Author Picture

সেকুলার নির্মাতা ইসমত চুগতাই

কাউসার মাহমুদ

স্বতন্ত্র স্বর ও নিজস্ব স্টাইলে উর্দূ সাহিত্য ইতিহাসে ইসমত চুগতাই (১৯১৫-১৯৯১) অনন্য উজ্জ্বল এক নাম। ধ্রুবতারা’র মতোই জ্বলজ্বলে উজ্জ্বল তার শ্রেষ্ঠ সব সৃষ্টিকর্ম। বহুলপ্রজ এ ছোটগল্পকার শিল্প-সাহিত্যে বিশেষ অবদানে অর্জন করেছেন ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মশ্রী পুরস্কারসহ নানাসব বৃহৎ সম্মাননা। কিন্তু ভারতীয় সিনেমায় তার বিশেষ ও গুরুত্বপূর্ণ অবদান সম্পর্কে কতটুকু জানি আমরা! কখনো আলোচনা হয় কি এ সম্বন্ধে!

পরিচালক ও নির্মাতা স্বামী শাহেদ লতিফের সঙ্গে- জিদ্দি (১৯৪৮) থেকে মেহফিল (১৯৮১) পর্যন্ত মোট ১৭টি ভারতীয় সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন তিনি। বিখ্যাত এ জুটি- দেব আনন্দ’কে তাদের সিনেমা ‘জিদ্দি’তে প্রধান রোল দিয়ে ডেব্যু করান। এবং ‘মারনে কি দাওয়া’ই কিয়ো মাঙ্গো/ জি-নে কি তামান্না কো-ন করে’ গানের মাধ্যমে কিশোর কুমারকে প্রথম প্লেব্যাক করার সুযোগ দিয়ে হিন্দি সিনেমায় পরিচয় করিয়ে দেন।

প্রসিদ্ধ চিত্রনাট্যকার ইসমত চুগতাই চিত্রনাট্যের পাশাপাশি একাধারে রচনা করেছেন জনপ্রিয় সব ডায়ালগ। বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে পরিচালনা ও নির্মাণ করেছেন বিভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্র। যাহোক- এই নিবন্ধে বিশেষত তার বিখ্যাত দুই ফিল্ম- ‘সোনে কি চিদ্দিয়া ও গরম হওয়া’র উপর দৃষ্টিপাত করা হবে।

‘সোনে কি চিদ্দিয়া’ মুক্তি পায় ১৯৫৮ সালে। যেটির গল্প তিনি নিজে লিখেছেন এবং কো-প্রোডিউসর হিসেবে তার স্বামীর সঙ্গে কাজ করেছেন। এটি একটি সামাজিক চলচ্চিত্র। ছবিটি ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের পেছনে লুকিয়ে থাকা নানাবিধ দৃশ্য উপস্থাপন করে। ছবিটিতে অভিনয় করেন নোটন, সংগীত শিল্পী ও অভিনেতা তালাত মাহমুদ এবং বলরাজ সাহনি। মূলত ছবিটিতে সিনেমা জগতের উজ্জ্বল আলোর পেছনে নির্যাতিত ও শোষিত এক শিশুশিল্পীর গল্প বলা হয়। মুক্তির পরপরই যেটি দর্শক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেন এবং এর মাধ্যমে ইসমত চুগতাই অর্জন করেন অকল্পনীয় খ্যাতি। ভারতীয়রা পায় একজন বিখ্যাত সাহিত্যিকের সঙ্গে খ্যাতিমান ও মেধাবী এক চলচ্চিত্রকারকে।

পুরো ছবিতে অভিনয় পারদর্শী ‘নূতন’ দূর্দান্ত অভিনয় করেন। এবং নিজের প্রিয় জায়গায় সর্বোচ্চ শৈল্পিক দক্ষতা ফুটিয়ে তুলে দর্শক ও সমালোচকদের মন জয় করতে সক্ষম হন। সর্বোপরি এমন পারফরম্যান্সের ফলস্বরূপ অর্জন করেন বেশ কটি পুরস্কার। এ সিনেমার গানের লিরিক লিখেন সাহির লুধিয়ানভি আর কম্পোজ করেন ও,পি নায়ার। এছাড়াও ব্যাবসাসফল এ ছবিটিতে যুক্ত করা হয়েছে কবি কাইফি আজমির বিখ্যাত কবিতা – ‘আজ কি রাত বহুত গরম হাওয়া চলতি হ্যায়/ আজ কি রাত না ফুটপাত পে নিন্দ আয়ে গি।’ কোনপ্রকার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক ছাড়াই এটি প্লে করেছিলেন বলরাজ সাহনি। এরপরও তা এতোটা শৈল্পিক, অকৃত্রিম হয়েছে যে, শিল্প ও সঙ্গীতমনষ্ক যে কোন শ্রোতাই তা আপন অনুভূতি স্পর্শ করে বারবার শুনতে চাইবে।

চুগতাই নির্মিত আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র ‘গরম হাওয়া।’ এটি মূলত ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজন ও মহাত্মা গান্ধীর হত্যার পর সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, রাজনৈতিক গোঁড়ামি ও সার্বিকভাবে সর্বত্র অসহিষ্ণুতার যে বিষবাষ্প ছড়িয়ে পড়েছিলে; সেই বিক্ষুব্ধ ও বীভৎসকালের গল্প বলে। যখন মানবতা ও মনুষ্য বিবেক ওই দুঃসহ সময়ের কবলে হারিয়ে গিয়েছিল। সে- দুঃসহ অন্ধকার এবং রক্তস্নাতকালের একটি চিত্র কাইফি আজমি তার বিখ্যাত দুটি পঙক্তিতে এভাবে বর্ণনা করেছেন – ‘গীতা কি কো-ই শুনতা না কোরান কি শুনতা/ হয়রান সা ঈমান ওহা ভি থা ইহা ভি।’

‘গরম হাওয়া’ অর্থ উত্তপ্ত বায়ূ। যা- ইসমত চুগতাই’র অপ্রকাশিত একটি ছোট গল্পের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়। গল্পটি চুগতাই- পাকিস্তানে দেশান্তরিত হওয়া তার কিছু নিকটাত্মীয়ের দুঃখ-দুর্দশা ও কষ্টে আহত হয়ে লিখেছিলেন। পরবর্তীতে সিনেমাটি নির্মাণকালে কাইফি আজমি ও শামা যাইদিকে এই ছবির জন্য অভিযোজিত করা হয়।

মিসেস চুগতাই প্রথমে এমএস সথিউ মহিশূর শ্রীনিবাস সথিউ
ও তার স্ত্রী শামা যাইদির কাছে গল্পটি বলেন। এদিকে শামা যাইদি একাধারে একজন মেধাবী চিত্রনাট্যকার, কাস্টম ডিজাইনার, আর্ট ডিরেক্টর, থিয়েটার শিল্পী ও ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার। অতএব সবকিছু ঠিক হলে ইসমত’র এ গল্পটি যখন চিত্রনাট্যে উন্নীত করা হয়, আগ্রা ও স্থানীয় জায়গাগুলোতে কাইফি আজমি তার অভিজ্ঞতাগুলো কাজে লাগান। এতে প্রখ্যাত শারদ বাদক উস্তাদ বাহাদুর খা কাইফির গানের সুর করেন।

বিতর্কিত বিষয় হিসেবে নির্মিত হতে থাকা এ চলচ্চিত্র- আগ্রা ও ফতেহপুরে শুটিংয়ের সময় বিভিন্নভাবে প্রতিবাদী জনতার রোষানলে পড়ে। শেষাবধি তাদের মনোযোগ ঘোরাতে নিরূপায় পরিচালককে ক্যামেরা-যন্ত্রসহ ফেইক আরেকটি শুটিং স্পট তৈরি করতে হয়।

অবশেষে ছবিটি সম্পন্ন হয়। কিন্তু তখনও ঝক্কিঝামেলা ফুরায় না। শুরু হয় সমস্যার নতুন উপসর্গ। জনগণ ও গর্ভমেন্টের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার ভয়ে বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মাতারা নতুন করে বেঁকে বসেন।

যদিও ছবির কাস্টিংয়ে একেবারে ভিন্ন ধরণের একটি গল্প বলা হয়েছে। তাছাড়া সথিউ যেহেতু দীর্ঘদিন ধরেই ভারতীয়, বামপন্থী থিয়েটার আ্যাসোসিয়েশন (আইপিটিএ)-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন- তাই দিল্লি, বোম্বে এবং আগ্রার থিয়েটার শিল্পীরা এই চলচ্চিত্রের বেশীরভাগ ভূমিকা পালন করেছেন। বলরাজ সাহনি পরিবারের প্রবীণতম বাসিন্দা হিসেবে তার রোল করেছেন। আর সেলিম মির্জা ছিলেন হতাশ এক মুসলিমের ভূমিকায়। যিনি সবকিছুর পরও পাকিস্তান যেতে অস্বীকার করেন।

যেন, তার বৃদ্ধ বয়সী মা যেমন পৈতৃক হাওলি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে নারাজ, তেমনি সেলিম মির্জাও নতুন ভারতে তার নিঃশ্বাস ধরে রাখতে চলেছেন যেন। সাম্প্রদায়িকতার জের ও অভিযোগে বহুকাল ধরে করে আসা জুতোর ব্যবসা হারিয়েও যিনি ভারতীয় বিশ্বাসকে ধর্ম নিরপেক্ষতায় বাঁচিয়ে রেখেছেন৷ শওকত আজমি- কাইফি আজমির স্ত্রী ( শাবানা আজমির মা) ছবিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। সেলিম মির্জার স্ত্রী বোম্বের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফারোখ শেখ ; যিনি তখন পর্যন্ত আইপিটিএ’র থিয়েটারে কদাচিত অভিনয় করেছিলেন; তিনি এ ছবিতে সিকান্দারের ভূমিকায় পুরোদমে আত্মপ্রকাশ করেন।

ছায়াছবির প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ শুটিংস্পট ছিল আর এস, লাল মাথুরের একটি পুরনো হাওলি। যা মির্জা ম্যানশনের জন্য সবদিক থেকেই পুরোপুরি উপযুক্ত ছিল। লাল মথুর পুরো সময়জুড়ে তাদের পাশে থাকার চেষ্টা করেছেন এবং শুটিংয়ের সুবিধার জন্য পুরো ইউনিটকেই নানা ভাবে সহযোগিতা করেছিলেন। এমনকি পরিচালক সথিউকে- শাহনির মায়ের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য শহরের এক পতিতালয় থেকে বদর বেগমকেও খুঁজে বের করে দেন। এর আগে সথিউ- বিশিষ্ট গজল গায়ক বেগম আখতারকে প্রথম এই জটিল ভূমিকাটিতে অভিনয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি তা যে-কোন কারণ দেখিয়ে ফিরিয়ে দেন। তারপর ৭০ এর দশকে বদর বেগম অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে কিছুদিন বোম্বেতে কাজ করে পরবর্তীতে তিনি আগ্রাতে ফিরে আসেন। এবং আগ্রার জাঁকজমকপূর্ণ রঙচঙে বাতির ভেতর একটি গণিকালয় স্থাপন করেন। যেখানে খদ্দেরদের দীর্ঘ লাইন ছিল। মূলত এটি তার জন্য ছবিতে বিশেষ এক ভূমিকা ছিলো।

সর্বোপরি ছবিটি সম্পন্ন হওয়ার পর সাম্প্রদায়িক অশান্তির আশঙ্কা করে এটি মুক্তি দিতে সেন্সর বোর্ড বেঁকে বসলে; এর জন্য অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ আট মাস। এসময় পরিচালক সথিউ দীর্ঘ দৌড়ঝাঁপ ও কষ্টক্লেষের পর বিভিন্ন সময়ে সরকারের অফিসায়ল ও রাজনৈতিক ব্যক্তিবৃন্দসহ সুশীল, সাংবাদিকদের বেশ ক’বার ছবিটি দেখিয়েছেন। তাদেরকে বুঝিয়েছেন যে এতে প্রশ্নারোপ বা কোনপ্রকার নেতিবাচক মন্তব্য উত্থাপনের সংযুক্তি নেই। এভাবে দীর্ঘ এ ক্লান্তিকর ঝামেলার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে ক্রিটিকাল ও কমার্শিয়াল উভয় সাফল্য অর্জনের মাধ্যমেই ১৯৭৩ সনে ছবিটি মুক্তি পায়। এবং জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ অন্যান্য বেশকিছু সম্মানজনক পুরস্কার লাভ করে। এর মাধ্যমে বেস্ট ডায়ালগ ফিল্মফেয়ার এ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন কাইফি আজমি। একইসঙ্গে সেরা চিত্রনাট্য পুরস্কার অর্জন করেন কাইফি আজমি ও শামা যাইদি। আর বেস্ট স্টোরি এ্যাওয়ার্ড অর্জন করেন মহান ইসমত চুগতাই।

বিশেষত কাইফি আজমির কবিতায় দীর্ঘ ও ঘটনাবহুল যাত্রার দৃশ্যায়ন হয়েছিল সময়ে সময়ে; যা ‘সোনা কি চিদ্দিয়া’র সংক্ষিপ্ত আবৃত্তি হিসেবে শুরু হয়েছিল এবং দীর্ঘ ১৫ বছর পর আরেকটি সফল ছবি গরম হাওয়ায় এসে যুক্ত হয়েছিল। কিন্তু এটাই ছিল উভয়ের করা একসঙ্গে শেষ ছবি। অবশেষে ১৯৭৩ সনের ১৩ এপ্রিল গুমোট গমগমে জ্বলন্ত বাতাস নমিত হয়ে আসে। আর ছবিটির ডাবিং কাজ শেষ হবার পরদিনই বালরাজ সাহনি মারা যান। চলচ্চিত্র সমালোচকদের মতে- ‘তিনি তার দীর্ঘ ও বর্ণাঢ্য জীবনের শেষ মুহুর্তটিতেও দূর্দান্ত অভিনয়ের মাধ্যমে জীবনের পর্দাটি নামিয়ে আনলেন।’

তার রেকর্ডকৃত এ ছবির শেষ; এমনকি তার জীবনে রেকর্ড করা শেষ লাইনটি হলো- ‘ইনসান কব তক একেলা জি স্যাকতা হ্যায়/ কতদিন মানুষ একা-একা বেঁচে থাকতে পারে।’ যে প্রশ্ন এখনো উত্তরহীন রয়ে গেছে!

মূল: সিরাজ খান অনুবাদ : কাউসার মাহমুদ

আরো পড়তে পারেন

আর্জেন্টিনা ১৯৮৬ বিশ্বকাপ স্কোয়াড ছিল দিয়েগো মারাদোনার চাইতেও বেশি কিছু

যে লোকটির জন্যে ’৮৬-এর বিশ্বকাপ সবসময়ই স্মরিত হবে, তিনি দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা। অবিসংবাদিতভাবে তিনিই ছিলেন সেই আসরের সেরা আর আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় দফা বিশ্বজয়ী হওয়ার তুরুপের তাস। সঙ্গত কারণেই আসর জুড়ে যাবতীয় শিরোনামের জন্মদাতা ছিলেন তিনিই। যদিও আর্জেন্টাইন দলে তার ভূমিকার এই আখ্যান কখনও কখনও অতিকথনও হয়ে থাকতে পারে। ‘সেইবার আর্জেন্টিনা শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিতেছিল— কিন্তু….

দ্য পিয়ানিস্ট ইয়ানী

পাঁচ তারকা হোটেলের সবচেয়ে ফাইন ডাইন রেস্টুরেন্টে অতিথিকে স্বাগত জানানোর জন্য বসে আছি। বিশ্বের অন্যতম উন্নত, সবুজ শহরের প্রতিনিধি আমাদের আমন্ত্রণে আজ সকালে দেশে এসে পৌঁছেছেন, কাল আমাদের আয়োজিত সেমিনারে বক্তব্য রাখবেন, অনুষ্ঠানের পূর্ববর্তী সৌজন্য ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে যেখানে আমার অফিসের শীর্ষ পদের ব্যক্তিবর্গ এবং একই কমিউনিটির বাংলাদেশের আরও কিছু ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।….

যে কোনো সুন্দরীর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে ভালবাসি

ছবি আঁকার এই শিল্পসংসারে হাশেম খান নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন রঙের বর্ণিল আলোয়। অনেক এঁকেছেন, লিখেছেনও প্রচুর। সান্নিধ্য পেয়েছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন, শফিউদ্দিন আহমেদ, আমিনুল ইসলাম ও পটুয়া কামরুল হাসানসহ আরও অনেক শিল্পীর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন : মনি হায়দার মনি হায়দার : আপনার শৈশবটা কোথায় কীভাবে কেটেছিল? হাশেম খান : আমার শৈশব গ্রামে, গ্রামের নাম শেখদি, একেবারে….

error: Content is protected !!