রাতারগুল নামটা কেমন অদ্ভুত, সিলেটের অন্য নামগুলোর সাথে যেন ঠিক মেলে না । সেখানে ‘ছড়া- ছড়ির’ ছড়াছড়ি, যেমন মালনিছড়া, সাতছড়ি, লোভাছড়া। মেঘালয় বেষ্টিত সিলেট হাজার ঝরা বা ছড়ার দেশ তাই ‘ছড়ার’ ছড়াছড়ি কিন্তু রাতারগুল? এ কেমন নাম অর্থই বা কি?
সিলেট শহর থেকে মাত্র ছাব্বিশ মাইল উত্তরে পাঁচশ চার একরের এক জায়গা, জায়গাটা একেবারেই অন্যরকম। অনন্য। যেন এক খণ্ড সুন্দরবন গোটা তুলে এনে কেউ বসিয়ে দিয়েছে শিমুলবিল, নোয়াবিল, গেয়াইন নদীর মাঝে-যার নাব্যতা ধরে রাখে চেংঙ্গির খাল। দূর থেকে মনে হয় ছায়াঘেরা সবুজ সরোবরে জমাট শেওলা, হাওরের মাঝে দারুচিনি দ্বীপ, আসলে ওটা বন, রাতার (মুতার) বন যে বনের ঘাস দিয়ে তৈরি হয় রাতা বা পাটি, আসলে ভাসন্ত পাটির বন বা রাতারগুল, মিঠা পানির ম্যানগ্রোভ, পৃথিবীর সংখ্যালঘু সোয়াম্প ফরেস্টের একটি, আমাদের দুর্লভ ঐশ্বর্য। ঐশ্বর্যই বটে, না দেখলে অনুভব করা কঠিন। সিলেটের এয়ারপোর্ট রোড থেকে সিলেট-কোম্পানিগঞ্জ হাইওয়ে ধরে পৌঁছতে হবে ধোপাগুল পয়েন্টে, সেখান থেকে ধোপাগুল হরিপুর রাস্তা ধরে গোয়াইন নদীর মটর ঘাট, সেখান থেকে ট্রলারে দশ মিনিটে রাতারগুল বন।
ছোট ছোট খাল চলে গেছে বনের ভিতর দিয়ে, দুপাশে করচ কদম হিজলের বন, আরো অনেক প্রজাতি আছে, অসংখ্য তাদের নাম, কিন্তু এখানে সকলের মিলিত প্রচেষ্টা এক, পানিতে বেঁচে থাকা…বর্ষায় কিংবা শীতে, সময়ে শুধু তাদের মৌসুমী সৌন্দর্যের পার্থক্য হয়ে যায়, বর্ষায় ভাসন্ত ফুলের মত, শীতে প্রাগৈতিহাসিক ভাস্কর্যের ন্যায়।
বর্ষায় গাছেদের গুচ্ছ ভাসে বিশ তিরিশ ফিট পানির ওপরে, শীতে দশ ফিট পানি কেবল, তার ওপরে শিকরের ঝালর, তার ওপরে গাছের চাঁদোয়া। বর্ষার নৌকো চলার খাল শীতে হয়ে যায় পায়ে চলার পথ। নীচে রাতার বন ওপরে প্রাচীন বৃক্ষের ভাস্কর্য। ছায়াচ্ছন্ন চিরল চাঁদোয়ার নীচে রাতার ঘেরা সরু পায়ে চলার পথ, কোথাও শেওলার চাতালে সরু সরু আঁকাবাঁকা পথ।
বর্ষায় গাছের শেকড় স্বচ্ছ পানির নীচে দোল খায়। ভ্রমণ পিপাসুরা কোষা নৌকায় যেতে যেতে গাছের ডালে হাত রেখে মাথা বাঁচাতে বাঁচাতে অবাক হয়ে দেখে গাছের শিকড়ের সাথে মাছেদের লুকোচুরি, আর শীতে সরু খালের ঘোলা পানিতে কোষা নৌকায় চলতে চলতে ঝুলন্ত শিকড়ের জঞ্জালে অভিভূত হয়ে ভাবে এ কোন সুদূর অতীতের মধ্য দিয়ে চলেছি? সাপেরা, পাখিরা, সরীসৃপেরা চলতে চলতে হঠাৎ থেমে ভাবে এই মরা সময়ে ওরা কি দেখতে এসেছে? ওরা কিভাবে জানবে আসলে ওরা খুঁজতে এসেছে ট্র্যাংকুইলিটি-বিরল নির্জনতা।
গাছের শিকড়ের সাথে মাছেদের লুকোচুরি, আর শীতে সরু খালের ঘোলা পানিতে কোষা নৌকায় চলতে চলতে ঝুলন্ত শিকড়ের জঞ্জালে অভিভূত হয়ে ভাবে এ কোন সুদূর অতীতের মধ্য দিয়ে চলেছি? সাপেরা, পাখিরা, সরীসৃপেরা চলতে চলতে হঠাৎ থেমে ভাবে এই মরা সময়ে ওরা কি দেখতে এসেছে?
বিরল সেই নির্জনতা এখানে এই রাতারগুলে অনায়াসে খুঁজে পাওয়া যায়-শীতে কিংবা বর্ষায় যখন পর্যটক গোয়াইনের মটরঘাট থেকে ট্রলারে রাতার বনের কোলে নেমে প্রাগৈতিহাসিক জড়ানো-প্যাঁচানো শিকড়বাকড়ের ভেজা ভেজা সরু পথ ধরে চলতে থাকে কোষা নৌকার সন্ধানে যা তাকে এঁকেবেঁকে নিয়ে যাবে সবুজ পানি আর গাছের ছায়ার আচ্ছাদনের ভিতর দিয়ে রাতার বনের একদম হৃদয়ের কাছটিতে, যেখানে দু’একটি পাখির কু কু কুজন ছাড়া আর সব শব্দেরা নিষিদ্ধ। এখানে শব্দেরা নিষিদ্ধ কিন্তু আলো আর ছায়ারা নয় তাই সেখানে গাছের ফাঁকে ফাঁকে সবুজ পানিতে চাঁদ বা সূর্যেরা ছায়া ফেলে, দিনে সূর্য চিরল পাতার ফাঁকে বিচ্ছুরিত করে আলো, জলের ছোঁয়ায় মাখন হয়ে গলে, আর রাতে চাঁদ নরম আলোয় আচ্ছন্ন করে পুরো বন, পাতার ফাঁকে চুমকড়ি আঁকে সবুজ শান্ত জলে, সকাল সন্ধ্যায় নিঃশব্দে পখিরা কুলায় ফেরে, ফেরে অনিশ্চিত পৃথিবীর বুকে থেকে একখণ্ড নিশ্চিত ‘অভয়ারণ্য’। রাতারের সকাল, সন্ধ্যা আর রাতের সৌন্দর্য তাই আলাদা, যেমন আলাদা দুপুরের- শীত কিংবা বর্ষায়।
তবে সেখানেও আছে বাস্তবতা, টুকরো টুকরো স্বার্থের দ্বন্দ্ব, প্রতিযোগিতা। তবে সেই প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে যায় নিস্তব্ধতা। নির্জনতার স্বরভঙ্গ করে না কখনো নৌকার মাঝিদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব অথবা সেই সব কচি শিশুদের গান যারা কোন কোন নৌকায় ভ্রমণকারীদের বিনোদন দিতে গায়… মধু হই হই বিষ হাওয়াইলা অথবা পুরানো কথাগুলো, অতীতের কথাগুলো কিংবা সিলেটের পোয়া আমি বাবা লন্ডনি…বরং তাতে মাত্রাই যোগ হয় কিছু।
আসেছেন তো রাতাগুলে? কিন্তু সাবধান নির্জনতা ভাঙবেন না, এখানে গাছেরা ভাঙে না, পাখিরা ভাঙে না, ভাঙে না সরীসৃপেরা, তাহলে আপনি কেন?
শাহজাহানপুর
২৬/২/২০২১