Sunday, October 26, 2025
spot_img
More

    সর্বশেষ

    জাদুকর

    সফল এবং সমৃদ্ধ একজন জাদুকর আমাদেরই কোনো এক কালে একটা ভাড়াবাড়িতে দুটো ঘর নিয়ে বসবাস করতেন। তার সময় কাটত চিন্তার খোরাক আছে এমন সব বিষয়ে পড়াশোনা করে এবং পণ্ডিতসুলভ মননশীল গবেষণার মধ্য দিয়ে। জাদু সম্পর্কে তার যদি কিছু জানা না থাকে সেটা জানার যোগ্য নয় বলে মনে করতে হবে। কারণ তার আগে যত জাদুকর বেঁচে ছিলেন তাদের সবার বই আর রেসিপি বিশেষ যত্নের সঙ্গে নিজের সংগ্রহে রেখে দিয়েছেন তিনি। তার নিজেরও বেশকিছু জাদুর আইটেম আছে। যেগুলো মানুষকে তাক লাগিয়ে দেবে।
    এই অমায়িক ভদ্রলোক পুরোপুরি সুখী হতে পারতেন যদি তার পড়াশোনায় কেউ বারবার বাধা সৃষ্টি না করত। কাউকে ডাকতে হয় না। লোকজন নিজে থেকে তার কাছে চলে আসে। এসে নিজেদের সমস্যার কথা শোনায়। দুঃখের কথা বলে (এসব বিষয়ে তার কোনো আগ্রহ নেই)। সমাধান আর সাহায্য চায়। আসতে মানা করলেও তার কথায় কান দেয় না কেউ। দরজায় আরও নক করে দুধঅলা, লন্ড্রিঅলা, কাগজের হকার। অথচ এসব জিনিস তার দরকার নেই। হয়তো দেখা গেল একটা কাজের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং জটিল অংশে ডুবে আছেন তিনি, এ সময় তার দরজায় কেউ ধাক্কা মারল। কেউ এলে দরজা না খুলে পারা যায় না। ধৈর্য ধরে তাকে বোঝাতে হয় তার এখন সময় হবে না। তারপর যখন আবার নিজের কাজে ফেরেন, দেখা যায় তার চিন্তার ধারা ভেঙে গেছে, কিংবা তার মিশ্রণ নষ্ট হয়ে গেছে।
    এক পর্যায়ে এই বিঘ্নগুলো তাকে রীতিমতো খ্যাপিয়ে তুলল। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন একটা কুকুর পালবেন। সেই কুকুরই লোকজনকে ভয় দেখিয়ে ভাগিয়ে দেবে। কিন্তু কুকুর কোথায় পাওয়া যাবে জানা নেই তার। জাদুকর ভাবলেন, পাশের ঘরে যে দরিদ্র তরুণ থাকে, কাচশিল্পী, যার সঙ্গে তার অল্প পরিচয় আছে, ওকে একবার জিজ্ঞেস করে দেখলে হয়। সে হয়তো কুকুরের হদিস দিতে পারবে। কাজেই পাশের ঘরে গেলেন তিনি। কাচশিল্পীকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, বলতে পার, আমি একটা কুকুর পাই কোথায়?’
    ‘কী ধরনের কুকুর?’ জানতে চাইলো কাচশিল্পী।
    ‘একটা ভালো কুকুর। যে কুকুর লোকজন দেখলে ঘেউ ঘেউ করে, ভয় দেখিয়ে ভাগিয়ে দেয়, কিন্তু আশা করে না তাকে খেতে দেয়া হবে। এমন কুকুর, যার গায়ে পোকা নেই, মাছি বসে না, অভ্যাসগুলো পরিচ্ছন্ন। যে কুকুর আমার বাধ্য থাকবে, আমি যা বলব শুনবে। সংক্ষেপে, একটা ভালো কুকুর,’ বললেন জাদুকর।
    ‘এরকম একটা কুকুর পাওয়া খুব কঠিন,’ মাথা নেড়ে বলল কাচশিল্পী। সে তার হাতের কাজে ব্যস্ত। কাচ দিয়ে বেগুনি গোলাপ ঝোপ, সবুজ পাতা আর হলুদ গোলাপ তৈরি করছে।
    কপালে চিন্তার রেখা নিয়ে তাকে দেখছেন জাদুকর।
    ‘তরল কাচে ফুঁ দিয়ে তুমি আমাকে একটা কুকুর বানিয়ে দিতে পারো না?’ এক সময় কাচশিল্পীকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
    ‘না পারার কী আছে, পারি,’ জানাল তরুণ কাচশিল্পী, ‘কিন্তু সেটা লোকজনকে দেখে ঘেউ ঘেউ করবে না, বুঝতেই তো পারছেন।’
    ‘হ্যাঁ, বুঝতে পারছি। তবে তা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না,’ জবাব দিলেন জাদুকর। ‘কাচের একটা কুকুরকে যদি ঘেউ ঘেউ করাতে না পারি তাহলে আর আমি কিসের জাদুকর হলাম!’
    ‘ভালো কথা, আপনি যদি কাচের কুকুরকে দিয়ে কাজ চালাতে পারেন, ফুঁ দিয়ে দেব একটা তৈরি করে। তবে শর্ত আছে, আমাকে কিন্তু কুকুরের দাম দিতে হবে।’
    ‘দেব তো,’ রাজি হলেন জাদুকর। ‘কিন্তু তোমরা যাকে টাকা বল, ওই ভয়ংকর জিনিসটা আমি রাখি না। দাম হিসেবে আমার তৈরি কোনো জিনিস নিতে হবে তোমাকে।’
    এক মুহূর্ত বিষয়টা নিয়ে ভাবল কাচশিল্পী। তারপর জানতে চাইল, ‘আপনি কি আমাকে এমন কিছু দিতে পারেন, যাতে আমার রিউম্যাটিক রোগটা ভালো হয়ে যাবে?’
    ‘ও, রিউম্যাটিক, কোনো ব্যাপার না।’
    ‘তা হলে সে কথাই রইল। আমি এখনই আপনার কুকুর তৈরির কাজে হাত লাগাচ্ছি। কী রঙের কাচ আমরা ব্যবহার করব?’
    ‘বেগুনি দারুণ একটা রং,’ বললেন জাদুকর। ‘কুকুরের জন্য একদমই স্বাভাবিক রং নয়। কী বলো?’
    ‘একদম,’ কাচশিল্পী বলল। ‘তাহলে বেগুনি রংই হোক।’
    কাজেই জাদুকর তার পড়াশোনার কাজে ফিরে গেলেন, আর তরুণ কাচশিল্পী কুকুর তৈরির কাজে হাত দিল।
    পরদিন সকালে সদ্য তৈরি কুকুরটাকে বগলদাবা করে জাদুকরের ঘরে হাজির হলো সে। টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখল সাবধানে। বেগুনি রঙের ভারি সুন্দর একটা কুকুর ওটা। গায়ের কাচের ভেতর সরু সরু সাদা-কালো কাচ ঢুকিয়ে দেয়ায় অনেকটা পশমের মতো দেখতে লাগছে, আর নাকের কাছে শোভা পাচ্ছে মোচড়ানো কাচের রিবন। কুকুরটার চোখ কালো কাচ দিয়ে তৈরি, তাতে রীতিমতো বুদ্ধির ঝিলিক আছে। মানুষের পরা অনেক কাচের চোখ থেকে যেমন ঝিলিক বেরোতে দেখা যায়।
    কাচশিল্পীর দক্ষতার খুব প্রশংসা করলেন জাদুকর এবং সঙ্গে সঙ্গে তার হাতে ছোট একটা শিশি গুঁজে দিলেন। বললেন, ‘এতে তোমার রিউম্যাটিক রোগ ভালো হয়ে যাবে।’
    ‘কিন্তু শিশিটা তো দেখছি খালি!’ কাচশিল্পী প্রতিবাদ করল।
    ‘আরে, না, ওতে এক ফোঁটা তরল আছে,’ জাদুকরের উত্তর।
    ‘মাত্র এক ফোঁটায় আমার রিউম্যাটিজম সারবে?’ সন্দেহের সুরে জানতে চাইল কাচশিল্পী।
    ‘নির্ঘাত সারবে। এটা তো সাধারণ কিছু না, মিরাকল। শিশির ওই এক ফোঁটা ওষুধ মানুষের জানা যে কোনো ধরনের রোগকে সঙ্গে সঙ্গে ভালো করে দেবে। কাজেই রিউম্যাটিজমের জন্য এটা বিশেষ করে ভালো। তবে খুব সাবধানে রেখো। কারণ এ ধরনের ওষুধ সারা পৃথিবীতে মাত্র এই এক ফোঁটাই আছে, আর এটার রেসিপি আমি ভুলে গেছি।’
    ‘ধন্যবাদ,’ বলল কাচশিল্পী। তারপর ফিরে গেল নিজের ঘরে।
    কুকুরের দিকে তাকিয়ে মন্ত্র জপছেন জাদুকর। কখনও চোখ বুজে ধ্যান করছেন, কখনও চোখ খুলে দোল খাচ্ছেন। সবশেষে মন্ত্র পড়ে কুকুরের গায়ে বার কয়েক ফুঁ দিলেন। ছোট্ট প্রাণীটি প্রথমে লেজটা একটু নাড়ল, তারপর সবজান্তার ভঙ্গিতে বাঁ-চোখটা একবার টিপল, আর সবশেষে ভয়ংকর শব্দে ঘেউ ঘেউ করে উঠল- অতটুকু একটা কাচের তৈরি বেগুনি কুকুরের গলা থেকে এত জোরালো আওয়াজ বেরোতে দেখলে কার না ভয় লাগবে। জাদুকরদের হাতে ম্যাজিক শিল্প এমন অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে যে বিস্ময়ে স্তম্ভিত না হয়ে উপায় থাকে না; যদি না, অবশ্যই, আপনি নিজে না জানছেন কাজটা কীভাবে করতে হয়, তখন কেউ আর আশা করবে না যে ওগুলো দেখে আপনি বিস্মিত হবেন।
    জাদুকর বিস্মিত না হলেও, ভারি খুশি হলেন। সময় নষ্ট না করে কুকুরটাকে তিনি দরজার বাইরে রেখে এলেন। এখন যেই তার দরজায় নক করতে আসবে, কুকুরটা ঘেউ ঘেউ করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করবে তাকে। যাতে তার মনিবের পড়াশোনা আর গবেষণায় ব্যাঘাত সৃষ্টি না হয়।
    ওদিকে কাচশিল্পী, ঘরে ফেরার পর সিদ্ধান্ত নিল ওই এক ফোঁটা সর্বরোগহর মহৌষধ এখনই ব্যবহার করবে না।
    ‘আজ আমার রিউম্যাটিকের ব্যথা না থাকারই মতো। আমি যখন আরও অনেক গুরুতর রোগে আক্রান্ত হব এটা তখন ব্যবহার করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।’
    কাজেই শিশিটা আলমারিতে তুলে রেখে আবার নিজের কাজে ফিরে গেল। কাচের আরও গোলাপ তৈরি করতে হবে। কদিন পর তার মনে হলো, ওষুধটা হয়তো রেখে দেয়ার জিনিস না। বেশিদিন ফেলে রাখলে ওটার গুণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে। কাজেই জাদুকরকে জিজ্ঞেস করার জন্য নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো সে। কিন্তু জাদুকরের ঘরের সামনে আসতেই তার তৈরি কাচের কুকুর মারমুখো হয়ে তেড়ে এলো। সারাক্ষণ ঘেউ ঘেউ করছে। দরজায় নক করা হলো না। তাড়াতাড়ি ওখান থেকে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে বাধ্য হলো সে।
    পরদিন সকালে খবরের কাগজে চোখ বোলাচ্ছে কাচশিল্পী। খবর বেরিয়েছে মক্ষিরানী গুরুতর অসুস্থ। রূপসী বলে খ্যাতি আছে এ তরুণীর। শহরের সবচেয়ে ধনী নারীও বলা হয় তাকে। তার আপনজন বলতে কেউ নেই, বাবা মারা যাওয়ার আগে অগাধ ধন-দৌলত আর সয়-সম্পত্তি রেখে গেছেন। খবরের শেষে বলা হয়েছে, দেশি-বিদেশি ডাক্তাররা হাল ছেড়ে দিয়েছেন, তারা মক্ষিরানীকে সুস্থ করতে পারবেন না।
    কাচশিল্পী দরিদ্র হতে পারে কিন্তু তার মাথায় অনেক আইডিয়া আসা-যাওয়া করে। হঠাৎ আলমারিতে রাখা ওষুধটার কথা মনে পড়ে গেল তার। ভাবছে নিজের চিকিৎসায় ব্যবহার না করে ওই ওষুধ অন্যের রোগ সারাতে কাজে লাগালে মন্দ কী, তার বিনিময়ে যদি অনেক ভালো কিছু পাওয়া যায়। সবচেয়ে সেরা কাপড় পরল সে। চিরুনি দিয়ে চুল আঁচড়াল। ভালো করে হাত ধুলো, টাই পরল। তারপর কোটের পকেটে শিশিটা নিয়ে রওনা হয়ে গেল মক্ষিরানীর বাড়ির উদ্দেশে।
    মক্ষিরানী থাকে বিশাল এক অট্টালিকায়। গেটে কাচশিল্পীর পথ আটকাল দারোয়ান। বলল, ‘না সাবান, না রং, না তরিতরকারি, না চুলের তেল, না বই, না বেকিং পাউডার। আমার ম্যাডাম মারা যাচ্ছেন এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য যা যা লাগবে সব আমরা জোগাড় করে ফেলেছি।’
    দারোয়ান তাকে ফেরিঅলা মনে করায় কাচশিল্পী শোকে কাতর হয়ে পড়ল। ‘বন্ধু হে,’ গর্বের সঙ্গে শুরু করল সে কিন্তু দারোয়ান তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘না কবরের ফলক। নিজেদের কবরস্থান আছে। ম্যাডাম মক্ষিরানীর জন্য সেখানে মনুমেন্ট তৈরির কাজ চলছে।’
    ‘তুমি যদি আমাকে কথা বলতে দাও, তোমার ম্যাডামকে তাহলে কবরস্থানে নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজনই পড়বে না,’ বলল কাচশিল্পী।
    ‘না কোনো ডাক্তার, না কোনো ওঝা, না কোনো হাতুড়ে, সাহেব; আমার ম্যাডাম আর কাউকে দেখাবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।’
    ‘আরে বোকা, আমি ডাক্তার নই,’ বলল কাচশিল্পী।
    ‘না বাকি কেউ। কিন্তু এখানে আপনার কাজটা কী তাহলে?’
    ‘আমি ম্যাজিক জানি, মন্ত্র পড়া মিশ্রণ দিয়ে তোমার ম্যাডামকে সুস্থ করে তুলতে পারব।’
    ‘দয়া করে ভেতরে আসুন, সাহেব,’ বিনয়ে বিগলিত হলো দারোয়ান। ‘ভেতরের হলঘরে গিয়ে বসুন। আমি বাড়ির ম্যানেজার সাহেবকে ফোন করে দিচ্ছি।’
    হলঘরে বসল কাচশিল্পী। ম্যানেজারকে তার আশ্বস্ত করতে হলো মক্ষিরানীকে সে সুস্থ করতে পারবে। এরপর মক্ষিরানীর খাস চাকরানি এলো তাকে নিতে। বলল, ‘আপনি আসায় আমরা খুব খুশি হয়েছি।’
    ‘কিন্তু,’ কাচশিল্পী বলল, ‘শুধু তোমরা খুশি হলে চলবে? তোমাদের ম্যাডাম আমাকে খুশি করতে পারবেন তো?’
    ‘আপনি কী চান বলুন?’
    ‘আমি যদি তোমার ম্যাডামকে সুস্থ করতে পারি, আমাকে তার বিয়ে করতে হবে।’
    ‘আমাকে তাহলে দেখতে হবে এই শর্তে তিনি রাজি হন কিনা,’ বলে চলে গেল খাস চাকরানি।
    তরুণী ধনকুবের সঙ্গে সঙ্গে কাচশিল্পীর প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেল। চিৎকার করে বলল, ‘মরে যাওয়ার চেয়ে যে কোনো বুড়ো-হাবড়াকেও বিয়ে করতে রাজি আছি আমি। এক্ষুনি তাকে নিয়ে এসো এখানে!’
    কাজেই কাচশিল্পী এলো। সামান্য একটু পানিতে শিশির ফোঁটাটা ফেলল। তারপর সেই পানি খেতে দিল মক্ষিরানীকে। এক মিনিট পর দেখা গেল পুরো সুস্থ হয়ে গেছে সে। নিজের মুখেই স্বীকার করল, জীবনে এত ভালো কখনও ছিল না।
    ‘ওরে আমার খোদা!’ হঠাৎ আঁতকে উঠল মক্ষিরানী। ‘আজ রাতে নীল আর আকাশকে সংবর্ধনা দিতে যেতে হবে আমার! যাও, যাও, জলদি তোমরা আমার মুক্তোরঙা ড্রেসটা নিয়ে এসো। আর আমি এক্ষুনি টয়লেট সেরে ফেলি। শোনো, কবরের জন্য যে ফুলের অর্ডার দেয়া হয়েছে সেটা বাতিল করে দাও। টেলিফোন করে বলে দাও, তোমাদের কালো শাড়িও দরকার নেই।’
    ‘কিন্তু, মিস মক্ষিরানী,’ কাচশিল্পী বলল, ‘আমার শর্ত ছিল সুস্থ হলে আপনি আমাকে বিয়ে করবেন…’
    ‘জানি,’ তরুণী জবাব দিল। ‘কিন্তু প্রিন্ট আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যথাযোগ্য ঘোষণা প্রচারের জন্যে সময় দিতে হবে না? বিয়ের কার্ড ছাপতেও তো সময় লাগবে। আপনি কাল আসুন, তখন এটা নিয়ে আমরা কথা বলব।’
    তরুণ কাচশিল্পী মক্ষিরানীর মন জয় করতে পারেনি। মক্ষিরানী এ রকম সাধারণ দেখতে তরুণকে বিয়ে করার কথা ভাবতে পারছে না। আপাতত তাকে ভাগাবার একটা ছুঁতো খুঁজে পেয়ে নিজের ওপর খুশি। তাছাড়া, নীল আর আকাশের বিবাহোত্তর সংবর্ধনায় না যাওয়ার কথা ভাবতেই পারছে না।
    কিন্তু ওদিকে কাচশিল্পী আনন্দে নাচতে নাচতে নিজের ঘরে ফিরল। কারণ সে ভাবছে তার কোটিপতি হওয়ার প্ল্যান সফল হতে চলেছে। বিরাট ধনী একটা স্ত্রী পেলে জীবনে আর কিছু লাগে নাকি? সারা জীবন সেই তো তাকে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াবে আর তার সব শখ মেটাবে।
    ঘরে ফিরে প্রথম যে কাজটা করল, তরল কাচ ফোলাবার সব যন্ত্রপাতি জানালা দিয়ে ফেলে দিল বাইরে। তারপর বসল স্ত্রীর বিপুল টাকা কীভাবে খরচ করবে তার একটা তালিকা তৈরি করতে।
    পরদিন মক্ষিরানীর বাড়িতে গেল। মক্ষিরানী একটা উপন্যাস পড়ছিল, আর পড়ার ফাঁকে একটা দুটো করে আঙুর খাচ্ছিল। মাঝে মধ্যে তরল ও গরম চকলেটের গ্লাসেও চুমুক দিচ্ছিল।
    ‘আচ্ছা, বলুন তো, আমি যে ওষুধ খেয়ে ভালো হলাম, সেটা আপনি কোত্থেকে পেয়েছেন?’
    ‘ওটা আমাকে দিয়েছে একজন জ্ঞানী জাদুকর,’ বলল কাচশিল্পী। আর তারপর, ভাবল এটা হয়তো মক্ষিরানীকে আগ্রহী করে তুলবে, তাই কীভাবে কাচ দিয়ে কুকুর বানিয়েছে সে, সেই কুকুর কীভাবে ঘেউ ঘেউ করে দরজা থেকে সবাইকে ভাগিয়ে দিচ্ছে, সবিস্তারে সেই গল্পটা শোনাল।
    ‘কী মজা!’ হেসে উঠে বলল মক্ষিরানী। ‘আমি চিরকাল চেয়েছি ওরকম একটা কাচের কুকুর থাকুকু আমার, যে কুকুর ডাকতে পারে।’
    ‘কিন্তু দুনিয়ায় সেরকম কুকুর ওই একটাই আছে,’ উত্তরে বলল কাচশিল্পী। ‘আর সেটার মালিক ওই জাদুুকর।’
    ‘আমি কোনো কথা শুনব না, ওটা আপনি আমাকে কিনে এনে দেবেন,’ গলায় ঝাঁজ এনে বলল মক্ষিরানী। ‘ডাকতে পারে এমন কাচের কুকুর ছাড়া একটা দিনও আমার পক্ষে সুখী হওয়া সম্ভব নয়।’
    মক্ষিরানীর কথা শুনে খুব চিন্তায় পড়ে গেল কাচশিল্পী। জানে এ কাজ তারা দ্বারা হওয়ার নয়। তবু তার মন পাওয়ার জন্য বলল, দেখা যাক কী করতে পারি। সে জানে যে কোনো পুরুষের কাজই হলো তার স্ত্রীকে খুশি করা। কে জানে, মক্ষিরানী হয়তো পরীক্ষা করে দেখছে স্বামী হিসেবে আমি কেমন হবো।
    উত্তর শুনে খুশি হলো মক্ষিরানী, বলল, ‘আমার আশা পূরণ করুন, তার এক সপ্তাহর মধ্যে আপনাকে আমি বিয়ে করব।’
    বাড়ি ফেরার পথে ভারী একটা বস্তা কিনল কাচমিস্ত্রি। তারপর যখন জাদুকরের ঘরের দরজাকে পাশ কাটাচ্ছে, হাতের বস্তাটা ছুড়ে দিল কুকুরের গায়ে। তারপর বস্তার মুখটা বন্ধ করে নাইলনের রশি দিয়ে বেঁধে দিল। বস্তায়বন্দি কাচের কুকুরকে নিয়ে ফিরে এলো নিজের ঘরে।
    পরদিন সকালে এক বাহককে দিয়ে বস্তায় ভরা কুকুরটা মক্ষিরানীর কাছে পাঠিয়ে দিল সে। একটা চিরকুটে হবু স্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাতেও ভুলল না। তারপর বিকালের দিকে সাজগোজ করে মক্ষিরানীর সঙ্গে দেখা করতে রওনা হলে। মনে মনে জানে তাকে অত্যন্ত কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বাগত জানানো হবে ওই প্রাসাদতুল্য বাড়িতেÑ যেহেতু মক্ষিরানী যে কুকুর শখ করেছিল সেটা সে চুরি করে এনে উপহার দিয়েছে তাকে।
    কিন্তু গেটের কাছে পৌঁছুতে আজ সেখানে কোনো দারোয়ানকে দেখতে পেল না। দেখতে পেল নিজের তৈরি কাচের কুকুরকে। সেটা তেড়ে এলো তার দিকে। সারাক্ষণ বিকট চিৎকার করছে।
    কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে বাড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো দারোয়ান। কাচমিস্ত্রি তাকে চিৎকার করে বলল, ‘তোমার কুকুরকে তুমি ডেকে নাও।’ আতঙ্কিত দেখাচ্ছে তাকে।
    ‘সেটা আমি পারব না, সাহেব,’ উত্তর দিল দারোয়ান। ‘আমার ম্যাডাম হুকুম করেছেন যখনই আপনি এখানে আসবেন, কাচের কুকুর যেন ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। আপনি বরং সাবধান হোন, সাহেব। কারণ সে যদি আপনাকে কামড়ে দেয় আপনার তাহলে গ্লাসোফোবিয়া হবে!’
    প্রাণের ভয়ে ওখান থেকে পালিয়ে এলো কাচমিস্ত্রি। ঘরে ফেরার পথে তার মনে পড়ল মক্ষিরানীর ফোন নম্বর আছে তার কাছে। একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে সেলফোন বের করে ওই নম্বর টিপল সে। মক্ষিরানীর মধুর গলা ভেসে এলো। ‘আমি মক্ষিরানী। আপনি কে বলছেন, প্লিজ?’
    ‘আপনি আমার সঙ্গে এরকম নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারলেন? কাচের কুকুরটাকে আমার পেছনে লেলিয়ে দিতে আপনার এতটুকু বাধল না?’ বেচারা কাচমিস্ত্রির প্রায় কেঁদে ফেলার অবস্থা।
    ‘শুনুন, সত্যি কথাই বলি,’ বলল মক্ষিরানী, ‘আপনাকে আমার পছন্দ হয়নি- আপনার গাল ম্লান আর গালের চামড়ায় ঝুলে পড়া ভাব। আপনার চুল কর্কশ আর বড়। চোখ ছোট আর লাল। হাত মোটাসোটা আর শক্ত। সবচেয়ে খারাপ আপনার পা। ওগুলো ধনুকের মতো বাঁকা।’
    ‘কিন্তু আমার চেহারা আর আকৃতির জন্য আমি তো দায়ী নই!’ মিনতির সুরে বলল কাচমিস্ত্রি। ‘আর তাছাড়া আপনি এই আমাকেই বিয়ে করবেন বলে কথা দিয়েছেন।’
    ‘আপনি দেখতে সুন্দর হলে আমি আমার কথা রাখতাম,’ জবাব দিল মক্ষিরানী। ‘কিন্তু বর্তমান অবস্থায় আপনি আমার যোগ্য নন। কাজেই আপনি যদি আমার বাড়ি থেকে দূরে সরে না থাকেন, আমি আমার কাচের কুকুরকে আপনার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতে বাধ্য হবো!’ লাইন কেটে দিল সে।
    ঘরে ফিরে দরজা বন্ধ করল কাচশিল্পী, সিলিং ফ্যানের সঙ্গে রশি ঝুলিয়ে গলায় ফাঁস লাগানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে।
    এই সময় নক হলো দরজায়। খুলে দেখল সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন স্বয়ং জাদুকর। তিনি বললেন, ‘আমি আমার কুকুরটা হারিয়েছি।’
    ‘তাই নাকি?’ বলল কাচমিস্ত্রি, রশি দিয়ে একটা ফাঁস তৈরির চেষ্টা করছে।
    ‘হ্যাঁ, কেউ ওটাকে চুরি করে নিয়ে গেছে।’
    ‘খুব খারাপ কথা,’ বলল কাচমিস্ত্রি, নির্লিপ্ত।
    ‘আমাকে তোমার আরেকটা বানিয়ে দিতে হবে,’ বললেন জাদুকর।
    ‘কিন্তু তা আর সম্ভব নয়, আমি আমার সব যন্ত্রপাতি ফেলে দিয়েছি।’
    ‘আমি তাহলে কী করব এখন?’ জিজ্ঞেস করলেন জাদুকর।
    ‘কী জানি কী করবেন, তবে কুকুরটার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করবেন কিনা সেটা আপনার ব্যাপার।’
    ‘কিন্তু আমার কাছে তো টাকা নেই।’ জাদুকর বিচলিত।
    ‘তাহলে নিজের কোনো একটা মিশ্রণ অফার করুন,’ কাচমিস্ত্রি পরামর্শ দিল। রশি দিয়ে একটা ফাঁস তৈরি করছে সে। মাথা দিয়ে গলিয়ে যাতে গলায় পরতে পারে।
    ‘আমার কাছে আর শুধু একটা মিশ্রণই রয়ে গেছে,’ বললেন জাদুকর, চিন্তিত, ‘আর সেটা হলো বিউটি পাউডার।’
    ‘কী!’ আচমকা চেঁচিয়ে উঠল কাচমিস্ত্রি। ছুড়ে ফেলে দিল হাতের রশি। ‘সে রকম সত্যি কিছু আছে নাকি আপনার কাছে?’
    ‘আছে তো, সত্যি আছে। ওই পাউডারের এমনই গুণ, যে মাখবে সেই সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়ার সবচেয়ে সুদর্শন মানুষে পরিণত হবে।’
    ‘আপনি যদি ওটাকে পুরস্কার হিসেবে ঘোষণা করেন,’ ব্যাকুল সুরে বলল কাচমিস্ত্রি, ‘আপনার জন্য কুকুরটাকে আমি খুঁজে আনার চেষ্টা করব। কারণ সবকিছুর ওপরে নিজেকে আমি সুন্দর দেখতে চাই।’
    ‘কিন্তু তোমাকে আমি আগেই সাবধান করে দিচ্ছি, ওই সৌন্দর্য হবে চামড়া যতটুকু পুরু ঠিক ততটুকু গভীর।’
    ‘সেটা ঠিক আছে,’ খুশি কাচমিস্ত্রি জবাব দিল। ‘আমি যখন আমার চামড়া হারাব, সুদর্শন থাকলাম কিনা কে তা গ্রাহ্য করে।’
    ‘তাহলে তুমি আমাকে জানাও কোথায় আছে আমার কুকুর, সঙ্গে সঙ্গে ওই পাউডার তুমি পেয়ে যাবে।’
    কাচমিস্ত্রি বাইরে রেরিয়ে গেল। পাড়াটা একবার চক্কর দিয়ে এসে জাদুকরকে জানাল, ‘আপনার কুকুরের খোঁজ পাওয়া গেছে। আপনি তাকে দেখতে পাবেন মিস মক্ষিরানীর বাড়ির গেটে।’
    কথাটা সত্যি কিনা জানার জন্যে তখুনি রওনা হয়ে গেল জাদুকর। ওই বাড়ির সামনে পৌঁছুতে যা দেরি। কাচের কুকুর ঘেউ ঘেউ করে ছুটে এলো। জাদুকর হাত লম্বা করে মন্ত্র উচ্চারণ করলেন। ব্যস, চোখের পলকে ঘুমিয়ে পড়ল কুকুর। সেটাকে তুললেন তিনি। তারপর নিজের ঘরে নিয়ে এলেন।
    পরে কাচমিস্ত্রিকে ডেকে অল্প এক চিমটি বিউটি পাউডার দিলেন তিনি। কাচমিস্ত্রি ওখানে দাঁড়িয়েই সেটুকু খেয়ে ফেলল এবং সঙ্গে সঙ্গে দুনিয়ার সুন্দরতম মানুষে পরিণত হলো সে।
    পরেরবার যখন মিস মক্ষিরানির বাড়িতে গেল, কোনো কুকুর তেড়ে এলো না। এবং কাচমিস্ত্রির ওপর নজর পড়তে যা দেরি, অমনি তার প্রেমে পড়ে গেল মক্ষিরানি।
    ‘আপনি শুধু যদি কোনো মন্ত্রী বা সাংসদের ছেলে হতেন,’ দীর্ঘশ্বাস চেপে বললেন তিনি, ‘আপনাকে আমি নিশ্চয়ই বিয়ে করতাম।’
    ‘আরে, আমি তো আপনার প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। আমি নিজেই একজন সাংসদ। আমার নির্বাচনী এলাকা কাচপুর-সারমেয়।’
    ‘তাই!’ আহ্লাদে আটখানা হলো মক্ষিরানী। ‘তাহলে, আপনি যদি সপ্তায় একশ টাকা হাতখরচায় রাজি থাকেন, বিয়ের কার্ডগুলো এনগ্রেভ করতে বলে দিই আমি।’
    কাচমিস্ত্রি ইতস্তত করছে। তারপর যখন চিন্তা করল তার ঘরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে রশি ঝুলছে, এই শর্তে রাজি হয়ে গেল।
    কাজেই তাদের বিয়ে হলো। তবে স্বামী এত বেশি সুদর্শন হওয়ার কারণে মক্ষিরানির ঈর্ষা হতে লাগল। তাই কাচমিস্ত্রিকে একটা কুত্তার জীবন কাটাতে বাধ্য করছে সে। ওদিকে কাচমিস্ত্রি চারদিক থেকে টাকা ধার করে মক্ষিরানিকে নিয়মিত বিপদে ফেলছে।

    কাচের কুকুরটার কথা যদি বলেন, জাদুর সাহায্যে আবার সেটাকে ঘেউ ঘেউ করতে শিখিয়েছেন জাদুকর। দরজার বাইরে বসে আবার আগের মতো লোকজনকে তাড়াচ্ছে ওটা। সবার কথা বাদ দিন। এবার নিজের কথা বলি- আমাকে বরং দুঃখিতই বলতে হবে, কারণ কাল একবার জাদুকরের কাছে যাওয়া দরকার আমার। এই গল্পের নৈতিক শিক্ষাটা কী জিজ্ঞেস করার জন্য।

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Latest Posts

    spot_imgspot_img

    সর্বাধিক পঠিত

    Stay in touch

    To be updated with all the latest news, offers and special announcements.