আমি: আমাদের সারাজীবনের দুঃখ-আনন্দের সমষ্টি কত? এখানে দুঃখকে আনন্দের উল্টো বা বিয়োগাত্মক আনন্দ বলে ধরে নেয়া যেতে পারে! অংকের কোন শাখা থেকে এই প্রশ্নের হিসাব মিলবে?

আর্কিমিডিস (Archimedes, খ্রিস্টপূর্ব ২৮৭-২১২) : এটি হবে একটি ক্ষেত্রফল (area) মাপার সমস্যা, জ্যামিতি দিয়ে চেষ্টা করা যেতে পারে। একদিকে আনন্দ-দুঃখ, আরেকদিকে সময়। মানুষের জীবনে আনন্দ-দুঃখ সময়ের সাথে কেমন করে বাড়ে কমে ? ধরা যাক x-axis এ সময় এবং y-axis এ আনন্দ-দুঃখ আঁকছি। গ্রাফটা কেমন হবে? গ্রাফটা যদি সরল রেখা হয় তাহলে হিসেবটা সহজেই করা যাবে। রেখার নিচের ক্ষেত্রফলটুকু হবে জীবনের দুঃখ-সুখের যোগফল। কিন্তু জীবনের সুখদুঃখ বক্রপথে চলে, বারে বারে দিক পরিবর্তন করে, চাকার মতো ঘোরে। এমন আঁকাবাঁকা রেখার নিচের ক্ষেত্রফল মাপা সহজ নয়।

অরিয়াভাটা (Aryabhata, ৪৭৬-৫৫০) : আমি ভারতের পাটালিপুত্রের বিজ্ঞানী। আমি ত্রিভুজের ক্ষেত্রফল মাপার সূত্র দিয়েছি, অনেক আঁকাবাঁকা জমির ক্ষেত্রফল মেপেছি। একটি আয়তক্ষেত্রের (rectangle) ক্ষেত্রফল ওর দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থের গুনফল, একটি ত্রিকোনোকার জমির ক্ষেত্রফল হলো ওর ভূমি এবং উচ্চতার গুণফলের অর্ধেক। তাই একটি আঁকাবাঁকা জমির ক্ষেত্রফল মাপতে হলে ওকে আগে কতগুলো আয়তক্ষেত্র এবং ত্রিকোণে ভাগ করতে হবে।

প্লেটো (খ্রিস্টপূর্ব ৪২৮-৩৪৮) আমার বিশ্বাস মহাবিশ্ব জন্মানোর আগে জ্যামিতি ছিল। জ্যামিতি আত্মাকে সত্যের দিকে নিয়ে আসে। আমার একাডেমির উপরে বড়ো করে লিখে দিয়েছি, ‘যে জ্যামিতি জানে না তার এখানে প্রবেশের অধিকার নেই!’ জীবনের সুখদুঃখের যোগফল জ্যামিতি দিয়ে বের করা যাবে।

অরিয়াভাটা: ধরা যাক একজন মানুষ ষাট বছর বাঁচলো। এর মধ্যে চল্লিশ বছর দশ মাত্রার আনন্দে কেটেছে, আর বিশ বছর কেটেছে আট মাত্রার দুঃখে। এমন মানুষের সারা জীবনের সুখদুঃখের যোগফল দুটি আয়তক্ষেত্রের ক্ষেত্রফলের বিয়োগফল, (৪০) (১০)-(২০) (৮)=২৪০ আনন্দ মাত্রা-বছর। তবে আর্কিমিডিস যেমন বলেছেন, মানুষের জীবনের সুখদুঃখ সরল পথে চলে না। বক্র পথের অংক বেজায় কঠিন হবে!

আর্কিমিডিস: ধরো একটি বৃত্ত যার ব্যাসার্ধ জ, বৃত্তটির ক্ষেত্রফল কত হবে? বৃত্তের পরিধি একটি বক্র রেখা, তবে একটি সহজ নিয়ম মেনে চলা বক্র রেখা, মানুষের জীবনের সুখদুঃখের মতো জটিল নয়। তবুও একটি বৃত্তের ক্ষেত্রফল বের করতে আমি অনেক পরিশ্রম করেছিলাম। উত্তরটা হলো ব্যাসার্ধের বর্গকে ‘পাই’ দিয়ে গুন করতে হবে, ‘পাই’ হলো বৃত্তের পরিধি-ব্যাসের অনুপাত। আমি প্রথমে বৃত্তটিকে অসংখ্য ক্ষুদ্রক্ষুদ্র ত্রিকোণে ভাগ করেছিলাম, তারপরে প্রয়োগ কিরেছিলাম বিভিন্ন জ্যামিতিক কৌশল। বৃত্তের ক্ষেত্রফল জানার পরে আমি লেগেছিলাম বলের মতো একটি গোলকের ক্ষেত্রফল মাপার পেছনে। অনেক মেহনত করে সেটাও বের করেছিলাম। তারপরে বের করেছিলাম একটি সিলিন্ডারের ক্ষেত্রফল। এদের পেছনে জীবনের এতো সময় ব্যায় করেছি যে আমার নির্দেশ ছিল, কবরে আমার মাথার কাছে যেন একটি গোলক এবং একটি সিলিন্ডার রেখে দেওয়া হয়।

নিউটন (১৬৪২-১৭২৬): একটি বৃত্ত বা গোলকের ক্ষেত্রফল নির্ণয়ের জন্যে আর্কিমিডিসের মতো গণিতজ্ঞের যদি এতো কষ্ট করতে হয়, তবে সাধারণ মানুষের উপায় কি ? শুধু জ্যামিতি, আলজেব্রা, এবং ত্রিকোণমিতি দিয়ে কাজ হবে না। আমি আবিষ্কার করতে চাই এক নতুন ধরণের গণিত যার নাম হবে ক্যালকুলাস!

লেখক : তোমার গতিসূত্র ক্যালকুলাসের ভাষায় লিখলে ওর মাহাত্ম ভালোমতো বোঝা যায়। পদার্থবিদ্যার সব সূত্রই এই ভাষায় লেখা। মনে হয় ঈশ্বর এই ভাষাতেই সংক্ষেপে মহাবিশ্বের সৃষ্টি রহস্য লিখেছেন!

নিউটন: আমি যখন মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব নিয়ে ভাবছিলাম, তখন প্রথম ক্যালকুলাস গণিতের প্রয়োজন অনুভব করি। একটি আপেল যখন পৃথিবীর কেন্দ্রের দিকে পড়ছে, পৃথিবীর প্রতিটি ক্ষুদ্রক্ষুদ্র অংশ ওকে আকর্ষণ করছে। সেই আকর্ষণের পরিমান এবং দিক প্রতিটি অংশের জন্যে আলাদা। শুধু জ্যামিতি, আলজেব্রা, এবং ত্রিকোণমিতি দিয়ে এদের যোগফল বের করা গণিতজ্ঞ আর্কিমিডিসের পক্ষেও সম্ভব নয়।

আমি: যখন প্রথম ক্যালকুলাস শিখি তখন সব কিছুই উদ্ভট মনে হয়েছিল। একটি বৃত্তের পরিধির অতি ছোট্ট একটি খন্ড সরল রেখার মতো দেখায়। ক্যালকুলাসের ভাষায় একে বলে, ফী, বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র (infinetesimal) অংশ। একটি বৃত্ত যেন কতগুলো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সরল রেখার সমষ্টি!

কার্ল মার্কস (Carl Marx, ১৮১৮-১৮৮৩): উদ্ভট মনে হওয়াটা স্বাভাবিক। আমি একে পরস্পর বিরোধী অবস্থান (contradictions) বলে চিহ্নিত করেছি। আমার দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (dialectic materialism) প্রকৃতির এইসব দ্বন্দ্বকে ঘিরেই গড়া। বস্তুর মধ্যে পরস্পর বিরোধী সত্তার অবস্থান, অতি সাধারণ রূপ থেকে জটিল রূপের সৃষ্টি, এক কাঠামো থেকে আরেক কাঠামোয় বিবর্তন! সমাজ বিজ্ঞান এবং অর্থনীতিতে এধরণের বিরোধের খোঁজ পেয়েছি, যেমন পুঁজি এবং শ্রম।

নিউটন: এবার জীবনের সুখদুঃখের হিসাবটা করা যাক। অংকের ভাষায় লেখা যাক, y=f(x), এখানে y হলো সুখদুঃখ, x হলো সময়, f কে বলা হয় ফাংশান (function), ফাংশানটার কাজ হলো সময়ের সাথে সুখদুঃখের সম্পর্কটা অঙ্কের ভাষায় বলে দেয়া। উত্তরটা হবে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত f(x)dx এর যোগফল। ইন্টেগ্রাল ক্যালকুলাস শেখায় কেমন করে এই যোগ করা যায়। যোগের অপর দিকে থাকে বিয়োগ বা ভাগ। সেটা ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাসের বিষয়। মানুষের সুখদুঃখ অনেক কিছুর উপর নির্ভর করতে পারে; স্বাস্থ্য, ভালোবাসা, নিরাপত্তা, অর্থ, ইত্যাদি। এমন জটিল ফাংশানের জন্যে চাই ভেক্টর ক্যালকুলাস।

আরো পড়তে পারেন

হাঁটার দর্শন ও বরেণ্যদের হাঁটাহাঁটি

মানুষ দু’পায়ে হাঁটা প্রাণী। জন্মের প্রথম বছর হাঁটতে পারে না। মানুষের বাচ্চা হাঁটা শুরু করতে এক বছরের বেশি গড়ায়। যদিও অনেক প্রাণীর বাচ্চারা জন্মের পরেই হাঁটতে পারে। মানুষ প্রাণীর বাচ্চারা জন্মের ছয় মাস পরে হামাগুড়ি দিতে শুরু করে। এরপর হাঁটতে শুরু করে এক থেকে দেড় বছর সময়ের মধ্যে। মানুষ হাঁটে। মানুষকে হাঁটতে হয়, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে। হাঁটা….

নতুন জীবনবোধের ঘোষক কাজী নজরুল ইসলাম

কাজী নজরুল ইসলাম লেখালেখিতে আত্মপ্রকাশ করেন ১৯১৯ সালে। তার মানে নজরুলের আগের আধুনিক বাংলাসাহিত্যের বয়স একশ বছরের কিছু বেশি। বিশ শতকের আগের আধুনিক বাংলাসাহিত্যকে প্রবণতার দিক এক কথায় যদি ধরতে চাই তাহলে বলতে হবে, এ সাহিত্য প্রধানত ইউরোপীয় চিন্তাচেতনা ও সাহিত্যের প্রেরণাজাত। সমগ্র উনিশ শতক আসলে বাঙালির ‘আধুনিক’ হওয়ার প্রচেষ্টার কাল। ইংরেজের বইপত্র, শিক্ষা ও….

ছাত্র-প্রতিবাদ: শক্তির এক প্রমাণপত্র

নিয়তি চিত্রনাট্য লেখে ঠিকই। তবে সেই কলমে কালিটা আপনাকেই জোগাতে হয়। নয়তো নিয়তি নিশ্চুপ বসে থাকে প্রাণহীন কলমের প্রান্ত হাতে; আর জীবন-ইতিহাসের পৃষ্ঠা সাদাই থেকে যায় আলস্যের করুণ পরিণতি হয়ে। সেই করুণ পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই হঠাৎ আমাদের ছাত্রসমাজ বৈষম্যবিরোধী এক্সটেনশন নিয়ে হাজির হলো নিয়তিকে দিয়ে বাঙালির বিজয়গাঁথা লিখিয়ে নিতে। ‘এমন কতদিন কাঁদিনি /….

error: Content is protected !!