Author Picture

পুতুলের সংসার

মুকুল

মোড়ে খোকার পান দোকানে গিয়ে পুতুল আবদারী সুরে বললো, ‘ও দা! একটু পান খাওয়াবা না?’
খোকা মাথা নিচু করে পান বানিয়ে যাচ্ছে। মাথাটা উঁচু করে দেখে বলে, ‘দাড়াও দিচ্ছি।’
পাশে দাঁড়ানো মাছওয়ালা সুশান্ত, পুতুলের গায়ের সাথে গা ঘেষে দাঁড়াতে গেলে, পান খাওয়া দাত বের করে পুতুল খেঁকিয়ে উঠে বলে, ‘এ বুড়ো চোদা মরণডা দূরে সইরে দাড়া । শাউওর মধ্যি ঢুইকে না দাড়াতি পারলি মনে শান্তি লাগে না তাইনে?’
সুশান্ত ফুটো বেলুনের মত মুখখানা ঝুলিয়ে সরে দাঁড়ায়। পান মুখে দিয়ে গজগজ করতে করতে আবার রাস্তা ঝাড়ু দিতে শুরু করে পুতুল। সম্প্রতি নেতা খাতা ধরে পৌরসভার রাস্তা ঝাড়ু দেয়ার কাজ পেয়েছে সে। সকাল বিকাল দুই বেলা ঝাড়ু দেয় আর মোড়ে এক কোনায় বসে চিতৈ পিঠা বানায়। পাশে বসে সঙ্গ দেয় পুতুলের আঠারো বছর বয়সী মেয়ে। নিষিদ্ধ পল্লীর জীবন ছেড়ে চল্লিশোর্ধ্ব কালো কুচকুচে রুক্ষ চেহারার পুতুল, তার চেয়ে বয়সে অনেক ছোট সুঠাম দেহের সুমনকে বিয়ে করেছে। থাকে সেই পল্লীর পাশের এক বস্তিতে। সুমন রিক্সা চালায় আর পুতুল সম্রাজ্ঞীর মত বসে রিক্সায় চড়ে বেড়ায়। তা সুমন রিক্সা নিয়ে যেখানেই থাকুক না কেন, পুতুলকে আনা নেয়া এবং পুতুলের ফায়ফরমাশ খাটাই হলো তার আসল কাজ। এর বাইরে সংসারে তার বিশেষ কোন ভূমিকা নেই।

সেদিন রাতে, বারোটার দিকে পিঠা বিক্রি শেষে সুমনের রিক্সায় চেপে বসে পুতুল। ভরা পূর্নিমায় চকচক করছে ভৈরব নদী। ফাল্গুনী হাওয়ায় চারিদিক নেশাগ্রস্ত। নদী পাড়ের রাস্তায় ফুরফুরে বাতাসে শা শা করে ছুটে চলছে সুমনের রিক্সা। পায়ের উপর পা তুলে শরীর এলিয়ে দিয়ে বসে আছে পুতুল। শ্মশান ঘাট পার হয়ে যেই খেয়া ঘাটের কাছে আসলো, হঠাৎ কার যেন একটা গোঙানি শুনতে পায় পুতুল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে, কোনো একটা দোকানের সামনে শুয়ে ব্যথায় গোঙাচ্ছে কেউ।
এই দেখে রিক্সা থামাতে বলে পুতুল। জবাবে সুমনের খুব একটা ইচ্ছা না থাকলেও তার কথা না রাখার সাহস তার নেই। অগত্যা রিক্সা থামায় সুমন। লাফ দিয়ে নেমে এগিয়ে যায় পুতুল। দেখে, এক পাগলি শুয়ে পড়ে ব্যথায় কাতরাচ্ছে। ভালোভাবে খেয়াল করলে দেখে, বাস স্ট্যান্ডের পাগলিটার এমন করুণ অবস্থা। তখন সে আরও কাছে গেলে তার যেন ভিরমি খাওয়ার জোগাড়। কারণ, পাগলির আসলে প্রসব বেদনা উঠেছে। অতএব, এই মুহূর্তে পুতুল কি করবে একটু দ্বিধায় পড়ে যায়। কিন্ত পরমুহূর্তেই সে সুমনকে বলে, ‘ধরো জলদি ওরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া লাগবি।’
সুমন এইবার আমতা আমতা করে বলে, ‘কি কচ্ছো না কচ্ছো এই রাইতে এই ঝামেলা কিডা কান্দে নেবে?’
পুতুল খেঁকিয়ে উঠে, ‘এ বাড়ার বাল! যা কইছি তাই শোন কথা বেশি না কয়ে। দেকতি পারতিছিসনে এ মইরে যাচ্ছে?’
অগত্যা সুমন আগায়।
দুজন মিলে পাগলিকে ধরে রিক্সায় উঠিয়ে সদর হাসপাতালে নিয়ে যায়।

জরুরি বিভাগে দায়িত্বে থাকা নার্স, ওয়ার্ড বয়রা অধিকাংশই ঘুমে। তাদের ভেতর কেবল দুজন মাত্র মানুষ জেগে খোশগল্প করছে। অথচ, কোনো পাগলকে নিয়ে আসায় তারা খুব একটা গা করছিলো না যেন।
‘কই পাইছেন এরে?’
‘কি করবানি এহন?’
‘কিডা দেকপে এরে এত রাতে?’—এইসব নানা প্রশ্নে যখন জেরবার পুতুল তখন চিল্লাতে শুরু করে।
‘এ আপনারা কি এমন তামাশা করবেন, না এরে ডেলিভারি করার ব্যবস্থা করবেন কোনডা? আমারে কিন্তু আপনারা চিনতি পারেন নি। এর ব্যবস্থা করবেন এহনই নতুবা কিন্তু এট্টুপরে হাসপাতাল ঘেরাও হবে কয়ে দিলাম।’
তার গগন বিদারী চিৎকার চেচামেচি শুনে এক ওয়ার্ড বয় ঘুম থেকে উঠে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে। পুতুলকে দেখেই সে চিনতে পেরে এবং নার্সদের কানেকানে বলে,
‘আপা! এর একটা দ্রুত বিহিত করেন। নতুবা, এ হলো পাড়ার মাইয়েছাওয়াল। শেষে সব বল্লার চাকের মত গুষ্টি শুদ্ধ আইসে ঝামেলা পাকাবেনে। তার চাইতে আমরা বরং বিষয়টা দেহি। যদি হলো তো হলো, নালি পরে একটা বুজ তো দেয়া যাবে।’
এই কথা শুনে এক নার্স দ্রুত ডাক্তারের রুমে যায়। তাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে সবকিছু বলার পর, ডাক্তার দ্রুত ইমার্জেন্সিতে এসে, রোগী চেক করে ওটিতে নিয়ে ট্রাই করতে বলে। নার্সরা পাগলিকে ওটিতে নিয়ে যায় এবং নরমাল ডেলিভারিতেই একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম হয় সেই মধ্যরাতে।
পুতুল গিয়ে বাচ্চাটি কোলে নেয়। তখন তার রুক্ষ পাশান হৃদয়েও একটা অজানা ঢেউ ওঠে। নিজের অজান্তেই চোখ বেয়ে পানি নেমে আসে তার। বহু বছর হয় পুতুল কাঁদে না। পাড়ায় যখন প্রথম প্রথম আসে পুতুল তখন নেশাখোর খদ্দের আর সরদারনীর অত্যাচারে নিয়মিত কাঁদতো কিন্তু এক সময় সে পুরনো হয় তারও আধিপত্য হয়। সেই সাথে চোখের জলও শুকিয়ে যায়। ওখানেই একটা সন্তান জন্ম দেয় পুতুল; যাকে বছর দুই আগে বিয়ে দিয়েও নিজের কাছে রেখেছে। জামাই গ্যারেজে কাজ করে এবং যথারীতি পুতুলের সংসারেই থাকে। সংসার খরচ সবাই দিলেও কর্তৃত্ব পুতুলের হাতেই।
সেই পুতুল বহুদিন পর আজ কাঁদছে।

একটু পর এক নার্স এসে বলে, ‘ডাক্তার ডাকতেছে আপনারে।’
পুতুল বাচ্চাকে কোলে নিয়েই ডাক্তারের রুমে যায়। ডাক্তার তার কাছে পুরো বৃত্তান্ত জানতে চায়।
সব শুনে ডাক্তার বলে, ‘দেখেন! বিষয়টা আইনত এখন পুলিশকে জানানো আমাদের কর্তব্য। এবং এ শিশু পুলিশের মাধ্যমে সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় নিয়ে যাওয়া হবে এই হচ্ছে সিস্টেম।’
এই শুনে পুতুল ভাবনায় পড়ে যায়। কেননা, শিশুটিকে কোলে নেওয়ার থেকে এক অদ্ভূত মমতা অনুভব করছে সে। তাই শিশুটিকে তার দিয়ে দিতে হবে, এটা সে মানতেই পারছে না। ফলে কি করবে কিছুই মাথায় আসছে না তার। পরমুহূর্তেই মনে পড়ে, তার নিজের মেয়ের মা হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এদিকে তার মনেও এই বাচ্চার প্রতি একটা গোপন দাবী জন্ম নিচ্ছে। কিন্তু তা প্রকাশ করতে পারছে না সে।

এদিকে কেইসটি জটিল হতে পারে এই আশংকায় ইতোমধ্যেই ইমার্জেন্সি মেডিকেল অফিসার আরএমও কে ফোন দিয়ে আনিয়েছে। আরএমও এসে দেখে হাসপাতাল মোড়ে পিঠা বিক্রি করা পুতুল। পুতুলের কাছ থেকে নিয়মিত পিঠা কেনে সে। অতপর সবকিছু শুনে পুতুলকে ডাক দেয় সে। তার কাছেও সবিস্তারে শুনে আরএমও একই কথা বলে। তখন পুতুল আরএমওর কাছে কাঁচুমাচু করে তার গোপন ইচ্ছেটা প্রকাশ করেই ফেলে।
তা শুনে ডাক্তার বলে, ‘এই বাচ্চা নিয়ে তুমি কি করবা? নিজেই তো অভাবে সংসার চালাও। তার চেয়ে বরং বাচ্চাটি যদি সরকারের অধিনে যায় তাহলে একটা ভালো পরিবারে মানুষ হবে।’
পুতুল করজোড়ে মিনতি করে এবং একপর্যায়ে কেঁদেই বলে, ‘সার! আপনি পুলিশরে না জানালিই তো হয়। চুপচাপ আমারে দিয়ে দেন। আমি গরিব ঠিকাছে, কিন্তু এই বাচ্চারে ভালো মতই মানুষ করতি পারবো। লেহাপড়া শিখেবো। আমি তো এইখানেই থাকি আপনি সব খোঁজ জানতি পারবেন। আপনি একটু দেহেন না সার। আমার মাইয়েডাও মা হতি পারবে না। এই বাচ্চাডা নিয়ে আমরা অনেক যতনে পালবানি সার।’
পুতুলের অঝোর কান্নায় আরএমও দ্বিধায় পড়ে যায়। যদিও সে আগেও খেয়াল করেছে পুতুলের দৃঢ়চেতা এবং লড়াই করে টিকে থাকার মনোভাব খুব প্রবল। তাই কয়েক মুহুর্তে কিছু না বলে সে বাইরে গিয়ে একটা সিগারেট ধরায়। তারপর এসে বলে, ‘আচ্ছা! এই বাচ্চা আমি তোমায় দিতে পারি ঠিক। কিন্তু স্থানীয় কোনো নেতা বা গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি লাগবে।’
পুতুল বলে, ‘আচ্ছা সার আমি আসতিছি।’
পুতুল সেই রাতেই ফোন দেয় উপজেলা চেয়ারম্যান এর খাস লোক হিরুকে। হিরুর মাধ্যমে পাড়ায় বাংলা মদের কারবার চলে এবং পাড়ার ঝক্কি-ঝামেলা হিরুই সামলায়।
সব শুনে হিরু বলে, ‘ওকে আমি বসরে ফোন দিচ্ছি। তুই বস্তিতে মদের শেল্টারের ব্যাপারটা দেখ।’ এই বলে ফোন রেখে দেয় হিরু।

এর মাঝে কেটে গেছে বেশকিছু সময়। আরএমও-কে বুঝিয়ে শুনিয়ে পুলিশ খবর দিতে দেরি করাচ্ছে। এদিকে পুতুল গিয়ে বার বার মেয়েটাকে দেখে আদর করে। পাগলী বিরবির করে যাচ্ছে আধো ঘুমে, দুধও খাওয়াচ্ছে মেয়েকে। বেশকিছু সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আরএমওর কাছে ফোন আসে উপজেলা চেয়ারম্যানের। তাকে আচ্ছা আচ্ছা বলতে শোনা যায় শুধু।
এরপর ফোন রেখে আরএমও বলে, ‘আচ্ছা! তুমি তাহলে বাচ্চাটা নিয়ে এখনই চলে যাও। কারণ সকাল হলে জানাজানি হবেই এবং পুলিশের কানেও খবর যাবে।’

পুতুল এক ছুটে গিয়ে মেয়েটাকে কোলে নেয়। চলে আশার সময় পেছন তাকিয়ে দেখে, পাগলিটা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। যেন বুঝতে পারছে তার বাচ্চাটা আর তার নেই। এক পলক দেখে পুতুল মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার চোখে আবারও সেই কান্নার জল। যাহোক, তারপর হাসপাতাল গেইটে তৌহিদের দোকানে ঘুমিয়ে থাকা কর্মচারী ছোকরাটাকে জাগিয়ে দুধ নিয়ে বলে, ‘কবা যে পুতুল নিছে।’
ঝড়ের বেগে সুমন রিক্সা চালাচ্ছে আর গজগজ করছে—
‘কি দরকার ছিলো এই বাচ্চা আনার? এত ঝক্কি ঝামেলা পোয়ানোর। এমনিই খাতি পারিনে তার মদ্যি এইডে আবার। এর দুধ খাওয়ানোর টাহা আসপেনে কোয়ানতে?’
অনেকক্ষণ বকে যাওয়ার পর পুতুল বলে উঠে, ‘এ বাড়া এ! এক লাথি দিয়ে নদীতে ফেলায় দেব যদি আর একটা কথা কইস। এই মাইয়ে আমি আনিছি আমি পালবো, যেরম তোরে পালতিছি। তোর মত বাপে খেদানো মায় খেদানো কেস খাইয়ে পলায় বেড়ানো জুয়োন বিটারে যদি আমি আমার শাউওর মধ্যি যায়গা দিয়ে চালাতি পারি, বাপের পরিচয় না থাকা মাইয়েরে পাইলে বড় করে বিয়ে দিয়ে নিজের কাছে রাকতি পারি—তালি পরে একটা বাচ্চা পালার ক্ষমতাও আমার আছে। তোর এই বিষয়ে কতা কওয়া লাগবে না, চিন্তাও করা লাগবে না। তোর যা কাজ তুই তাই কর।’
সুমন বিড়বিড় করতে করতে চুপ মেরে যায়।
ফজরের আজান হবে হবে ভাব। চারিদিকে হিমশিতল ফাল্গুনী বাতাস বইছে। পাখিরা কিচিরমিচির শব্দে জেগে উঠছে। পুতুলের কোলে আরেক পুতুল ঘুমাচ্ছে…

আরো পড়তে পারেন

প্রতিদান

‘আমাকে আপনার মনে নেই। থাকার কথাও নয়। সে জন্য দোষও দেব না। এত ব্যস্ত মানুষ আপনি, আমার মত কত জনের সঙ্গেই হঠাৎ চেনা-জানা। কেনইবা মনে রাখবেন তাদের সবাইকে?’ বেশ শান্ত গলায় বললেন মিসেস অঙ্কিতা। টেবিল থেকে কি যেন একটা নিলেন তিনি। পিটপিট করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সাফরাব। একটা ইনজেকশন, একটা ছোট টেস্টটিউবের মতো ভায়াল,….

লিলিথ

শাওয়ার বন্ধ করে দিতেই পানির হালকা ঝিরঝিরে শব্দটা বন্ধ হয়ে যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে ঝরনার শব্দ আজকাল বাসাতেই শোনা যাচ্ছে। আর এ শব্দটা অদ্ভুত সুন্দর। কেমন যেন মোলায়েম। সাদা তুলতুলে মেঘের মতো। অনেক দূর থেকে ভেসে ভেসে এসে জড়িয়ে ধরে। চোখের পাতাগুলোয় ঠান্ডা আমেজ ছড়িয়ে ঘাড় বেয়ে নামতে থাকে। আরামে চোখ বুজে আসে আমার। রিলাক্স হতে….

বন্ধনবিলাস

এ শতকের ধূলিধূসরিত ঢাকায় দাঁড়িয়ে কল্পনা করাও কঠিন। গত শতকের ঢাকা ছিল রাজহাঁসের পালকের মতো পরিচ্ছন্ন ধবধবে। একতলা-দোতলার ছাদে শীতলপাটি বিছিয়ে রাতের আকাশের দিকে চাইলে দেখা যেত নক্ষত্রদের কনফারেন্স। মেঘহীন রাতগুলোতে খুব কাছের হয়ে যেত দূরছায়া নীহারিকার পথ। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। অগণ্য তারার যে কোনো তারাকে। রাস্তার দু’ধারে জামরুল-জিউল আর বাবলার অন্ধকার ঢাকতে….

error: Content is protected !!