Sunday, October 26, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    মধ্যরাতের ফুর্তিবাজ

    আজ বিকালের বাসে খাগড়াছড়িতে পৌঁছেছে স্বপন। সন্ধ্যেটা কাটিয়েছে বাসস্ট্যান্ডের কাছেই ছোট একটা পার্কে। সেখানে লোকজন তেমন ছিল না। ভিতরের দিকে পাতাবাহার আর কলাবতীর ঝাড়ে আড়াল করা নিরিবিলি কোনায় চুপচাপ বসেছিল। ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রা শেষে নিজেকে খুব নিস্তেজ লাগছিল। ক্লান্তিতে দুই চোখের পাতা বুজে আসতে চাইলেও গত রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা স্মরণ করে একটা দুঃস্বপ্নের ভিতর থেকে যেন বার বার জেগে উঠছিল সে। ঢাকা থেকে পালিয়ে এলেও অঘটনটা তাকে পিছনে পিছনে তাড়া করে আসছে। মোবাইল ফোনটা পুরোপুরি বন্ধ করে রেখেছে। কেউ যেন তার হদিস বের করতে না পারে। তবু মন থেকে ভয় দূর করতে পারছে না।

    সামনের উঁচু গাছগুলোর ওপাশে আকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মেঘের শরীরে গোধূলির রঙ মাখিয়ে সূর্য ডুবে গেল। সন্ধ্যেটা যেন সেই অপেক্ষায় ছিল। গোধূলির রঙ মিলিয়ে যেতেই সন্ধ্যার ছায়ায় ঢেকে গেল পার্কের ভিতরটা। গাছগাছালি আর ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে সুড় সুড় করে বেরিয়ে আসা শীতল ধোঁয়াটে অন্ধকার নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়তে থাকল চারপাশে। এ সময় হঠাৎ দপ করে সামনের রাস্তার বাতিগুলো একসাথে জ্বলে উঠলে স্বপন পার্ক থেকে বের হওয়ার কথা চিন্তা করল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়াল, তারপর ট্রাভেল ব্যাগটা পিঠে ফেলে পার্কের গেট লক্ষ্য করে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল।
    স্বপন আলো-আঁধারিতে রাস্তা ধরে হাঁটছে। অনেকটা লক্ষ্যহীন ভাবে হাঁটছে। খাগড়াছড়িতে এই প্রথম আসা। শহরের কিছুই চিনে না সে। পাহাড়ি শহরটার এই দিকটায় মনে হয় লোক চলাচল কম। কিছু রিকশা ঠুন ঠুন বেল বাজিয়ে যাওয়া-আসা করছে। রাস্তার ওপাশে একসারি দোকানঘর। একটা ঘরের সামনে উঁচু ঢিবির মত দেখতে চুলায় আগুন জ্বলছে। একজন লোক তাওয়ার সামনে বসে কিছু ভাজছে। দোকানঘরটির দোতলার বারান্দার রেলিং এ ঝুলছে বড় একটা সাইনবোর্ড। ওতে লেখা, ডল হাউস। থাকা খাওয়ার সুবন্দবস্ত আছে।
    ভাজাভুজির গন্ধে স্বপনের পেটে ক্ষুধা মোচড় দিয়ে উঠল । সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি। আসার পথে বাসে দুটো আমড়া কিনে খেয়েছিল। ব্যাস, ওই টুকুই।
    পেটে ক্ষুধার আগুন নিয়ে সে ডল হাউসের রেস্তোরাঁয় ঢুকল। ভিতরের দিকে টেবিলে বসতেই মোটাসোটা একটা লোক এসে তার পাশে দাঁড়াল। রেস্তোরাঁর খানসামা হবে।

    -কি খাবেন?
    -পরোটা আছে?
    -আছে।
    -নানরুটি হবে না? একটু ভেবে স্বপন জিজ্ঞাসা করল।
    -আছে।
    -মাংস হবে?
    -গরু ভুনা হবে, দিব? স্বপন মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল ।
    -এক নান, গরু হাফ। ভিতরে রান্নাঘরের উদ্দেশে জোর গলায় হাঁকলো খানসামা।

    খানসামা খাবার দিয়ে গেলে স্বপন রুটির টুকরায় ঝোল মাখিয়ে চিবাতে লাগল। ঝোলে হলুদের গন্ধ। ঝালও বেশ। গোস্তের টুকরাটা মুখে তুলতে গিয়ে রেখে দিল। চালের রুটি আর মাংস ভুনা সে শখ করে খায় বলে প্রায়ই ছুটির দিন ডলি সেটা রান্না করে। ডলির হাতের রান্না খুব ভালো। যে খেয়েছে সেই প্রশংসা করেছে। এখন থেকে ডলি আর তার জন্য রাধবে না। এতক্ষণে নিশ্চয় প্রতিবেশীরা ডলির খবর জেনে গেছে। ডলির মামা নিশ্চয়ই থানায় খবর দিয়েছেন। পুলিশ স্বপনকে খুজতে শুরু করেছে। এসব কথা চিন্তা করে সে ভিতরে ভিতরে বেশ বিচলিত বোধ করল। ওর মনে হলো ডলির জন্য একধরনের কষ্ট আর উদ্বেগে ক্রমশই তার বুক ভারি হয়ে উঠছে।

    -খাবার ভালো হয় নাই? গরম করে দিব? তাকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে দেখে কখন যে খানসামা লোকটি এসে কাছে দাঁড়িয়েছে স্বপন খেয়াল করেনি। ওর কথায় যেন হুঁশ ফিরে পেল।
    -খাবার ঠিক আছে। আমার তেমন ক্ষিধে নেই। বিরস মুখে স্বপন বলল। আচ্ছা, এখানে কি থাকার ব্যবস্থা আছে?
    -আছে। সব রকম ব্যবস্তা আছে। পান চিবাতে চিবাতে খানসামা বলল। কথায় কেমন যেন মুরব্বিয়ানা ভাব।
    -ভাড়া কত?
    -তিনশ’ টাকা, সিঙ্গেল রুম। পাংখা ছাড়া। লাগবে?
    মনে হলো সে স্বপনের দিকে তাকিয়ে তাকে মাপজোখ করছে। স্বপন প্লেটে হাত ধুয়ে ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে উঠে দাঁড়াল। পকেট থেকে টাকা বের করতে করতে শুনল লোকটি পিছন থেকে হাঁকছে,
    -খাওনের বিল চল্লিশ টাকা।

    স্বপন বিল পরিশোধ করে বাইরে বেরিয়ে এলো তারপর রাস্তার ডান পাশ ধরে হাঁটতে থাকল। ডলির চিন্তার সাথে এখন একটা নুতন চিন্তা তার মাথায় বন বন করে ঘুরছে। তার কাছে মাত্র হাজার চারেক টাকা আছে। তাড়াহুড়া করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় সাথে নিয়ে এসেছে। হোটেলের যে খরচ। থাকা-খাওয়ার খরচ মিলিয়ে এই টাকায় সে কত দিন চলতে পারবে? ভেবে ভেবে খুব অশান্তি লাগছে তার।

    কাছেই রাস্তার পাশে একটা ভাঙাচোরা জিপগাড়ি থেমে আছে। পিছনটা পুরনো ছেঁড়া তেরপলে ঢাকা। একজন ছোকরা বয়সী ছেলে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে চেঁচাচ্ছে।
    এই গেল লাস্ট টিপ, বাঘাই হাট, লাস্ট টিপ্।

    হঠাৎ রাস্তার উল্টোদিকে চোখ পড়তেই স্বপন দেখল জনাচারেক পুলিশের একটি দল হেঁটে হেঁটে এই দিকে আসছে। টহল পুলিশ হবে। কাঁধে বন্দুক ঝুলিয়ে কেমন খুঁতখুঁতে সন্ধানি চোখে এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে পুলিশগুলো হাঁটছে। ব্যাগ কাঁধে এ সময় এভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পুলিশগুলো তাকে আবার কোন রকম সন্দেহ করে বসবে না তো? আর সন্দেহের বশে ওরা যদি তাকে জেরা করতে শুরু করে তাহলে সে নিশ্চিত ধরা পড়ে যাবে। এইসব চিন্তা করে স্বপন ভিতরে ভিতরে ঘেমে উঠল। পুলিশকে এখন খুব ভয় হচ্ছে ওর। ওদের চোখ থেকে নিজেকে আড়াল করতে তাড়াতাড়ি জিপ গাড়ির সামনের সিটে উঠে বসল।
    -বস, ভালো আছেন তো?
    পাশে ড্রাইভারের সিটে বসা লোকটি জানালায় হাত নাড়াতে নাড়াতে পুলিশগুলোকে উদ্দেশ করে বলে উঠল। অন্ধকারে বসে থাকা লোকটিকে লক্ষ্য করেনি সে। গাড়ির ড্রাইভার হবে। পুলিশদের মধ্যে কেউ হয়তো তার পরিচিত হবে। স্বপন মনে মনে ড্রাইভার লোকটির উপর বিরক্ত হলো। কুশল জিজ্ঞাসা করার আর সময় পেল না ব্যাটা। তবে ওর কুশল বার্তার কোন সাড়া এলো না টহলদারদের পক্ষ থেকে। মেজাজি চালে গাড়িটা পাশ কাটিয়ে চলে গেল ওরা। আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে স্বস্তিতে নড়ে চড়ে বসল স্বপন।
    শালাদের একটু তোয়াজ না করলে রুটে গাড়ি চালানো মুশকিল।
    ড্রাইভার যেন আপন মনে কথা বলে উঠল। ওর কথায় পাহাড়ি টান আছে। ফস করে দিয়াশলাই জ্বালিয়ে সিগারেট ধরালো সে। দিয়াশলাই এর আলোয় এক পলক লোকটির চেহারা দেখতে পেল স্বপন। ফর্সা মুখে চ্যাপ্টা নাক, মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা। পাহাড়ি বটে।
    গাড়িটা ক্যাচ ক্যাচ শব্দে বার কয়েক দুলে উঠল। স্বপন বুঝলো পিছনে যাত্রী উঠছে। হেলপার ছোরা থেকে থেকে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে,
    এই গেল। এই গেল। বাঘাই ঘাট, লাস্ট টিপ।

    স্বপন গাড়িতে বসে মনস্থির করল বাঘাই ঘাট পর্যন্ত যাবে। শহরের বাইরে বলে হয়তো সেখানে সস্তায় থাকা যাবে। জায়গাটা নিরাপদ মনে হলে সেখানেই থেকে যাবে।

    ওস্তাাদ, ছয়জন পেসেঞ্জার হইছে। টান দেন। হেলপার গাড়ির পিছনে থাপ্পড় দিতে দিতে বলল। গাড়ি স্টার্ট দিল ড্রাইভার।
    কিছুক্ষণের মধ্যে গাড়ি শহর ছেড়ে নির্জন পাহাড়ি পথ ধরে চলতে থাকল। পথের দুই পাশে ঝোপঝাড় আর গাছগাছালি শরীরে অন্ধকার মেখে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। দূরে দূরে অন্ধকারে ডুবে থাকা পাহাড়ের গায় বাড়ি ঘরের আলো ছোট ছোট বুঁদবুঁদের মত ভাসছে। গাছ গাছালির ফাঁকে- পাহাড়ের মাথায় ধূসর মেঘের ভিতর ফানুসের মত উড়ছে ঠান্ডা গোল চাঁদ। হেড লাইটের টিম টিমে হলুদ আলো জ্বেলে গাড়ি চলছে। পথের ধার ঘেঁষে অন্ধকার খাদ। উঁচু নিচু পথে চলতে চলতে কখনও গাড়িটা ঝাঁকি খেয়ে ক্যাচ ক্যাচ শব্দে ভয়ানকভাবে দুলে উঠছে। স্বপনের ভয় হচ্ছে। সে সিটে পিঠ ঠেঁসে শক্ত হয়ে বসে থাকল। স্বপনের মনে পড়ে একবার ডলিকে নিয়ে আশুলিয়ার ওয়ান্ডার ল্যান্ডে গিয়েছিল। ডলি ঘোড়ার রাইডে উঠেছিল। প্রচন্ড দুলুনিতে ভয় পেয়ে তাকে জাপটে ধরে শক্ত হয়ে বসে ছিল। ডলি গাড়ির দুলুনি একেবারেই সহ্য করতে পারে না।

    -এখানে বেড়াতে আসছ নাকি? ইঞ্জিন আর বাতাসের শব্দ ছাপিয়ে ড্রাইভারের ভারি উঁচু গলার স্বর শুনতে পেল স্বপন। ড্রাইভার তাকেই জিজ্ঞাসা করছে। উত্তরে মাথা নাড়াল সে।
    -ঢাকা থেকে আসতেছ? উত্তরে আবারো মাথা নাড়ল।
    -এটা ট্যুরিস্ট সিজন তো, ট্যুরিস্ট আসতে শুরু করছে। বেশি লোকজন আসে ঢাকা থেকে। কম বয়সি ছেলে পুলে। পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়, ঝর্ণায় গোসল করে আর ফুর্তি টুর্তি করে। ড্রাইভার বলল। সাথে ট্রাভেল ব্যাগ দেখে সে তাকে ট্যুরিস্ট ভেবেছে হয়তো। কাল রাত থেকে মুখে কুলুপ এঁটে আছে স্বপন। মনটাও অস্থির। একজন কথা বলার সঙ্গী পেলে মন্দ হয় না। কথা বলে সময় কাটবে, মনও শান্ত হবে।
    -বাঘাই হাট আর কত দূর? গলার স্বর যতটুকু সম্ভব উঁচু করে স্বপন জিজ্ঞাসা করল।
    -এই তো আর আধাঘণ্টা।
    -বাঘাই হাটে থাকার জায়গা আছে? স্বপন আবার জিজ্ঞাসা করল।
    -থাকা, খাওয়া, ফুর্তি, সব কিছুর জায়গা আছে। আমি পাহাড়ের আদিবাসী। চান্দের গাড়ি চালাই। গাইডের কাজও করি। এই এলাকার সব কিছু আমার জানা। বলতে বলতে সে অন্ধকারে স্বপনের মুখের দিকে তাকাল। হয়তো তার প্রতিক্রিয়া বুঝতে চেষ্টা করছে।
    -আমার নাম শিশির। উচ্চারণে শব্দের সামান্য মিশ্রণ থাকলেও লোকটি মোটামুটি ভালো বাংলা বলছে।
    -আমার নাম স্বপন। শিশিরের বাড়িয়ে দেওয়া হাতে হাত মেলাল সে। স্বপন টের পেল লোকটির হাতের তালু বেশ শক্ত আর খসখসে।
    -তুমি পাহাড়ের লোক। এত পরিষ্কার বাংলা বলা কোথায় শিখলে?
    -সেইটার একটা হিস্টরি আছে।
    -কি রকম?
    -আমার জন্ম হইছিল চাকমা পরিবারে। আমার বাবা জুম চাষ করতো। আমি তখন বেবী। বয়স পাঁচ। একদিন বাঙালিরা আমাদের পাড়ায় হামলা করল। বাড়িঘরে আগুন দিল। বাবা-মা দুজন আগুনে পুড়ে বারবাকিউ হয়ে গেল। বাঙালিরা আমাকে পেদানি দিয়ে হাফডেড করে রাস্তায় ফেলে রাখলো। জলছড়ার সান্টু চৌকিদার আমাকে রাস্তায় দেখতে পেয়ে ওর বাড়ি নিয়ে গেল। চৌকিদারের ছেলে মেয়ে ছিল না। ওরাই আমাকে পেলে পুলে বড় করেছে। চৌকিদার আব্বা আমাকে বাংলা লেখা পড়া শিখাল। বলতে বলতে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল সে। মনে মনে যেন পুরনো স্মৃতিগুলো হাতড়াচ্ছে। তারপর ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল,
    মাঝে মাঝে ভাবি, কি বিচিত্র মানুষের মন। একজন খুঁচায়ে খুঁচায়ে ঘা করে, আর একজন এসে মলম লাগায়। নিজের কথায় মজা পেয়ে জোরে হেসে উঠল শিশির।
    -তুমি থাকো কোথায়?
    -খাগড়াছড়ি। টাউনের কাছে আমার একটা ছোট ঝুপড়ি ঘর আছে। বাঘাই হাটে লাস্ট ট্রিপ মেরে আড্ডা মারি, ফুর্তি ফার্তি করি তারপর ঘরে গিয়ে ঘুমাই। একটু আধটু ফুর্তি না করলে লাইফটা ড্রাইফিসের মত গান্দা হয়ে যায়। ঘাড় কাত স্বপনের দিকে তাকিয়ে সে হাসল।
    পাহাড়ি লোকটার কথাবার্তা কেমন যেন বাউন্ডুলে, ছন্নছাড়া ধরনের। তবে ওর এই অকপট, খোলামেলা কথাগুলো স্বপন বেশ উপভোগ করছে।
    -বিয়ে করনি বোধ হয়? একটু ইতস্তত করে প্রশ্ন করল স্বপন।
    -বিয়ে করবো করবো করে করা হইতেছে না। একটা মেয়ের সাথে আমার ইয়ে আছে। ওর আবার হাজবেন্ড আছে। ভেরি ওল্ডমেন। ওল্ডমেনটা মরতেছে না আর সে জন্য মেয়েটাকে বিয়েও করা হচ্ছে না। শালা বুড়া ভাম, কবে যে হেভেনে যাবে বুঝতে পারি না। শিশিরের গলায় হতাশার সুর।
    একটু থেমে শিশির বলল, তোমাকে নিয়ে যাব সেখানে। সোনালি ভেরি গুড গার্ল। দুজনে মিলে ফুর্তি করে আসবো। বলতে বলতে হঠাৎ সুর পাল্টে উঁচু গলায় চিৎকার করে উঠল সে, শালা শিয়ালের বাচ্চা। ঘ্যাচ করে ব্রেক মেরে গাড়ি থামাল। রাস্তার উপর কয়েকটা শেয়াল কিছু একটা মুখে নিয়ে টানা হেঁচড়া করছিল। গাড়ি থেমে যাওয়ায় চোখ তুলে তাকাল জন্তুগুলো। হেড লাইটের আলো পড়ে ওদের চোখ জ্বল জ্বল করে জ্বলছে।
    -ওই পোলা, খেদা ওইগুলাকে।
    পেছন থেকে হাত তালি দিতে দিতে হৈ হৈ করে চিৎকার করে উঠল হেল্পার ছেলেটি। ওর চিৎকারে শিয়ালগুলো ভয় পেয়ে ছোটাছুটি করে পাশের ঝোপের ভিতর অদৃশ্য হলো।
    -শালা মরা-খেকো শিয়াল। শ্মশান থেকে পোড়া হাড়গোড় কুড়ায়ে কামড়া কামড়ি করে খায়। ভেরি বেড এনিমেল। শেয়ালগুলোকে গালমন্দ করতে করতে শিশির গাড়ির ব্রেক ছাড়ল । গাড়ি আবার চলতে শুরু করল। বোঝা গেল শিশির তার পছন্দ অপছন্দের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য গুড আর বেড শব্দ দুটি জুতসই জায়গায় ব্যবহার করে থাকে।

    সামনের অন্ধকার বাকটা ঘুরে অল্প কিছুদূর গিয়ে একটা বাজার মত জায়গায় গাড়ি থামাল শিশির। রাস্তার দুই পাশে দোকানপাটে টিম টিম করে আলো জ্বলছে। লোকজনের আনাগোনাও বেশ।
    এই নামেন, বাঘাই হাট। বাঘাই হাট। হেল্পার চেঁচিয়ে বলল। দুপ দাপ করে নেমে গেল যাত্রীরা। শিশিরের হাতে যাত্রীর ভাড়ার টাকা গুনে দিয়ে হেল্পার ছেলেটিও অন্ধকার রাস্তায় উধাও হয়ে গেল। মনে হচ্ছে এখানে কোথাও ছেলেটির বাড়ি।
    -আজকের মত কামকাজ শেষ। আমরা এখন সোনালির বাড়িতে যাব। দুইজনে মিলে ফুর্তি করবো। তারপর খাগড়াছড়ি ফিরে যাবো। আমি সিঙ্গেল মেন। তুমি ইচ্ছা করলে আমার বাড়িতে ঘুমাতে পারো। তোমার সাথে কথা বলে আমার ভালো লাগতেছে। স্বপনের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে শিশির বলল। ওর চোখে মুখে খুশি খুশি ভাব।
    (খুবই উত্তম আর স্বস্তিকর প্রস্তাব)। অল্প সময়ের পরিচয়ে পাহাড়ি লোকটার কাছ থেকে এমন আন্তরিকতা স্বপন আশা করেনি। নিমিষেই সে রাজি হয়ে গেল। ধন্যবাদ বলে গভীর কৃতজ্ঞতায় শিশিরের হাতে হাত মেলাল। রাতে থাকার জায়গা নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় ছিল। দুশ্চিন্তাটা গেল। নিজেকে এখন অনেক নিশ্চিন্ত মনে হচ্ছে ওর।
    -তাহলে চল, তোমার সোনালিকে দেখে আসি। স্বপন মনে মনে বেশ উৎসাহ পাচ্ছে।
    সরু পাহাড়ি পথ ঘুরে ঘুরে অবশেষে গাছ গাছালি আর বাঁশঝাড় পরিবেষ্টিত একটা ছোট বাড়ির সামনে এসে শিশির থামল। দেখাদেখি ওর সাথে গাড়ি থেকে নামল স্বপন। বারান্দার সামনে আঙ্গিনায় একটা বেঞ্চ পাতা রয়েছে। ভিতরে মিটমিটে আলো জ্বলছে। সাড়া পেয়ে একজন বয়স্ক বুড়ো লোক গুটি গুটি পায়ে বারান্দায় বেরিয়ে এলো।
    -নমস্কার বাবু। আমি শিশির। তুমি ভালো তো? শিশির হাত জোড় করে নমস্কার করল। অনেকটা নির্লিপ্ত চোখে ওদের দিকে এক পলক তাকাল বুড়ো, হাত উঁচিয়ে বেঞ্চে বসার ইঙ্গিত করে আবার শ্লথ পায়ে ঘরের ভিতর ঢুকল।
    হেডমেন, বীরেন চাকমা। সোনালির হাসবেন্ড। গলার স্বর একটু খাটো করে শিশির জানালো।
    অল্পক্ষণ পরেই সোনালির দেখা মিলল। হাতের লণ্ঠন বারান্দার একপাশে রেখে চঞ্চল পায়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল মেয়েটি। স্বপনের মনে হলো অন্ধকারের গুটি কেটে যেন একটা উজ্জ্বল রঙিন প্রজাপতি উড়ে এসে তার দৃষ্টি জুড়ে বসলো। কুড়ি-বাইশ বছরের টলটলে যুবতী। পরনে পাহাড়ি মেয়েদের আঁটসাট পোশাক। গায়ের রং ফর্সা। বোধহয় কাঁচা হলুদের রং বললে ঠিক হবে। ফুলদার রঙিন ব্লাউজ পুরুষ্ট বুকের বন্যতাকে বেঁধে রাখতে পারছে না যেন।
    -এত দেরি করে আইছো কেন? শিশিরের দিকে একটু ঝুঁকে প্রায় ফিসফিস করে বলল সোনালি। গলায় অনুযোগের সুর।
    -কি করবো, প্যাসেঞ্জার পেতে দেরি হয়ে গেল। এখন তাড়াতাড়ি পানি নিয়া আস। গলা শুকায়ে ডেজার্ট হয়ে গেছে। শিশির হাত বাড়িয়ে সোনালির ফোলা ফোলা টসটসে গাল টিপে দিল। চকিতে একবার পিছনে তাকাল সোনালি। বোঝা গেল মেয়েটি বুড়োর কারণে বেশ সতর্ক ।
    -পানি আনতেছি। বলে চঞ্চল পায়ে ঘরের ভিতর ছুটে গেল সোনালি।
    স্বপন তার ছুটে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে যায়। ভালোলাগা মানুষটিকে কাছে পেলে কে না আনন্দে উদ্বেলিত হয়। ডলিও এমনটি হতো। স্বপন অফিস থেকে ঘরে ফিরলেই ডলি আনন্দে উচ্ছল হয়ে উঠতো। স্বপনের মনে হতো ডলি যেন সারাদিন তার আসার অপেক্ষাতে উদগ্রীব হয়ে বসে ছিল। কখনও অফিস থেকে ফিরতে একটু দেরি হলে ডলির অনুযোগের সীমা থাকতো না। ডলি অসুস্থ হওয়ার পর যত দিন যেতে লাগল, তার অনুযোগ আর অভিযোগের মাত্রা বাড়তে থাকলো। দিন দিন কেমন কঙ্কালসার, খুঁত খুঁতে আর সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠল সে। সন্দেহ মনকে কলুষিত করে আর ভালোবাসাকে বিস্বাদ করে। সেরকমই হতে থাকল। স্বপনের মনে হলো ডলির আচরণ ক্রমশই তাকে ভিতরে ভিতরে বিরক্ত আর অসহিষ্ণু করে তুলছে। ডলির প্রতি তার ভালোবাসা যেন ধীরে ধীরে ফুরিয়ে যাচ্ছে।
    -এত কি ভাবতেছ? কাঁধে শিশিরের শক্ত হাতের নাড়া খেয়ে হুঁশে ফিরল স্বপন।
    -তোমার বান্ধবী দেখতে শুনতে সত্যি সুন্দর। আমার স্ত্রীও এ রকম চঞ্চল আর সুন্দরী ছিল। বলতে বলতে থেমে গেল স্বপন। শিশির দু’চোখে আগ্রহ নিয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে ছিল কিন্তু তাকে চুপ থাকতে দেখে সেও চুপ মেরে গেল। তবে স্বপনের চিন্তাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে অনুমান করল স্ত্রীর জন্য বাঙালি লোকটির মনে কোন রকম কষ্ট জমে আছে। তাই স্ত্রীকে নিয়ে কথা বাড়াতে চাচ্ছে না হয়তো।
    একটা থালায় জগ আর প্লাস্টিকের মগ নিয়ে ফিরে এলো সোনালি। সঙ্গে ছোট পিরিচে পিঠা জাতীয় কিছু।
    -এগুলো কি? প্লটের দিকে আঙ্গুল হেলিয়ে শিশির জিজ্ঞাসা করল।
    -পিঠা। আমি বানাইছি। তোমার জন্য রেখে দিছিলাম। খাও। স্বপনের দিকে চেয়ে বলল, তুমিও খাও।
    -আমরা খাব। তুমি আমার কাছে একটু বস না। শিশির মেয়েটির কোমর জড়িয়ে ধরে ওর দিকে টানতেই সে হাঁসফাঁস করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। আড়চোখে বারান্দার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় ধমকে উঠল, তুমি যে কি কর। বুড়া দেখতে পাবে না? আমি যাই, পরে আসবো। বলে সে দ্রুত পায়ে ঘরের ভিতর মিলিয়ে গেল।
    শিশির জগ কাত করে দুটো মগ ভরল। এক ধরনের উটকো গন্ধে জায়গাটা ভরে উঠেছে। কেমন যেন নেশা-ধরা ঘ্রাণ। মগটা স্বপনের হাতে দিয়ে শিশির বলল, ভেরি গুড ড্রিঙ্ক। লোকে বলে পাগলা পানি। চুমুক দিলে মাথার সব টেনশন পালায়ে যায়। তবে, চুমুক দেবার আগে আমার জন্য একটু প্রার্থনা করবে?
    -কি প্রার্থনা, বল?
    -প্রার্থনা কর, বুড়া হেডমেন যেন খুব তাড়াতাড়ি হেভেনে চলে যায়। শিশির মুখে হাতচাপা দিয়ে হাসতে লাগল। স্বপনও হেসে উঠল।
    মগে চুমুক দেওয়া মাত্র স্বপন পাগলা পানির গুণাগুণ টের পেল। প্রচন্ড ঝাঁজে তার জ্বিবের ডগা থেকে পাকস্থলী পর্যন্ত ছ্যাঁত করে উঠল। এ রকম অভিজ্ঞতা এই প্রথম।
    শিশির বাঁ হাতের মুঠোয় মগটা ধরেছে। ওর হাতের মাঝখানের দুটো আঙ্গুল বেমানান ধরনের ছোট আর বাঁকানো। স্বপনকে সেদিকে চেয়ে থাকতে দেখে সে হেসে বলল,
    -শিয়াল কামড় দিছিল।
    -শিয়াল কামড়েছে? স্বপনের চোখে বিস্ময়।
    -আমি তখন ছোট্ট বেবী। আমাকে গাছের ছায়ায় বসিয়ে বাবা মা জুমে কাজ করতে ছিল। হঠাৎ একটা শিয়াল এসে আমার হাত কামড়ায়ে ধরল। বাবা ছুটে না এলে শিয়াল আমার সব ফিঙ্গার খেয়ে ফেলতো। তখন থেকে আমি শিয়ালকে ভয় পাই। শালারা মড়া খেকো। ভেরি ব্যাড এনিমেল। শিয়ালকে গালি দিয়ে যেন মনের ঝাল ঝাড়ল শিশির।
    শিশির মগে চুমুক দিতে দিতে ঘন ঘন বারান্দার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। ওর এই অস্থিরতার কারণ স্বপন বুঝতে পারছে। এক সময় ডলিকে নিয়ে সেও এ রকম অস্থিরতায় ভুগতো। ভালোলাগা মানুষটিকে কাছে পাওয়ার জন্য সকলের মনে হয়তো এ রকম ব্যাকুলতা থাকে।
    -আমার চৌকিদার আব্বা গুড মেন ছিল। কিন্তু ওর ভাইটা
    ছিল ভেরি ব্যাড মেন। চৌকিদার আব্বা মরে গেলে সে আমার পিছনে লাগল। আমার ওই ছোট জিনিসটা কেটে ছেটে আমাকে মুসলমান বানাবে। কয়েক দিন পর পর মৌলবীকে ডেকে আনে। আমি তখন বিগ বয়। অনেক কিছু বুঝতে শিখছি। আমার অরিজিনাল বাবা-মা ছিল চাকমা। আমার দাদা ছিল চাকমা। আমিও চাকমা। শিশির চাকমা। ঠিক না? বলে শিশির ওর দিকে তাকাল।
    প্রতিটি মানুষ তার নিজস্ব ধর্মকর্ম আর পরিচয় রক্ষা করার অধিকার রাখে। শিশির এর ব্যতিক্রম নয়। স্বপন মনে মনে পাহাড়ি লোকটির অহংবোধকে প্রশংসা না করে পারল না। মাথা নেড়ে সায় দিল। ওর সমর্থন যেন শিশিরকে উৎসাহিত করল। সে বলতে থাকল,
    -আমি চাকমা, চাকমার মতই থাকতে চাই, মুসলমানি করাতে রাজি হই না। তাই আঙ্কেল একদিন আমাকে হেভি পেদানি দিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিল। আমি পুওর বয় যাব কোথায়? শেষে রাগে দুঃখে সন্তুর দলে ভিড়ে গেলাম।
    কথা বলার ফাঁকে শিশির আর স্বপনের চোখ পলকের জন্য বারান্দার দরজায় আঁটকে গেল। সোনালি দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। মুখে চটুল হাসি। লম্বা চুলের বেণী বুকের উপর এনে আঙ্গুল দিয়ে খুটছে। বোঝা যাচ্ছে দুদন্ড ওদের কাছে এসে বসার খুবই ইচ্ছা হচ্ছে ওর, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছে না। বুড়ো নিশ্চয় ওকে চোখে চোখে রাখছে। ভিতর থেকে বুড়োর ডাক ভেসে আসতেই মুহূর্তের মধ্যে আবার সে বাড়ির ভিতর উধাও হয়ে গেল।

    শালা বুড়া ভাম। কবে যে হেভেনে যাবে! দরজা থেকে চোখ ফিরিয়ে শিশির বলল। ওর কথায় হতাশা আর আক্ষেপের সুর। নিজের মগে পানীয় ঢালল সে, তারপর স্বপনের মগে ঢালতে গিয়ে থেমে গেল।
    -আরে তোমার মগ দেখতেছি ফুল! খাও, খাও, এনজয় কর।
    সে মগটা স্বপনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, চিয়ার্স। স্বপন আলতোভাবে মগে চুমুক দিল। মনে হলো তরলটা জ্বলতে জ্বলতে ওর গলা দিয়ে পেটে নেমে যাচ্ছে। মুখে একটা বিস্বাদ ভাব নিয়ে অন্ধকারে মুখ কোঁচকালো স্বপন।
    -আমাদের ক্যাম্প ছিল বর্ডারে, শিশির বলতে থাকল, ক্যাম্পের কমান্ডার কেন জানি আমাকে পছন্দ করতো না। আমাকে দিয়ে খুন খারাবি করাতে চাইতো। একদিন এক বাঙালি কাঠুরেকে ধরে আনল। আমাকে বলল ওকে গুলি করতে। আমার সামনে লোকটা হাত জোড় করে দাঁড়ায়ে ঠি ঠি করে কাঁপছে। পাশেই ওর বেবী ছেলে আমার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়ে আছে। আমি বন্দুক নামায়ে নিলাম। কমান্ডার রেগে মেগে আমার পাছায় বুটজুতা দিয়ে এমন লাত্থি মারল যে মনে হলো ভুঁইকাপ হয়েছে, আমার প্যান্টে টয়লেট হয়ে গেল। সেই রাতেই পালিয়ে খাগড়াছড়ি ফিরে এলাম। খুন খারাবির কাজ আমাকে দিয়ে হবে না।
    শিশিরের কথা শুনতে শুনতে স্বপন আবার অন্যমনস্কতায় ডুবে গেল। গত রাতের দৃশ্যটা তার চোখে ভাসছে। ডলি কেমন ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। ওর চোখের বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ফুটে ছিল ভয় আর অবিশ্বাস!
    -মনে হচ্ছে তুমি একটা কিছু চিন্তা করে মন খারাপ করতেছ। স্বপনের কাঁধে নাড়া দিয়ে শিশির বলল। জীবনে সুখ দুঃখ আছে। যত বেশি দুঃখকে ভুলে থাকবে সুখকে তত বেশি কাছে পাবে। আর দুঃখ ভুলে থাকতে হলে ফুর্তি কর। শিশির পাগলা পানির মগে দীর্ঘ আয়েশী চুমুক দিল।

    হয়তো এসবই শিশিরের ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতার ফসল। তার নিজস্ব জীবনদর্শন। তবে কথাগুলো অর্থবহ, শুনতে ভালো লাগছে স্বপনের। এই অকপট সরল ফুর্তিবাজ পাহাড়ি লোকটাকে দেখে বোঝার উপায় নেই তার জীবনে এখন পর্যন্ত এতসব অঘটন ঘটে গেছে। তারপরও সে কত হাসি খুশি, ফুর্তিবাজ, একজন সুখী মানুষ।
    চাঁদটা কখন যে মাথার উপর উঠে এসেছে খেয়াল করেনি ওরা কেউ। চাঁদের হলুদ আলো ডালপালার ফাঁক দিয়ে ঝরে পড়ছে আঙ্গিনার ভিতর। আলো-আঁধারিতে ভরে আছে চারপাশ। বাঁশঝাড়ের পাতা কাঁপিয়ে পাহাড়ের মৃদু শীতল বাতাস বইতে শুরু করেছে। স্বপন হাই তুলল। কাল সারারাত ঘুমাতে পারেনি সে। মনে হচ্ছে গভীর ঘুমে তার চোখের পাতা ভারি হয়ে আসছে।
    -মনে হচ্ছে, বেশ রাত হয়েছে। স্বপন হাই তুলতে তুলতে বলল।
    -রাত যত বাড়বে, ফুর্তির নেশা তত বেশি জমবে। ঢুলু ঢুলু চোখে তার দিকে তাকাল শিশির, তারপর হঠাৎ নড়ে চড়ে বসল। বলল, মনে হচ্ছে তোমার ঘুম পাইতেছে। আজ তাহলে বাড়ি চল। নেশা বেশি হয়ে গেলে আমার আবার একটু সমস্যা হয়।
    -কি রকম সমস্যা?
    -নেশার ভিতর আমি একটা জিনিসকে একসাথে অনেকগুলো দেখি। যেমন ধর, আমি যদি সোনালির দিকে তাকাই, মনে হয় সোনালি অনেকগুলা যমজ বোনদের মাঝখানে দাঁড়ায়ে আছে। কোনটা আসল সোনালি, আমি বুঝতে পারি না।
    সমস্যাটা তেমন গুরুতর কিছু নয়। স্বপন ভাবল। নেশাগ্রস্ত মানুষের এ রকম দৃষ্টি বিভ্রম হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়।
    ওদের দুজনকে উঠতে দেখে সোনালি বেরিয়ে এলো। মনে হচ্ছে সে যেন ঘরের ভিতর থেকে লোক দুটোর উপর সজাগ চোখ মেলে জেগে বসে ছিল। তার চোখে রাতের মত গভীর দৃষ্টি, ঠোঁটে হাসির মৌ ঝরছে। স্বপনকে পকেটে হাত ঢুকাতে দেখে শিশির ওর হাত চেপে ধরল,
    -তোমাকে কিছু দিতে হবে না। আজকে তুমি আমার গেস্ট। তবু স্বপন একটা একশো টাকার নোট সোনালির হাতে গুঁজে দিল। শিশির সোনালির গাল টিপে দিয়ে বলল, আবার আসবো, এইবার সকাল সকাল আসবো।

    গাড়িতে চড়তে চড়তে স্বপন দেখল আঙ্গিনায় আলো-আঁধারিতে থালা হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে সোনালি। গাড়ি ছাড়া পর্যন্ত তেমনি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল।
    শিশির ধীরে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছে। পাহাড়ি পথ চাঁদের আলোয় ডুবে আছে। বড় নির্জন। গাড়ির শব্দ আর হেডলাইটের আলোয় শিয়ালগুলো এপাশ ওপাশে ছুটে পালাচ্ছে। শিশির চুপচাপ স্টিয়ারিং ঘোরাচ্ছে। ঢুলু ঢুলু চোখ মেলে তাকিয়ে আছে পথের দিকে। স্বপনের নিজেকেও কেমন যেন নেশাগ্রস্ত লাগছে। ক্লান্তি আর অবসাদে দুই চোখের পাতা ক্রমশই ভারি হয়ে আসছে। সিটে হেলান দিয়ে ধীরে ধীরে চোখ বুজলো সে।
    গাড়ি চালাতে চালাতে শিশির হঠাৎ খিক খিক করে হেসে উঠল। ওর হাসির শব্দে স্বপন চোখ মেলে তাকাল।
    -কি হলো? হাসছো কেন?
    -মনে হলো সোনালি আমার পেটে কাতুকুতু দিতেছে। সোনালির আঙ্গুল পাখির পালকের মত নরম তো! শিশির বলে উঠল। ওর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। বোধহয় পাগলা পানির নেশায় ধরেছে। নেশার ঘোরে কথা বলছে। স্টিয়ারিং হাতে ঢুলু ঢুলু চোখ মেলে সে তাকিয়ে আছে পথের দিকে। ওর উপর এক পলক চোখ বুলিয়ে স্বপন আবার চোখ বুজল।
    বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল স্বপন। একসময় তন্দ্রার মধ্যে শিশিরের ক্লান্তি জড়ানো কণ্ঠস্বর শুনতে পেল সে।
    -সামনে অনেকগুলো বাঁক, কোন দিকে যাব? শিশির তাকে পথের হদিস জিজ্ঞাসা করছে।
    -পথঘাট তো তোমার জানা, বাঁক-টাকগুলো তুমিই আমার চেয়ে ভালো চিনবে। তন্দ্রার ঘোরে স্বপন বলল তারপরই হঠাৎ একটা কিছু মনে হওয়ায় ধড়ফড় করে সোজা হয়ে বসল। চোখ মেলে সামনে তাকাল। তবে ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে। শিশিরের নেশাগ্রস্ত দৃষ্টি গাড়িটাকে বাঁকের ফাঁদে ফেলে দিয়েছে। স্বপন অনুভব করল, প্রচন্ড ঝাঁকি খেয়ে চান্দের গাড়িটা ভয়ংকর শব্দে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে গড়িয়ে পড়ছে। গাড়ির ভিতর ওরা দুজন তালগোল পাকাতে পাকাতে নেমে যাচ্ছে নরকের দিকে।
    কয়েকবার চেষ্টার পর চোখের পাতা সামান্য ফাঁক করে তাকাতে পারল স্বপন। ভোরের আলোর হালকা আভা পড়ছে চোখে। বাঁ দিকে কাত হয়ে শুয়ে আছে সে। মাথা নড়ানোর শক্তি নেই। ঘাড়ে এবং শরীরে সুই ফোটানোর মত ব্যথা। ঠোঁটে একটা তরল নোনা স্বাদ। পাশেই উপুড় হয়ে শুয়ে আছে শিশির। বন্ধ চোখের পাশটা বিশ্রী রকম ফোলা। কপাল ও গালের পাশে কাটা ছেঁড়া দাগ ঘিরে রক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে আছে। ওর ঠোঁট অল্প অল্প নড়ছে। বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। স্বপন কান পেতে শোনার চেষ্টা করল। অস্পষ্ট জড়ানো স্বরে শিশির যেন কাকে উদ্দেশ করে বলছে,
    মনে হচ্ছে শালারা আমার ডেডবডি খাটিয়ায় করে পোড়াতে নিয়ে যাচ্ছে। ওদের বলবে বেশি করে খড়ি দিয়ে আগুন ধরাতে। খড়িতে অকটেন দিতে বলবে। অকটেনে আগুন ধরে ভালো। হাড়গোড় সব পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। মড়া-খোর শিয়ালগুলো যেন আমার হাড়গোড় নিয়ে কামড়াকামড়ি করতে না পারে।

    স্বপন আন্দাজ করল একটা পিকআপ ভ্যানের পেছনে শুইয়ে রাখা হয়েছে ওদের দুজনকে। ওদের নিয়ে পিক আপটা কোথাও ছুটে চলেছে। মাঝে মাঝে গাড়ির ঝাঁকুনিতে অসহ্য ব্যথায় কেঁপে উঠছে ওর শরীর। পিপাসায় মুখ শুকিয়ে আছে। জ্বিব দিয়ে ঠোঁট চাটতেই চটচটে নোনা স্বাদে ওর মুখ ভরে গেল। রক্তের স্বাদ! আধবোজা আতঙ্কিত চোখ মেলে গত রাতের কথা মনে করল স্বপন। চান্দের গাড়িটা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচে পড়ে গিয়েছিল। এরপর আর কিছুই মনে আসছে না। ওর ডলির কথা মনে হলো। ডলি যেন ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ডলির শীতল নিষ্পলক চোখের দিকে তাকাতে পারছে না স্বপন। ভয়ে ওর চোখের পাতা বুঁজে আসছে। অনুশোচনায় ভরে উঠছে ওর মন। সে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করে বলল, বিশ্বাস কর ডলি, আমি তোমাকে মেরে ফেলতে চাইনি। অফিস থেকে দেরি করে বাড়ি ফেরায় তুমি যখন রাগে আমার ফাইলটা ছুড়ে ফেলে দিলে তখন আমারো প্রচন্ড রাগ হলো। আমি তোমার গলা চেপে ধরলাম। দেখলাম, আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে তুমি নেতিয়ে পড়লে। আমি ভাবতে পারিনি তুমি মরে যাবে। বিশ্বাস কর ডলি-। স্বপন অনুভব করছে ডলির জন্য কষ্টে তার বুকের ভিতরটা খাঁ খাঁ করে উঠল। দুই চোখ জলে ভরে উঠেছে।
    ওদের পাশেই একধারে সিটে বসে ছিল টহল পুলিশদের একজন। পিক আপের সামনে বসা লোকগুলোর উদ্দেশে সে চেঁচিয়ে উঠল, স্যার, লাশগুলো তো কথা বলছে। কোথায় নিয়ে যাব এদেরকে, থানায় না হাসপাতালে?

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.