Sunday, October 26, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    রহস্যময় এলেনা ফেরান্তে

    সফল হওয়া একটা প্রক্রিয়া। আর বিখ্যাত হওয়া একটা ইভেন্ট। প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ইভেন্ট শেষ হয়। কখনও দ্রুত। কখনও ধীরে। কিন্তু শেষ হওয়া নিশ্চিত। খ্যাতির আলোর জীবনকাল চিরস্থায়ী নয়। সময়ের নিয়মে সেই আলো নিভে যায়। কারণ আলোটা আমাদের নয়। এর উৎস অন্য। আমাদের কাজ হল সঠিক জায়গায় দাঁড়ানো প্রিজমের মতো। যাতে আলোটা আমাদের ওপর পরে বিচ্ছুরিত হয়ে রামধনু তৈরি করতে পারে। কাহিনির আলো দিয়ে সাহিত্যজগতে এমনই রামধনু তৈরি করেছেন এলেনা ফেরান্তে; পরিষ্কার প্রিজমের মতো।

    গত মাসের শুরুর দিকে, নিউ ইয়র্ক টাইমস বুক রিভিউ লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং সমালোচকদের একটি জরিপের ওপর ভিত্তি করে এলেনা ফেরান্তের বই ‘মাই ব্রিলিয়ান্ট ফ্রেন্ড’কে একবিংশ শতাব্দীর ১০০টি সেরা বইয়ের তালিকায় প্রথম স্থানে রেখেছিল। চার খণ্ডের ‘মাই ব্রিলিয়ান্ট ফ্রেন্ড’ সিরিজের প্রথম খণ্ডটি প্রকাশের পর ৪০টি দেশে ১ কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে এবং এর থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে একটি সফল টিভি সিরিজও তৈরি করা হয়েছে। টাইম ম্যাগাজিন ২০১৬ সালে ফেরান্তেকে ১০০ জন সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজন বলে অভিহিত করেছে।

    বিভিন্ন বেস্টসেলার তালিকায় স্থান পাওয়া ‘মাই ব্রিলিয়ান্ট ফ্রেন্ড’কে বিংশ শতাব্দীর ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ বই হিসেবেও মনে করা হয়। বইটির সাফল্যের গোপনীয়তা প্রকাশ হলেও, এর লেখকের পরিচয় রহস্য আবৃতই রয়ে গেছে। ফেরান্তে বিশ্বের অন্যতম প্রশংসিত লেখক। তবুও তার সাক্ষাৎকার খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব, কারণ তিনি (তিনি বা তারা) তার পরিচয় গোপন রাখতে অত্যন্ত নিম্ন-কী প্রোফাইল বজায় রেখেছেন। আজ পর্যন্ত, পাঠকরা জানেন না ফেরান্তে আসলে কে।

    আন্তর্জাতিক একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া সত্ত্বেও, ফেরান্তে ১৯৯২ সালে তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশের পর থেকে তার পরিচয় গোপন রেখেছেন। ফেরান্তে মনে করেন যে ‘বইগুলো একবার লেখা হয়ে গেলে তাদের লেখকের কোনও প্রয়োজন নেই।’ তিনি প্যারিস রিভিউকে বলেছিলেন যে তার এরকমটা করার প্রাথমিক কারণ ছিল লজ্জা: ‘আমার খোলস থেকে বেরিয়ে আসার চিন্তায় আমি ভীত ছিলাম।’ তিনি বারবার যুক্তি দিয়েছিলেন যে পরিচয় গোপন রাখা তার কাজের একটি পূর্বশর্ত এবং তার আসল নামটি স্পটলাইটের বাইরে রাখা তার লেখা চালিয়ে যাওয়ার চাবিকাঠি। ফেরান্তের মতে, ‘আমি জানতাম যে সম্পূর্ণ বইটি আমাকে ছাড়াই পৃথিবীতে তার পথ তৈরি করবে…।’

    ‘বর্তমানে মানুষ যেখানে আত্ম-প্রচারে কুণ্ঠাহীন, সেখানে এলেনা ফেরান্তে নিজেকে লুকিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।’ ফেরান্তে সম্পর্কে এমনটাই মত ইতালীয় সাহিত্যের পণ্ডিত এবং ঔপন্যাসিক এনরিকা ফেরারা’র। ফেরান্তের মাই ব্রিলিয়ান্ট ফ্রেন্ড, দ্য স্টোরি অফ এ নিউ নেম, দোজ হু লীভ অ্যান্ড দোজ হু স্টে এবং দ্য স্টোরি অফ দ্য লস্ট চাইল্ড; ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে প্রকাশিত উপন্যাসে ইতালীর নেপলসে জন্মগ্রহণকারী লীলা এবং লেনু নামে দুজন মেয়ের জীবন কাহিনী বলা হয়েছে। উপন্যাসটি ২০১০ সালে শুরু হয় যখন কথক এলেনা গ্রেকো (লেনু) তার একজন পুরানো বন্ধুর ছেলের কাছ থেকে একটি ফোন কল পান, যে বলেছিল— তার মা নিখোঁজ হয়ে গেছে। লেনু তার বন্ধু লীলার এই অন্তর্ধানকে তার একটি সচেতন সিদ্ধান্ত বলে বিশ্বাস করে। তখন লেনু তার বন্ধুর সম্পর্কে না লেখার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং ১৯৫০-এর নেপলস থেকে শুরু করে লীলা সম্পর্কে সে যতটুকু মনে করতে পারে তা কাগজে লিখতে শুরু করে।

    বিভিন্ন বেস্টসেলার তালিকায় স্থান পাওয়া ‘মাই ব্রিলিয়ান্ট ফ্রেন্ড’কে বিংশ শতাব্দীর ‘সর্বশ্রেষ্ঠ’ বই হিসেবেও মনে করা হয়। বইটির সাফল্যের গোপনীয়তা প্রকাশ হলেও, এর লেখকের পরিচয় রহস্য আবৃতই রয়ে গেছে। ফেরান্তে বিশ্বের অন্যতম প্রশংসিত লেখক। তবুও তার সাক্ষাৎকার খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব, কারণ তিনি (তিনি বা তারা) তার পরিচয় গোপন রাখতে অত্যন্ত নিম্ন-কী প্রোফাইল বজায় রেখেছেন। আজ পর্যন্ত, পাঠকরা জানেন না ফেরান্তে আসলে কে

    এলেনা এবং লীলা হিংসা ও কলহপূর্ণ একটি দরিদ্র পাড়ায় বেড়ে ওঠে। যেখানে খুব কম শিশুই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বাইরে শিক্ষা পায়। এমন পরিবেশ থেকে আসা দুই বুদ্ধিমান ও সাহসী শিশু লেনু এবং লিলা’র বন্ধুত্ব বিশ্বব্যাপী পাঠকদের মুগ্ধ করেছে, যা ‘ফেরান্তে ফিভার’ নামে পরিচিত। কিন্তু কোন জিনিস এই ইতালীয় উপন্যাসটিকে এত বিশেষ করে তোলে? কীভাবে একটি গল্প, যা ইতালীয় ইতিহাস, রাজনীতি এবং সমাজের সাথে গভীরভাবে প্রোথিত, তা বিশ্বব্যাপী পাঠকদের সম্পৃক্ত করেছে? এই প্রশ্নে উত্তর খুজঁতে ইউরোনিউজ কালচার বিশ্বের কিছু বইপ্রেমী এবং সমালোচকের সাথে কথা বলেছিল।

    দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর সমালোচক রজার কোহেন লিখেছেন: ‘দুই নারীর পারস্পরিক আদান-প্রদানের গুণাবলী চতুর্দশের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে, যা একইসাথে অন্তর্মুখী এবং সুস্পষ্ট, ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক, যা দুজনের ছয় দশকেরও বেশি সময় জুড়ে আছে। বামপন্থী রেড ব্রিগেডের বিপ্লবী সহিংসতা থেকে শুরু করে উগ্র নারীবাদ পর্যন্ত নারীদের জীবন এবং সেই জীবনগুলো ইতালির উত্থানের সাথে সম্পর্কযুক্ত।’ ইতালীয় লেখক এবং অনুবাদক এনরিক ফেরেরার মতে— ‘মাই ব্রিলিয়ান্ট ফ্রেন্ড’ নারীর বন্ধুত্ব এবং মা ও কন্যার সম্পর্ক সম্পর্কে কথা বলে, যেভাবে অন্য কোনও লেখক আগে করেনি। এটাই গল্পটিকে বৈশ্বিকভাবে প্রাসঙ্গিক করে তোলে।’ মাই ব্রিলিয়ান্ট ফ্রেন্ড-এ আদর্শায়নের জন্য কোনও জায়গা নেই। লেখক পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লেনু এবং লিলাকে প্রথমবারের মতো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুখোমুখি হওয়ার পর থেকে যে প্রতিযোগিতা, গভীর প্রশংসা, লজ্জা এবং ঈর্ষার মিশ্রণে যুক্ত করেছে তা মহিলাদের চরিত্রগুলোর সাথে খুব সহজেই মিলিয়ে দেয়। তবে ফেরান্তে শুধুমাত্র তার নারী অনুরাগীদের কারণেই নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর তালিকার শীর্ষস্থান দখল করেননি। ফেরারা মনে করেন, কিছু মানুষ যারা নিজেরা নারী না হলেও নারীর দৃষ্টিকোণ আবিষ্কার করতে সমানভাবে আগ্রহী। ‘ফেরান্তে একটি হোমোফোবিক বিশ্বকে বর্ণনা করেছেন, যেখানে পুরুষরাও অস্বস্তি বোধ করে এবং এটাই বইটিকে পুরুষ পাঠকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলে,’ ফেরারা যোগ করেন।

    লন্ডনে বসবাসকারী পাঠক মায়ার মতে— ‘ফেরান্তে নারীর বন্ধুত্ব সম্পর্কে যেভাবে লেখেন, আমি আমার জীবনে এরকম আর কোনও বইতে পড়িনি।’ ব্রাসেলসের একটি বইয়ের দোকানী ফ্রেডরিক বিশ্বাস করেন যে ‘মাই ব্রিলিয়ান্ট ফ্রেন্ড-কে সর্বজনীন করে তোলার মূল উপাদানটি হল এর সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রতিকৃতি। এটি বেলজিয়ান, ফরাসি, জার্মানদের জন্য, যারা ধনী বা ক্ষমতাবান নয়, এটি তাদের কথা বলে।’ প্রকৃতপক্ষে— অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অবিচার এবং দুর্নীতির বিষয়গুলো কেবল গল্পের প্রসঙ্গের চেয়েও বেশি – তারা গল্পটিকে এভাবেই সংজ্ঞায়িত করে।

    ‘মাই ব্রিলিয়ান্ট ফ্রেন্ড’-এর আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হল নেপলস, যে শহরের এক অখ্যাত পাড়াকে ঘিড়ে গল্পটি আবর্তিত হয়। নেপলস শুধুমাত্র ইতালীয় পাঠকদের কৌতূহলী করে না, এটি ব্রজিলীয়ান বংশোদ্ভূত লন্ডনের বাসিন্দা মায়ার কাছেও বাড়ির মতো মনে হয়: ‘আমি বইটির ভৌগোলিক এবং ঐতিহাসিক প্রসঙ্গের সাথে পরিচিত ছিলাম না, কিন্তু আমি এর সাথে সম্পর্ক খুঁজে পাই।’ প্রকৃতপক্ষে ‘মাই ব্রিলিয়ান্ট ফ্রেন্ড’ এর প্রতিটি চরিত্র একটি রহস্যের আভায় আবৃত, যেখানে সবকিছু ঝাপসা এবং পরিচয়ের কোনও সীমা নেই। পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি প্রান্তে ফেরান্তের উপন্যাসগুলোর দেখা পাওয়া যায়।

    ফেরান্তের বই বিশ্বের অনেক ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। আর এক্ষেত্রে প্রেক্ষাপটের জাদুকে অক্ষুণ্ণ রাখতে ফেরান্তের অমূল্য সমর্থন পেয়েছিলেন তার বইয়ের অনুবাদকরা; যেকারণে নেপোলিটান শব্দ, প্রাণবন্ত অভিব্যক্তি এবং চরিত্রের নাম অনুবাদ এবং একই সাথে গল্পের মূল নির্যাস সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছে। ফেরান্তে তার লেখার মাধ্যমে এমন একটি জগৎ তৈরি করতে চেয়েছেন যেখানে অন্যদের প্রতি সম্পূর্ণ উন্মুক্ততা থাকবে; এটিই পাঠকদের কাছে এলেনা ফেরান্তেকে আকর্ষণীয় করে তোলে। কিন্তু যখন ফেরান্তে এবং তার বইগুলোর জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়, তখন নিবেদিত ভক্তরা একটি অবিচলিত প্রশ্নের মুখোমুখি হন: এলেনা ফেরান্তে আসলে কে? ভক্তদের এই প্রশ্নের উত্তর এখনও অজানা।

    ২০১৪ সালে এক ই-মেইল সাক্ষাৎকারে, এন্টারটেইনমেন্ট উইকলি ফেরান্তেকে জিজ্ঞাসা করেছিল: ‘আপনি কি কখনও আপনার পরিচয় প্রকাশ না করার জন্য অনুতাপ করেছেন? এমন কোনো মুহূর্ত কি এসেছে, যখন আপনার ইচ্ছা হয়েছে জানালা খুলে চিৎকার করে বলতে— এই পৃথিবীটা আমি সৃষ্টি করেছি!’ ফেরান্তের উত্তর ছিল সংক্ষিপ্ত। ‘আপনার জানালার ছবিটা মজার, আমার বাড়ি ওপরের তলায়, আমি উচ্চতা ভয় পাই এবং আমি অহংকারের আনন্দে জানালায় ঝুঁকে পড়া এড়িয়ে চলি।’

    সূত্র: নিউইয়র্ক টাইমস এবং ইউরোনিউজ

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.