বই-মেলা থেকে আঁচলভর্তি বই নিয়ে এক কিশোরী হাসি মুখে বাড়ি ফিরছে। দৈনিক পত্রিকায় এই ছবিটি দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো। নয়ন ভরা জল, আঁচল ভরা ফুল, এ সব আমার চেনা। কিন্তু আঁচল ভরা বই ? কিশোরীর ভীরু মনে প্রেমের মুকুলের পাশাপাশি এবার জ্ঞানের মুকুলও ফুটবে নাকি? এ মেয়ের বর জুটবে তো?
রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’ উপন্যাসের নায়ক অমিত রায় নিজের বিয়ের ঘটকালি নিজেই করতে গিয়েছিলেন। অমিতের মতে বিয়ের ব্যপারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো: বর যেন কনেকে রূপে ছাড়িয়ে না যায়। বিয়ের যোগ্যতার ফর্দে পাত্রের বিদ্যা-বুদ্ধির বিবরন লিখতে হবে, কিন্তু পাত্রীর বেলায় ওটা থাক না ফাঁকা! অমিত রায় লোকটি উদ্ভট, উল্টাপাল্টা কথা বলে সবাইকে চমকে দেওয়াই ওর সভাব। এ রকম মধ্যযুগীয় কুসংস্কার নিশ্চয় রবীন্দ্রনাথের মনের কথা নয়। তবে অমিত রায়ের কথা রবি ঠাকুরে আরেক নায়িকা চিত্রাঙ্গদা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিলেন:

‘‘আমি চিত্রাঙ্গদা, রাজেন্দ্র নন্দিনী,
নহি দেবী, নহি সামান্য নারী।
পূজা করি মোরে রাখিবে উর্ধে সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি।’’
ধনু-বিদ্যা, রাষ্ট্র-বিদ্যা, রাজদন্ড-নীতিতে পারদর্শী এমন যে অসামান্য রাজকুমারী, তার বর জোটাতে পঞ্চশরকে বর দিতে হলো। ব্রহ্মচারী ব্রতধারী অর্জুন ধরা পড়লেন রূপের ফাঁদে। আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারী- এমন গ্রাম্য প্রবাদ অর্জুনও খন্ডাতে পারলেন না। ধিক পার্থ, ধিক! বীর-শ্রেষ্ঠ অর্জুনের এমন পদস্খলন কবি দিজেন্দ্রলাল রায়কে বড় দাগা দিয়েছিল, শুনেছি তিনি চিত্রাঙ্গদা বইটি পুড়িয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে শুধু পার্থ কেন, যমুনাতীরে পার্থসারথীর দুর্দশার কথা-ও তো আমাদের জানা আছে। ‘‘চলে নীল শাড়ি নিঙাড়ি নিঙাড়ি পরান সহিত মোর’’ বলে শ্রীকৃষ্ণ কি বিলাপ করেন নি! শ্রীমতি রাঁধার চুল, শাড়ি, গায়ের রং, অঙ্গভঙ্গিমা, এমনকি দাঁতের বিবরণ পর্যন্ত আমাদের জানা আছে, কিন্তু তাঁর বিদ্যা-বুদ্ধির খবর কেউ কি রাখেন?
‘‘সাধারণ মেয়ে’’ মালতীর বর জোটাতে রবিঠাকুর শরৎচন্দ্রের সাহায্য চাইলেন। শরৎবাবুর কলমের এক খোঁচায় মালতী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে প্রথম হয়ে বিলেতে পাড়ি দিল। ওটাই তো হলো মস্ত ভুল! তারপরে ‘‘চার অধ্যায়’’ এর নায়িকা! মুক্তমনা, বিজ্ঞ, সংস্কারমুক্ত মেয়ে-চরিত্র সৃষ্টি করার বিপদ রবীন্দ্রনাথ বেশ বুঝতে পেরেছিলেন। মেয়েদের মাতৃভাব এবং সখীভাব ছেলেদের যথাক্রমে আশ্বস্ত ও উজ্জীবিত করে। কিন্তু অন্দরমহলে দেবী সরস্বতীর আনাগোনা ছেলেরা তেমন পছন্দ করে না। যে মেয়ে বই পড়ে, সে কি চুল বাঁধে, রান্না করে? বিয়ের কনের কম্পিটিসানে লক্ষীর কাছে সরস্বতীকে বারে বারে হার মানতে হয়েছে।
পশ্চিমা দেশগুলিতে কিন্তু অনেক পরিবর্তন এসেছে। লক্ষীর সেই রমরমা রাজত্ব আর নেই। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এখন ছেলেদের চেয়ে মেয়ে শিক্ষাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশী। ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়েসের ছেলেমেয়েদের মধ্যে ছেলেদের সংখ্যা আমেরিকায় ৫% বেশী, কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে মেয়েদের সংখ্যা প্রায় ২০% বেশী। ১৯৭৮ সালের আগে ছাত্র বেশি ছিল, এখন ছাত্রীদের রাজত্ব চলছে। এই বৈষম্য প্রতি বছর বেড়েই চলেছে। অমিত রায়ের কথামত বিয়ে-শাদি কি তাহলে লাঠে উঠবে?

“Peter, Peter pumpkin eater,
Had a wife but couldn’t keep her.

Peter, Peter pumpkin eater,
Had another and didn’t love her;
Peter learned to read and spell,
And then he loved her very well.”

ছেলেরা যদি পিটাররের মতো বই পড়া আর বানান শেখা শুরু করে? লাভ হবে কি? আমরা এক কালে শাখামৃগ ছিলাম এ কথা মেয়েরা ভুলতে বসেছে, কিন্তু ছেলেরা মাঠে-ঘাটে-পথে এখনো বাঁদরামি করে বেড়াচ্ছে- একান্ত বাড়াবাড়ি না হলে মেয়েরা এটা যে খুব অপছন্দ করে তা নয়। ডারউইনের বিবর্তনবাদ থেকে এর একটা বৈজ্ঞানিক বাখ্যা দেওয়া সম্ভব। তবে বিবর্তনের চাকা প্রতিমুহুর্তে অনেক দিকে ঘোরে। যুক্তরাষ্ট্রে রান্নাবান্না, কাপড়কাঁচা, থালাবাসন ধোয়া, ঘরমোছা, বাচ্চা সামলানো, ডাইপার বদলানো জাতীয় কাজগুলিকে কেউ আর এখন শুধু মেয়েদের কাজ বলে মনে করে না। ছেলেরা খুশি মনেই এ সব কাজে হাত দিচ্ছে, এবং যথেষ্ট দক্ষতা দেখাচ্ছে। Survival of the fittest! রবীন্দ্রনাথের ‘‘শেষের কবিতা’’ আর ‘‘সাধারন মেয়ের’’ দিন পশ্চিমা দেশগুলিতে ফুরিয়ে গেছে, সময় এসেছে ‘‘সাধারন ছেলের’’ গল্প লেখার। এ যুগের ‘‘লাবন্যরা’’ মা-মাসির কোল যতটুকু ভালবাসে, তার চেয়েও বেশী ভালবাসে কর্মস্থলের কেদারা; স্বামীর আদরের চেয়ে অর্থনৈতিক স্বাধীনতার উপরেই তাদের বেশী ভরসা। বিদ্যা এবং অর্থের মধ্যে এখন তেমন কোন বিবাদ নেই, বরং কিছুটা গলাগলি। পিতার টাকার উপর নির্ভর না করে মেয়েরা সরস্বতীর বিদ্যার বরে টাকা আর বর দুটোই জোগাড় করছে। বিয়ের আসরে মেয়েরা আর খেলার পুতুল বা পন্য নয়, কন্যার বাইরের রূপটাই একমাত্র বিবেচ্য নয়। হঠাৎ কোন শুভ লগ্নে রূপের-অতীত রূপ প্রেমিকের চোখে পড়ে, অসুন্দর মেয়ের সুদর্শন বর জোটে। অমিত রায়, তোমার স্থান আজ ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে।

আরো পড়তে পারেন

মহামায়া (পর্ব-২)

পড়ুন—  মহামায়া (পর্ব-১) ৩. কাঁচা রাস্তায় উঠতে উঠতে কাপড় ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে। পায়ের সাথে কাপড় জড়িয়ে যাচ্ছে। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। সবার আগে মনিশঙ্কর হাঁটছে। তার হাতে মাথায় খাবারের টিন। একটা কাপড়ের ট্রাঙ্ক। সকলের হাতেই কাপড়ের পুটুলি। এতটুকু আসতেই হাপিয়ে উঠেছে। আরো অনেকটা দূর যেতে হবে হেঁটে। তারপর নৌকায় সীমানার কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায়।….

মহামায়া (পর্ব-১)

১. সূর্য উঠতে এখনো অনেকটা দেরি। আকাশে কোনো তারা নেই। পুরোটা আকাশ মেঘে ঢাকা। রাতের অন্ধকারটা আজকে আরও বেশি চোখে লাগছে। বাতাস হচ্ছে। মাঝে মাঝে মেঘের আলোতে দেবীপুর গ্রামটা দেখা যাচ্ছে। মুহুর্তের জন্য অন্ধকার সরে আলোয় ভেসে যাচ্ছে। রাধাশঙ্করের ভিটাবাড়ি, ধান ক্ষেত, বাঁশঝাড় হাইস্কুল আলোয় ভেসে যাচ্ছে মুহূর্তের জন্য। মহামায়া আর মনিশঙ্করের ঘরে হারিকেন জ্বলছে।….

স্বর্ণবোয়াল

মোবারক তার কন্যার পাতে তরকারি তুলে দেয় আর বলে, আইজ কয় পদের মাছ খাইতেছ সেইটা খাবা আর বলবা মা! দেখি তুমি কেমুন মাছ চিনো! ময়না তার গোলগাল তামাটে মুখে একটা মধুর হাসি ফুটিয়ে উল্লসিত হয়ে ওঠে এই প্রতিযোগিতায় নামার জন্য। যদিও পুরষ্কার ফুরষ্কারের কোন তোয়াক্কা নাই। খাবার সময় বাপবেটির এইসব ফুড়ুৎ-ফাড়ুৎ খেলা আজকাল নিয়মিত কারবার।….

error: Content is protected !!