Author Picture

পল সেজান ও আমার গাছপালা

মুহম্মদ নূরুল হুদা

সাগরপাড়ের গিরি-বালি-জলধোয়া কক্সবাজার। আমি বলি দরিয়ানগর। বাংলাদেশের সেই উপকূলীয় অঞ্চলেই আমার জন্ম, বৃদ্ধি ও ঋদ্ধি। মনে পড়ে শৈশবের স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা। ভোরে ঘুম ভেঙে গেলে ভিটেবাড়ির হরেক রকম গাছপালাই কেবল নয়, বরং পূবপাশে দিগন্ত-আড়াল-করা লুসাই পাহাড়ের শীর্ষদেশে নানা প্রকারের সবুজ তরুশ্রেণীর ঠায় দাাঁড়িয়ে থাকা, হালকা বাতাসে ওদের দুলে-ওঠা, কিংবা প্রবল বর্ষায় ওদের এলায়িত কুন্তলের ঝাপসা-আঁধার রূপ, কিংবা সূর্যাস্তের অব্যবহিত পরপরই মহেশখালি দ্বীপের আদিনাথ মন্দিরের পাশে দাঁড়ানো সুউচ্চ বৃক্ষের হঠাৎ আলোকবৃক্ষে পরিণত হওয়া- এসব অন্তর্বায়িত দৃশ্যও আমার ভেতর সহজ-সরল গাছপালাকে কেমন যেন রূপান্তরপ্রবণ অভিব্যক্তিতে সমর্পণ করেছিলো। মনে হতো এই প্রকৃতির মতোই নিরীহ একটি তরুও প্রতি মুহূর্তে তার ছুরৎ পাল্টিয়ে নতুন নতুন ইশারা দিতে পারে, যার সবটা আমি বুঝি না। কখনো পাখির মতো ডানাও মেলতে চায় যেন এক একটি তরু। ঘূর্ণিঝড়ে সওয়ার হয়ে সে-ও উড়ে যেতে চায় প্রবল বেগে। মাঝে মাঝে মনে হতো, এসবই আমার মনের ভুল, বোধের বিভ্রম। কিংবা চিন্তার অসংলগ্নতা।

অথচ আমার এই বিসদৃশ দৃষ্টিও যে সত্য হতে পারে, অন্তত একজন শিল্পীর দৃষ্টিতে, তার আকস্মিক পরিচয় পেয়ে যাই ১৯৬৭ সালে, যখন আমি আঠারো-উনিশ বছরের সদ্য-কৈশোরোত্তীর্ণ তরুণ। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র। একটি আর্ট একজিবিশনে হঠাৎ ঊনবিংশ শতকীয় ফরাসি ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকর পল সেজানের কিছু চিত্র দেখে আমি চমকে গেলাম। কিছু বোঝার আগেই আমার মনে হলো এই চিত্রকরের চিত্তলোকে যে গাছ নতুনভাবে জন্ম নিয়েছে সেগুলো আমার দেখা গাছগুলোর অনুরূপ। ওরা শুধু জীবন্তই নয়, বরং নানাবিধ ব্যাখ্যাতীত অভিব্যক্তি দিতে পারঙ্গম। শুরু হলো কার্যকারণহীন ভালো লাগা। আমি হলে ফিরে রাত জেগে জেগে লিখলাম একটি কবিতা। বিষয় : সমুদ্রের তীরে সূর্যাস্তের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা আদিনাথ মন্দিরের পাশের সেই আলোকোজ্জ্বল বৃক্ষ। আমি তেমন কিছু না ভেবেই কবিতাটির নাম দিলাম ‘সেজানের গাছ’। অর্থাৎ আমার গাছ আর সেজানের গাছ সময়, ভূগোল, সংস্কৃতি বা বোধের ভিন্নতা পেরিয়ে এক জায়গায় এসে অভিন্ন হয়ে গেল। এটিও কি অন্যরকম এক নান্দনিক দৃষ্টি? উত্তর যা-ই হোক, এটি আমার প্রথম কাব্য ‘শোণিতে সমুদ্রপাত’ গ্রন্থে সংকলিত হলো। প্রকাশিত ভাষ্যটি :

 

সেজানের গাছ

সময়স্তম্ভের মতো আলোর শরীর নিয়ে
সমুদ্রসঙ্গমে তার আজো অধিবাস
আজো তার ইচ্ছেগুলি তুমুল ফেনার স্বরে
অঙ্গ জুড়ে সবুজ আসর
পাখির উড়াল আঁকা ডালপালা
তবুও শিকড় তার গভীর গিরির উচ্চে
বাতাসের সহগামী করে
জালের বিথার।
সাতরঙা পাখিগুলি সন্ধ্যার বাতাস কেটে
নিশ্চুপ মিনার থেকে সমুদ্রের ডাক উড়ে যায়
অতল অরব জলে অতলান্ত ছায়া যেন কাঁপে।

অসময় উড়োলে সে-ও, অথচ শাখায় তার
বুঝি তাই আকাঙ্খার প্রতিলিপি প্রহরের
আলোর অঙ্গসজ্জায়
সে এখন
সূর্যাস্তের ভিন্নমুখী হলে
পাখির আবাস-
প্রহরায় রেখে
একঠায়
সেজানের গাছ।

* এই কবিতাটি লেখার পর থেকেই পল সেজান ও তার অঙ্কিত তরুরাজি প্রায় পক্ষপাতদুষ্টভাবেই আমার প্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান নিয়েছে।

আরো পড়তে পারেন

চোখ মানুষের জীবনের গল্প ধারণ করে: বেরিশা আলিসদোত্তি

দক্ষ ছায়াপুতুল নাচিয়ের জন্য অন্ধকারই প্রধান প্রেক্ষাপট। আলো সেখানে এক ‘ভাইটাল নেগেটিভ’। আলবেনিয়ান নারীবাদী চিত্রশিল্পী ফিতোরে বেরিশা আলিসদোত্তি তেমনি। নিজে নারী স্বাধীনতা ভোগ করলেও নির্যাতনের অন্ধকারে বন্দি নারীই তার শিল্পের বিষয়বস্তু। যদিও নিঃসঙ্গতার ‘মুদ্রাদোষ’ তার ছিল; তবুও সমাজের চোখরাঙানিকে অগ্রাহ্য করে নির্মাণ করে যাচ্ছেন অন্য এক সাঁকো। যেন প্রতিবাদের ‘এন্টিবডি’ ছড়িয়ে দিচ্ছেন সমাজের শিরায়। আর….

আর্জেন্টিনা ১৯৮৬ বিশ্বকাপ স্কোয়াড ছিল দিয়েগো মারাদোনার চাইতেও বেশি কিছু

যে লোকটির জন্যে ’৮৬-এর বিশ্বকাপ সবসময়ই স্মরিত হবে, তিনি দিয়েগো আরমান্দো ম্যারাডোনা। অবিসংবাদিতভাবে তিনিই ছিলেন সেই আসরের সেরা আর আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় দফা বিশ্বজয়ী হওয়ার তুরুপের তাস। সঙ্গত কারণেই আসর জুড়ে যাবতীয় শিরোনামের জন্মদাতা ছিলেন তিনিই। যদিও আর্জেন্টাইন দলে তার ভূমিকার এই আখ্যান কখনও কখনও অতিকথনও হয়ে থাকতে পারে। ‘সেইবার আর্জেন্টিনা শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জিতেছিল— কিন্তু….

দ্য পিয়ানিস্ট ইয়ানী

পাঁচ তারকা হোটেলের সবচেয়ে ফাইন ডাইন রেস্টুরেন্টে অতিথিকে স্বাগত জানানোর জন্য বসে আছি। বিশ্বের অন্যতম উন্নত, সবুজ শহরের প্রতিনিধি আমাদের আমন্ত্রণে আজ সকালে দেশে এসে পৌঁছেছেন, কাল আমাদের আয়োজিত সেমিনারে বক্তব্য রাখবেন, অনুষ্ঠানের পূর্ববর্তী সৌজন্য ডিনারের ব্যবস্থা করা হয়েছে যেখানে আমার অফিসের শীর্ষ পদের ব্যক্তিবর্গ এবং একই কমিউনিটির বাংলাদেশের আরও কিছু ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।….

error: Content is protected !!