Author Picture

রোমান্টিক প্রেম

খন্দকার রেজাউল করিম

‘আমি যার বরষার আনন্দ-কেকা
নৃত্যের সঙ্গিনী দামিনী-লেখা
সে রহে কোথায়, হায়!’

উনিভার্সিটির ক্যাফেটেরিয়াতে একাকী লাঞ্চ করছিলাম। পাশের টেবিল থেকে মেয়েটি উঠে এসে আমার টেবিলের একটি চেয়ার টেনে বসে পড়লো। বললো,
‘ধন্যবাদ, আমি আপনার কাছে অনেক কৃতজ্ঞ।’
‘আমি কি তোমাকে চিনি?’
‘এক কালে চিনতেন। এখন হয়তো ভুলে গেছেন। তিন বছর আগে আমি আপনার অ্যাস্ট্রোনমি ক্লাসের ছাত্রী ছিলাম।’
‘ওসব ক্লাসে প্রায় দেড় শ ছাত্র-ছাত্রী থাকে। ভুলে যাওয়াটা স্বাভাবিক। কৃতজ্ঞতার কারণটা কি? নিশ্চয় ভালো গ্রেড পেয়েছিলে।’
‘না, একেবারেই বাজে গ্রেড পেয়েছিলাম। কিন্তু আপনার ক্লাসেই আমি আমার সোল-মেটকে খুঁজে পেয়েছিলাম। সেদিন ক্লাস ছিল প্লানেটারিয়ামে। দেরি করে ফেলেছিলাম, আপনি প্লানেটারিয়ামের সব বাতি নিভিয়ে দিয়েছিলেন, শুধু প্লানেটারিয়াম-ডোমের তারাগুলো জ্বলজ্বল করছিলো। তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে অন্ধকারে ওর সাথে ধাক্কা লাগলো, সেই থেকে প্রেম।’
‘Congratulations! প্লানেটোরিয়াম-আকাশের রাশিচক্রের এমন সুফলের কথা কে জানতো! সোল-মেটকে বিয়ে করতে যাচ্ছ, এমন কপাল কয়জনের হয়। তা বিয়েটা কবে হচ্ছে?’
‘আরো এক বছর পরে। ততদিনে আমরা দুজনেই ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি পেয়ে যাবো। আপনাকে অবশ্যই বিয়ের কার্ড পাঠাবো।’

তোর সোল-মেট শুধুই একজন, তাকে ছাড়া তুই বাঁচবি না, এসব মেয়ে পটানো কথা। ডাঁহা মিথ্যে, ধাপ্পাবাজি। রসায়ন-প্রাণিবিদ্যা জ্ঞানহীন কবি-সাহিত্যিক এবং বলিউড-হলিউডের সিনেমা-নির্মাতাদের বানানো গুজব

বিয়ের কার্ড পাই নি, তবে প্রার্থনা করি ওদের বিয়ে হয়ে গেছে এবং বিয়ের পর ওরা সুখেই আছে। রোমান্টিক প্রেমের গল্পে সোল-মেট কথাটি খুব প্রচলিত। আত্মার আত্মীয়, মনের দোসর, হৃদয়ের মনি, সহচরী, জীবনসঙ্গিনী, আদরিনী, সোহাগিনী, মায়াবন বিহারিণী, স্বপনচারিনী। রোমান্টিক প্রেমতত্ত্ব মতে শুধু সোল-মেটকে পেলেই আপনার জীবন পরিপূর্ণ হবে। এই পৃথিবীতে তিন শ কোটি নারী আছে। আপনি যদি পুরুষ হন তবে এদের মধ্যে শুধু একজনই আপনার মনের দোসর। দুটো নয়, চারটে নয়, এক লক্ষ জন নয়, শুধু একজন।
তিন শ কোটি মেয়ের মাঝে দোসরকে খুঁজে পাবেন কি করে? রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করুন। অন্যমনস্ক থাকুন। হটাৎ কোনো মেয়ের সাথে ধাক্কা লাগতে পারে। সেই হবে আপনার মনের দোসর। বাংলা নাটকের প্রেমিক প্রেমিকারা ইদানিং এ ভাবেই একজন আরেকজনের দোসর খুঁজে পাচ্ছে। অবশ্য দোসরের সঙ্গে ধাক্কা না লেগে তার গাড়ির সাথে ধাক্কা লাগলেও চলবে। অথবা রাস্তায় দাঁড়িয়ে রিকশা, রিকশা বলে চেঁচাতে থাকুন। দৈবাৎ সেই সময়ে আপনার দোসর এসে হাজির হবে, তারও সেই মুহূর্তে একটি রিকশার জরুরি প্রয়োজন। ইদানিং ইউ টিউবের কল্যানে বাংলাদেশের অনেক নাটক-সিনেমা দেখছি। ইউ টিউবে নাটক দেখার একটা সুবিধে এই যে ফাস্ট ফরোয়ার্ড বোতাম টিপে একঘন্টার নাটক দশ মিনিটে দেখা যায়। পৃথিবীর সর্বকালের জনপ্রিয় সিনেমা Casablanca একটি ত্রিভুজ প্রেমের গল্প। শেষ বিদায়ের ক্ষনে ব্যর্থ প্রেমিক Humphrey Bogart নায়িকা Ingrid Bergman এর দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিলো, ‘Here’s looking at you, kid’ আমেরিকায় প্রেমিকাকে বেবি বা কিড বলে ডাকা অনেক দিনের রেয়াজ। বাংলাদেশের নাটকে প্রেমিক প্রেমিকাকে ‘জান’ এবং প্রেমিকা প্রেমিককে ‘বাবু’ বলে সম্বোধন করে। দুজনে ফুচকা খায়, লেকের ধারে ঘোরাঘুরি করে, মুঠোফোনে কথা বলে। আমেরিকার কিশোরীদের মাঝে প্রচলিত ‘ক্রাশ’ শব্দটিও এখন বাংলা নাটকে ঘনঘন ব্যবহার হচ্ছে।
‘নাম তার কমলা,
দেখেছি তার খাতার উপরে লেখা।
সে চলেছিল ট্রামে, তার ভাইকে নিয়ে কলেজের রাস্তায়।
আমি ছিলেম পিছনের বেঞ্চিতে।
মুখের এক পাশের নিটোল রেখাটি দেখা যায়,
আর ঘাড়ের উপর কোমল চুলগুলি খোঁপার নীচে।
কোলে তার ছিল বই আর খাতা।
যেখানে আমার নামবার সেখানে নামা হল না।’
রবি ঠাকুরের এই রোমান্টিক প্রেমের কবিতায় অবস্থা সুবিধার নয় দেখে প্রেমিক নিজ থেকেই কেটে পড়ে। বুদ্ধিমান প্রেমিক। তবুও পেছন থেকে ঘাড়ের কোমল চুল বা মুখের নিটোল রেখাটি দেখে মনের দোসর বেছে নেয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ? চুল আর মুখের মাঝে মেয়েটির মনের খবর কি লুকিয়ে আছে?
আমার এক সহকর্মী অধ্যাপক এবং বন্ধুর ডিগ্রির শেষ নেই, সে একই সাথে বায়োলজিস্ট, রসায়নবিদ, মনস্তত্ত্ববিদ, এবং ডাক্তার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ও প্রেম নিয়ে গবেষণা করে। প্রেমহীন দম্পতিরা ওর ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য আসে। গজও মেশিনে ব্রেন স্ক্যান করে এবং রক্তে হরমোনের পরিমান মেপে ও রোগ নির্ণয় করে। বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিলো।
‘বাংলা নাটকে একটি ছেলে ও মেয়ে থাক্কা খায়। তারপরে ওদের প্রেম হয়ে যায়। আমার ক্লাসের দুই ছাত্র-ছাত্রীর একই দশা। এটা কেমন করে সম্ভব?’
‘ব্যাপারটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। তুই যদি একটি মেয়ের সঙ্গে ধাক্কা খাস তবে তোর ব্রেনের ফ্রন্টাল লোবের নিউরোনগুলো তোলপাড় কান্ড শুরু করবে, তোর রক্তে ডোপামিন, সিরোটোনিন, এবং অক্সিটোসিনের মাত্রা সাথেসাথে বেড়ে যাবে। এসব তোকে প্রেমে পড়তে সাহায্য করবে। অভিনেত্রী যাযা গ্যাবোর এ ভাবেই প্রেমে পড়েছিলেন।’
‘বলিস কি! কিন্তু ধাক্কা-ধাক্কি ব্যাপারটা একেবারেই কাকতলীয়। মনের দোসর যদি একজনই হয়, তবে তার সঙ্গে ধাক্কা লাগার সম্ভবনা প্রায় শূন্য। পৃথিবীতে তিনশ কোটি নারী আছে!’
‘তোর সোল-মেট শুধুই একজন, তাকে ছাড়া তুই বাঁচবি না, এসব মেয়ে পটানো কথা। ডাঁহা মিথ্যে, ধাপ্পাবাজি। রসায়ন-প্রাণিবিদ্যা জ্ঞানহীন কবি-সাহিত্যিক এবং বলিউড-হলিউডের সিনেমা-নির্মাতাদের বানানো গুজব। এসবে কান দিয়ে ছেলেমেয়েরা মরীচিকার পিছনে ছুটছে, অকারণে কষ্ট পাচ্ছে। অসংখ্য মেয়ে একটি ছেলের মনের দোসর হতে পারে। জর্জ বার্নার্ড শ বলেছেন, ‘love consists in overestimating the differences between one woman and another.’ প্রেমের হরমোনগুলো সবার মাঝে একই ভাবে কাজ করে। তবে হরমোন-ক্ষরণ পরিবেশের উপরে নির্ভর করে। যেমন ঘুমের হরমোন মেলাটোনিনের সাথে সূর্যের আড়ি। লেকের ধারে, সমুদ্র সৈকতে, বাদল রাতে, দামি রেস্টুরেন্টের আলো-আঁধারি পরিবেশে প্রেমের হরমোনের প্রস্রবণ বেড়ে যায়, অনেক মিথ্যে কথা সত্যি বলে মনে হয়। ওকেই বলে রোমান্টিক প্রেম।’

আরো পড়তে পারেন

প্রতিদান

‘আমাকে আপনার মনে নেই। থাকার কথাও নয়। সে জন্য দোষও দেব না। এত ব্যস্ত মানুষ আপনি, আমার মত কত জনের সঙ্গেই হঠাৎ চেনা-জানা। কেনইবা মনে রাখবেন তাদের সবাইকে?’ বেশ শান্ত গলায় বললেন মিসেস অঙ্কিতা। টেবিল থেকে কি যেন একটা নিলেন তিনি। পিটপিট করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো সাফরাব। একটা ইনজেকশন, একটা ছোট টেস্টটিউবের মতো ভায়াল,….

লিলিথ

শাওয়ার বন্ধ করে দিতেই পানির হালকা ঝিরঝিরে শব্দটা বন্ধ হয়ে যায়। প্রযুক্তির কল্যাণে ঝরনার শব্দ আজকাল বাসাতেই শোনা যাচ্ছে। আর এ শব্দটা অদ্ভুত সুন্দর। কেমন যেন মোলায়েম। সাদা তুলতুলে মেঘের মতো। অনেক দূর থেকে ভেসে ভেসে এসে জড়িয়ে ধরে। চোখের পাতাগুলোয় ঠান্ডা আমেজ ছড়িয়ে ঘাড় বেয়ে নামতে থাকে। আরামে চোখ বুজে আসে আমার। রিলাক্স হতে….

বন্ধনবিলাস

এ শতকের ধূলিধূসরিত ঢাকায় দাঁড়িয়ে কল্পনা করাও কঠিন। গত শতকের ঢাকা ছিল রাজহাঁসের পালকের মতো পরিচ্ছন্ন ধবধবে। একতলা-দোতলার ছাদে শীতলপাটি বিছিয়ে রাতের আকাশের দিকে চাইলে দেখা যেত নক্ষত্রদের কনফারেন্স। মেঘহীন রাতগুলোতে খুব কাছের হয়ে যেত দূরছায়া নীহারিকার পথ। যেন হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে। অগণ্য তারার যে কোনো তারাকে। রাস্তার দু’ধারে জামরুল-জিউল আর বাবলার অন্ধকার ঢাকতে….

error: Content is protected !!