Author Picture

কাশীনাথ রায়ের কাব্যনাটক: ডিভাইন কমেডি

লীনা দিলরুবা

‘ডিভাইন কমেডি’র গঠনগত সুষমা এবং এর কাঠামোগত ভারসাম্য আধুনিক সূক্ষ্মতার সঙ্গে সমিল রেখে রচিত। ১৯৬৫ সালে বাংলাদেশে এমন একটি কাব্যনাটক লেখা হয়েছিল এটি প্রায় বিস্ময়কর ঘটনা। বস্তুত এত বছর পরেও কাব্যনাটকটি যে আমাদের বুর্জোয়া জীবনের নিষ্প্রাণ যান্ত্রিকতাকে ভয়াবহভাবে প্রাসঙ্গিক করেছে এজন্য খানিকটা চাঞ্চল্যবোধ করছি। সৈয়দ শামসুল হকের ‘ঈর্ষা’ কাব্যনাটকটি যারা পড়েছেন, বাংলাভাষার স্থিতিস্থাপকতার বাড় সম্পর্কে তাদের ধারণা হয়েছে। ‘ঈর্ষা’ আগে না ‘ডিভাইন কমেডি’ আগে সেই মাপজোকে আমি যাবো না। কিন্তু যারা ‘ঈর্ষা’ পড়েছেন, তাদের গ্রন্থপাঠের অভিজ্ঞতা কতোখানি বর্ণময় হলো সেটি নিণর্য় করতে কাশীনাথ রায়ের ‘ডিভাইন কমেডি’ও পড়বেন। ১৯৬৫ সালের রুলটানা কাগজের ‘কাব্যের প্রশ্রয়ে’— লেখাটি হারিয়ে গিয়েছিল সত্তর-একাত্তর সালে। পরে ১৯৯৪ সালে পাণ্ডুলিপিটি উদ্ধার হয় অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে এবং এটিই পরিমার্জিত আকারে প্রকাশিত হলো ‘ডিভাইন কমেডি’ নামে, যেখানে কাশীনাথ রায় তাঁর শক্তিমত্তার নির্ভুল স্বাক্ষর রেখেছিলেন। জীবনানন্দ দাশের ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার আবহাওয়া পুনর্গঠিত করে অক্ষরবৃত্ত ছন্দে কাব্যনাটকটি রূপক প্রতীকের অসংখ্য দৃশ্যের জন্ম দিয়েছে।

নর-নারীর বিবাহিত জীবনের স্থূল পার্থিবতা, একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতাবোধ, সম্পর্কের টানাপোড়েন ও দ্বন্দ্ব এখানে লক্ষণীয়। নাটকের কেন্দ্রবিন্দুতে জীবনের অন্তসারশূন্যতাকে প্রতিস্থাপিত করেছেন কাশীনাথ রায়। ‘আট বছর আগের একদিন’-এ এক সংসার-বিরাগী যুবকের কথা লিখেছিলেন জীবনানন্দ। সবই ছিল তার, তবু কালি-গোলা অন্ধকারে, রাতের আঁধারে সে আত্মহত্যা করেছিল। হৃদয়ের কোন তাপ নেভাতে সে প্রাণ-সংহার করেছিল, স্বভাবত প্রশ্ন জাগে

কাশীনাথ রায়ের কাব্যময়তা, চরিত্রচিত্রণের দক্ষতা চোখে পড়ার মতো। নর-নারীর বিবাহিত জীবনের স্থূল পার্থিবতা, একাকীত্ব, বিচ্ছিন্নতাবোধ, সম্পর্কের টানাপোড়েন ও দ্বন্দ্ব এখানে লক্ষণীয়। নাটকের কেন্দ্রবিন্দুতে জীবনের অন্তসারশূন্যতাকে প্রতিস্থাপিত করেছেন কাশীনাথ রায়। ‘আট বছর আগের একদিন’-এ এক সংসার-বিরাগী যুবকের কথা লিখেছিলেন জীবনানন্দ। সবই ছিল তার, তবু কালি-গোলা অন্ধকারে, রাতের আঁধারে সে আত্মহত্যা করেছিল। হৃদয়ের কোন তাপ নেভাতে সে প্রাণ-সংহার করেছিল, স্বভাবত প্রশ্ন জাগে। কবি বলছেন : ‘জীবনের এই স্বাদ’ তার অসহ্য বোধ হয়েছিল, বস্তুত মর্গে গিয়ে তার হৃদয় জুড়ালো। এ কথা বলে আত্মহত্যার মতো হটকারিতাকেও কবি তাৎপর্য দিয়েছেন, বলেছেন, ‘তবু এ-মৃতের গল্প;—কোনও নারীর প্রণয়ে ব্যর্থ হয় নাই; বিবাহিত জীবনের সাধ কোথায় রাখে নি কোনও খাদ।’ যদি খাদ না-ই থাকে, তবু কেন মানুষ আত্মহত্যা করে?

কবিতাটিতে জীবনানন্দের কল্পনা-মনীষার আশ্চর্য আয়তন লক্ষ করলে কেবল অবাক হতে হয়:

শোনা গেল লাশ কাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে— ফাল্গুনের রাতের আঁধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ।

বধূ শুয়ে ছিল পাশে— শিশুটিও ছিল;
প্রেম ছিল, আশা ছিল— জ্যোৎস্নায়— তবু সে দেখিল
কোন ভূত? ঘুম কেন ভেঙে গেল তার?
অথবা হয় নি ঘুম বহু কাল— লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমায় এ-বার।

তাকে ভূতে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল, নাকী মরে যাবার সাধ থেকে সে আত্মহত্যা করেছিল? নিশ্চিত সুখের জীবন ফেলে কোন ভূতে পেলে কিংবা কোন সাধ থেকে মানুষ অন্ধকার রাতের আঁধারে গলায় ফাঁস দিতে যায়? চারপাশের যৌক্তিকতারহিত বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত মানুষেরা বুঝি এমন— স্ত্রী-সন্তানের পাশে শয্যার সুখ, উষ্ণ জায়গা থেকেও পালাতে চায় ! মানুষের জীবনের ভরকেন্দ্রে আসলে কী দাঁড়িয়ে ! প্রেম-সম্পর্ক-আত্মীয়তা কতখানি ছায়া হয়ে থাকে মানুষের? জীবন কী কেবল ক্লান্তি আর ক্লান্তির এক সমগ্র? কেবল আত্মগ্লানি, নিঃসঙ্গতা, ধ্বংস, স্ববিরোধিপূর্ণ অনুশোচনা, জ্বলন্ত অগ্নি? তাই লাশ কাটা ঘরে তারা অনন্ত ঘুম ঘুমাতে যায়?
জানি— তবু জানি
নারীর হৃদয়— প্রেম— শিশু— গৃহ— নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়—
আরও এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত— ক্লান্ত করে;
লাশকাটা ঘরে
সেই ক্লান্তি নাই;
তাই
লাশকাটা ঘরে
চিৎ হয়ে শুয়ে আছে টেবিলের প’রে।

স্থির, অকম্প মানুষটি শুয়ে আছে টেবিলের ওপর, যাকে নারীর হৃদয়, প্রেম, শিশু, গৃহ, অর্থ, কীর্তি, স্বচ্ছলতা কোনোকিছু নয়, বরং সংজ্ঞাতীত কোনো বিপন্ন-বিস্ময় আক্রান্ত করেছিল। তাই সে ক্লান্ত, থেকে ক্লান্ত, থেকে ক্লান্ত হয়েছে। ক্রমাগত ক্লান্ত হয়েছে। সন্তানবান হয়েও তার ক্লান্তি কমেনি। প্রেমে ক্লান্তি কমেনি। গৃহ, সংসার তাকে উপহার দিয়েছে অভূতপূর্ব সব ক্লান্তি। শেষ পর্যন্ত যেন সবই নিষ্ফল। জগৎ এক সর্বধ্বংসী মাঠ। সবাই এখানে প্রতিনিয়ত নানা আক্রোশে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। ক্লান্তি মুছতে কেউ কেউ স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে রাতের আঁধারে গলায় ফাঁস দিয়ে টেবিলের প’রে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। ‘ডিভাইন কমেডি’তে কাশীনাথ রায় প্রলম্বিত করেছেন ক্লান্তির সংজ্ঞাকে। বা প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছেন একে ‘ডিভাইন কমেডি’তে। ক্লান্তির সমান্তরালে তিনি এ-জীবনকে দেখেছেন নতুন দৃষ্টিকে। ‘আট বছর আগের একদিন’ ভুলে যেতে পারবে না বাঙালি পাঠক। কবিও ভুলতে দিতে চান না। তাই তার পাত্র-পাত্রীরা নিজেদের ভূমিকায় অভিনয় করে ঠিকই, ভুলতে পারে না, এ জীবনের ক্লান্তির পরিণামের কথা। লাশকাটা ঘরের দৃশ্য মঞ্চায়িত হবার উপলক্ষ প্রত্যক্ষ করতে অপেক্ষার তিরতির উত্তেজনায় থাকে তারা। ‘ডিভাইন কমেডি’তে দাম্পত্য সম্পর্ককে তীব্র বিদ্রুপ বাণে বিদ্ধ করেছেন কাশীনাথ রায়। সম্পর্ক যেন একদলা শুষ্ক ফুল, নিরীহ কঙ্কাল; তাতে প্রাণ দেবার চেষ্টা যা হয়েছে, বিবাহ কী তার মধ্যে নিকৃষ্টতম?

১৯৬৫ সালে লেখা কাশীনাথ রায়ের ‘ডিভাইন কমেডি’

নাটকটির শুরুতে আমরা জানতে পারি মুক্তবন্ধনে বিশ্বাসী দুই নর-নারী সমীক্ষা এবং অতনু একদশক আগে বিবাহের সম্পর্কে জড়িয়েছিল এক শর্তে— দিনশেষে তারা ঘরে ফিরবে অথবা ফিরবে না। একদশক পর এক ঘনিষ্ঠ মুহূর্তে তারা তাদের সম্পর্ক হাতড়ে দেখে, প্রেমের সম্পর্ক কেবল প্রেম দেয় না, শূন্যতাও উপহার দেয়। অতনু-সমীক্ষা দম্পতির উছলে পড়া সুখের জীবনে কী যেন ঢুকে পড়েছে! অর্থহীন করে দিতে চাইছে সবকিছু। গলার কাছে চেপে বসে আছে সম্পর্কের ফাঁস। ঘরে ফিরবে অথবা ফিরবে না, এ কী সম্ভব আসলে !
সমীক্ষা অতনুর কাছে জানতে চেয়েছিল, দিনটি কোন তিথির? অতনু স্মরণ করতে পারে না, আর সমীক্ষা পারে না স্বামীর অজ্ঞতার অপরাধ ক্ষমা করতে। বলে:

কেমন অতিথি
তুমি? কলঙ্কিনী হয়ে যে-নারী ছড়াত
একদা নিষিদ্ধ রাতে জীবনের মানে,
আজ বাসি সংসারের গানে
তার কোনো খবরই রাখ না।

অতনু কী লজ্জিত হয় ! বলে:
সমুদ্রের নোনা
জলে কি তরঙ্গ মরে যায়?

সমীক্ষা যেন তরঙ্গ, আর অতনু নোনা জল! নিজেকে কেমন নিথর মনে হয় তার। বলতে চেষ্টা করে, যে কোনো তিথিতেই সমীক্ষা তিথিময়!
সমীক্ষা ভৎর্সনা করে ওঠে। বলতে চায়, কথায় ভোলাতে চায় কেন অতনু? অতনু, দুঃখিত হয়, বলে, এটা সমীক্ষার শুচিবায়ুতা। সমীক্ষা অস্বীকার করে, সে নিজের অবস্থানে সঠিক।
কথায় কথায় দুজনে মেতে থাকে। হঠাৎ সমীক্ষা জানায়, তাদের এক পিসি, লতু পিসির স্বামী আত্মহত্যা করেছেন।

অতনু চমকে যায়। আত্মহত্যা কেন?
সমীক্ষা বলে:
শেষটাতে উদাসীন
হয়ে উঠেছিলেন দারুণ। ভদ্রলোক
অথচ তেমন কোনো শোক
স্ত্রীর কাছে পাননি কখনো। লতু পিসি
ভালোবেসেছেন অহর্নিশি। স্বামীর ইচ্ছার টুকিটাকি,
ফাঁকি
রাখেননি ইহকালে পতিঅন্ত প্রাণের চত্বরে।

অতনু বলতে চায়, এত করেও আত্মহত্যা!
সমীক্ষা অতনুর কথায় মনোযোগ না দিয়েই জানায়:

কিছুকাল থেকে
খোলা জানালায় মাথা রেখে
রাতভর পাগলের মতো
শ-বার অন্তত
পৃথিবীর নামগুলো একে একে আওড়ে যেতেন,
আর বলতেন :
‘আমার নামের যত মানে
দেয়ালে চৌকাঠে আর পাশের বাগানে
আটকে গেছে, আমার নামের কোনো মানে
নেই, কোনোকালেই ছিল না।
অতএব, লতু, মিথ্যে বোনা-মিথ্যে বোনা
তোমাতে আমার প্রেম-আমার সন্ত্রস্ত প্রেম-
রক্ত ইচ্ছা জ্বালা অস্থিরতা।’

সমীক্ষা অতনুর কাছে জানতে চায়, লতু পিসির এতো প্রেমের পরেও কেন তার স্বামী আত্মহত্যা করলো! জীবনের মানে তবে কী? বলে:

ঘরকন্না? বনের হরিণ?
জীবন তবে কি আটবছর আগের একদিন?

দুজনেই যেন বুঝতে পারছে, সংসার অর্থহীন। অতনু অস্থির হয়ে পড়ে। তার মনের কথাগুলো কী বেরিয়ে পড়বে এবার?
নিজের কথা ভাবে সমীক্ষা। অহঙ্কারের মতো করে বলে:
আমি কিন্তু পাকা ঘরনির
বীজমন্ত্র পেয়ে গেছি ঠিক।

তাই তো! কিন্তু সংসারের নিরেট মালিকানা নিয়েও সমীক্ষার সংশয় কাটে না। অতনু ছদ্ম-আক্রোশে জানতে চায়, সমীক্ষা কেন দিন শেষে সংসারে ফিরে আসে? সমীক্ষা বিস্মিত হয়, এ প্রশ্ন কেন? সংসারেই তো ফিরে আসবে। বা আসতে হয়! অতনু কি সংসারবিবাগী? বেদনায় মরে যেতে চায় সমীক্ষা। অতনুর সেদিকে খেয়াল নেই। নিজের স্ত্রীকে তার কাছে আজন্মের সন্ন্যাসী মনে হয়। সংসারে থেকেও যে নেই। সমীক্ষা জানায়, বিবাগী নয়। সে ঘরই চায়। এবার অতনু ভৎর্সনা করে ওঠে। ঘর পরম সহায়— এটা তো তথাকথিত নারীদের মনোভাব। সমীক্ষার ক্ষেত্রে তো এটি প্রযোজ্য হবার কথা ছিল না! হঠাৎ কী হল!

সমীক্ষা স্বামীকে বলে:
গুরুদেব, আপনার বাকরুদ্ধ মহিমা অপার
আপনি কী করে বুঝবেন ! এই ঘরের দেয়াল
খোলা মাঠ দিয়ে গড়া। এ-ঘরের ছাদ
নক্ষত্রের চেয়ে উঁচু, আকাশের চেয়েও অবাধ।
এ-ঘরের শ্বাস ঝড়ো হাওয়ার চেয়েও বেসামাল।

অতনু ভয় পায়। কেঁপে ওঠে। সমীক্ষা ঘরকে মাঠ ভাবছে! তবে কী এবার ঘর ভাঙবে? না। সমীক্ষা অতনুকে নিশ্চিন্ত করতে চায়। ঘর ভাঙবে না সে। এ-ঘর মাঠের আদলের মতো স্থায়ী ঠিকানা তার কাছে।
অতনু এবার কৌতূহলে জানতে চায়, কিসের আশ্বাসে, কোন বিশ্বাসে সে ঘরকে স্থায়ী ভাবে? সমীক্ষা জানায় ঘরই তো ঠাঁই। অতনু আবার জানতে চায়, ঠাঁই কেন?

সমীক্ষা বলে:
সব পাখি ঘরে ফেরে তাই।
এবার সে জীবননান্দকে উজিয়ে রবীন্দ্রনাথের কাছে যেতে চায়। বলে, রবীন্দ্রনাথও খেয়া পারাপার করে শেষে ঘরেই ফিরেছেন। তাই সবাই শেষ পর্যন্ত ঘরে ফেরে। সমীক্ষা জানায়, রবীন্দ্রনাথে ডুবে থাকলেও দিনশেষে অতনুই সমীক্ষার বড় আশ্রয়।
অতনু যেন অস্থির হয়। জানতে চায়, রাত কখন ফুরাবে? কখন সকাল হবে!
অতনু মনে মনে ভাবে:
অন্ধকারে কিছুতে সময়
কাটে না। (থেমে) তা ছাড়া রাত্রিতেই
আত্মহত্যা করা যায় সহজে (প্রায় চেঁচিয়েই)
নিতান্ত সহজেই।

সমীক্ষা বিভ্রান্ত হয়। কি হলো অতনুর?
অতনু সমীক্ষাকে উপেক্ষা করতে চায়।
বলতে চায়, সে মরতে চায়।
অতনু বলে:
যতবার মেকি
দিনকে রেখেছিল পাহারায়
চোরা পায়
রাত্রিকে টেনেছি তত কাছে
পাছে
মিথ্যে হয়ে যায় আড়ম্বর
তাই আমি চোখের ওপর
ছড়াই তৃষ্ণার সরঞ্জাম,
ক্লান্তি যার আরও এক নাম।

সমীক্ষা আতঙ্কিত হয়। আদর-সোহাগে ভরিয়ে দিতে চায় অতনুর দেহ-মন। কিন্তু অতনু সেসব চায় না এখন। অন্তত এ-রাতে নয়!
কিন্তু সমীক্ষা মরিয়া। অতনু বলে,
এ তোমার প্রেম নয়। এর নাম মুগ্ধ আত্মরতি।

সমীক্ষা দুঃখিত হয়। বলে:
প্রেম তো চিরকাল
নিজেকেই খোঁজে-নিজ সত্তার প্রবাল-
নিজ জন্ম-নিজ মৃত্যু-গতি অসংগতি !

অতনু:
না, আমি মানি না, প্রেম কেবলই আপন
প্রতিবিম্ব করে অন্বেষণ।
আমি চাই আমার অধিক-
হোক তা অনন্ত খরা, লোকষ্মান কিংবা অলৌকিক।

সমীক্ষা:
আমি কি তা নই?

অতনু:
না। তুমি অথই।
আলিঙ্গন-গভীর উত্তাল ওঠা-পড়া-
কেবলই আপন তটরেখা ছুঁয়ে ছুঁয়ে।

সমীক্ষা:

তাহলে কি বিদেশ বিভূঁয়ে
খুঁজবে প্রেম অন্তর্ঘাতী চরা?

অতনু স্বীকার করে। হ্যাঁ। সে নিজেকে উজিয়ে এগুতে চায় না। তার কোনো দুঃখ নেই। কোনো সন্তাপ নেই। অতনু অনুভব করে, সে যেন সমীক্ষার ক্ষুধার্থ উপাসক কেবল।
সমীক্ষা যেন ক্লান্ত। সবকিছুকেই কি অতনু নির্বাসন দেবে?
অতনু জানায়, সেটি নয়। সমীক্ষা ঘরের টানে বেঁধে আছে, অতনুও যেন সে তারে বাঁধা।
অতনু এবার গভীর ক্লান্তিতে জানায়, তার নামের কোনো মানে নেই!
লতু পিসির স্বামীর মতো অতনু নিজের নামের কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছে না দেখে সমীক্ষা কেঁপে ওঠে। অতনুর উপর যেন লতু পিসির স্বামী ভর করেছেন।
দৃশ্যের শেষে অতনু ঘরে পায়চারি করে। সমীক্ষা আকুল হয়ে কাঁদছে।

দ্বিতীয় দৃশ্যে অতনু-সমীক্ষার পুত্র খোকন আহ্লাদ করে বাবাকে বলে, তার কলের গাড়ি ভেঙে গেছে, এখন সে কী করে রাক্ষসের তেপান্তর পাড়ি দেবে! বাবা বলে, কলের গাড়ি লাগবে না, একটু বড় হলে পায়ে হেঁটেই খোকন দূর দেশে চলে যেতে পারবে। খোকন কৌতূহলে জানতে চায়, তার বাবা তো অনেক অনেক বড়, তবে কেন সে দূর দেশে চলে যায় না, রাক্ষুসিরা খেয়ে ফেলবে বলে? অতনু খোকনকে বলে, রাক্ষুসিরা বড় মানুষের রক্ত ভালোবাসে না। তাই। খোকন অবাক হয়, বলে, দূরে গেলে মা বুঝি বকবে বাবাকে? অতনুর অস্বস্তি হয়। প্রসঙ্গ পালটে ছেলেকে দৈত্য, রাজা এসব গল্প শুনাতে চায়। খোকনের ওসবে আগ্রহ নেই। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে জানতে চায়, মেঘ যে ছুটে পালাচ্ছে, ওরা বুঝি ঘর থেকে ছুটি পেয়ে গেছে? বাবা-ছেলেতে গল্প করে এসব…। সমীক্ষা প্রবেশ করে। গতরাতের স্মৃতি তাড়া করছে তাকে। সমীক্ষা নিজের সিদ্ধান্ত জানাতে চায়, সে অতনুকে মুক্তি দিতে আগ্রহী, এর পর সে নিজেও মুক্তি চায়।

তৃতীয় দৃশ্যে অতনু রাস্তায় দাঁড়িয়ে। রাস্তায় তখন ধেয়ে আসছে দীর্ঘ মিছিল। অন্ন চাই বস্ত্র চাই বাঁচার মতো বাঁচতে চাই। নাগরিকের মৌলিক দাবী। সন্দেহ নেই। সেখানেই এক কর্মচ্যুত সাংবাদিকের দেখা পায় অতনু।
সাংবাদিক অতনুকে মিছিলে যাবার আহ্বান জানায়।
অতনু মিছিলে চলে যায়। গল্প জুড়ে দেয় সাংবাদিকের সঙ্গে। সেখানেও সংসার-সংসার খেলা। মৃত্যু। সাংবাদিকের বউ গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

সাংবাদিক:
কেবলই অভাব ঘেঁটে শেষটায় আমরা দুজন
খুইয়েছিলাম সব প্রেম।

অতনু:
মেয়েরাও
যদি জানত ধন্য-করা ঘর
কী দারুণ মৃত্যু পুষে রাখে!

অতনু বলে:
আমার সমস্ত মন বাতগ্রস্ত। তৃপ্তির পাহাড়
আমার সমগ্র বৃষ্টি কেড়ে নেয়। আমি তাই পথে
পালিয়ে এসেছি কোনোমতে-
পিছনে বন্ধনময়ী প্রেয়সী ঘরনি।
সাংবাদিক মনস্তাপে ভুগে। সে তো কখনো অসাধারণ কিছু চায়নি। কেবল ভাত-কাপড় চেয়েছিল। অথচ প্রাপ্তি শূন্য। তাঁর জীবন কাটছে মৃত স্ত্রীর আত্মা শুঁকে।
সাংবাদিকের সংসারে যা নেই, তার সবই তো আছে অতনুর সংসারে! তবু কেন জীবন হতে চায় আট বছর আগের একদিন!
অতনুর এবার দেখা হয় মিছিলের এক মুখের সঙ্গে। সে স্লোগান দিচ্ছিলো। কিন্তু কোনো গভীর সংকল্পে নয়। টাকার লোভে। অতনু জীবনের অন্তসারশূন্যতাকে আবার নতুন করে উপলব্ধি করে।

রঙ্গমঞ্চে এবার কবির উপস্থিতি—
অতনু: মুক্তি চাই, আমি মুক্তি চাই।
কবি: মুক্তি ! কীসে থেকে !
অতনু: গৃহের উষ্ণতা থেকে, পরিতৃপ্ত দেহমন থেকে।
কবি: তুমি কি একাই
চেয়েছ অমন মুক্তি? জান না তোমার
কতজন পূর্বসূরি ছিলেন, উত্তরসূরি কত?
অতনু: জানি, ভাই। আরও জানি তাদের বিক্ষত
পরিণাম, বিরুদ্ধ আত্মার সমাচার।
কবি: তাই কি মিছিলে
অবশেষে নিলে
আশ্রয়? তাই কি পান্থজনের সন্ধান?
অতনু: হ্যাঁ। আমার রুদ্ধ প্রেম, অবরুদ্ধ গান
কিছুতেই নয় আট বছর আগের একদিন…

কাব্যনাটকটির শেষে অতনু-সমীক্ষা সম্পর্কের শূন্যতা, সীমাহীন ক্লান্তি নিয়ে ভবঘুরের মতো মিছিলে চলে যায়। একসময় তাদের একমাত্র সন্তান খোকনও মিছিলের মুখ হয়। সে বলতে থাকে—
‘অন্ন চাই বস্ত্র চাই বাঁচার মতো বাঁচতে চাই’।
সমীক্ষা-অতনু ‘আট বছর আগের একদিন’ এর হাতছানি এড়াবার পথ খুঁজে ফেরে, ম্লোগানে আর মিছিলে। তারা তাদের একক জীবন থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে সংখ্যাগরিষ্ঠের মৌলিক দাবীর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে যেন অবসান ঘটাতে চায় নিজেদের অন্তহীন ক্লান্তির।

আরো পড়তে পারেন

প্রতিটি শূন্যতা যেন নতুন শোকের জন্ম দেয়

শূন্যতার আকাশে স্মৃতির মেঘ জমে। জীবন সরে সরে আসে মৃত্যুর দিকে। ফুরিয়ে আসা সময়ের দাপট এড়াতে পারে না কেউ। একজীবনে বহু জীবনাবসানের দেখা পাওয়া যায়, হয়তো দুর্ভাগ্যক্রমেই। ব্যক্তির মৃত্যুর পরিসমাপ্তি একবারই হয়, তবে সেই ব্যক্তি যদি বহুপ্রাণের সাথে জুড়ে থাকেন, তাঁর অনুপস্থিতি বারংবার অনুভূত হয়। প্রতিটি শূন্যতা যেন এক নতুন শোকের জন্ম দেয়। ২০২৪ সালে….

কোলরিজ: দার্শনিক, রোমান্টিক এস্থেটিক কবি

স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ, ১৭৭২ সালের ২১ অক্টোবর ইংল্যান্ডের ডেভনশায়ারের অটারি সেন্ট মেরি শহরে জন্মগ্রহণ করেন। অটারি সেন্ট মেরি হলো ইংল্যান্ডের ডেভন কাউন্টির একটি ঐতিহাসিক গ্রাম, যেখানে স্যামুয়েল টেলর কোলরিজের দুর্দান্ত শৈশব কেটেছিল। কোলরিজের নান্দনিক চেতনায়, মননে, শিল্পবোধে এ গ্রামের ‘সেন্ট মেরি’স চার্চ’, যা একটি অ্যাংলিকান গির্জা, ডেভনের ছোট ছোট পাহাড়, ‘ডার্টমুর’, ‘এক্সমুর’ ছিল আন্দোলিত। এখানে….

অর্বিটাল’র স্রষ্টা সামান্থা হার্ভে জিতলেন বুকার প্রাইজ

আঘাতপ্রাপ্ত পৃথিবীর গল্পে আমি থাকেত চাই শুধু মানবতা আর প্রকৃতির কাছে ঋণী। ব্রিটিশ লেখিকা সামান্থা হার্ভে এমন কথা বলেছেন কি না জানা হয়নি। তবে বুকার পুরস্কারের বিচারক প্যানেল হার্ভের মানবতা আর প্রকৃতির কাছে ঋণী থাকার মনোভাবের পরিচয় পেয়েছেন তাঁর অসাধারণ উপন্যাস অর্বিটাল’র মধ্যে। যার জন্য ২০২৪ সালে বুকার পুরস্কার বিজয়ী হিসেবে সামান্থা হার্ভেকেই বেছে নিয়েছেন….

error: Content is protected !!