Author Picture

সৈকতের নাম প্লায়া লাস পেনিটাস

মঈনুস সুলতান

সপ্তাহ তিনেক হলো, আমি নিকারাগুয়ার লেওন শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাস করছি একটি গেস্টহাউসে। গেস্টহাউসের এক ঈভনিং পার্টিতে আমার সাথে মোলাকাত হয়েছে সিনিওর ডিগমারের। সিনিওর অল্পবিস্তর কবিতা লিখেন, পান করেন প্রচুর, এবং হামেশা সিগার ফুঁকে বেফজুল গালগল্প করতে ভালোবাসেন। তাঁর সাথে আমার জানপহচান বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেতে দেরি হয়নি একটুকু।

আজকাল আমি সিনিওর ডিগমারের সাথে হামেশা বেড়াতে যাচ্ছি, পূরাতাত্ত্বিক রিসোর্সে ভরপুর কোন না কোন গির্জায়। লেওন শহরের এল কালভারিও নামে একটি সুদর্শন চার্চ আমাদের প্রিয় হয়ে ওঠেছে। প্রয়শঃ আমি সিনিওর ডিগমারের সাথে শহরের গলিপথ ধরে হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে এসে বসি, শিল্পকলার সমজদারে সয়লাব একটি ক্যাফেতে। ওখানে সিনিওর ডিগমারের মারফত পরিচিত হই, চিত্রশিল্পের কোন উপাসক, বা পোস্টমডার্ণ ঘরানার কবিতার পাড় উমেদারদের সাথে।

আজ আমাদের ভ্রমণ-রুটিনে খানিকটা পরিবর্তন আনার জন্য চলে এসেছি, লেওন শহর থেকে সামান্য দূরে প্রশান্ত মহাসাগরের শান্ত এক সৈকতে। সৈকতটির নাম প্লায়া লাস পেনিটাস। মহাসমুদ্রের ঊর্মিমুখর সবুজ জলে ফুঁসে ওঠা শুভ্র ফেনার দিকে তাকিয়ে মুখ থেকে অজান্তে বেরিয়ে যায়- হোয়াট আ গর্জিয়াস সিবিচ। সিনিওর ডিগমার স্নকার খুলে তা ব্যাকপ্যাকে রেখে, বালুকায় খালি পায়ে হাঁটতে হাঁটতে তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশ করেন,‘ওয়াও, লুক এ্যাট অল দিজ মাইটি ওয়েভস্ আর ক্রাসিং এ্যাট দি শোর লাইন।’ বালুকায় ঝাপিয়ে পড়া জলে পা চুবিয়ে এক নারী তার দুটি পোষা কুকুর নিয়ে চরছেন। আমাদের দিকে চোখ পড়তেই হাত তুলে ওয়েভ করেন। আমাদের সামনে দিয়ে সার্ফবোর্ড নিয়ে হাঁটে স্বর্ণাভ ব্লন্ড চুলের খালিগায়ে সুইমিং ট্রাংক পরা একটি যুবক। তার বিকিনি পরা সাথি মেয়েটির কাঁধ ও পিটে উল্কি করে আঁকা সমুদ্রের শঙ্ক ও প্রবাল। হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে আসি ম্যানগ্রোব বনের কাছাকাছি। এদিককার সৈকত প্রায় নির্জন, বালুকাবেলায় পা ছড়িয়ে বসে কেবল মাত্র এক দম্পতি, তারা অন্তরঙ্গতায় নিবিড় হয়ে আছে। তাদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ডিগমার কলোকোয়েল এসপানিওলে কিছু বললে, যুগলের পুরুষটি তার বান্ধবীর কাঁধ স্পর্শ করে উচ্ছলতায় শিস দিয়ে ওঠে। ডিগমার তাদের দিকে দুহাতের ভঙ্গিতে কী এক ইঙ্গিত করেন, মেয়েটিও উচ্ছলতায় শরীক হয়ে সিনিওরের দিকে হাত ও ঠোঁটের ভঙ্গিতে ছুড়ে দেয় উড়ন্ত চুমো। আর নোনাজলের আঁশটে গন্ধমাখা বাতাসে আমারও মেজাজ প্রফুল্ল হয়ে ওঠে।

আমরা সৈকতে বাঁশ,বেত ও শনে তৈরী তিনটি সুনসান বিচ্ বাংলোর সামনে দিয়ে হাঁটি। এদের সমুদ্রমুখি কাঠের বেলকনির দিকে ইশারা দিয়ে সিনিওর ডিগমার বলেন,‘মাই ডিয়ার ম্যান, রিলাক্স, ডোন্ট থিংক আবাউট টাইম, ডোন্ট থিংক আবাউট গোয়িং ব্যাক টু গেস্টহাউস, এনজয় দ্যা বিচ, রাত নামলে ঘরে ফিরে যাওয়ার কোন প্রয়োজন নেই, চাইলে তুমি এ ধরনের একটি বাংলোয় রাত কাটিয়ে দিতে পারো।’ হাঁটতে হাঁটতে আমিও প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি,‘ গেস্টহাউস তো আমার নিজস্ব বাড়ি না, দিনযাপনের সাময়িক নিবাস মাত্র। ওখানে ফিরে যাওয়ার আমার তেমন কোন টান নেই। দিজ্ বাংলোজ এট্রাক্ট মি আ লট। বাট, ওয়ান থিংক আই অ্যাম এফরেইড অব… চমৎকার এ ওয়াটার-ফ্রন্ট বেলকনিতে বসে সমুদ্রের তরঙ্গমালার দিকে তাকালে .. ইউ নো হোয়াট? আই অ্যাম শিওর আই উইল ফিল সুপার লোনলি।’ আমার মন্তব্য শুনে সিনিওর গোঁফের ফাঁকে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে তুলে বলেন,‘ লাস পেনিটাস বিচে বিকাল ঘনিয়ে আসলে সমুদ্রজলে ছড়ায় দারুণ গোধূলি, তখন তুমি একাকী কোন বেলকনিতে বসে কিছু পান করতে না চাইলে, পারহেপ্স ইউ উইল ফাইন্ড সামওয়ান হিয়ার, হয়তো খুঁজে পাবে এমন কাউকে, যার সান্নিধ্যে স্রেফ উষ্ণ হয়ে ওঠবে তোমার সন্ধ্যা।’

অন্তরঙ্গতায় নিবিড় দম্পতি

সিনিওরের লম্বা-চাওড়া কমেন্ট শুনতে শুনতে আমি দেখি- সৈকতে কাঁকড়ার পদছাপ আঁকা বালুকায় তোয়ালে বিছিয়ে শুয়ে বিকিনি পরা দুটি মেয়ে। এদের একটি পেপারব্যাক পড়তে পড়তে আড়চোখে আমাদের দিকে তাকায়। অন্য মেয়েটির কপালে রাখা শশার কাটা দুটি টুকরা। সিনিওর তাদের দিকে সরাসরি তাকিয়ে শিস দিয়ে বলেন,‘ওলা চিকাস্ , বুয়েন দিয়া, বা মেয়েরা, শুভদিন।’ যুবতী দুটি ঝটপট করে ওঠে এগিয়ে এসে পরিচিত হয়। এদের একটির নাম বিয়াংকা, অন্যটি ক্রিসটেলা। এরা নৃতাতত্ত্বিক পরিচয়ে নিকারাগুয়েনসে, তবে অভিবাসির সন্তান হিসাবে বাস করে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়। সামারের ছুটিতে ফিরে এসেছে তাদের মা-বাবার দেশ নিকারাগুয়ায়। সৈকতে সূর্যস্নান ছাড়াও এরা পার্টটাইম পেশা হিসাবে মেরিন গাইডের কাজ করে। চাইলে এদের সাথী করে নাও বেয়ে চলে যাওয়া যায় কাছেরই একটি জনহীন দ্বীপ ইসলা হুয়ান ভেনাডোতে। সিনিওর আমার লেখাজোখার স্বভাবের উল্লেখ করে বলেন,‘সালুদার আ উন এসক্রিতর, বা মেয়েরা সম্ভাষণ জানাও একজন লেখককে।’ এতে ক্রিসটেলা দারুণভাবে অবাক হয়ে বলে,‘ ওয়াও, আ রিয়েল রাইটার, আই ডোন্ট নো হাউ টু সে হ্যালো টু আ রাইটার।’ আমি বলি,‘তোমার নামটা খুবই সুন্দর, অন্য কোন ডাকনাম আছে কী তোমার?’ সে জবাব দেয়,‘লুক এ্যাট মাই স্কিন কালার, আই এ্যাম ডার্ক, তো পরিবারের সবাই আমাকে ডাকে নিগ্রিতা বলে।’ কথা বলতে বলতে সে ঘন হয়ে কাছে আসতেই আমি তার কাঁধে আলতো করে হাত বুলিয়ে বলি,‘গার্ল, ইউ শিওর হ্যাভ ফ্লোলেস স্মুদ স্কিন।’ নিগ্রিতা খিলখিল করে হেসে চোখের ঘন পাপড়ি তুলে এমনভাবে তাকায় যে, মনে হয়, তার সম্বিতে নিঃসঙ্গতার সাথে মিশে আছে এক ধরনের মেলাংকোলি। আন্দাজ করি,মেয়েটি বৃষ্টিপাতের শব্দ শুনতে খুবই ভালোবাসে।

ক্রিসটেলা বা নিগ্রিতা তার তোয়ালে,ব্যাকপ্যাক ইত্যাদি পিক করে আনতে ফিরে গেলে আমি এবার বিয়াংকার দিকে নজর দেই। দারুণ ফিগারের এ মেয়েটি যেন ম্যানস্ ম্যাগাজিনের পৃষ্টা থেকে বিকিনি পরে নেমে এসছে সমুদ্র সৈকতে। চোখমুখে একটু মুডি হলেও, কথাবার্তায় এ মেয়েটি আরো সাবলিল। শ্যামলাঙ্গি নারীটি তার পাড়াপড়শিদের কাছে ‘চিকা মরানো’ বলে পরিচিতা। সে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে,‘সিনিওর এসক্রিতর, রাইট সামথিং টাচি হিয়ার,’ বলেই সে দুষ্টুমিভরা দুচোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকায়। আমি ভালোবাসার এসপানিওল শব্দ ‘আমর’ তার করতলে লিখে দেই। বিয়াংকা ঠোঁট বৃত্তাকার করে ‘নট সো সুন সিনিওর’, বলে আমার কব্জিতে চাপ দেয়।

মেয়েটির জন্য এবার জেনুইনলি আমার উদ্বেগ হয়। কিন্তু কোন কিছু বলতে সাহস পাই না। মনে হয়, ক্রিসটেলা সম্পর্কে অধিক কিছু জানতে গেলে তা আমার মাঝে সৃষ্টি করবে অহেতুক স্ট্রেস। সে পাত্রের সবটুকু পানীয় পান করে, তারপর তলানি থেকে আনারসের একটি কিউব আংগুলে নিয়ে তা আমার মুখে তুলে দিলে- আমি তার কব্জিতে চাপ দেই। চোখেমুখে এবার চটুল আগ্রহ ফুটিয়ে তুলে সে বলে,‘ইউ হ্যাভ আ ভেরী গুড ফ্যাশন সেন্স। স্টোন ওয়াশড্ জিন্সের সাথে কটনের ধবধবে সাদা শার্ট পরেছো। আই লাইক ইয়োর ভিনটেজ রাউন্ড সানগ্লাসেস্। বাট্ আই সি আ হিউজ প্রবলেম আবাউট দ্যা ওয়ে ইউ ড্রেসড্ ।’

ক্রিসটেলা ব্যাকপ্যাক ইত্যাদি কাঁধে ফেলে ফিরে আসলে আমি হিপ পকেট থেকে ফ্লাস্ক বের করে জানতে চাই, ‘ চিকাস্,কিয়ারেস উনা চোপিতা, বা গার্লস্, ওয়ান্ট সাম ড্রিংকস্?’ বিয়াংকা আমার হাত থেকে ফাস্ক নিয়ে ছিপি খুলে জ্যাক ডানিয়েলের সিপ্ নেয়। ক্রিসটেলাও ফ্লাস্কের সামান্য একটু ঝাঁঝালো তরল চেখে বলে,‘আই উড লাইক আ কাগুয়ামা,’ কাগুয়ামা শব্দটির সরাসরি প্রতিশব্দ হচ্ছে সমুদ্রের কচ্চপ। ভাবি, মেয়েটি হয়তো লাঞ্চে কচ্চপের মাংশ খেতে চাচ্ছে। অসুবিধা কিছু নেই। ঘাড় হেলিয়ে আমি সম্মতি জানাতেই সিনিওর বলেন,‘লেটস্ গো টু আ রেস্টুরেন্ট।’

আমরা ছনে ছাওয়া কাঠের দোতালা চাং-বাংলোর মতো একটি রেস্তোরাঁর সিঁড়ি বেয়ে ওপর তলায় উঠে আসি। সিনিওর ডিগমার পানীয়ের অর্ডার দিতে দিতে বলেন,‘ দিস ইজ সুয়াপা রেস্টুরেন্ট, এরা লাস পেনিটাসের সবচেয়ে ভালো সিফুডের সরবরাহকারী। এখানকার খাবার লাভলি মেয়ে দুটিরও পছন্দ হবে।’ আস্ত একটি কচ্চপের খোলে পানীয় পরিবেশিত হলে কাগুয়ামা শব্দে যে ক্রিসটেলা কচ্চপের মাংশ খেতে চায়নি তা বুঝতে পারি। ড্রিংকস্টি নিকারাগুয়ার সমুদ্র সৈকতে কাগুয়ামা বা সিটার্টোল বলে পরিচিত হলেও আদতে তা হোয়াইট ওয়াইন ও ক্লাউডি লেমোনেডের মিশ্রিত এক ধরনের ককটেল। আনারসের কিউব ভাসা এ পানীয় লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে হোয়াইট সাংগ্রিয়া বলে পরিচিত। বাথরুম থেকে বিকিনি বটমের ওপর ম্যানগ্রোব বনের ছাপচিত্র আঁকা ত্রিকোণা ছরং জড়িয়ে বেরিয়ে আসে বিয়াংকা। তার বিকিনি-টপ ছাপিয়ে উদ্ভাসিত হওয়া স্তন যুগলে অসাবধানে লেগে আছে কিছু বালুকা। সে বড় বড় চোখে সারা কামরা স্ক্যান করে আমার সাথে চোখাচুখি হতেই মিষ্টি করে হাসে। আমি ওয়াইন গ্লাসে কচ্চপের খোল থেকে হোয়াইট সংগ্রিয়া ঢেলে তার হাতে তুলে দেই। সে তাতে চুমুক দিয়ে বলে,‘ভেরী টেইস্টি এন্ড সুদিং, কিন্তু এরা ককটেলে বেশ খানিকটা হোয়াইট রাম মিশিয়েছে মনে হয়।’ সিনিওর ডিগমার কচ্চপের খোলের তরল মিক্সে ভেসে থাকা কয়েকটি আংগুর চামচ দিয়ে বিয়াংকার গ্লাসে তুলে দিয়ে বলেন,‘ চিকা মরানো, মনে হয় মেকাপ ছাড়াই তোমাকে সবচেয়ে ভালো দেখায়।’ মেয়েটি প্লাল্টি দেয়,‘ হোয়াই ইউ থিংক আই লুকড্ প্রিটি উইথআউট মেকাপ?’ ডিগমার তিন আংগুলে তার গন্ডদেশ আলতো করে চেপে দিয়ে বলেন,‘ ইয়োর আন পাউডারড্ চিকস্ আর বেগিং ফর কিসেস্ ।’ এতে ফিক করে হেসে বিয়াংকা তাঁর দিকে মুখ বাড়িয়ে দেয়। সিনিওর তার দু’গালে হাল্কা করে ঠোঁট ছুঁইয়ে হাত ধরে তাকে টেনে নিয়ে যান বিলিয়ার্ড টেবিলের দিকে।

রামের ফোঁড়নে সামান্য কড়া হলেও ক্লাউডি লেমোনেড মেশানো পানীয়টি সামার ড্রিংকস্ হিসাবে স্বাদে চমৎকার। আমি তা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করতে করতে অপেক্ষা করি। বেশ খানিকটা সময় বাথরুমে কাটিয়ে খাকি কাটাউট প্যান্ট পরে বেরিয়ে আসে ক্রিসটেলা। মুখে হাল্কা মেকাপ মেখে এসেছে সে। তার বেশ দীর্ঘ কুচকুচে কালো চুল কাঁধ ছাপিয়ে কুঁকড়ানো কাসকেডে নেমে এসেছে পিট অব্দি। কচ্চপের খোলে ফলের টুকরা ভাসা পানীয়ের দিকে তাকিয়ে সে খুশিতে উচ্চসিত হয়ে, দু’হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে, এমন এক ভঙ্গি করে যে, মনে হয়, একটি পাখি যেন উড়াল দেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সে নিজ হাতে পাত্রে পানীয় ঢেলে নিয়ে চেয়ারে বসে চুমুকে বেশ খানিকটা পান করে বলে,‘ এসতা বেবিডা এস মুই মারাবিয়াসো, বা দিস ইজ আ ট্রুলি মার্ভেলাস ডিংকস্।’

সৈকতে বিয়াংকা ও ক্রিস্টিলা

পান করতে করতে ক্রিসটেলা জানতে চায়,‘ সো ইউ আর আ রাইটার, ডু ইউ অলসো রিড আ লট অব বুকস্ ?’ আমি মাথা হেলিয়ে সায় জানাই। সে আমার দিকে ঝুঁকে এসে ফের জানতে চায়,‘ আর ইউ ইন্টারেস্টেড টু হিয়ার হোয়াট আই অ্যাম রিডিং নাউ?’ আমি তার চোখের দিকে তাকাই, মেয়েটির আখি যুগলকে অনায়াসে বলা চলে ডাগর, কিন্তু ওখানে ভাসছে অজানা এক রহস্যময় বিষাদ, মনে হয়- এ নারী অনায়াসে প্ররোচিত করতে পারে যে কোন পুরুষকে আত্মহননে। কিছু বলতে হয় না, ক্রিসটেলা ব্যাকপ্যাক থেকে বের করে আমাকে একটি বই দেখায়। মাস দুয়েক আগে বইটি আমিও পড়েছি। ডিপ্রেশনের ভোগা তরুণদের দিনযাপনের বিশ্লেষণে ভরপুর বইটির নাম ‘প্রজাক ন্যাশন: ইয়াং এন্ড ডিপ্রেস্ড ইন আমেরিকা।’ আমি এবার কৌতূহলি হয়ে জানতে চাই,‘নিগ্রিতা, বইটির লেখক সম্পর্কে নিশ্চয়ই তোমার পরিষ্কার ধারনা আছে।’ ক্রিসটেলা আমার ঊরুতে মৃদুভাবে চাটি মেরে বলে,‘ ইউ কল্ড মি নিগ্রিতা, ইট সাউন্ডস্ সো কিউট।’ সে অকারণে কাঁধ ঝাঁকায়। শুভ্র মসলিনের স্কার্ফে প্যাচানো স্তন যুগলে ঊর্মি তুলে বলে,‘ ইয়াহ্, এলিজাবেথ ওয়ারথঝেল রোউট দিস বুক। দ্যাটস্ ট্রু, বাট্, তাঁর জীবনের সাথে আমার বেড়ে ওঠার এতো মিল আছে যে, পড়তে পড়তে মনে হয়েছে, আমি যেন নিজের আত্মজীবনী পড়ছি।’

আমি মেয়েটিকে আরো গভীরভাবে অনুভব করার জন্য খুঁটিয়ে তাকালে, তার কোমরে বিকিনি লাইনেই ঠিক উপরে তিনটি কাটা দাগ দেখে উদবিগ্নভাবে মন্তব্য করি,‘ এলিজাবেথ ওয়ারথঝেলের জীবনের সাথে আমার তেমন কোন মিল নেই, কিন্তু বইটি পড়ে আজকালকার টিনএজারদের দিনযাপনের কষ্ট, বিষাদগ্রস্থতা এবং ড্রাগসে নির্ভরশীল হয়ে ওঠার ব্যাপারে প্রচুর জানতে পেরেছি।’ ক্রিসটেলা নিজে থেকে বলে,‘এলিজাবেথকে আমার যমজ বোনের মতো মনে হয়। তার মতো আমারও মা-বাবার মাঝে ডিভোর্স হয়, যখন আমার বয়স মাত্র এগারো। মা পর পর মাত্র তিন বছরে আজানা দুই ষন্ডা গোছের পুরুষকে বিয়ে করলে- তাঁর পরিবারে আমার দিনযাপন অসহনীয় হয়ে ওঠে। ফিরে আসি বাবার কাছে, কিন্তু যে সব সেক্সি গার্লফ্রেন্ডদের পেছনে বাবা ছুটতো, নান অব দেম হ্যাড এভার লাইকড মি।’ শুনে আমি বলি,‘লো সিয়েনতো, মুই তিসতে এনকোচাডো, বা তোমার বৃত্তান্ত শুনে আমি খুবই দুঃখিত নিগ্রিতা।’ আমার মন্তব্যে যেন শুনতে পায়নি, এ রকম নির্লিপ্তভাবে সে কথা বলতে থাকে,‘ এলিজাবেথ তাঁর শরীরে ধারালো ছুরি দিয়ে দাগ কাটেন যখন তাঁর বয়স মাত্র তেরো। তাঁর সাথে আমার একটাই অমিল, আমি ছুরি দিয়ে নিজের দেহ থেকে রক্ত ঝরাই প্রথম চৌদ্ধ বছর বয়সে, তারপর আরেক বার কেটাছেড়া করি মারত্মকভাবে যখন আমার বয়স সতেরা।’

আমার পক্ষে উদ্বেগ চেপে রাখা কঠিন হয়, তাই বলি,‘হাউ আর ইউ ডুয়িং নাউ নিগ্রিতা?’ সে হাসিতে বিষাদ ঝরিয়ে বলে,‘ নট সো ব্যাড। কলেজ থেকে ড্রপআউট হওয়ার পর থেকে আর সিজোফ্রেনিয়া ফিরে আসেনি। নিকারাগুয়াতে আমি ভালোই আছি, আমেরিকাতে ফিরে গেলেই দেখা দেয় যত বিতিকিচ্ছিরি সমস্যা।’ কেন জানি তার কাছে আমার নিজের কথা বলতে ইচ্ছা হয়। খুব ফ্র্যংকভাবে বলি,‘ আমেরিকাতে জীবনযাপন এতো দ্রুত যে, ওখানে বসবাস করতে গেলে আমারও সমস্যা হয়। আই লাইক লিভিং আপ ইন নিকারাগুয়া। এখানকার রিলাক্সড্ স্লো-পেস্ লাইফ স্টাইল আমার খুব পছন্দ।’ আত্মপ্রতিফলনের সুরে ক্রিসটেলা এবার জানায়,‘ ইয়াহ্, লাইফ ইজ আ বিট ফাস্ট ইন আমেরিকা, কিন্তু এতে আমার কোন সমস্যা হয় না, ফ্লোরিডাতে বড় হয়েছি আমি, এ্যজ আ ম্যাটার অব ফ্যাক্ট, আই অ্যাম আ ফ্লোরিডা গার্ল। স্পীড আমার জন্য কোন বিষয়ই না।’ এ পর্যন্ত বলে সে পানপাত্রে আরেক দফা হোয়াইট সাংগ্রিয়া নিয়ে বার বার দ্রুত চুমুক দেয়।

একটি প্রশ্ন আমার করোটিতে ঘুরপাক করলে সাতপাঁচ ভেবে তাকে জিজ্ঞেস করে বসি,‘ হোয়াট এ্যাডজেক্টলি ইয়োর প্রবলেম? আমেরিকাতে তোমার কী সমস্যা হয় নিগ্রিতা?’ সে এবার চোখমুখ মারাত্মক রকমের সিরিয়াস করে ফিসফিসিয়ে বলে,‘ অই যে সব সময় মনে হয়, কেউ আমাকে ফলো করছে, নজর রাখছে হামেশা আমার গতিবিধির ওপর। আমি বার বার নতুন সিম কিনি, সেল ফোন বদলাই, কিন্তু তারা কীভাবে যেন আমার টেলিফোন নাম্বার জেনে যায়, আড়ি পেতে শুনে আমি কার সাথে কখন কী বলছি। আমার একাউন্ট এতবার হ্যাক হয়েছে যে,কাউকে ইমেইল করতে খুব ভয় হয়, ব্যাংকে পর্যন্ত শান্তিতে সামান্য কিছু টাকাপয়সাও রাখতে পারি না।’

সুনসান বিচ্ বাংলো

মেয়েটির জন্য এবার জেনুইনলি আমার উদ্বেগ হয়। কিন্তু কোন কিছু বলতে সাহস পাই না। মনে হয়, ক্রিসটেলা সম্পর্কে অধিক কিছু জানতে গেলে তা আমার মাঝে সৃষ্টি করবে অহেতুক স্ট্রেস। সে পাত্রের সবটুকু পানীয় পান করে, তারপর তলানি থেকে আনারসের একটি কিউব আংগুলে নিয়ে তা আমার মুখে তুলে দিলে- আমি তার কব্জিতে চাপ দেই। চোখেমুখে এবার চটুল আগ্রহ ফুটিয়ে তুলে সে বলে,‘ইউ হ্যাভ আ ভেরী গুড ফ্যাশন সেন্স। স্টোন ওয়াশড্ জিন্সের সাথে কটনের ধবধবে সাদা শার্ট পরেছো। আই লাইক ইয়োর ভিনটেজ রাউন্ড সানগ্লাসেস্। বাট্ আই সি আ হিউজ প্রবলেম আবাউট দ্যা ওয়ে ইউ ড্রেসড্ ।’ তার মন্তব্যে আমি হেসে ফেলে বলি,‘ কাট ইট আউট কুইক গার্ল, সমস্যাটা কী খুলে বলে ফেলতো নিগ্রিতা?’ রীতিমতো পেশাদার ফ্যাশন কনসালটেন্টের গাম্ভীর্য্যে সে জবাব দেয়,‘ এ রকম পোষাকে তোমাকে মানিয়েছে দারুণ, কিন্তু এতে সৃষ্টি হয়েছে এক ধরনের ইমোশনাল ডিসটেন্সের। কেমন যেন মনযোগ দিয়ে আঁকা পোর্টেটের মতো লাগছে। তাকিয়ে উপভোগ করা যায়, কিন্তু কাছে যেতে ইচ্ছা হয় না।’ আমি চোখেমুখে কপট উদ্বেগ ফুটিয়ে তুলে বলি,‘ আই সি, সাউন্ডস্ লাইক আ রিয়েল প্রবলেম, কিন্তু কী পরলে তোমার মাঝে কাছে আসার উদ্দীপনা তৈরী হবে? জাস্ট টেল মি প্লিজ নিগ্রিতা।’ মেয়েটির অভিব্যক্তিতে দুষ্টুমির আভা এবার পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। সে আমার চোখে চোখ রেখে বলে,‘এই যে প্যান্টের ভেতর শার্ট টাকইন করে রেখেছে, দিস ইজ ক্রিয়েটিং দ্যা ডিসটেন্স। একটু কুঁচকানো শার্ট টাকইন না করে পরো, দেখবে চেহারায় কী রকম আটপৌরে ভাব চলে আসে। এন্ড ওয়ান মোর থিংগ, গার্লস্ লাইক টু সি ইয়োর চেস্ট, তো সবগুলো বোতাম খুলে নিচে চিংড়িমাছের ছবি আঁকা একটি টিশার্ট পরো, দেন ইউ ইউল সি দ্যা এফেক্ট। তোমার পোষাকআশাক ওরকমভাবে একটু এডজাস্ট করলে আমারই ইচ্ছা হবে, তোমার চেস্ট এরিয়াতে মাথা রেখে স্ট্রেস্ লাগব করতে।’ সব শুনে আমি প্রতিক্রিয়ায় তার কব্জি চেপে দিয়ে বলি,‘ দেখি, সৈকতের কোন দোকান থেকে চিংড়িমাছ আঁকা টিশার্ট কিনতে পারি কি না?’ হঠাৎ করে সে যেন লজ্জা পেয়ে চোখ নামায়।

রেস্তোরাঁর শেফ টেবিলে খাবার লাগিয়ে ঘন্টা বাজিয়ে জানান দেন। সিনিওর ডিগমার ও বিয়াংকা বিলিয়ার্ড খেলা ছেড়ে এসে টেবিলে বসে। অলিভ ওয়েলে ভাজা মশলাদার আলুর সাথে আমার প্লেটে পরিবেশিত হয়েছে কেমোমিল ভিনিগারে আর্দ্র তাজা সব্জির স্যালাদ, ও আধপোড়া পেঁয়াজ ও রসুন ছড়ানো ম্যাকারেল মাছের ফ্যালে। ডিশটি খুবই উপদেয়। খেতে খেতে দেখি, সিনিওর ডিগমমার আস্ত একটি গ্রিল করা রেড স্নেপার মাছের কাটা বাছতে বাছতে কলোকোয়েল এসপানিওলে বিয়াংকার সাথে টুকটাক কথা বলছেন। আর বিয়াংকা ভাঁজা কালামারি ও কাঁকড়ার মাংশ বাটার সচে চুবিয়ে খেতে খেতে মাঝে-মাঝে দারুণ সুইটভাবে হেসে ডিগমারের আলাপে সাড়া দিচ্ছে। কোন কথা না বলে ক্রিসটেলা লবস্টারের খোল ভাঙ্গে। তার দিকে তাকালে মনে হয় না, এ মুহূর্তে প্রশান্ত মহাসাগরের বেজায় বৃহৎ গলদাচিংড়িটি ভক্ষণ ছাড়া অন্য কোন বিষয়ে তার কোন আগ্রহ আছে। খাবারের পালা চুকতেই সিনিওর ডিগমার কায়াক জাতীয় নাও ভাড়া করে ইসলা হুয়ান ভেনাডো দ্বীপে যাওয়ার প্রস্তাব করেন। এতে আমরা সবাই সমবেতভাবে উদ্দীপ্ত বোধ করি।

সিনিওর ডিগমার যাত্রার আয়োজনে মেতে ওঠেন। তিনি ডিনারের জন্য তরতিয়া রুটি, আবাকাডো দিয়ে তৈরী গোয়াকোমলি সচ, জলের বোতল ইত্যাদি খরিদ করে রসদপত্র বরফ দেয়া কুলারে পুরেন। আমি ভাড়া করি, জলতলে প্রবালের বাগিচা পর্যবেক্ষণের জন্য চারটি স্নরকেল, বা ডুবসাঁতারে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার জন্য লম্বা নল লাগানো এক ধরনের ওয়াটারপ্রুফ হেলমেট।। তাতে উৎসাহিত হয়ে সিনিওর নির্জন দ্বীপে রাত্রিযাপনের জন্য স্লিপিংব্যাগ ভাড়া করার প্রস্তাব করেন। মেয়ে দুটি বেজায় ‘আগ্রেডাবলে বা সব কিছুতেই সহজে সম্মত’ টাইপের। তারা কোন হেলদোল না দেখিয়ে হুয়ান ভেনাডো দ্বীপে রাত্রিযাপনের আয়োজনে আর কী কী ভাড়া করতে হবে তার পরামর্শ দেয়।

আরো পড়তে পারেন

আগ্নেয়গিরি থেকে পায়ে হেঁটে বেস-ক্যাম্পে ফেরা

ইথিওপিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে আছে ‘অ্যারতে-আলে’ নামে লাভা উৎক্ষেপণে প্রজ্বলিত একটি আগ্নেয়গিরি। আমরা বেশ কয়েকজন পর্যটক আজ জোট বেঁধে, একটি ট্যুর কোম্পানির গাইডের তত্ত্বাবধানে ওই আগ্নেয়গিরির পাশের একটি লাভা-হ্রদের পাড়ে ক্যাম্পিং করার উদ্যোগ নিয়েছি। ওখানে যেতে হলে প্রথমে একটি বেস-ক্যাম্পে এসে প্রস্তুতি নিয়ে ট্র্যাক করতে হয় ঘণ্টাকয়েক। বেস-ক্যাম্পে পৌঁছানোও ঝকমারি বিশেষ, আমরা ঘণ্টাকয়েক ল্যান্ডরাবারে প্রায়-দুর্গম এক….

মনে করি আসাম যাব

আফ্রিকার মাসাইমারা সাফারিতে যাওয়ার পর আর কোনো বড় সাফারিতে যাওয়ার সুযোগ হয়নি। অপর্না সেনের ‘মিস্টার অ্যান্ড মিসেস আইয়ার’ সিনেমাতে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার চরিত্রে রাহুল বোসের মুখে কাজিরাঙার কথা শোনার পর এ রিজার্ভ ফরেস্টে সাফারি করার ইচ্ছা জেগেছিল। মনে হচ্ছিল বাড়ির খুব কাছের এ জায়গাটাতে যে কোনো সময়েই যাওয়া যায়, আমাদের উত্তর পূর্ব সীমান্ত পেরিয়ে আর….

শিল্পের দেশে সৌন্দর্যের দেশে

অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি ভেনিসে পা রেখেছিলাম এক রৌদ্রোজ্জ্বল গ্রীষ্মের দুপুরে। যাত্রীবোঝাই পাবলিক বাসে চেপে যাত্রা করলাম সেন্ট মার্কোসের উদ্দেশে। সেন্ট মার্কোসে অবস্থিত বিখ্যাত স্থাপত্য ক্যাথেড্রাল। ক্যাথেড্রালের চারদিকের দেয়াল সুসজ্জিত কারুকার্যে খচিত। চিত্রকর্ম ও অক্ষরে লিপিবদ্ধ বিভিন্ন কাহিনি মুগ্ধতা তৈরি করে। এখানেই ভেনিসের প্রাণভোমরা, সেই বিখ্যাত গ্র্যান্ড ক্যানেল যা যুক্ত করেছে শতাধিক জলরাশিকে। বিশাল খাল ভেনিসকে….

error: Content is protected !!