস আগে কার্টারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহকর্মী ফটোসাংবাদিক কেন অস্টারব্রোক পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তার সামনেই দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনীর (এনপিকেএফ) গুলিতে নিহত হন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিখ্যাত ‘ব্যাং-ব্যাং ক্লাব’ গড়ে তুলেছিলেন চারজন সঙ্কটকালীন ফটোসাংবাদিক। কার্টার ও কেন ছিলেন তাদের অন্যতম। এই দলটি নিয়ে ২০১০ সনে নির্মাতা স্টিভেন সিলবার ‘দ্য ব্যাং ব্যাং ক্লাব’ নামে একটি সিনেমা করেছেন।
যাহোক, অনেকে মনে করেন কেনের আকস্মিক মৃত্যুর খবর কেভিন কার্টারের কফিনে শেষ পেরেকটি মারে। এই চিঠি পড়ে অনুমান করা যায়, সুদানের দুর্ভিক্ষের ছবিটিও কার্টারের হতাশার একটি কারণ ছিল। তিনি আত্ম-গ্লানিতে ভুগতে শুরু করেছিলেন। শিশুটির সম্ভাব্য পরিণতির জন্য হয়তো নিজেকে দায়ী করা শুরু করেছিলেন। দীর্ঘদিন যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে থাকার কারণেও কার্টারের মনোজগতে বিরূপ প্রভাব পড়ে থাকতে পারে।
সুজান সনটাগ তার ‘রিগার্ডিং দ্য পেইন অব আদার্স’ (২০০৩) গ্রন্থে বলেছেন, ‘‘কোনো প্রকৃত আতঙ্কের ক্লোজ-আপের দিকে তাকানোর লজ্জা যেমন আছে, শিউরে ওঠাও আছে। সম্ভবত যারা এই চরম পর্যায়ের যন্ত্রণার উপশম ঘটাতে কিছু করে উঠতে পারেন, তাদেরই এ জাতীয় যন্ত্রণার ছবির দিকে তাকানোর অধিকার রয়েছে—যেমন, যেখানে ছবিটি তোলা হয় সেই সামরিক হাসপাতালের শল্যচিকিৎসকেরা কিংবা তারা, যারা এটা থেকে কিছু শিখতে পারেন। বাদবাকি আমরা সকলেই স্রেফ মজা দেখি, সে আমরা চাই বা না চাই।’’ কার্টারও কি মজার দেখতে আসা লোকের দলে ছিলেন?—এটি একটি দীর্ঘ একাডেমিক আলোচনা, কার্টার আত্মহত্যা করেও যে আলোচনার ইতি টানতে পারেননি।