সময় যখন ধীরে ধীরে আলোর গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে শিখছে, তখন মানুষের কল্পনাও যেন ছুটছে তার চেয়েও দ্রুত। সেই কল্পনাকে বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে আনছে রাশিয়ার পরমাণু গবেষণা সংস্থা রসঅ্যাটম (Rosatom)— বিজ্ঞানের এমন এক নতুন অধ্যায় লিখে, যা হয়তো একদিন ইতিহাসের প্রথম পাতায় স্থান নেবে।
সম্প্রতি রসঅ্যাটমের বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন এক বিস্ময়কর আবিষ্কার— প্লাজমা ইলেক্ট্রো-রিঅ্যাকটিভ রকেট ইঞ্জিনের এক ল্যাবরেটরি প্রোটোটাইপ, যা কাজ করে ম্যাগনেটিক প্লাজমা অ্যাক্সিলারেটর–এর নীতিতে। এই ইঞ্জিনের টান শক্তি ছয় নিউটনেরও বেশি, আর এর স্পেসিফিক ইমপালস প্রতি সেকেন্ডে অন্তত একশ কিলোমিটার। পরিসংখ্যানটি ঠান্ডা মনে যতটা যান্ত্রিক মনে হতে পারে, কল্পনায় তার অভিঘাত ততটাই উষ্ণ— মানুষের মহাকাশযান হয়তো এখন এমন গতিতে উড়বে, যা একসময় শুধু কল্পবিজ্ঞানের বইয়েই সম্ভব ছিল।
এই প্রকল্পটি রাশিয়ার পরমাণু বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনের বিস্তৃত কর্মসূচির অংশ— যা ২০২৫ সালে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে জাতীয় প্রকল্প “নিউ নিউক্লিয়ার অ্যান্ড এনার্জি টেকনোলজিস”–এর অন্তর্গত উদ্যোগে। এই প্রকল্পের লক্ষ্য একটাই— মানব সভ্যতার পরবর্তী গন্তব্যকে আরেকটু কাছে টেনে আনা।
গবেষণাগারে যখন এই প্লাজমা ইঞ্জিনটি পরীক্ষার জন্য চালু হয়, তার পালস-পিরিয়ডিক মোডে গড় শক্তি পৌঁছে যায় প্রায় ৩০০ কিলোওয়াটে। এত শক্তিতে মহাকাশযান কেবল দ্রুতই ছুটবে না, বরং ব্যবহার করবে অতি অল্প জ্বালানি—যা বর্তমান রকেট প্রযুক্তির তুলনায় প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ। এটি শুধু অর্থনৈতিক বিপ্লব নয়, বরং মহাকাশ প্রকৌশলের এক নৈতিক পরিবর্তনও—যেখানে অপচয়ের বদলে এসেছে মিতব্যয়, আর ধীরগতির বদলে এসেছে নির্ভুল ত্বরণ।
ট্রইৎস্ক ইনস্টিটিউট অব ইনোভেটিভ অ্যান্ড থার্মোনিউক্লিয়ার রিসার্চের (Triniti) বিজ্ঞানবিভাগের প্রথম উপ-মহাপরিচালক আলেক্সেই ভোরোনভ এক সাক্ষাৎকারে বলেন,
“মঙ্গল অভিযানে বর্তমানে একমুখী যাত্রাতেই প্রায় এক বছর লেগে যায়। এই দীর্ঘ সময় মহাজাগতিক বিকিরণের মুখোমুখি থাকা মানব শরীরের জন্য ভয়ানক বিপজ্জনক। কিন্তু প্লাজমা ইঞ্জিন যদি সফলভাবে ব্যবহার করা যায়, তাহলে সেই পথ পেরোনো সম্ভব হবে মাত্র ৩০ থেকে ৬০ দিনে।”
তার কণ্ঠে তখন শুধু বিজ্ঞানের যুক্তি নয়, এক প্রাচীন মানবস্বপ্নের প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছিল— “মানুষ মঙ্গল স্পর্শ করবে”, এই বাক্যটি যেন আর অলীক নয়, বরং ক্যালেন্ডারের এক ঘনিয়ে আসা তারিখ।
এই প্রকল্পের পরীক্ষাগারটি নিজেই যেন এক মহাকাশ। রসঅ্যাটম ট্রইৎস্ক শহরে তৈরি করেছে এক বিশাল প্রায়োগিক স্ট্যান্ড, যার হৃদয়স্থলে রয়েছে এক দৈত্যাকৃতি ভ্যাকুয়াম চেম্বার— ব্যাস চার মিটার, দৈর্ঘ্য চৌদ্দ মিটার। ভিতরে স্থাপন করা হয়েছে উচ্চক্ষমতার ভ্যাকুয়াম পাম্পিং সিস্টেম ও তাপ অপসারণের যন্ত্র, যা পৃথিবীতেই সৃষ্টি করছে মহাকাশের প্রতিরূপ। সেখানে বিজ্ঞানীরা এখন প্রতিদিনই মানুষের ভবিষ্যতের ইঞ্জিনে আগুন ধরাচ্ছেন— প্রতিটি পরীক্ষার শব্দ যেন নতুন যুগের প্রভাতরব।
রসঅ্যাটম কেবল এই ইঞ্জিনেই থেমে নেই। জাতীয় মহাকাশ অনুসন্ধান কর্মসূচির অধীনে তারা তৈরি করছে নতুন প্রজন্মের পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্র, যা কাজ করবে মহাকাশযান, গবেষণা স্টেশন, এমনকি অন্য গ্রহে ভবিষ্যৎ মানব ঘাঁটির জ্বালানি সরবরাহকারী হিসেবে।
এই অভিযানে যুক্ত রয়েছে মস্কো এক্সপেরিমেন্টাল ডিজাইন ব্যুরো (MOKB Mars), যারা তৈরি করছে আধুনিক অটোমেটিক কন্ট্রোল ও ন্যাভিগেশন সিস্টেম— যেগুলো ইতিমধ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে Arctic-M ও Electro-L স্যাটেলাইট সিরিজে।
অন্যদিকে VNIIEF (All-Russian Scientific Research Institute of Experimental Physics)–এর বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন এক নতুন যোগাযোগ ব্যবস্থায়— লেজার ভিত্তিক স্পেস কমিউনিকেশন–যা পৃথিবী থেকে ৪৫,০০০ কিলোমিটার দূরের স্যাটেলাইটে তথ্য পাঠাতে সক্ষম হবে। মহাকাশে আলোর রেখা ছুঁয়ে কথা বলার এই প্রযুক্তি হয়তো একদিন মানুষের ভাষাকে সময় ও দূরত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত করে দেবে।
VNIIEF এবং MOKB Mars মিলে তৈরি করেছে স্পেকট্র–আরজি (Spektr-RG) মহাকাশ পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। ২০১৯ সালে উৎক্ষেপিত এই রুশ-জার্মান যৌথ প্রকল্পটি আজ মহাবিশ্বের উচ্চ-শক্তির রশ্মির মানচিত্র তৈরি করছে। এতে সংযোজিত হয়েছে রাশিয়ার প্রথম এক্স-রে টেলিস্কোপ ART–XC, যার উদ্ভাবকদের ২০২৪ সালে রাষ্ট্রীয় পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
এই টেলিস্কোপের চোখ দিয়ে মহাবিশ্বে তাকালে আমরা কেবল তারকার মৃত্যু বা জন্ম দেখি না, দেখি মানুষের দৃষ্টির সীমা কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে— আর সেখানে নতুন চোখ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টাই যেন বিজ্ঞান।
মানুষের মহাকাশযাত্রা কেবল গতি বা প্রযুক্তির প্রশ্ন নয়— এটি শরীর ও জীবনের সীমা পরীক্ষা করার প্রশ্নও।
ইনস্টিটিউট অব ফিজিক্যাল অ্যান্ড টেকনিক্যাল প্রবলেমস (IFTP) তৈরি করেছে এমন এক গামা–রে ইনস্টলেশন, যা পৃথিবীতেই মহাজাগতিক বিকিরণের পরিবেশ পুনর্নির্মাণ করতে পারে। ফলে স্যাটেলাইট বা নভোযানের ইলেকট্রনিক অংশগুলোকে আগেই পরীক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে মহাকাশের মতো পরিস্থিতিতে।
আর স্পেশালাইজড রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ইনস্ট্রুমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং (SNIIP)–এর উদ্ভাবিত “ম্যাট্রোশকা মডিউল” গত দুই দশক ধরে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে মানুষের শরীরে বিকিরণের প্রভাব পরিমাপ করছে— প্রতিটি ডেটা যেন এক একটি সতর্কবার্তা, আবার এক একটি প্রতিশ্রুতিও— যে মানুষ এখন শিখছে মহাকাশে বেঁচে থাকার উপায়।
রসঅ্যাটমের এই নতুন ইঞ্জিন কেবল প্রযুক্তিগত মাইলফলক নয়, এটি যেন এক দার্শনিক ইঙ্গিতও—মানুষের মধ্যে সেই পুরনো অস্থিরতা আবার জেগে উঠেছে, যে অস্থিরতা একদিন তাকে মহাসাগর পাড়ি দিতে শিখিয়েছিল, পাহাড় টপকাতে শিখিয়েছিল। আজ সেই অস্থিরতা বলছে, “তুমি মঙ্গল ছুঁয়ে দেখো।”
হয়তো আগামী প্রজন্মের কোনো নভোযাত্রী জানালার বাইরে তাকিয়ে বলবে— “ওই লালচে বিন্দুটা? ওটা তো মাত্র এক মাসের পথ।”
বিজ্ঞান যখন কল্পনাকে বাস্তবের রূপ দেয়, তখন প্রতিটি সূত্র, প্রতিটি কণাই হয়ে ওঠে কবিতা। রসঅ্যাটমের প্লাজমা ইঞ্জিন সেই কবিতার নতুন পঙ্ক্তি— যেখানে মানুষ আর তার স্বপ্নের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশই গলে যাচ্ছে আলোর গতিতে।
সূ্ত্র: neimagazine.com




